“আমার বাক্যে স্থির থাক”
“তোমরা যদি আমার বাক্যে স্থির থাক, তাহা হইলে সত্যই তোমরা আমার শিষ্য।”—যোহন ৮:৩১.
১. (ক) স্বর্গে ফিরে যাওয়ার সময় যিশু পৃথিবীতে কী রেখে গিয়েছিলেন? (খ) কোন প্রশ্নগুলো আমরা বিবেচনা করব?
খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা, যিশু খ্রিস্ট যখন স্বর্গে ফিরে গিয়েছিলেন তখন তিনি এই পৃথিবীতে তাঁর দ্বারা লিখিত কোনো বই, নির্মিত স্মৃতিসৌধ বা জমানো ধনসম্পদ রেখে যাননি। কিন্তু, তিনি তাঁর শিষ্যদের রেখে গিয়েছিলেন এবং সেইসঙ্গে শিষ্য হওয়ার জন্য যে-নির্দিষ্ট বিষয়গুলো করা প্রয়োজন তা বলেছিলেন। বস্তুতপক্ষে, যোহনের সুসমাচারে আমরা দেখি যে, যেকেউ যিশুর শিষ্য হতে চায় তাকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা পূরণ করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেছিলেন। এই চাহিদাগুলো কী? সেগুলো পূরণ করার জন্য আমরা কী করতে পারি? আর কীভাবে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, আজকে ব্যক্তিগতভাবে আমরা খ্রিস্টের শিষ্য হওয়ার যোগ্য?a
২. শিষ্য হওয়ার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা কী, যা যোহনের সুসমাচারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে?
২ যিশুর মৃত্যুর প্রায় ছয় মাস আগে তিনি যিরূশালেমে গিয়েছিলেন এবং সেখানে সপ্তাহব্যাপী কুটির পর্ব উদ্যাপনের জন্য একত্রিত হওয়া জনতার কাছে প্রচার করেছিলেন। ফলে, সেই পর্ব যখন প্রায় অর্ধেকের দিকে, তখন “লোকদের মধ্যে অনেকে তাঁহাতে বিশ্বাস করিল।” যিশু প্রচার করেই চলেছিলেন, যার ফলে পর্বের শেষ দিনে আবারও “অনেকে তাঁহাতে বিশ্বাস করিল।” (যোহন ৭:১০, ১৪, ৩১, ৩৭; ৮:৩০) সেই সময় যিশু নতুন শিষ্যদের প্রতি তাঁর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিলেন এবং শিষ্য হওয়ার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ চাহিদার কথা বলেছিলেন, যা প্রেরিত যোহন লিপিবদ্ধ করেছিলেন: “তোমরা যদি আমার বাক্যে স্থির থাক, তাহা হইলে সত্যই তোমরা আমার শিষ্য।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।)—যোহন ৮:৩১.
৩. ‘[যিশুর] বাক্যে স্থির থাকিবার’ জন্য একজনের কোন গুণ থাকা দরকার?
৩ ওই কথাগুলো বলে যিশু এটা ইঙ্গিত করছিলেন না যে, নতুন শিষ্যদের বিশ্বাসের অভাব আছে। বরং, তিনি এটাই বলছিলেন যে, তাঁর প্রকৃত শিষ্য হওয়ার জন্য তাদের সামনে সুযোগ খোলা আছে—যদি তারা তাঁর বাক্যে স্থির থাকে এবং ধৈর্য ধরে। তারা তাঁর বাক্য গ্রহণ করেছিল কিন্তু এখন তাদের সেই বাক্যে স্থির থাকা দরকার ছিল। (যোহন ৪:৩৪; ইব্রীয় ৩:১৪) বাস্তবিকই, যিশু ধৈর্যকে তাঁর অনুসারীদের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ একটা গুণ হিসেবে দেখেছিলেন যে, যোহনের সুসমাচারে লেখা আছে তাঁর প্রেরিতদের সঙ্গে সর্বশেষ আলোচনায় যিশু দুবার ঐকান্তিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছিলেন: “আমার পশ্চাৎ আইস।” (যোহন ২১:১৯, ২২) অনেক প্রাথমিক খ্রিস্টান ঠিক তা-ই করেছিল। (২ যোহন ৪) কী তাদের ধৈর্য ধরতে সাহায্য করেছিল?
