যিহোবা করুণার সাথে শাসন করেন
ইতিহাসব্যাপী অনেক মানব শাসকেরা তাদের প্রজাদের দুঃখকষ্টের প্রতি তাচ্ছিল্যপূর্ণ অবজ্ঞার সাথে ক্ষমতা প্রয়োগ করে এসেছেন। কিন্তু, একটি জাতি—অর্থাৎ ইস্রায়েলকে মনোনয়ন করে ও তাদেরকে করুণার সাথে শাসন করে যিহোবা এক বৈসাদৃশ্য দেখিয়েছিলেন।
যখন ইস্রায়েলীয়রা প্রাচীন মিশরের দাস ছিল, যিহোবা তাদের সাহায্যের জন্য আর্তনাদ শুনেছিলেন। “তাহাদের সকল দুঃখে তিনি দুঃখিত হইতেন, . . . তিনি আপন প্রেমে ও আপন স্নেহে তাহাদিগকে মুক্ত করিতেন।” (যিশাইয় ৬৩:৯) যিহোবা ইস্রায়েলীয়দের রক্ষা করেছিলেন, অলৌকিকভাবে তাদের জন্য খাবার যুগিয়েছিলেন আর তাদের নিজ দেশে তাদেরকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিলেন।
যিহোবার করুণাময় গুণটি এর পরে আরও প্রকাশ পেয়েছিল এই জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ব্যবস্থাগুলির মধ্যে। তিনি ইস্রায়েলীয়দের আজ্ঞা দিয়েছিলেন অনাথ, বিধবা ও প্রবাসীদের সাথে করুণাপূর্ণভাবে আচরণ করতে। তারা অক্ষমদের কাছ থেকে অন্যায় সুযোগ নিতে পারত না।
ব্যবস্থার একটি চাহিদা ছিল যে যাদের প্রয়োজন তাদের প্রতি যেন করুণা দেখান হয়। শস্যচ্ছেদনের পর দরিদ্রেরা অবশিষ্ট শস্য সংগ্রহ করতে পারত। বিশ্রাম (সপ্তম) বৎসরে ঋণ থেকে মুক্ত করে দেওয়া হত। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সমস্ত বিক্রিত জমি যোবেল (৫০তম) বছরে ফিরিয়ে দিতে হত। প্রাচীন ইস্রায়েল—এর জীবন ও রীতিনিয়মগুলি (ইংরাজি) বিবৃতি দেয়: “আধুনিক অর্থে ইস্রায়েলে, প্রকৃতই কোন সামাজিক শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল না।” “বসতির প্রাথমিক দিনগুলিতে সমস্ত ইস্রায়েলীয়রা কমবেশি জীবনযাপনের একই মান উপভোগ করত।”—লেবীয় পুস্তক ২৫:১০; দ্বিতীয় বিবরণ ১৫:১২-১৪; ২৪:১৭-২২; ২৭:১৮.
যিহোবার করুণা অনুকরণ করা
ঈশ্বরের দাসেরা তাঁর করুণার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, ইতিহাসব্যাপী, কিছু নব প্রতিষ্ঠিত রাজারা পূর্ববর্তী রাজ বংশের জীবিত সদস্যদের হত্যা করেছিলেন। কিন্তু যিহোবার দাস দায়ূদ তা করেননি। রাজা শৌলের মৃত্যুর পর, দায়ূদ শৌলের জীবিত পৌত্ত্র ও উত্তরাধিকারী মফীবোশতকে সুরক্ষা যুগিয়েছিলেন। “রাজা শৌলের পৌত্ত্র, যোনাথনের পুত্ত্র মফীবোশতের প্রতি করুণা করিলেন।”—২ শমূয়েল ২১:৭.
যীশুর মত করে কোন মানুষ যিহোবার করুণা অনুকরণ করেনি। তাঁর অনেক অলৌকিক কাজ ঈশ্বরীয় করুণার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। একটি পরিস্থিতিতে একজন কুষ্ঠরোগী তাঁকে বিনতি করেছিলেন: “যদি আপনার ইচ্ছা হয়, আমাকে শুচি করিতে পারেন।” যীশু করুণাবিষ্ট হয়ে তাকে স্পর্শ করে বলেছিলেন: “আমার ইচ্ছা, তুমি শুচীকৃত হও।” (মার্ক ১:৪০-৪২) আর একবার বিস্তর জনতা যীশুকে অনুসরণ করেছিল। উত্তেজিত জনতার ভিড়ের মধ্যে দুইজন অন্ধের প্রতি যীশুর দৃষ্টি পড়ে যারা চিৎকার করে বলেছিলেন: “প্রভু দায়ূদ-সন্তান, আমাদের প্রতি করুণা করুন। . . . যীশু করুণাবিষ্ট হইয়া তাহাদের চক্ষু স্পর্শ করিলেন, আর তখনই তাহারা দেখিতে পাইল।”—মথি ২০:২৯-৩৪.
