শৌল তার প্রাক্তনবন্ধু ও শত্রুদের সঙ্গে দেখাকরেন
শৌল, পরে যিনি প্রেরিত পৌল নামে পরিচিত হয়েছিলেন, তিনি খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার পর যখন প্রথমবারের মতো যিরূশালেমে ফিরে এসেছিলেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই কিছুটা ভয় পেয়েছিলেন।a তিন বছর আগে তিনি সেই শহর পরিত্যাগ করেছিলেন, যিশুর শিষ্যদের বিরুদ্ধে ভয়প্রদর্শন করেছিলেন ও হত্যার নিশ্বাস টেনেছিলেন। দম্মেশকে যেকোনো খ্রিস্টানকে খুঁজে পেলে তিনি তাদেরকে গ্রেপ্তার করার অনুমতি লাভ করেছিলেন।—প্রেরিত ৯:১, ২; গালাতীয় ১:১৮.
তিনি নিজে যখন একজন খ্রিস্টান হয়েছিলেন, তখন শৌল পুনরুত্থিত মশীহের ওপর তার বিশ্বাসের কথা সাহসের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন। এর ফলে, দম্মেশকের যিহুদিরা তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। (প্রেরিত ৯:১৯-২৫) যিরূশালেমের প্রাক্তন যিহুদি বন্ধুদের কাছ থেকে তিনি কি সত্যিই উষ্ণ অভ্যর্থনা আশা করতে পারতেন? কিন্তু, শৌলের কাছে যে-বিষয়টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটা হল যিরূশালেমে খ্রিস্টের অনুসারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা। সেটা সহজ হবে না।
“পরে তিনি যিরূশালেমে উপস্থিত হইয়া শিষ্যবর্গের সহিত যোগ দিতে চেষ্টা করিলেন; কিন্তু সকলে তাঁহাকে ভয় করিল, তিনি যে শিষ্য, ইহা বিশ্বাস করিল না।” (প্রেরিত ৯:২৬) সেটাই স্বাভাবিক। তার সম্বন্ধে সেই সময় পর্যন্ত যে-বিষয়টা তারা জানত সেটা ছিল, তিনি একজন নির্দয় তাড়নাকারী। একজন খ্রিস্টান হিসেবে তার বিশ্বাসের প্রকাশ্য ঘোষণা, মণ্ডলীতে অনুপ্রবেশ করার এক কৌশল বলে মনে হতে পারে। তাই, যিরূশালেমের খ্রিস্টানরা তার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে চেয়েছিল।
কিন্তু, তাদের মধ্যে একজন শৌলকে সাহায্য করেছিলেন। বাইবেল জানায় যে, শৌলের ধর্মান্তরিত হওয়া ও দম্মেশকে তার প্রচার কাজ সম্বন্ধে জানানোর জন্য বার্ণবা এই প্রাক্তন তাড়নাকারীকে “প্রেরিতদের নিকটে” নিয়ে গিয়েছিলেন, যা স্পষ্টতই পিতর (কৈফার) এবং প্রভুর ভাই যাকোবকে নির্দেশ করে। (প্রেরিত ৯:২৭; গালাতীয় ১:১৮, ১৯) বার্ণবা কেমন করে শৌলের ওপর নির্ভর করেছিলেন, তা অজানা থেকে গিয়েছে। দুজনে কি পরিচিত ছিল, যা বার্ণবাকে সতর্কতার সঙ্গে শৌলকে পরীক্ষা করে দেখতে ও তারপর তার আন্তরিকতাকে সমর্থন করতে পরিচালিত করেছিল? দম্মেশকের খ্রিস্টানদের সঙ্গে কি বার্ণবার যোগাযোগ ছিল আর তিনি কি শৌলের পরিবর্তন সম্বন্ধে জানতেন? বিষয়টা যা-ই হোক না কেন, বার্ণবা শৌলের সম্বন্ধে সন্দেহগুলোকে দূর করেছিলেন। ফলস্বরূপ, শৌল প্রেরিত পিতরের সঙ্গে ১৫ দিন থেকেছিলেন।
পিতরের সঙ্গে পনেরো দিন
কোনো মানুষের অনুমোদনের প্রয়োজন ছাড়াই শৌল সরাসরি যিশুর কাছ থেকে তার কার্যভার পেয়েছিলেন, যেমন গালাতীয়দের উদ্দেশে তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন। (গালাতীয় ১:১১, ১২) কিন্তু শৌল নিঃসন্দেহে যিশুর পরিচর্যা সম্বন্ধে ভালভাবে জানার গুরুত্বকে উপলব্ধি করেছিলেন। পিতরের সঙ্গে থাকা শৌলকে যিশুর পরিচর্যা সম্বন্ধে জানার জন্য প্রচুর সুযোগ প্রদান করবে। (লূক ২৪:১২; ১ করিন্থীয় ১৫:৩-৮) পিতর ও যাকোব সম্বন্ধে শৌলের অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার ছিল আর তাদেরও শৌলের দর্শন এবং তার কার্যভার সম্বন্ধে তাকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার ছিল।
তিনি কি প্রাক্তন বন্ধুদের কাছ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন?
