‘বিশ্বাস দ্বারা চলা, বাহ্য দৃশ্য দ্বারা নয়’
“আমরা বিশ্বাস দ্বারা চলি, বাহ্য দৃশ্য দ্বারা নয়।”—২ করিন্থীয় ৫:৭.
১. ‘বিশ্বাস দ্বারা চলা’-র অর্থ কী?
ঈশ্বরের বাক্যে বর্ণিত নির্দেশনার সাথে মিল রেখে প্রতিবার আমরা যখন প্রার্থনা করি, আমরা দেখাই যে আমাদের অন্তত কিছু পরিমাণ বিশ্বাস রয়েছে। যখন আমরা অন্যদের কাছে ঈশ্বরের রাজ্য সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেওয়া শুরু করি, তাতেও বিশ্বাস প্রদর্শিত হয়। আর আমরা যখন আমাদের জীবন যিহোবার কাছে উৎসর্গ করি, তখন আমরা প্রমাণ দিচ্ছি যে আমাদের আকাঙ্ক্ষা হল ‘বিশ্বাস দ্বারা চলা’ অর্থাৎ এমন এক জীবনধারা অনুধাবন করা যা বিশ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।)—২ করিন্থীয় ৫:৭; কলসীয় ১:৯, ১০.
২. মণ্ডলীর কার্যকলাপে অংশ নেওয়াই কেন প্রমাণ করে না যে একজনের বিশ্বাস রয়েছে?
২ যদি আমরা সত্যই এইভাবে জীবনধারণ করতে উদ্যত হই, তাহলে আমাদের সুপ্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসের প্রয়োজন। (ইব্রীয় ১১:১, ৬) যিহোবার সাক্ষীদের উচ্চ নৈতিক মান ও সাক্ষীদের মধ্যে অবস্থিত প্রেম দেখে অনেক লোকেরা তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। এটি এক উত্তম শুরু কিন্তু এর অর্থ নয় যে এইধরনের লোকেদের বিশ্বাস রয়েছে। অন্যান্যদের হয়ত দৃঢ় বিশ্বাসী বিবাহ সাথী বা পিতা কিংবা মাতা থাকতে পারেন আর তারা হয়ত তাদের প্রিয়জনেরা যে কাজে রত তার কয়েকটিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। একজনের গৃহে এইধরনের প্রভাব থাকা সত্যই আশীর্বাদস্বরূপ কিন্তু এটিও ঈশ্বরের প্রতি ব্যক্তিগত প্রেম ও ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিকল্প নয়।—লূক ১০:২৭, ২৮.
৩. (ক) সুপ্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস থাকার জন্য বাইবেল সম্বন্ধে ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কোন্ দৃঢ়প্রত্যয় থাকা প্রয়োজন? (খ) বাইবেলের অনুপ্রেরণা সম্বন্ধে কেন কিছু ব্যক্তিরা অন্যদের চেয়ে আরও দ্রুত প্রত্যয়ী হয়ে ওঠেন?
৩ যারা বিশ্বাস দ্বারা চলেন তারা সম্পূর্ণরূপে দৃঢ়প্রত্যয়ী যে বাইবেল হল ঈশ্বরের বাক্য। পবিত্র শাস্ত্রাবলী বাস্তবিকই যে “ঈশ্বর-নিশ্বসিত”a তার প্রচুর প্রমাণ রয়েছে। (২ তীমথিয় ৩:১৬) একজন ব্যক্তি দৃঢ়প্রত্যয়ী হওয়ার আগে এই প্রমাণের কতখানি পরীক্ষা করা প্রয়োজন? সেটি হয়ত তার পটভূমির উপর নির্ভর করে হতে পারে। একজন ব্যক্তিকে যা সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট করে তা হয়ত অন্যের মধ্যে বিশ্বাস জন্মাতে পারে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনকি যদিও একজনকে প্রচুর অকাট্য প্রমাণ দেখানো হয়, তবুও হয়ত তিনি এর যুক্তিসংগত উপসংহারের বিরোধিতা করতে পারেন। কেন? কারণ আকাঙ্ক্ষাগুলি তার হৃদয়ের গভীরে সমাহিত অবস্থায় থাকে। (যিরমিয় ১৭:৯) তাই একজন ব্যক্তি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যের প্রতি আগ্রহী বলে দাবি করলেও, তার হৃদয় হয়ত জগতের অনুমোদন লাভের আকাঙ্ক্ষী হয়। তিনি হয়ত বাইবেলের মানগুলির সাথে সংঘর্ষপূর্ণ জীবনপ্রণালী পরিত্যাগ করতে চান না। কিন্তু, কেউ যদি সত্যের জন্য প্রকৃতই ক্ষুধার্ত হন, যদি তিনি তার অন্তরস্থ অনুভূতিগুলির প্রতি সৎ হন ও নম্র হন, তবে যথাসময়ে তিনি উপলব্ধি করবেন যে বাইবেল হল ঈশ্বরের বাক্য।
৪. বিশ্বাস অর্জনের জন্য একজন ব্যক্তির কিসের প্রয়োজন?