৪. কোন বিষয়টা প্রাথমিক খ্রিস্টানদের ধৈর্য ধরতে সাহায্য করেছিল?
৪ প্রেরিত যোহন, যিনি প্রায় সাত দশক ধরে খ্রিস্টের একজন বিশ্বস্ত শিষ্য ছিলেন, তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বস্ত খ্রিস্টানদের প্রশংসা করেছিলেন, এই কথা বলে: “তোমরা বলবান্, এবং ঈশ্বরের বাক্য তোমাদের অন্তরে বাস করে, আর তোমরা সেই পাপাত্মাকে জয় করিয়াছ।” খ্রিস্টের সেই শিষ্যরা ধৈর্য ধরেছিল অথবা ঈশ্বরের বাক্যে স্থির ছিল কারণ ঈশ্বরের বাক্য তাদের মধ্যে ছিল। এটার জন্য তাদের আন্তরিক উপলব্ধিবোধ ছিল। (১ যোহন ২:১৪, ২৪) একইভাবে আজকে, ‘শেষ পর্য্যন্ত স্থির থাকিবার’ জন্য আমাদের নিশ্চিত হওয়া দরকার যে ঈশ্বরের বাক্য আমাদের মধ্যে রয়েছে। (মথি ২৪:১৩) কীভাবে আমরা তা করতে পারি? যিশুর বলা একটা দৃষ্টান্ত এর উত্তর দেয়।
“বাক্য শুনে”
৫. (ক) যিশুর বলা একটা দৃষ্টান্তে কোন কোন ধরনের ভূমির কথা বলা হয়েছে? (খ) যিশুর দৃষ্টান্তে বীজ ও ভূমি কোন বিষয়কে প্রতিনিধিত্ব করে?
৫ যিশু একজন বীজবাপকের দৃষ্টান্ত দিয়েছিলেন, যিনি বীজ বপন করেন আর এটা মথি, মার্ক ও লূকের সুসমাচারে লিপিবদ্ধ রয়েছে। (মথি ১৩:১-৯, ১৮-২৩; মার্ক ৪:১-৯, ১৪-২০; লূক ৮:৪-৮, ১১-১৫) আপনি যখন এই বিবরণগুলো পড়বেন, আপনি লক্ষ করবেন যে, এই দৃষ্টান্তের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একইধরনের বীজ বিভিন্ন রকমের ভূমিতে পড়ে ও বিভিন্ন ফল উৎপন্ন করে। প্রথম ধরনের ভূমি শক্ত, দ্বিতীয়টা অগভীর এবং তৃতীয়টা কাঁটা দিয়ে আবৃত। চতুর্থ ধরনের ভূমি প্রথম তিনটের চেয়ে আলাদা আর সেটা হচ্ছে ‘উত্তম ভূমি।’ যিশুর নিজের ব্যাখ্যা অনুসারে, বীজ হচ্ছে ঈশ্বরের বাক্যে পাওয়া রাজ্যের বার্তা এবং ভূমি প্রতিনিধিত্ব করে বিভিন্ন হৃদয়ের লোকেদের। যদিও বিভিন্ন ধরনের ভূমির দ্বারা চিত্রিত লোকেদের কিছু বৈশিষ্ট্য একই কিন্তু উত্তম ভূমির দ্বারা চিত্রিত ব্যক্তিদের এমন একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেটা বাকি সকলের চেয়ে তাদের একেবারে আলাদা করে।
৬. (ক) কীভাবে যিশুর দৃষ্টান্তের চতুর্থ ধরনের ভূমি বাকি তিনটের চেয়ে আলাদা এবং এর অর্থ কী? (খ) খ্রিস্টের শিষ্য হিসেবে ধৈর্য ধরার জন্য কী অপরিহার্য?