স্তিফানকে প্রথম খ্রিস্টান শহীদ বলা হয়। পূর্বে যাদের সঙ্গে স্তিফানের বাদানুবাদ হয়েছিল তারা ছিল ‘লিবর্ত্তীনদের সমাজ-গৃহের [“যে সমাজ-ঘরকে মুক্ত-করা লোকদের সমাজ-ঘর বলা হত সেই সমাজ-ঘরের,” বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারসন] কুরীণীয় ও আলেক্সান্দ্রীয় এবং কিলিকিয়া ও এশিয়ার’ লোক। শৌল এখন “গ্রীক ভাষাবাদী যিহূদীদের” অথবা গ্রিক-ভাষাবিদদের ‘সহিত তর্ক করিতেছিলেন,’ ও তাদের কাছে সাহসের সঙ্গে সাক্ষ্যদান করছিলেন। প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? তারা তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল।—প্রেরিত ৬:৯; ৯:২৮, ২৯.
তার জীবনের আমূল পরিবর্তন সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করতে চাওয়া ও তার প্রাক্তন বন্ধুদের কাছে মশীহ সম্বন্ধে শিক্ষা দিতে চেষ্টা করা শৌলের জন্য স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এই যিহুদি গ্রিক-ভাষাবিদরা, শৌলের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল, যারা তাকে একজন রাষ্ট্রদ্রোহী বলে মনে করেছিল।
তিনি কতখানি বিপদের মধ্যে ছিলেন, সেটা কি শৌল উপলব্ধি করেছিলেন? আমরা পড়ি যে, যখন তিনি ধর্মধামে বা মন্দিরে প্রার্থনা করছিলেন, তখন তিনি অভিভূত হয়ে যিশুকে দেখেছিলেন, যিনি তাকে বলেছিলেন: “ত্বরা কর, শীঘ্র যিরূশালেম হইতে বাহির হও, কেননা এই লোকেরা আমার বিষয়ে তোমার সাক্ষ্য গ্রাহ্য করিবে না।” শৌল উত্তর দিয়েছিলেন: “প্রভু, তাহারা ত জানে যে, যাহারা তোমাতে বিশ্বাস করিত, আমি প্রতি সমাজ-গৃহে তাহাদিগকে কারাবদ্ধ করিতাম ও প্রহার করিতাম; আর যখন তোমার সাক্ষী স্তিফানের রক্তপাত হয়, তখন আমি আপনি নিকটে দাঁড়াইয়া সম্মতি দিতেছিলাম।”—প্রেরিত ২২:১৭-২০.
কেউ কেউ শৌলের উত্তরকে এই অর্থে নিয়ে থাকে যে, তিনি ঝুঁকির কথা স্বীকার করেছিলেন। অন্যেরা মনে করে যে, তিনি বলছিলেন: ‘আমি তাদের মতোই একজন তাড়নাকারী ছিলাম আর তারা তা জানে। নিশ্চিতভাবেই আমার ধর্মান্তরিত হওয়াকে তাদের গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। আমি হয়তো তাদেরকে সত্য বুঝতে সাহায্য করতে পারব।’ তা সত্ত্বেও যিশু জানতেন যে, সেই যিহুদিরা একজন ‘ধর্মভ্রষ্টের’ সাক্ষ্যদানের প্রতি মনোযোগ দেবে না। তিনি শৌলকে বলেছিলেন: “প্রস্থান কর, কেননা আমি তোমাকে দূরে পরজাতিগণের কাছে প্রেরণ করিব।”—প্রেরিত ২২:২১, ২২.