বিশাল জনতা অন্যদের প্রতি যীশুর সহানুভূতিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়নি। একটি পরিস্থিতিতে তিনি বলেছিলেন, “এই লোকসমূহের প্রতি আমার করুণা হইতেছে,” কারণ তারা কিছু সময় ধরে অনাহারে ছিল। তাই তিনি তাদের অলৌকিকভাবে খাইয়েছিলেন। (মার্ক ৮:১-৮) ভ্রমণ করার সময়ে যীশু জনতাকে শুধু শিক্ষাই দিতেন না কিন্তু তাদের প্রয়োজনের প্রতিও লক্ষ্য রাখতেন। (মথি ৯:৩৫, ৩৬) এইধরনের ভ্রমণের পর, যীশু ও তাঁর শিষ্যদের বিশ্রাম নেওয়ার, এমনকি খাওয়ারও সময় থাকত না। বাইবেলের বিবরণ আমাদের জানায়: “পরে তাঁহারা নৌকাযোগে বিরলে এক নির্জ্জন স্থানে যাত্রা করিলেন। কিন্তু লোকে তাঁহাদিগকে যাইতে দেখিল, এবং অনেকে তাঁহাদিগকে চিনিতে পারিল, তাই সকল নগর হইতে পদব্রজে সেখানে দৌড়িয়া তাঁহাদের অগ্রে গেল। তখন যীশু বাহির হইয়া বিস্তর লোক দেখিয়া তাহাদের প্রতি করুণাবিষ্ট হইলেন, কেননা তাহারা পালক-বিহীন মেষপালের ন্যায় ছিল; আর তিনি তাহাদিগকে অনেক বিষয় শিক্ষা দিতে লাগিলেন।”—মার্ক ৬:৩১-৩৪.
কেবলমাত্র লোকেদের অসুস্থতা ও দারিদ্রই নয় কিন্তু তাদের আধ্যাত্মিক অবস্থাও যীশুকে প্রভাবিত করেছিল। তাদের নেতারা তাদের ওপর অন্যায় সুযোগ নিয়ে থাকতেন, তাই যীশু “তাহাদের প্রতি করুণাবিষ্ট হইলেন।” গ্রীক শব্দ “করুণাবিষ্ট হইলেন” এর অর্থ “অন্তর থেকে আকুল আকাঙ্ক্ষা বোধ করা।” বাস্তবিকই যীশু একজন করুণাপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন!
নিষ্ঠুর জগতে করুণা
যীশু খ্রীষ্ট হলেন এখন যিহোবার স্বর্গীয় রাজ্যের রাজা। প্রাচীন ইস্রায়েলের প্রতি তিনি যেমন করেছিলেন, বর্তমানেও, ঈশ্বর তাঁর লোকেদের করুণার সাথে শাসন করেন। “তাহারা আমারই হইবে, ইহা বাহিনীগণের সদাপ্রভু কহেন; আমার কার্য্য করিবার দিনে তাহারা আমার নিজস্ব হইবে; . . . আমি তাহাদের প্রতি . . . মমতা করিব।”—মালাখি ৩:১৭.
যিহোবার করুণা যারা লাভ করতে চান তাদের অবশ্যই তাঁর সমস্ত পথ অনুকরণ করতে হবে। এটি সত্য যে, আমরা যে জগতে বাস করি সেখানে লোকেরা অপরের প্রয়োজনের প্রতি সাড়া দেওয়ার চেয়ে বরঞ্চ তাদের নিজেদের জীবনধারা সংরক্ষিত রাখার প্রতি বেশি আগ্রহী। কর্মী ও ভোক্তার নিরাপত্তার প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা প্রায়ই তাদের নিজেদের লাভ খুঁজে থাকেন। ২ তীমথিয় ৩:১-৪ পদে, বাইবেল নিখুঁতভাবে আমাদের সময়ের নৈতিক আবহাওয়া সম্পর্কে বর্ণনা করে যা বহু লোকের অন্তরের করুণাকে হত্যা করেছে।
তবুও, সম্ভবত আমরা করুণা দেখানোর সুযোগ পেতে পারি। আমরা কি আমাদের প্রতিবেশীদের কোনও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করতে পারি? অসুস্থ কোন ব্যক্তির কাছে কি আমরা যেতে পারি? “ক্ষীণসাহসদিগকে সান্ত্বনা কর, দুর্ব্বলদিগের সাহায্য কর,” এই পরামর্শটির সাথে সংগতি রেখে যারা হতাশাগ্রস্ত তাদের কি আমরা সান্ত্বনা দিতে পারি?—১ থিষলনীকীয় ৫:১৪.