৪ যে লোকেদের বাইবেল অধ্যয়ন করতে সাহায্য করা হচ্ছে, প্রায়ই কয়েক মাসের মধ্যেই তারা উপলব্ধি করেন যে, এটি যে ঈশ্বরের বাক্য তার যথেষ্ট প্রমাণ তারা ইতিমধ্যেই পেয়েছেন। যিহোবার দ্বারা নির্দেশিত হওয়ার জন্য যদি এটি তাদের হৃদয়কে উন্মুক্ত করতে প্রণোদিত করে, তাহলে তারা যা শেখেন তার দ্বারা তাদের আভ্যন্তরীণ চিন্তা, তাদের আকাঙ্ক্ষা ও তাদের অভিপ্রায়গুলি ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হবে। (গীতসংহিতা ১৪৩:১০) রোমীয় ১০:১০ পদ বলে একজন ব্যক্তি “হৃদয়ে” বিশ্বাস অনুশীলন করেন। এইধরনের বিশ্বাসই প্রকাশ করে যে, প্রকৃতপক্ষে একজন ব্যক্তিবিশেষ কেমন অনুভব করেন আর তার জীবনধারায় এটি প্রদর্শিত হবে।
নোহ সুপ্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসানুসারে কাজ করেছিলেন
৫, ৬. নোহের বিশ্বাস কিসের উপর ভিত্তি করে ছিল?
৫ নোহ ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি, যার সুপ্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস ছিল। (ইব্রীয় ১১:৭) এর জন্য তার ভিত্তি কী ছিল? নোহের কাছে ঈশ্বরের বাক্য ছিল, লিখিত আকারে নয় কিন্তু তার কাছে তা বলা হয়েছিল। আদিপুস্তক ৬:১৩ পদ বলে: “ঈশ্বর নোহকে কহিলেন, আমার গোচরে সকল প্রাণীর অন্তিমকাল উপস্থিত, কেননা তাহাদের দ্বারা পৃথিবী দৌরাত্ম্যে পরিপূর্ণ হইয়াছে।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) যিহোবা নোহকে একটি জাহাজ নির্মাণের জন্য পরিচালনা দিয়েছিলেন আর এর গঠনপ্রণালী সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা প্রদান করেছিলেন। তারপর ঈশ্বর আরও বলেছিলেন: “আকাশের নীচে প্রাণবায়ুবিশিষ্ট যত জীবজন্তু আছে, সকলকে বিনষ্ট করণার্থে আমি পৃথিবীর উপরে জলপ্লাবন আনিব, পৃথিবীস্থ সকলে প্রাণত্যাগ করিবে।”—আদিপুস্তক ৬:১৪-১৭.
