দ্বিতীয় বিবরণ
৪ “এখন হে ইজরায়েল, আমি তোমাদের যে-আইনকানুন এবং বিচার সংক্রান্ত রায় সম্বন্ধে শেখাচ্ছি, সেগুলো মন দিয়ে শোনো এবং সেগুলো পালন করো, যাতে তোমরা বেঁচে থাক আর সেই দেশে গিয়ে সেটাকে দখল কর, যেটা তোমাদের পূর্বপুরুষদের ঈশ্বর যিহোবা তোমাদের দিতে চলেছেন। ২ আমি তোমাদের যে-সমস্ত আজ্ঞা দিচ্ছি, সেগুলোর সঙ্গে তোমরা কিছু যোগ করবে না অথবা সেগুলো থেকে কিছু বাদ দেবে না, যাতে তোমরা তোমাদের ঈশ্বর যিহোবার সমস্ত আজ্ঞা পালন করে চল।
৩ “তোমরা নিজেদের চোখে দেখেছ, যিহোবা পিয়োরের বাল দেবতার বিষয়ে কী করেছিলেন। তোমাদের ঈশ্বর যিহোবা তোমাদের মধ্য থেকে সেই সমস্ত ব্যক্তিকে মেরে ফেলেছিলেন, যারা পিয়োরের বাল দেবতার উপাসনা করেছিল। ৪ কিন্তু, তোমরা সবাই আজ বেঁচে রয়েছ কারণ তোমরা তোমাদের ঈশ্বর যিহোবাকে আঁকড়ে ধরে রয়েছ। ৫ দেখো, আমার ঈশ্বর যিহোবা আমাকে যেমন আজ্ঞা দিয়েছেন, তেমনই আমি তোমাদের তাঁর সমস্ত আইনকানুন এবং বিচার সংক্রান্ত রায় সম্বন্ধে শিক্ষা দিয়েছি, যাতে তোমরা সেই দেশে সেগুলো পালন করতে পার, যেটা তোমরা দখল করতে চলেছ। ৬ তোমরা এই সমস্ত আইনকানুন ভালোভাবে পালন করবে কারণ এমনটা করার মাধ্যমে সমস্ত জাতির সামনে তোমাদের প্রজ্ঞা এবং বোঝার ক্ষমতা প্রকাশ পাবে আর তারা এই আইনকানুন সম্বন্ধে শুনে বলবে, ‘এই বিশাল জাতির লোকেরা সত্যিই বিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান।’ ৭ এমন আর কোন বিশাল জাতি রয়েছে, যাদের দেবতা তাদের এতটা কাছে থাকেন, যতটা আমাদের ঈশ্বর যিহোবা আমাদের কাছে থাকেন? আমরা যখনই তাঁকে ডাকি, তখনই তিনি আমাদের কথা শোনেন। ৮ আজ আমি তোমাদের যে-সম্পূর্ণ ব্যবস্থা দিচ্ছি, সেইরকম আইনকানুন এবং বিচার সংক্রান্ত রায় আর কোন বিশাল জাতির রয়েছে?