৬ লূক ৮:১২-১৫ পদের বিবরণ দেখায় যে, চারটে ক্ষেত্রেই লোকেরা “বাক্য শুনে।” কিন্তু, যাদের ‘সৎ ও উত্তম হৃদয়’ রয়েছে, তারা কেবল ‘বাক্য শুনিবার’ চেয়েও আরও বেশি কিছু করে। তারা সেটা “ধরিয়া রাখে, এবং ধৈর্য্য সহকারে ফল উৎপন্ন করে।” উত্তম ভূমি নরম ও গভীর হওয়ায় বীজের শিকড়গুলো অনেক গভীর পর্যন্ত ঢোকে ও এর ফলে বীজ অঙ্কুরিত হয় এবং ফল উৎপন্ন করে। (লূক ৮:৮) একইভাবে, যাদের উত্তম হৃদয় রয়েছে তারা ঈশ্বরের বাক্যকে উপলব্ধি করে এবং তা হৃদয়ঙ্গম করে। (রোমীয় ১০:১০; ২ তীমথিয় ২:৭) ঈশ্বরের বাক্য তাদের মধ্যে স্থির থাকে। ফলে, তারা ধৈর্যের সঙ্গে ফল উৎপন্ন করে। তাই, খ্রিস্টের শিষ্য হিসেবে ধৈর্য ধরার জন্য ঈশ্বরের বাক্যের প্রতি এক গভীর, আন্তরিক উপলব্ধিবোধ অপরিহার্য। (১ তীমথিয় ৪:১৫) কিন্তু, কীভাবে আমরা ঈশ্বরের বাক্যের প্রতি এইরকম আন্তরিক উপলব্ধি গড়ে তুলতে পারি?
হৃদয়ের অবস্থা এবং অর্থপূর্ণ ধ্যান
৭. উত্তম হৃদয়ের সঙ্গে কোন কাজ ওতপ্রোতভাবে জড়িত?
৭ লক্ষ করুন যে, উত্তম হৃদয়কে বাইবেল বার বার কোন কাজের সঙ্গে জড়িত করে। “ধার্ম্মিকের মন উত্তর করিবার নিমিত্ত চিন্তা [“ধ্যান,” NW] করে।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) (হিতোপদেশ ১৫:২৮) “আমার মুখের বাক্য ও আমার চিত্তের ধ্যান তোমার দৃষ্টিতে গ্রাহ্য হউক, হে সদাপ্রভু।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) (গীতসংহিতা ১৯:১৪) “আমার চিত্তের আলোচনা [“ধ্যান,” NW] বুদ্ধির ফল হইবে।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।)—গীতসংহিতা ৪৯:৩.
৮. (ক) বাইবেল পড়ার সময় আমাদের কী এড়িয়ে চলা উচিত কিন্তু কী করা উচিত? (খ) ঈশ্বরের বাক্য নিয়ে প্রার্থনাপূর্বক ধ্যান করে আমরা কোন কোন উপকার লাভ করি? (‘সত্যে সুস্থির আছে’ শিরোনামের বাক্সের বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করুন।)
৮ এই বাইবেল লেখকদের মতো, আমাদেরও ঈশ্বরের বাক্য ও তাঁর কার্যকলাপ নিয়ে উপলব্ধি সহকারে ও প্রার্থনাপূর্বক ধ্যান করা দরকার। বাইবেল অথবা বাইবেল-ভিত্তিক প্রকাশনাগুলো পড়ার সময় আমাদের তাড়াহুড়োপ্রবণ পর্যটকদের মতো করা উচিত নয়, যারা একটা সুন্দর জায়গা থেকে দ্রুত আরেকটায় চলে যায়, কোনো কিছু ভাল করে না দেখেই কেবল ছবি তুলতে থাকে। বরং, বাইবেল অধ্যয়ন করার সময় আমরা চাইব একটু চিন্তা করতে, এক অর্থে দৃশ্যটাকে উপভোগ করতে।b যা পড়ছি তা নিয়ে যখন আমরা শান্তভাবে চিন্তা করি, তখন ঈশ্বরের বাক্য আমাদের হৃদয়কে প্রভাবিত করে। এটা আমাদের আবেগকে নাড়া দেয় এবং আমাদের চিন্তাধারাকে একটা নির্দিষ্ট আকার দেয়। এ ছাড়া, এটা আমাদের একান্ত চিন্তাভাবনাগুলোকে প্রার্থনার মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে জানাতে প্রেরণা দেয়। ফলে, যিহোবার প্রতি আমাদের আসক্তি আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে এবং ঈশ্বরের প্রতি আমাদের প্রেম, এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিস্থিতিতেও যিশুকে অনুসরণ করে চলতে পরিচালিত করে। (মথি ১০:২২) এটা স্পষ্ট যে, ঈশ্বর যা বলেন তা নিয়ে ধ্যান করা অপরিহার্য যদি আমরা শেষ পর্যন্ত বিশ্বস্ত থাকতে চাই।—লূক ২১:১৯.