৬ এই ঘটনার আগে কি বৃষ্টি হয়েছিল? বাইবেল এই বিষয়ে কিছু বলে না। আদিপুস্তক ২:৫ পদ বলে: “সদাপ্রভু ঈশ্বর . . . বৃষ্টি বর্ষান নাই।” নোহের দিন নয় কিন্তু তার চেয়েও অনেক আগের সময় সম্বন্ধে বর্ণনা করতে গিয়ে মোশি এইভাবেই বিষয়গুলি ব্যক্ত করেছিলেন, যিনি এর কয়েক শতাব্দী পরে জীবিত ছিলেন। আদিপুস্তক ৭:৪ পদে যেমন দেখানো হয়েছে, যিহোবা নোহের সাথে কথপোকথনের সময় বৃষ্টির বিষয় উল্লেখ করেছিলেন আর তিনি যা বোঝাতে চেয়েছিলেন স্পষ্টতই নোহ তা বুঝেছিলেন। তবুও, নোহের বিশ্বাস কেবল তিনি যা দেখতে পেয়েছিলেন তার উপর ছিল না। প্রেরিত পৌল লিখেছিলেন যে নোহ “যাহা যাহা তখন দেখা যাইতেছিল না, এমন বিষয়ে আদেশ” পেয়েছিলেন। ঈশ্বর নোহকে বলেছিলেন যে তিনি পৃথিবীতে “জলপ্লাবন” অথবা “আকাশমণ্ডলীয় জলরাশি” আনতে যাচ্ছেন, যেভাবে নতুন জগৎ অনুবাদ (ইংরাজি)-এ আদিপুস্তক ৬:১৭ পদের একটি পাদটীকা বর্ণনা করে। সেই সময় পর্যন্ত এইধরনের কোন ঘটনা কখনও ঘটেনি। কিন্তু নোহের দৃষ্টিগোচরীভূত সমস্ত সৃষ্টি এক স্পষ্ট প্রমাণস্বরূপ ছিল যে বাস্তবিকই ঈশ্বর এইধরনের এক ধ্বংসাত্মক জলপ্লাবন আনতে পারেন। বিশ্বাস দ্বারা পরিচালিত হয়ে নোহ জাহাজ নির্মাণ করেছিলেন।
৭. (ক) ঈশ্বর নোহকে যা আদেশ দিয়েছিলেন তা সম্পাদন করতে তার কিসের প্রয়োজন ছিল না? (খ) নোহের বিশ্বাস বিবেচনা করে আমরা কিভাবে উপকৃত হই এবং কিভাবে আমাদের বিশ্বাস অন্যদের জন্য এক আশীর্বাদস্বরূপ হতে পারে?
৭ জলপ্লাবন কখন শুরু হবে তার কোন তারিখ ঈশ্বর নোহকে দেননি। কিন্তু নোহ জাহাজ নির্মাণ ও প্রচার করাকে তার জীবনে দ্বিতীয় স্থানে রেখে, সেটিকে দেখাই যাক কী ঘটে এমন মনোভাব পোষণ করার অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করেননি। যথেষ্ট সময় থাকতেই ঈশ্বর নোহকে কখন জাহাজে উঠতে হবে তা বলেছিলেন। এই সময়ের মধ্যে “নোহ সেইরূপ করিলেন, ঈশ্বরের আজ্ঞানুসারেই সকল কর্ম্ম করিলেন।” (আদিপুস্তক ৬:২২) নোহ বিশ্বাস দ্বারা চলেছিলেন, বাহ্য দৃশ্য দ্বারা নয়। আমরা কতই না কৃতজ্ঞ যে তিনি এইরূপ করেছিলেন! তার বিশ্বাসের কারণে আমরা আজ বেঁচে আছি। আমাদের ক্ষেত্রেও, আমরা যে বিশ্বাস দেখাই তা কেবল আমাদের জন্যই নয় কিন্তু আমাদের সন্তান ও আমাদের চতুর্দিকের অন্যান্য লোকেদের জন্য ভবিষ্যতে যা রয়েছে, তার উপর এক গভীর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
অব্রাহামের বিশ্বাস
৮, ৯. (ক) কিসের উপর অব্রাহাম তার বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন? (খ) কোন্ উপায়ে যিহোবা অব্রাহামকে “দর্শন” দিয়েছিলেন?
৮ আরেকটি উদাহরণ বিবেচনা করুন—যেটি অব্রাহাম সম্বন্ধীয়। (ইব্রীয় ১১:৮-১০) কোন্ ভিত্তির উপর অব্রাহাম তার বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন? ঊর দেশ, যেখানে তিনি বড় হয়ে উঠেছিলেন সেখানকার কল্দীয়রা প্রতিমাপূজক ও বস্তুবাদী ছিল। কিন্তু ভিন্ন প্রভাবগুলি অব্রাহামের দৃষ্টিভঙ্গিকে আকৃতি দিয়েছিল। সম্ভবত, নোহের পুত্র শেমের সাথে তিনি মেলামেশা করেছিলেন, যিনি অব্রাহামের জন্মের পর ১৫০ বছর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। অব্রাহাম দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়েছিলেন যে যিহোবা হলেন “স্বর্গমর্ত্ত্যের অধিকারী পরাৎপর ঈশ্বর।”—আদিপুস্তক ১৪:২২.