করুণা আমাদের অপরের ভুলত্রুটিগুলির প্রতি রুক্ষ প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে চলতে সাহায্য করবে। আমাদের বলা হয়েছে: “সর্ব্বপ্রকার কটুকাটব্য, রোষ, ক্রোধ, কলহ, নিন্দা এবং সর্ব্বপ্রকার হিংসেচ্ছা তোমাদের হইতে দূরীকৃত হউক। তোমরা পরস্পর মধুর স্বভাব ও করুণাচিত্ত হও, পরস্পর ক্ষমা কর, যেমন ঈশ্বরও খ্রীষ্টে তোমাদিগকে ক্ষমা করিয়াছেন।”—ইফিষীয় ৪:৩১, ৩২.
এছাড়াও করুণা আমাদের ক্ষমতা অপব্যবহারের প্রবণতাকে এড়িয়ে চলতে সাহায্য করবে। বাইবেল জানায়: “তোমরা . . . করুণার চিত্ত, মধুর ভাব, নম্রতা, মৃদুতা, সহিষ্ণুতা পরিধান কর।” (কলসীয় ৩:১২) নম্রতা আমাদের অধীনস্থ ব্যক্তিদের অবস্থা বুঝতে সাহায্য করে। করুণাপূর্ণ হওয়ার অন্তর্ভুক্ত হল নম্র ও যুক্তিবাদী হওয়া এমন নয় যাকে সন্তুষ্ট করা কঠিন। দক্ষতা অন্য মানুষদের কেবলমাত্র যন্ত্রাংশ ভেবে সেইভাবে তাদের সাথে ব্যবহার করার জন্য এক অজুহাত হওয়া উচিত নয়। এছাড়াও, পরিবারে করুণাপূর্ণ স্বামীরা মনে রাখেন যে তাদের স্ত্রীরা দুর্বল পাত্র। (১ পিতর ৩:৭) এই সমস্ত ক্ষেত্রে যীশুর করুণাপূর্ণ উদাহরণের বিষয়ে ধ্যান করা আমাদের সাহায্য করতে পারে।
যেহেতু যীশু তাঁর পার্থিব পরিচর্যার সময়ে লোকেদের বিষয়ে গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন, তাই আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে তিনি এখন এবং ভবিষ্যতেও অবিরতভাবে এক করুণাপূর্ণ শাসক হবেন। তাঁর সম্বন্ধে গীতসংহিতা ৭২ অধ্যায় ভবিষ্যদ্বাণীমূলকভাবে বলে: “তিনি দুঃখী প্রজাগণের বিচার করিবেন, তিনি দরিদ্রের সন্তানদিগকে ত্রাণ করিবেন, কিন্তু উপদ্রবীকে চূর্ণ করিবেন। তিনি এক সমুদ্র অবধি অপর সমুদ্র পর্য্যন্ত, ঐ নদী অবধি পৃথিবীর প্রান্ত পর্য্যন্ত কর্ত্তৃত্ব করিবেন। তিনি দীনহীন ও দরিদ্রের প্রতি করুণা করিবেন, তিনি দরিদ্রগণের প্রাণ নিস্তার করিবেন।”—গীতসংহিতা ৭২:৪, ৮, ১৩.
তাঁর সম্বন্ধে ঈশ্বরের বাক্য ভাববাণী করে: “ধর্ম্মশীলতায় দীনহীনদের বিচার করিবেন, সরলতায় পৃথিবীস্থ নম্রদের জন্য নিষ্পত্তি করিবেন; . . . তিনি . . . দুষ্টকে বধ করিবেন।” কিভাবে এমনকি কিছু নিষ্ঠুর ও পশুতুল্য ব্যক্তিরা তাদের পথগুলি পরিবর্তন করবে তা বর্ণনা করার পর, ভবিষ্যদ্বাণীটি বলে চলে: “সে সকল আমার পবিত্র পর্ব্বতের কোন স্থানে হিংসা কিম্বা বিনাশ করিবে না; কারণ সমুদ্র যেমন জলে আচ্ছন্ন, তেমনি পৃথিবী সদাপ্রভু-বিষয়ক জ্ঞানে পরিপূর্ণ হইবে।” (যিশাইয় ১১:৪-৯) পৃথিবীব্যাপী এক মনুষ্য সমাজ যারা যিহোবাকে জানেন ও তাঁর করুণার পথগুলি অনুকরণ করেন তাদের জন্য এই ভবিষ্যদ্বাণী কতই না যথার্থ প্রতিশ্রুতি প্রদান করে!