৯. কীভাবে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, আমাদের হৃদয় ঈশ্বরের বাক্যের প্রতি সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে তৎপর?
৯ যিশুর দৃষ্টান্ত আরও দেখায় যে, বীজ অর্থাৎ ঈশ্বরের বাক্যের বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তাই বিশ্বস্ত শিষ্য হিসেবে স্থির থাকার জন্য আমাদের উচিত (১) দৃষ্টান্তে উল্লেখিত ভূমির অনুর্বর অবস্থা দ্বারা চিত্রিত প্রতিবন্ধকতাকে শনাক্ত করা এবং (২) সেগুলোকে সংশোধন করার জন্য বা এড়িয়ে চলার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া। এভাবে আমরা নিশ্চিত হতে পারব যে, আমাদের হৃদয় রাজ্যের বীজের প্রতি সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে তৎপর থাকবে এবং ফল উৎপন্ন করে চলবে।
“পথের পার্শ্বে”—মগ্ন
১০. যিশুর দৃষ্টান্তের প্রথম ধরনের ভূমির বর্ণনা দিন এবং এর অর্থ ব্যাখ্যা করুন।
১০ প্রথম যে-ধরনের ভূমিতে বীজ পড়ে তা হল “পথের পার্শ্বে,” যেখানে বীজ “পদতলে দলিত” হয়। (লূক ৮:৫) যে-রাস্তা শস্যখেতের মধ্যে দিয়ে যায় সেটার পাশের ভূমি, পথিকদের হাঁটাচলার ফলে শক্ত হয়ে পড়ে। (মার্ক ২:২৩) একইভাবে, যারা জগতের বিষয়গুলোকে তাদের সময় ও শক্তির ওপর অযথা বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ দেয়, তারা এক সময় দেখতে পাবে তারা এত বেশি মগ্ন যে, ঈশ্বরের বাক্যের প্রতি আন্তরিক উপলব্ধিবোধ গড়ে তুলতে তারা আর সক্ষম নয়। তারা এটা শোনে কিন্তু এটা নিয়ে ধ্যান করতে ব্যর্থ হয়। তাই তাদের হৃদয় অসংবেদনশীল অবস্থায় থেকে যায়। এটির প্রতি ভালবাসা গড়ে তোলার আগেই “দিয়াবল আসিয়া তাহাদের হৃদয় হইতে সেই বাক্য হরণ করিয়া লয়, যেন তাহারা বিশ্বাস করিয়া পরিত্রাণ না পায়।” (লূক ৮:১২) এটাকে কি রোধ করা যেতে পারে?
১১. কীভাবে আমরা আমাদের হৃদয়ের অবস্থাকে শক্ত ভূমির মতো হয়ে যাওয়া থেকে রোধ করতে পারি?
১১ হৃদয়কে পথের পাশে পড়া অনুর্বর ভূমির মতো হওয়া থেকে রোধ করতে অনেক কিছু করা যেতে পারে। পদদলিত ও শক্ত ভূমি নরম ও উর্বরা হতে পারে, যদি এটাকে চাষ করা হয় এবং এটার ওপর দিয়ে চলাচলকারী পথিক ও যানবাহনকে ভিন্নমূখী করা যায়। একইভাবে, ঈশ্বরের বাক্য অধ্যয়ন এবং তা নিয়ে ধ্যান করার ফলে হৃদয় উত্তম, উর্বর ভূমিতে পরিণত হতে পারে। মূল বিষয়টা হল, জীবনের তুচ্ছ বিষয়গুলো নিয়ে অতিরিক্ত মগ্ন না হওয়া। (লূক ১২:১৩-১৫) এর পরিবর্তে, জীবনের “ভিন্ন প্রকার [“বেশি গুরুত্বপূর্ণ,” NW]” বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার জন্য পর্যাপ্ত সময় রয়েছে কিনা, সেই বিষয় নিশ্চিত হওয়া।—ফিলিপীয় ১:৯-১১.