৯ আরও কিছু অব্রাহামের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। যিহোবা “অব্রাহাম হারণে বসতি করিবার পূর্ব্বে যে সময়ে মিসপতামিয়ায় ছিলেন, তৎকালে . . . তাঁহাকে দর্শন দিয়াছিলেন, আর বলিয়াছিলেন ‘তুমি স্বদেশ হইতে ও আপন জ্ঞাতি কুটুম্বদের মধ্য হইতে বাহির হও, এবং আমি যে দেশ তোমাকে দেখাই, সেই দেশে চল।’” (প্রেরিত ৭:২, ৩) কিভাবে যিহোবা অব্রাহামকে “দর্শন” দিয়েছিলেন? অব্রাহাম সরাসরি ঈশ্বরকে দেখেননি। (যাত্রাপুস্তক ৩৩:২০) কিন্তু, সম্ভবত যিহোবা স্বপ্ন, মহিমার এক অতিমানবীয় প্রদর্শন অথবা দূতরূপ বার্তাবাহক কিংবা প্রতিনিধির মাধ্যমে অব্রাহামকে দর্শন দিয়েছিলেন। (আদিপুস্তক ১৮:১-৩; ২৮:১০-১৫; লেবীয় পুস্তক ৯:৪, ৬, ২৩, ২৪ পদের সাথে তুলনা করুন।) যেভাবেই যিহোবা অব্রাহামকে দর্শন দিয়ে থাকুন না কেন, সেই বিশ্বস্ত পুরুষের প্রত্যয় ছিল যে ঈশ্বর তার সম্মুখে এক মহামূল্যবান সুযোগ রেখেছিলেন। বিশ্বাসে অব্রাহাম কাজ করেছিলেন।
১০. যিহোবা কিভাবে অব্রাহামের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করেছিলেন?
১০ ঈশ্বর যে দেশের প্রতি তাকে পরিচালিত করছিলেন তার বিশদ বর্ণনার উপর অব্রাহামের বিশ্বাস নির্ভর করেনি। সেই দেশ কখন তাকে দেওয়া হবে তা জানার উপরও এটি নির্ভর করেনি। তার বিশ্বাস ছিল কারণ তিনি যিহোবাকে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর হিসাবে জানতেন। (যাত্রাপুস্তক ৬:৩) যিহোবা অব্রাহামকে বলেছিলেন যে তার সন্তান হবে কিন্তু কখনও কখনও অব্রাহাম চিন্তা করেছিলেন যে তা কিভাবে হতে পারে। তিনি বৃদ্ধ হয়েছিলেন। (আদিপুস্তক ১৫:৩, ৪) যিহোবা অব্রাহামকে তারকারাজির প্রতি দৃষ্টিপাত করতে ও যদি তিনি পারেন তা গণনা করতে বলার মাধ্যমে তার বিশ্বাসকে শক্তিশালী করেছিলেন। “এইরূপ তোমার বংশ হইবে,” ঈশ্বর বলেছিলেন। অব্রাহাম গভীরভাবে প্রণোদিত হয়েছিলেন। এটি নিশ্চিত ছিল যে ওই বিস্ময়কর জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর সৃষ্টিকর্তা যা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তা তিনি পূর্ণও করতে পারেন। অব্রাহাম “সদাপ্রভুতে বিশ্বাস করিলেন।” (আদিপুস্তক ১৫:৫, ৬) যা তিনি শুনেছিলেন সেটি তার ভাল লেগেছিল; এই কারণে অব্রাহাম কেবল সাধারণভাবে তা মেনে নেননি, তার সুপ্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস ছিল।
১১. (ক) অব্রাহামের বয়স যখন প্রায় ১০০ বছর, বৃদ্ধা সারা যে একজন পুত্র প্রসব করবেন, ঈশ্বরের এই প্রতিজ্ঞার প্রতি তিনি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন? (খ) কোন্ ধরনের বিশ্বাস নিয়ে অব্রাহাম তার পুত্রকে মোরিয়া পর্বতে হোমার্থে বলিদান করার পরীক্ষাটির মুখোমুখি হয়েছিলেন?