সহখ্রিস্টানরা যখন এই বিপদ সম্বন্ধে জানতে পেরেছিল, তখন তারা তাড়াহুড়ো করে শৌলকে কৈসরিয়ার সমুদ্র বন্দরে নিয়ে গিয়েছিল এবং ৫০০ কিলোমিটার দূরের তার্ষে পাঠিয়ে দিয়েছিল, যেটা ছিল তার নিজ শহর। (প্রেরিত ৯:৩০) এটা ছিল শৌলের যিরূশালেমে ফিরে আসার বেশ কয়েক বছর আগে।
তার তাড়াহুড়ো করে চলে যাওয়াটা হয়তো খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর জন্য এক সুরক্ষাস্বরূপ হয়েছিল। প্রাক্তন তাড়নাকারীর উপস্থিতি সম্ভাব্য উত্তেজনা জাগিয়ে তুলেছিল। শৌলের চলে যাওয়ার পর, “যিহূদিয়া, গালীল ও শমরিয়ার সর্ব্বত্র মণ্ডলী শান্তিভোগ করিতে ও গ্রথিত হইতে লাগিল, এবং প্রভুর [“যিহোবার,” NW] ভয়ে ও পবিত্র আত্মার আশ্বাসে চলিতে চলিতে বহুসংখ্যক হইয়া উঠিল।”—প্রেরিত ৯:৩১.
সতর্ক হওয়ার বিষয়ে শিক্ষা
প্রথম শতাব্দীর মতো, আজকের দিনেও হয়তো সেই পরিস্থিতিগুলো দেখা দিতে পারে, যেখানে সতর্কতা অবলম্বন করা যথার্থ। অপরিচিতদেরকে আমাদের অযথা সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু কখনো কখনো, বিবেকবর্জিত ব্যক্তিরা হয় ব্যক্তিগত লাভের জন্য অথবা মণ্ডলীর ক্ষতি করার লক্ষ্য নিয়ে যিহোবার লোকেদেরকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। তাই, আমরা বিচক্ষণতাকে কাজে লাগাই, যাতে বঞ্চকদের প্রতারণার শিকার না হই।—হিতোপদেশ ৩:২৭; ২ তীমথিয় ৩:১৩.
যিরূশালেমে প্রচার করার জন্য শৌলের প্রতিক্রিয়া আরেকটা ক্ষেত্রকে তুলে ধরে, যেটাতে খ্রিস্টানরা সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে। প্রাক্তন বন্ধুবান্ধবসহ নির্দিষ্ট পাড়াপড়শি অথবা কিছু ব্যক্তির কাছে সাক্ষ্যদান করা বিপদজনক হতে পারে—শারীরিকভাবে, আধ্যাত্মিকভাবে অথবা এমনকি নৈতিকভাবে। যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করা উপযুক্ত, যেমন সময় ও স্থান বাছাই করতে সমর্থ হওয়া।—হিতোপদেশ ২২:৩; মথি ১০:১৬.
আমরা আস্থা রাখতে পারি যে, এই বিধিব্যবস্থার শেষ উপস্থিত হওয়ার আগে ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার প্রচারিত হবে। এমনকি প্রাক্তন বন্ধু ও শত্রুদের কাছেও ‘প্রভুর নামে সাহসপূর্ব্বক প্রচার করিবার’ ক্ষেত্রে শৌল কতই না উত্তম এক উদাহরণ স্থাপন করেছেন!—প্রেরিত ৯:২৮.
[পাদটীকা]
a আজকের দিনে শৌল প্রেরিত পৌল নামে বেশি পরিচিত। কিন্তু, এই প্রবন্ধে উল্লেখিত বাইবেলের অধিকাংশ পদে তাকে তার যিহুদি নাম শৌল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।—প্রেরিত ১৩:৯.
[১৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
যিরূশালেমে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে, শৌল সাহসের সঙ্গে গ্রিকভাষী যিহুদিদের কাছে সাক্ষ্যদান করেছিলেন