“পাষাণের উপরে”—ভয় পাওয়া
১২. যিশুর দৃষ্টান্তে উল্লেখিত দ্বিতীয় ধরনের ভূমিতে উৎপন্ন অঙ্কুর শুকিয়ে যাওয়ার মূল কারণটা কী?
১২ বীজ যখন দ্বিতীয় ধরনের ভূমিতে পড়ে, তখন এটা কেবল প্রথমটার মতো ভূমিতেই পড়ে থাকে না। এটা শিকড় বিস্তার করে এবং অঙ্কুরিত হয়। কিন্তু যখন সূর্য ওঠে, তখন সেই অঙ্কুর সূর্যের তাপে উত্তপ্ত হয় ও শুকিয়ে যায়। এই তাৎপর্যপূর্ণ বিশদ বর্ণনাটা লক্ষ করুন। অঙ্কুর শুকিয়ে যাওয়ার মূল কারণ উত্তাপ নয়। কারণ উত্তম ভূমিতে যে-চারাগাছটা জন্মায় সেটাও সূর্যের তাপ পায় কিন্তু শুকিয়ে যায় না—বস্তুতপক্ষে সেটা আরও বেড়ে ওঠে। এই পার্থক্যের কারণটা কী? যিশু ব্যাখ্যা করেন যে, “অধিক মৃত্তিকা না পাওয়াতে” এবং “রস না পাওয়াতে” এই অঙ্কুর শুকিয়ে যায়। (মথি ১৩:৫, ৬; লূক ৮:৬) ‘পাষাণ’ যেহেতু মাটির ওপরের স্তরের ঠিক নিচেই থাকে, তাই এটা বীজকে বাধা দেয় যাতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা ও দৃঢ়তা লাভ করার জন্য এর শিকড় যথেষ্ট গভীরে যেতে না পারে। অঙ্কুর শুকিয়ে যায় কারণ ভূমি অগভীর।
১৩. কোন ধরনের ব্যক্তিরা অগভীর ভূমির মতো এবং তারা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় সেটার প্রধান কারণটা কী?
১৩ দৃষ্টান্তের এই অংশটুকু সেই ব্যক্তিদের বোঝায়, যারা “আনন্দপূর্ব্বক সেই বাক্য গ্রহণ করে” এবং উদ্যোগের সঙ্গে যিশুকে “অল্প কালমাত্র” অনুসরণ করে। (লূক ৮:১৩) “ক্লেশ কিম্বা তাড়না” তুল্য সূর্যের তীব্র তাপের সম্মুখীন হয়ে তারা এতটাই ভয় পেয়ে যায় যে, তাদের আনন্দ ও শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং খ্রিস্টকে অনুসরণ করা ছেড়ে দেয়। (মথি ১৩:২১) কিন্তু, তাদের ভয় পাওয়ার প্রধান কারণটা বিরোধিতা নয়। শত হলেও, খ্রিস্টের লক্ষ লক্ষ শিষ্য বিভিন্ন ধরনের ক্লেশ সহ্য করে কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা বিশ্বস্ত থাকে। (২ করিন্থীয় ২:৪; ৭:৫) কেউ কেউ কেন ভয় পায় ও সরে যায় সেটার প্রধান কারণ হল, তাদের হৃদয়ের পাষাণতুল্য অবস্থা তাদেরকে ইতিবাচক ও আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে ধ্যান করার ক্ষেত্রে বাধা দেয়। ফলে, যিহোবা ও তাঁর বাক্যের জন্য তারা যে-উপলব্ধিবোধ গড়ে তোলে তা অত্যন্ত বাহ্যিক হয় এবং এতটা দুর্বল থাকে যে, বিরোধিতা প্রতিরোধ করতে পারে না। একজন কীভাবে এইধরনের পরিণতিকে রোধ করতে পারে?
১৪. একজন ব্যক্তির হৃদয়ের অবস্থা অগভীর ভূমির মতো হয়ে যাওয়া রোধ করার জন্য কোন পদক্ষেপগুলো নেওয়া উচিত?