১১ যখন অব্রাহামের বয়স ১০০ বছর ও সারা প্রায় ৯০ বছর বয়স্কা ছিলেন, যিহোবা পুনরায় তাঁর প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছিলেন যে অব্রাহামের একটি পুত্র হবে আর সারা মা হবেন। অব্রাহাম বাস্তবসম্মতভাবে তাদের পরিস্থিতি বিবেচনা করেছিলেন। “তথাপি ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞার প্রতি লক্ষ্য করিয়া অবিশ্বাস বশতঃ সন্দেহ করিলেন না; কিন্তু বিশ্বাসে বলবান্ হইলেন, ঈশ্বরের গৌরব করিলেন, এবং নিশ্চয় জানিলেন, ঈশ্বর যাহা প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, তাহা সফল করিতে সমর্থও আছেন।” (রোমীয় ৪:১৯-২১) অব্রাহাম জানতেন যে ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা নিষ্ফল হতে পারে না। তার বিশ্বাসের কারণেই পরবর্তী সময়ে যখন ঈশ্বর তাকে তার পুত্র ইস্হাককে মোরিয়া দেশে নিয়ে যেতে ও হোমার্থে বলিদান করতে বলেছিলেন, অব্রাহাম ঈশ্বরের বাধ্য হয়েছিলেন। (আদিপুস্তক ২২:১-১২) অব্রাহামের পূর্ণ প্রত্যয় ছিল যে ঈশ্বর যিনি অলৌকিকভাবে সেই পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন, তিনি তার সাথে যুক্ত তাঁর কৃত অন্যান্য প্রতিজ্ঞাগুলি পরিপূর্ণ করার জন্য তাকে জীবনে ফিরিয়ে আনতেও পারেন।—ইব্রীয় ১১:১৭-১৯.
১২. অব্রাহাম কতদিন বিশ্বাসে চলেছিলেন এবং তার ও তার পরিবারের সদস্যগণ যারা দৃঢ় বিশ্বাস প্রদর্শন করেছিলেন তাদের জন্য কোন্ পুরস্কার অপেক্ষা করছে?
১২ অব্রাহাম দেখিয়েছিলেন যে তিনি বিশ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিলেন কেবল কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নয় বরঞ্চ তার সম্পূর্ণ জীবনব্যাপী। তার জীবনকালে অব্রাহাম উত্তরাধিকার হিসাবে ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রতিজ্ঞাত দেশের কোন অংশই লাভ করেননি। (প্রেরিত ৭:৫) তবুও অব্রাহাম পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েননি এবং কল্দীয়দের ঊর দেশে ফিরে যাননি। ১০০ বছর ধরে, তার মৃত্যু পর্যন্ত ঈশ্বর তাকে যে দেশে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেখানে তিনি তাঁবুতে বাস করেছিলেন। (আদিপুস্তক ২৫:৭) অব্রাহাম ও তার স্ত্রী সারা, তাদের পুত্র ইস্হাক ও তাদের পৌত্র যাকোব সম্বন্ধে ইব্রীয় ১১:১৬ পদ বলে: “ঈশ্বর তাঁহাদের ঈশ্বর বলিয়া আখ্যাত হইতে, তাঁহাদের বিষয়ে লজ্জিত নহেন; কারণ তিনি তাঁহাদের নিমিত্ত এক নগর প্রস্তুত করিয়াছেন।” হ্যাঁ, তাঁর মশীহ রাজ্যের পার্থিব এলাকায় তাদের জন্য যিহোবা একটি স্থান রেখেছেন।
১৩. আজকে যিহোবার দাসেদের মধ্যে কারা অব্রাহামের মত বিশ্বাসের সাক্ষ্য দেন?
১৩ আজকে যিহোবার দাসেদের মধ্যে এমন ব্যক্তিরা আছেন যারা অব্রাহামের মত। তারা অনেক বছর ধরে বিশ্বাস দ্বারা চলেছেন। তারা ঈশ্বরের প্রদত্ত শক্তিতে পর্বততুল্য বাধাগুলি অতিক্রম করেছেন। (মথি ১৭:২০) ঈশ্বর যা প্রতিজ্ঞা করেছেন, ঠিক কখন তিনি তাদের তার অধিকার দেবেন তা না জানায় তারা তাদের বিশ্বাসে কম্পমান নন। তারা জানেন যে যিহোবার বাক্য নিষ্ফল হতে পারে না আর তাঁর সাক্ষীদের মধ্যে গণিত হওয়াকে তারা এক অমূল্য সুযোগ হিসাবে গণ্য করেন। আপনিও কি এইরকম বোধ করেন?