৯ “সাবধান থেকো এবং নিজেদের প্রতি ভালো করে মনোযোগ দিয়ো, যাতে তোমরা নিজেদের চোখে যা-কিছু দেখেছ, সেগুলো কখনো ভুলে না যাও এবং তোমরা যতদিন বেঁচে থাক, ততদিন তোমাদের হৃদয় থেকে সেগুলো মুছে না যায়। তোমরা এই সমস্ত কথা তোমাদের ছেলেদের এবং তোমাদের নাতিদেরও জানিয়ো। ১০ যে-দিন তোমরা হোরেবে তোমাদের ঈশ্বর যিহোবার সামনে দাঁড়িয়েছিলে, সেই দিন যিহোবা আমাকে বলেছিলেন, ‘সমস্ত লোককে আমার সামনে একত্রিত করো, যাতে তারা আমার আজ্ঞাগুলো শোনে, যেন তারা সারাজীবন ধরে আমাকে ভয় করতে শেখে এবং তাদের ছেলেদেরও তা শেখায়।’
১১ “তখন তোমরা সবাই পর্বতের কাছে এলে এবং সেটার নীচে দাঁড়ালে। সেই পর্বতটা আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছিল এবং সেটার আগুন আকাশে গিয়ে ঠেকছিল। চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার এবং ঘন কালো মেঘ ছেয়ে গিয়েছিল। ১২ তারপর যিহোবা আগুনের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। তোমরা শুধু তাঁর কথা শুনতে পেলে কিন্তু তাঁকে দেখতে পেলে না। সেখানে শুধু একটা কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল। ১৩ ঈশ্বর তোমাদের তাঁর চুক্তি অর্থাৎ দশ আজ্ঞা* শোনালেন আর তোমাদের আদেশ দিলেন, যেন তোমরা সেগুলো পালন কর। এরপর, তিনি পাথরের দুটো ফলকে সেই আজ্ঞাগুলো লিখে দিলেন। ১৪ সেইসময় যিহোবা আমাকে আজ্ঞা দিলেন, যেন আমি তোমাদের তাঁর আইনকানুন এবং বিচার সংক্রান্ত রায় সম্বন্ধে শিক্ষা দিই, যাতে তোমরা সেই দেশে সেগুলো পালন করতে পার, যেটা তোমরা দখল করতে চলেছ।
১৫ “হোরেবে যিহোবা যখন আগুনের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তোমরা তাঁর কোনো আকার দেখনি। তাই, তোমরা নিজেদের প্রতি ভালো করে মনোযোগ দাও, ১৬ যেন তোমরা উপাসনার জন্য কোনো মূর্তি তৈরি করে কলুষিত হয়ে না পড়। তোমরা কারোরই আকারের মূর্তি তৈরি করবে না, হোক তা কোনো পুরুষের বা মহিলার, ১৭ পৃথিবীর কোনো পশুর, আকাশে ওড়ে এমন কোনো পাখির, ১৮ মাটির উপর বুকে ভর দিয়ে চলে এমন কোনো প্রাণীর অথবা পৃথিবীর জলে থাকে এমন কোনো মাছের। ১৯ তোমরা যখন চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকাবে এবং সূর্য, চাঁদ ও তারা দেখবে, তখন তোমরা যেন আকাশের সমস্ত বাহিনীর সামনে মাথা নত করার এবং সেগুলোর সেবা করার জন্য প্রলুব্ধ না হও। তোমাদের ঈশ্বর যিহোবা এই সমস্ত কিছু আকাশের নীচে বসবাসকারী লোকদের জন্য দিয়েছেন। ২০ তোমরাই সেই লোক, যাদের যিহোবা লোহা গলানোর অগ্নিকুণ্ড থেকে, মিশর থেকে বের করে এনেছিলেন, যাতে তোমরা তাঁর সম্পদ* হয়ে ওঠ, যেমনটা আজ তোমরা হয়েছ।