১৪ একজন ব্যক্তির নিশ্চিত হওয়া দরকার যে, কোনো পাষাণতুল্য বাধা, যেমন দৃঢ়-প্রতিষ্ঠিত তিক্ততা, গুপ্ত স্বার্থপরতা বা এইধরনের কঠিন কিংবা আভ্যন্তরীণ অনুভূতি তার হৃদয়ে গেঁথে আছে কি না। এইধরনের একটা প্রতিবন্ধক যদি ইতিমধ্যেই থেকে থাকে, তা হলে ঈশ্বরের বাক্যের শক্তি সেটাকে ভেঙে ফেলতে পারে। (যিরমিয় ২৩:২৯; ইফিষীয় ৪:২২; ইব্রীয় ৪:১২) এরপর, প্রার্থনাপূর্বক ধ্যান ব্যক্তির হৃদয়ের একেবারে গভীরে ‘বাক্যকে রোপিত’ করতে উদ্দীপিত করবে। (যাকোব ১:২১) এটা নিরুৎসাহের সময়গুলোকে মোকাবিলা করার মতো শক্তি এবং পরীক্ষা সত্ত্বেও বিশ্বস্ত থাকার মতো সাহস জোগাবে।
“কাঁটাবনের মধ্যে”—বিভক্ত হওয়া
১৫. (ক) কেন যিশুর বলা তৃতীয় ধরনের ভূমি বিশেষ করে আমাদের মনোযোগ পাওয়ার যোগ্য? (খ) তৃতীয় ধরনের ভূমির ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত কী হয় এবং কেন?
১৫ তৃতীয় ধরনের ভূমি, যেখানে কাঁটা রয়েছে তা বিশেষভাবে আমাদের মনোযোগ পাওয়ার যোগ্য কারণ কয়েকটা দিক দিয়ে এটা উত্তম ভূমির মতোই। উত্তম ভূমির মতো কাঁটাবনের ভূমিও বীজকে শিকড় বিস্তার করতে এবং অঙ্কুরিত হতে সুযোগ দেয়। প্রথম দিকে, এই দুই ধরনের ভূমিতে নতুন চারাগাছের বৃদ্ধিতে তেমন কোনো পার্থক্য থাকে না। কিন্তু, সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয় যে তা শেষ পর্যন্ত চারাগাছকে চেপে রাখে। উত্তম ভূমির বিপরীতে এই ভূমি কাঁটা দ্বারা আবৃত হয়। এই ভূমিতে যখন চারাগাছ বেড়ে ওঠে, তখন এটা ‘সঙ্গে সঙ্গে অঙ্কুরিত কাঁটা সকলের’ কাছ থেকে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়। কিছু সময়ের জন্য দুটোই পুষ্টি, আলো এবং ফাঁকা জায়গা পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাঁটাগাছগুলো চারাগাছকে ঢেকে ফেলে এবং এটাকে ‘চাপিয়া রাখে।’—লূক ৮:৭.
১৬. (ক) কোন ধরনের লোকেরা কাঁটাযুক্ত ভূমিকে চিত্রিত করে? (খ) তিনটি সুসমাচারের বিবরণ অনুসারে, কাঁটা কোন বিষয়কে প্রতিনিধিত্ব করে?—পাদটীকা দেখুন।
১৬ কোন ধরনের লোকেরা কাঁটাযুক্ত ভূমিকে চিত্রিত করে? যিশু ব্যাখ্যা করেন: “তাহা এমন লোক, যাহারা শুনিয়াছে, কিন্তু চলিতে চলিতে জীবনের চিন্তা ও ধন ও সুখভোগের দ্বারা চাপা পড়ে, এবং পক্ব ফল উৎপন্ন করে না।” (লূক ৮:১৪) ঠিক যেমন বীজবাপকের বীজ ও কাঁটাগুলো একই সময়ে ভূমিতে বেড়ে ওঠে, সেভাবে কিছু ব্যক্তি একই সময়ে ঈশ্বরের বাক্য গ্রহণ করতে এবং “সুখভোগের” চেষ্টা করে। ঈশ্বরের বাক্যের সত্য তাদের হৃদয়ে বপন করা হয় কিন্তু এটা বিভিন্ন বিষয় থেকে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়, যেগুলো তাদের মনোযোগ কেড়ে নেয়। তাদের রূপক হৃদয় বিভক্ত হয়ে পড়ে। (লূক ৯:৫৭-৬২) এটা তাদের ঈশ্বরের বাক্য নিয়ে প্রার্থনাপূর্বক ও অর্থপূর্ণ ধ্যান করার জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে। তারা ঈশ্বরের বাক্য পুরোপুরি গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় এবং এভাবে সহ্য করার জন্য যে-আন্তরিক উপলব্ধিবোধের প্রয়োজন সেটার অভাব বোধ করে। ধীরে ধীরে, তাদের আধ্যাত্মিক আগ্রহগুলো অনাধ্যাত্মিক বিষয়গুলোর দ্বারা এতটাই ঢেকে যায় যে, সেগুলো “[“পুরোপুরিভাবে,” NW] চাপা পড়ে।”c যারা সর্বান্তঃকরণে যিহোবাকে ভালবাসে না, তাদের জন্য কতই না এক দুঃখজনক পরিণতি!—মথি ৬:২৪; ২২:৩৭.