যে বিশ্বাস মোশিকে পরিচালিত করেছিল
১৪. মোশির বিশ্বাসের ভিত্তি কিভাবে স্থাপিত হয়েছিল?
১৪ বিশ্বাসের আরেকজন উদাহরণ হলেন মোশি। তার বিশ্বাসের ভিত্তি কী ছিল? এটি শৈশবেই স্থাপন করা হয়েছিল। যদিও ফরৌণের কন্যা মোশিকে নীল নদের তীরে একটি নলের পেটরায় পেয়েছিলেন ও তাকে পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু মোশির নিজ ইব্রীয় মা, যোকেবদ তার ছেলের শৈশবকালে তাকে স্তন্যপান করিয়েছিলেন ও তার যত্ন নিয়েছিলেন। স্পষ্টতই যোকেবদ তাকে উত্তম শিক্ষা দিয়েছিলেন, তার মধ্যে যিহোবার প্রতি প্রেম ও অব্রাহামের কাছে তাঁর প্রতিজ্ঞার প্রতি উপলব্ধিবোধ গড়ে তুলেছিলেন। পরবর্তীকালে, ফরৌণের গৃহের একজন সদস্য হিসাবে মোশি, “মিস্রীয়দের সমস্ত বিদ্যায় শিক্ষিত হইলেন।” (প্রেরিত ৭:২০-২২; যাত্রাপুস্তক ২:১-১০; ৬:২০; ইব্রীয় ১১:২৩) কিন্তু মোশির অনুকূল অবস্থান সত্ত্বেও, তার হৃদয় ঈশ্বরের বন্দী দাসেদের সাথে ছিল।
১৫. নিজেকে যিহোবার লোকেদের একজন হিসাবে চিহ্নিত করা মোশির জন্য কী অর্থ রেখেছিল?
১৫ তার ৪০ বছর বয়সে, মোশি একজন ইস্রায়েলীয় যার প্রতি অন্যায় করা হচ্ছিল তাকে উদ্ধারের জন্য একজন মিশরীয়কে আঘাত করেছিলেন। এই ঘটনাটি দেখায় যে মোশি ঈশ্বরের লোকেদের কোন্ দৃষ্টিতে দেখতেন। বাস্তবিকই, “বিশ্বাসে মোশি বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে পর ফরৌণের কন্যার পুত্ত্র বলিয়া আখ্যাত হইতে অস্বীকার করিলেন।” মিশরীয় রাজসভার একজন সদস্য হিসাবে “পাপজাত ক্ষণিক সুখভোগ” এর প্রতি আসক্ত থাকার পরিবর্তে, তিনি নিজেকে অন্যায় আচরণ ভোগকারী ঈশ্বরের লোকেদের মধ্যে একজন হিসাবে চিহ্নিত করতে বিশ্বাস দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন।—ইব্রীয় ১১:২৪, ২৫; প্রেরিত ৭:২৩-২৫.
১৬. (ক) মোশিকে যিহোবা কোন্ কার্যনিযুক্তি দিয়েছিলেন আর ঈশ্বর তাকে কিভাবে সাহায্য করেছিলেন? (খ) মোশি তার কার্যনিযুক্তি সম্পন্ন করতে কিভাবে বিশ্বাস দেখিয়েছিলেন?