২১ “তোমাদের কারণে যিহোবা আমার উপর প্রচণ্ড রেগে গেলেন আর তিনি দিব্য করে বললেন, তিনি আমাকে জর্ডন পার হতে দেবেন না এবং সেই উত্তম দেশে যেতে দেবেন না, যেটা তোমাদের ঈশ্বর যিহোবা তোমাদের উত্তরাধিকার হিসেবে দিতে চলেছেন। ২২ আমি এই দেশেই মারা যাব, আমি জর্ডন পার হব না। কিন্তু, তোমরা জর্ডন পার হবে আর সেই উত্তম দেশ দখল করে নেবে। ২৩ তোমরা এই বিষয়ে সতর্ক থেকো, যেন তোমরা কখনো সেই চুক্তি ভুলে না যাও, যা তোমাদের ঈশ্বর যিহোবা তোমাদের সঙ্গে করেছেন আর উপাসনার জন্য তোমরা যেন খোদিত মূর্তি তৈরি না কর, কোনো আকারের প্রতিমা তৈরি না কর, ঠিক যেমনটা তোমাদের ঈশ্বর যিহোবা তোমাদের বারণ করেছেন। ২৪ কারণ তোমাদের ঈশ্বর যিহোবা গ্রাসকারী আগুনের মতো। তিনি এমন একজন ঈশ্বর, যিনি চান যেন একমাত্র তাঁর প্রতি ভক্তি দেখানো হয়।
২৫ “তোমাদের সন্তান ও নাতি-নাতনি হওয়ার এবং সেই দেশে অনেক দিন বাস করার পর তোমরা যদি মন্দ কাজ কর এবং কোনো প্রকারের খোদিত মূর্তি তৈরি কর আর এভাবে তোমাদের ঈশ্বর যিহোবার দৃষ্টিতে মন্দ কাজ করে তাঁকে রাগিয়ে তোল, ২৬ তা হলে তোমরা নিশ্চিতভাবেই সেই দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, যেটা তোমরা জর্ডন পার হয়ে দখল করতে চলেছ। আজ আমি আকাশ ও পৃথিবীকে সাক্ষি রেখে তোমাদের এই কথা বলছি। তোমরা সেই দেশে বেশি দিন থাকতে পারবে না, তোমরা পুরোপুরি বিনষ্ট হয়ে যাবে। ২৭ যিহোবা তোমাদের বিভিন্ন জাতির মধ্যে ছিন্নভিন্ন করে দেবেন। যিহোবা তোমাদের যে-সমস্ত দেশে তাড়িয়ে নিয়ে যাবেন, সেখানে তোমরা গুটি কয়েক জনই বেঁচে থাকবে। ২৮ সেখানে তোমাদের মানুষের হাতে তৈরি কাঠ ও পাথরের দেবতাদের সেবা করতে হবে, যারা না পারে দেখতে, না পারে শুনতে, না পারে খেতে আর না পারে ঘ্রাণ নিতে।
২৯ “তোমরা যদি সেখানে থাকার সময় তোমাদের ঈশ্বর যিহোবার অনুসন্ধান কর আর সমস্ত হৃদয় এবং সমস্ত প্রাণ দিয়ে তাঁর অন্বেষণ কর, তা হলে তোমরা অবশ্যই তাঁকে খুঁজে পাবে। ৩০ ভবিষ্যতে তোমাদের উপর যখন এই সমস্ত বিপদ আসবে আর তোমরা খুব সমস্যার মধ্যে থাকবে, তখন তোমরা তোমাদের ঈশ্বর যিহোবার কাছে ফিরে আসবে আর তাঁর কথা শুনবে। ৩১ তোমাদের ঈশ্বর যিহোবা একজন করুণাময় ঈশ্বর। তিনি কখনোই তোমাদের পরিত্যাগ করবেন না আর কখনোই তোমাদের নিশ্চিহ্ন হতে দেবেন না। তিনি দিব্য করে তোমাদের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে যে-চুক্তি করেছিলেন, সেটা কখনোই ভুলে যাবেন না।
৩২ “এখন একটু অতীতের কথা স্মরণ করো। যে-দিন ঈশ্বর পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন, সেই দিন থেকে শুরু করে তোমাদের অস্তিত্বে আসার আগের সময়ের কথা স্মরণ করো। আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত খুঁজে দেখো। আগে কখনো কি এইরকম মহৎ ঘটনা ঘটেছে কিংবা কেউ কি এইরকম ঘটনা সম্বন্ধে শুনেছে? ৩৩ তোমাদের মতো অন্য কোনো জাতির লোক কি আগুনের মধ্য থেকে ঈশ্বরকে কথা বলতে শুনেছে এবং বেঁচে থাকতে পেরেছে? ৩৪ তোমরা নিজের চোখে দেখেছ যে, তোমাদের ঈশ্বর যিহোবা তোমাদের মিশর থেকে বের করে তাঁর নিজের জাতি করার জন্য কী কী করেছেন। তিনি মিশরের উপর একটার পর একটা পরীক্ষা নিয়ে এসেছিলেন, সেখানে চিহ্ন দেখিয়েছিলেন, অলৌকিক কাজ করেছিলেন, যুদ্ধ করেছিলেন, ভয়ংকর ভয়ংকর কাজ করেছিলেন এবং নিজের