১৭. যিশুর দৃষ্টান্তে বর্ণিত রূপক কাঁটাগুলো দ্বারা যাতে না চাপা পড়ি সেইজন্য আমাদের কোন বিষয়গুলো বেছে নেওয়া দরকার?
১৭ বস্তুগত বিষয়গুলোর আগে আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে আমরা এই জগতের ব্যথা ও সুখভোগের দ্বারা চাপা পড়াকে এড়িয়ে চলি। (মথি ৬:৩১-৩৩; লূক ২১:৩৪-৩৬) বাইবেল পড়া এবং যা পড়ি তা নিয়ে ধ্যান করাকে আমাদের কখনও উপেক্ষা করা উচিত নয়। যদি আমরা আমাদের জীবনকে যথাসম্ভব সাদাসিধে রাখি, তা হলে আমরা মনোযোগ নিবিষ্ট করতে ও প্রার্থনাপূর্বক ধ্যান করার জন্য আরও বেশি সময় পাব। (১ তীমথিয় ৬:৬-৮) ঈশ্বরের যে-দাসেরা তা করেছে—যারা এমন যেন ফল-দানকারী চারাগাছকে আরও পুষ্টি, আলো ও ফাঁকা জায়গা দেওয়ার জন্য কাঁটাগুলোকে মাটি থেকে তুলে ফেলেছে—তারা যিহোবার আশীর্বাদ উপভোগ করছে। ২৬ বছর বয়সী সান্ড্রা বলে: “যখন আমি সত্যে থাকার আশীর্বাদগুলো নিয়ে ধ্যান করি, তখন আমি বুঝতে পারি যে, জগৎ এমন কিছুই দিতে পারে না, যেটার সঙ্গে এর তুলনা করা চলে!”—গীতসংহিতা ৮৪:১১.
১৮. খ্রিস্টান হিসেবে কীভাবে আমরা ঈশ্বরের বাক্যে স্থির থাকতে এবং ধৈর্য ধরতে পারি।
১৮ তাই এটা স্পষ্ট যে, যতক্ষণ পর্যন্ত ঈশ্বরের বাক্য আমাদের মধ্যে স্থির থাকে আমরা যুবক-বৃদ্ধ সকলে ঈশ্বরের বাক্যে স্থির থাকব এবং খ্রিস্টের শিষ্য হিসেবে ধৈর্য ধরব। তাই, আসুন আমরা নিশ্চিত হই যে আমাদের রূপক হৃদয়ের ভূমি যেন কখনও শক্ত, অগভীর বা আগাছার দ্বারা আবৃত না হয় কিন্তু সবসময় নরম ও গভীর থাকে। এভাবে আমরা ঈশ্বরের বাক্যকে পুরোপুরি বুঝতে পারব এবং “ধৈর্য্য সহকারে ফল উৎপন্ন” করব।—লূক ৮:১৫.
[পাদটীকাগুলো]
a এই প্রবন্ধে আমরা এই চাহিদাগুলোর মধ্যে প্রথমটা বিবেচনা করব। বাকি দুটো পরের প্রবন্ধগুলোতে আলোচনা করা হবে।
b উদাহরণস্বরূপ, বাইবেলের কোনো একটা অংশ যা আপনি পড়েছেন তা নিয়ে প্রার্থনাপূর্বক ধ্যান করার জন্য আপনি নিজেকে জিজ্ঞেস করতে পারেন: ‘এটা কি যিহোবার কোনো একটা বা একাধিক গুণকে প্রকাশ করে? কীভাবে এটা বাইবেলের মূল বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত? কীভাবে আমি এটা আমার জীবনে কাজে লাগাতে পারি অথবা অন্যদের সাহায্য করার জন্য ব্যবহার করতে পারি?’