১৬ তাঁর লোকেদের স্বস্তি নিয়ে আসার জন্য পদক্ষেপ নিতে মোশি অত্যন্ত উদ্গ্রীব ছিলেন কিন্তু তাদের উদ্ধারের জন্য ঈশ্বরের সময় তখনও আসেনি। মোশিকে মিশর থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। তার প্রায় ৪০ বছর পরে যিহোবা ইস্রায়েলীয়দের বের করে নিয়ে আসতে পরিচালনা দেওয়ার জন্য মিশরে ফিরে যেতে, একজন দূতের মাধ্যমে মোশিকে নিযুক্ত করেছিলেন। (যাত্রাপুস্তক ৩:২-১০) মোশি কিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন? ইস্রায়েলকে উদ্ধার করতে যিহোবার ক্ষমতা সম্বন্ধে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেননি, বরঞ্চ ঈশ্বর তাকে যে ভূমিকা পালন করতে বলেছিলেন তার জন্য তিনি নিজেকে অযোগ্য মনে করেছিলেন। প্রেমের সাথে যিহোবা মোশিকে প্রয়োজনীয় উৎসাহ প্রদান করেছিলেন। (যাত্রাপুস্তক ৩:১১–৪:১৭) মোশির বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছিল। তিনি মিশরে ফিরে গিয়েছিলেন এবং যিহোবার উপাসনায় ইস্রায়েলকে যেতে না দেওয়ার জন্য মিশরের উপর যে আঘাতগুলি আসবে সেই সম্বন্ধে ফরৌণের সম্মুখাসম্মুখি হয়ে তাকে বারংবার সতর্ক করেছিলেন। সেই আঘাতগুলি ঘটাতে মোশির ব্যক্তিগত কোন ক্ষমতা ছিল না। তিনি বিশ্বাস দ্বারা চলেছিলেন, বাহ্য দৃশ্য দ্বারা নয়। যিহোবা ও তাঁর বাক্যের উপর তার বিশ্বাস ছিল। ফরৌণ মোশিকে ভয় দেখিয়েছিলেন। কিন্তু মোশি তার বিশ্বাসে অটল ছিলেন। “বিশ্বাসে তিনি মিসর ত্যাগ করিলেন, রাজার কোপ হইতে ভীত হন নাই, কারণ যিনি অদৃশ্য, তাঁহাকে যেন দেখিয়াই স্থির থাকিলেন।” (ইব্রীয় ১১:২৭) মোশি সিদ্ধ ছিলেন না। তিনি ভুল করেছিলেন। (গণনাপুস্তক ২০:৭-১২) কিন্তু ঈশ্বর কর্তৃক নিযুক্ত হওয়ার পর, তার সম্পূর্ণ জীবনধারা বিশ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল।
১৭. বিশ্বাস দ্বারা চলা নোহ, অব্রাহাম ও মোশির জন্য কী ফল নিয়ে এসেছিল, যদিও তারা ঈশ্বরের নতুন জগৎ দেখার জন্য বেঁচে ছিলেন না?
১৭ আপনার বিশ্বাস যেন নোহ, অব্রাহাম এবং মোশির মত হয়। এটি সত্য যে, তাদের দিনে তারা ঈশ্বরের নতুন জগৎ দেখেননি। (ইব্রীয় ১১:৩৯) তখনও ঈশ্বরের নিরূপিত সময় আসেনি; তাঁর উদ্দেশ্যের অন্যান্য দিকগুলি ছিল যা তখনও পরিপূর্ণ হওয়ার প্রয়োজন ছিল। তবুও ঈশ্বরের বাক্যের উপর তাদের বিশ্বাস কম্পমান হয়নি এবং ঈশ্বরের জীবন পুস্তকে তাদের নাম রয়েছে।
১৮. স্বর্গীয় জীবনের আহ্বানপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পক্ষে বিশ্বাস দ্বারা চলা অপরিহার্য কেন?