শক্তিশালী হস্ত বিস্তার করে তোমাদের সেখান থেকে বের করে এনেছিলেন। তিনি কি আগে কখনো কোনো জাতির মধ্য থেকে আরেকটা জাতিকে বের করার জন্য এমনটা করেছেন? ৩৫ এই সমস্ত কিছু তোমাদের এই কারণেই দেখানো হল, যাতে তোমরা জানতে পার যে, যিহোবাই সত্য ঈশ্বর। তিনি ছাড়া আর কোনো ঈশ্বর নেই। ৩৬ তিনি তোমাদের সংশোধন করার জন্য স্বর্গ থেকে তোমাদের সঙ্গে কথা বললেন আর পৃথিবীতে তিনি তোমাদের তাঁর ভয়াবহ আগুন দেখালেন আর তোমরা তাঁকে আগুনের মধ্য থেকে কথা বলতে শুনলে।
৩৭ “ঈশ্বর তোমাদের পূর্বপুরুষদের খুব ভালোবাসতেন আর তিনি তাদের পরে তাদের বংশকে বেছে নিলেন। এই কারণেই তিনি তোমাদের সঙ্গে থেকে নিজের মহাশক্তির মাধ্যমে তোমাদের মিশর থেকে বের করে আনলেন। ৩৮ তিনি তোমাদের সামনে থেকে এমন জাতিগুলোকে দূর করে দিলেন, যেগুলো তোমাদের চেয়ে অনেক গুণ বড়ো ও শক্তিশালী ছিল, যাতে তিনি তোমাদের তাদের দেশে নিয়ে যান এবং তাদের জমিজায়গা তোমাদের উত্তরাধিকার হিসেবে দেন, যেমনটা আজ ঘটছে। ৩৯ তাই, আজ এই কথা তোমরা জেনে নাও আর নিজের হৃদয়ে গেঁথে নাও যে, উপরে আকাশে এবং নীচে পৃথিবীতে একমাত্র যিহোবাই সত্য ঈশ্বর। তিনি ছাড়া আর কোনো ঈশ্বর নেই। ৪০ আর আজ আমি তোমাদের যে-আইনকানুন ও আজ্ঞা দিচ্ছি, সেগুলো তোমরা অবশ্যই পালন কোরো, যাতে তোমাদের এবং তোমাদের পরে তোমাদের সন্তানদের মঙ্গল হয় আর তোমরা সেই দেশে দীর্ঘদিন ধরে বেঁচে থাক, যেটা তোমাদের ঈশ্বর যিহোবা তোমাদের দিতে চলেছেন।”
৪১ সেইসময় মোশি জর্ডনের পূর্ব দিকে তিনটে নগর আলাদা করলেন। ৪২ কোনো ব্যক্তি যদি ঘৃণার কারণে নয় কিন্তু অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে, তা হলে তাকে এই নগরগুলোর মধ্যে কোনো একটা নগরে পালিয়ে যেতে হবে এবং সেখানেই থাকতে হবে। ৪৩ এই তিনটে নগর হল রূবেণীয়দের জন্য মালভূমির প্রান্তরে অবস্থিত বেৎসর, গাদীয়দের জন্য গিলিয়দে অবস্থিত রামোৎ এবং মনঃশীয়দের জন্য বাশনে অবস্থিত গোলন।
৪৪ মোশি ইজরায়েলের লোকদের এই ব্যবস্থা দিলেন। ৪৫ ইজরায়েলীয়েরা মিশর থেকে বের হওয়ার পর মোশি তাদের এই আইনকানুন, বিচার সংক্রান্ত রায় এবং তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য এই নির্দেশনা দিলেন। ৪৬ মোশি লোকদের এইসমস্ত কথা সেই সময় বললেন, যখন তারা জর্ডনের কাছে বৈৎ-পিয়োরের সামনের উপত্যকায় ছিল। বৈৎ-পিয়োর হিষ্বোনে বসবাসরত ইমোরীয়দের রাজা সীহোনের দেশে অবস্থিত। মোশি ও ইজরায়েলীয়েরা মিশর থেকে বের হওয়ার পর এই রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। ৪৭ তারা তার দেশ এবং বাশনের রাজা ওগের দেশ দখল করে নিল। এই দুই ইমোরীয় রাজা জর্ডনের পূর্ব দিকে বাস করতেন। ৪৮ ইজরায়েলীয়েরা অর্ণোন উপত্যকার কাছে অবস্থিত অরোয়ের থেকে শুরু করে সীওন অর্থাৎ হর্মোণ পর্বত পর্যন্ত সমস্ত এলাকা এবং ৪৯ জর্ডনের পূর্ব দিকে অবস্থিত পুরো অরাবা এবং দূরে পিস্গার ঢালু অংশের নীচে অবস্থিত অরাবার সাগর* পর্যন্ত এলাকা দখল করে নিল।