c যিশুর নীতিগল্প সম্বন্ধে তিনটি সুসমাচারের বিবরণ অনুসারে, বীজ এই জগতের দুঃখ ও সুখভোগ দ্বারা চাপা পড়ে: “সংসারের চিন্তা,” “ধনের মায়া,” “অন্যান্য বিষয়ের অভিলাষ” এবং ‘সুখভোগ।’—মার্ক ৪:১৯; মথি ১৩:২২; লূক ৮:১৪; যিরমিয় ৪:৩, ৪.
আপনার উত্তর কী?
• কেন আমাদের ‘যীশুর বাক্যে স্থির থাকা’ দরকার?
• কীভাবে আমরা ঈশ্বরের বাক্যকে আমাদের হৃদয়ে স্থির থাকতে দিতে পারি?
• কোন ধরনের লোকেরা যিশুর দ্বারা উল্লেখিত চার ধরনের ভূমিকে প্রতিনিধিত্ব করে?
• কীভাবে আপনি ঈশ্বরের বাক্য নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার জন্য সময় পেতে পারেন?
[১০ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]
‘সত্যে সুস্থির আছে’
খ্রিস্টের দীর্ঘদিনের অনেক শিষ্য বছরের পর বছর ধরে প্রমাণ করেছে যে, তারা ‘সত্যে সুস্থির আছে।’ (২ পিতর ১:১২) কী তাদের ধৈর্য ধরতে সাহায্য করে? তাদের কিছু মন্তব্য বিবেচনা করুন।
“আমি প্রতিদিন দিনের শেষে বাইবেলের কিছু অংশ পড়ি ও প্রার্থনা করি। এরপর আমি যা পড়েছি তা নিয়ে চিন্তা করি।”—জিন, ১৯৩৯ সালে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন।
“যিহোবা, যিনি অতি মহান তিনি কীভাবে আমাদের এত গভীরভাবে ভালবাসেন, তা নিয়ে ধ্যান করা আমাকে গভীর নিরাপত্তাবোধ ও বিশ্বস্ত থাকার শক্তি দেয়।”—প্যাট্রিশিয়া, ১৯৪৬ সালে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন।
“বাইবেল অধ্যয়নের ভাল অভ্যাসে লেগে থেকে এবং ‘ঈশ্বরের গভীর বিষয় সকল’ ভালভাবে বুঝতে পেরে আমি তাঁকে সেবা করে যেতে পেরেছি।”—১ করিন্থীয় ২:১০; অ্যানা, ১৯৩৯ সালে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন।
“আমি আমার হৃদয় ও উদ্দেশ্যগুলোকে পরীক্ষা করার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাইবেল ও বাইবেল-ভিত্তিক প্রকাশনাগুলো পড়ি।”—জেল্ডা, ১৯৪৩ সালে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন।
“আমার সর্বোত্তম সময় হচ্ছে যখন আমি হাঁটতে যাই এবং যিহোবার সঙ্গে প্রার্থনায় কথা বলি ও তাঁকে কেবল জানতে দিই যে, আমি প্রকৃতপক্ষে কেমন বোধ করি।”—রাল্ফ, ১৯৪৭ সালে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন।
“আমি দৈনিক শাস্ত্রপদটি আলোচনা করে এবং বাইবেলের কিছু অংশ পড়ে দিন শুরু করি। এটা আমাকে সারাদিন ধ্যান করার জন্য নতুন বিষয় জোগায়।—মেরি, ১৯৩৫ সালে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন।
“আমার জন্য বাইবেলের কোনো একটা বইয়ের প্রতিটা পদ আলোচনা প্রকৃতই এক শক্তিবর্ধক হিসেবে কাজ করে।”—ড্যানিয়েল, ১৯৪৬ সালে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন।
ঈশ্বরের বাক্য নিয়ে প্রার্থনাপূর্বক ধ্যান করার জন্য আপনি কখন সময় করে নেন?—দানিয়েল ৬:১০খ; মার্ক ১:৩৫; প্রেরিত ১০:৯.
[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে আমরা ‘ধৈর্য্য সহকারে ফল উৎপন্ন করিতে’ পারি