১৮ “ঈশ্বর আমাদের নিমিত্ত পূর্ব্বাবধি কোন শ্রেষ্ঠ বিষয় লক্ষ্য করিয়াছিলেন,” প্রেরিত পৌল লিখেছিলেন। অর্থাৎ ঈশ্বর পূর্বে তাদের জন্য কিছু উত্তম বিষয় লক্ষ্য করেছিলেন যাদের প্রেরিত পৌলের মত খ্রীষ্টের সাথে স্বর্গীয় জীবনে আহ্বান করা হয়েছে। (ইব্রীয় ১১:৪০) এই ব্যক্তিরাই বিশেষভাবে পৌলের মনে ছিলেন যখন তিনি ২ করিন্থীয় ৫:৭ পদে নথিবদ্ধ বাক্যগুলি লিখেছিলেন: “আমরা বিশ্বাস দ্বারা চলি, বাহ্য দৃশ্য দ্বারা নয়।” এই বিষয়টি যখন লেখা হয়েছিল তাদের মধ্যে কেউই তখন পর্যন্ত স্বর্গীয় পুরস্কার অর্জন করেননি। তারা তাদের মাংসিক চোখ দিয়ে তা দেখতে পাননি কিন্তু এর উপর তাদের বিশ্বাস সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। খ্রীষ্ট মৃতদের মধ্য থেকে উত্থিত হয়েছিলেন, যিনি স্বর্গীয় জীবনে আশীর্বাদপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথম ফল। আর তাঁর স্বর্গারোহণের আগে ৫০০ জনেরও বেশি সাক্ষী তাঁকে দেখেছিলেন। (১ করিন্থীয় ১৫:৩-৮) তাদের সম্পূর্ণ জীবনধারাকে সেই বিশ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করার জন্য তাদের যথেষ্ট কারণ ছিল। আমাদেরও বিশ্বাস দ্বারা চলার সুযুক্তিপূর্ণ কারণগুলি রয়েছে।
১৯. ইব্রীয় ১:১, ২ পদে যেমন দেখানো হয়েছে, ঈশ্বর কার মাধ্যমে আমাদের সাথে কথা বলেছেন?
১৯ আজকে যিহোবা তাঁর লোকেদের সাথে দূতের মাধ্যমে কথা বলেন না, যেমন তিনি জ্বলন্ত ঝোপের মধ্যে মোশির সাথে বলেছিলেন। ঈশ্বর তাঁর পুত্রের মাধ্যমে কথা বলেছেন। (ইব্রীয় ১:১, ২) ঈশ্বর তাঁর মাধ্যমে যা বলেছিলেন, তা তিনি বাইবেলে লিপিবদ্ধ করেছেন যা বিশ্বের চতুর্দিকের লোকেদের ব্যবহৃত বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদিত হয়েছে।
২০. নোহ, অব্রাহাম ও মোশির চেয়ে আমাদের পরিস্থিতি কিভাবে আরও অনেক বেশি অনুকূল?
২০ নোহ, অব্রাহাম ও মোশির থেকে আমাদের কাছে আরও বেশি কিছু আছে। আমাদের সম্পূর্ণ ঈশ্বরের বাক্য রয়েছে—এর অধিকাংশই ইতিমধ্যেই পরিপূর্ণ হয়েছে। সমস্ত প্রকার পরীক্ষা সত্ত্বেও যারা নিজেদের যিহোবার বিশ্বস্ত সাক্ষী হিসাবে প্রমাণ করেছিলেন সেই সব পুরুষ ও নারীদের সম্বন্ধে বাইবেল যা কিছু বলে তার আলোকে ইব্রীয় ১২:১ পদ পরামর্শ দেয়: “আইস, আমরাও সমস্ত বোঝা ও সহজ বাধাজনক পাপ ফেলিয়া দিয়া ধৈর্য্যপূর্ব্বক আমাদের সম্মুখস্থ ধাবনক্ষেত্রে দৌড়ি।” আমাদের বিশ্বাস প্রাপ্য বলে ধরে নেওয়ার মত কিছু নয়। “সহজ বাধাজনক পাপ” হল বিশ্বাসের অভাব। ক্রমাগত ‘বিশ্বাস দ্বারা চলা’-র জন্য এক কঠিন লড়াইয়ের প্রয়োজন।
[পাদটীকাগুলো]
a ওয়াচটাওয়ার বাইবেল অ্যান্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটি দ্বারা প্রকাশিত বাইবেল—ঈশ্বরের বাক্য অথবা মানুষের? (ইংরাজি) বইটি দেখুন।
আপনার মন্তব্য কী?
◻ ‘বিশ্বাস দ্বারা চলা’-র সাথে কী জড়িত?
◻ নোহ যেভাবে বিশ্বাস দেখিয়েছিলেন তার থেকে আমরা কিভাবে উপকৃত হতে পারি?
◻ অব্রাহাম যেভাবে বিশ্বাস অনুশীলন করেছিলেন তা কিভাবে আমাদের সাহায্য করে?
◻ বাইবেল কেন মোশিকে বিশ্বাসের এক উদাহরণ হিসাবে নির্দেশ করে?
[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]
অব্রাহাম বিশ্বাস দ্বারা চলেছিলেন
[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]
ফরৌণের সম্মুখে মোশি ও হারণ বিশ্বাস প্রদর্শন করেছিলেন