পাঠক-পাঠিকাদের থেকে প্রশ্নসকল
টোস্টিং অর্থাৎ মদের গ্লাস ওপরে তুলে শুভকামনা করার বিষয়ে বাইবেল যেহেতু কিছু উল্লেখ করে না, তা হলে কেন যিহোবার সাক্ষিরা টোস্টিংয়ে অংশ নেওয়া এড়িয়ে চলে?
মদের (অথবা অন্য কোনো মদ্যজাতীয় পানীয়ের) গ্লাস ধরে টোস্টিং করার প্রথা হচ্ছে বহু পুরোনো ও ব্যাপকভাবে প্রচলিত, যদিও স্থান বিশেষে এর পদ্ধতি আলাদা হতে পারে। মাঝে মাঝে যে-ব্যক্তিরা টোস্টিং করে, তারা একে অপরের গ্লাস আলতোভাবে ঠেকায়। যে-ব্যক্তি টোস্টিং করার প্রস্তাবটা রাখেন, তিনি সাধারণত কারো সুখ, সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘজীবন অথবা এই ধরনের কোনো বিষয়ের জন্য অনুরোধ বা শুভকামনা করেন। অন্য যে-ব্যক্তিরা এতে অংশ নেয়, তারা হয়তো উচ্চস্বরে তাদের সম্মতি জানায় অথবা তাদের গ্লাস ওপরে তুলে একটু মদ পান করে। অনেকের কাছে যদিও এটা নিছক এক প্রথা অথবা ভদ্রতাসুলভ এক কাজ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু যিহোবার সাক্ষিরা যেকারণে টোস্টিংয়ে অংশ নেয় না, তার পিছনে যুক্তিসংগত কারণগুলো রয়েছে।
এটার কারণ এই নয় যে, কেউ সুখী হোক ও সুস্বাস্থ্য উপভোগ করুক, তা খ্রিস্টানরা কামনা করে না। মণ্ডলীগুলোর উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে, প্রথম শতাব্দীর পরিচালক গোষ্ঠী এমন একটা শব্দ দিয়ে উপসংহার করেছিলেন, যা “তোমাদের মঙ্গল হউক” বা তোমাদের সুস্বাস্থ্য কামনা করছি, “ভাল থেকো,” অথবা “বিদায়” বলে অনুবাদ করা যেতে পারে। (প্রেরিত ১৫:২৯) আর কিছু সত্য উপাসক মানব রাজাদের উদ্দেশে বলেছিল: “আমার প্রভু . . . নিত্যজীবী হউন” অথবা “মহারাজ চিরজীবী হউন।”—১ রাজাবলি ১:৩১; নহিমিয় ২:৩.
কিন্তু, টোস্টিংয়ের এই প্রথাটার উৎপত্তি কোথা থেকে হয়েছে? ১৯৬৮ সালের ১লা জানুয়ারি প্রহরীদুর্গ (ইংরেজি) পত্রিকা দি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা (১৯১০), খণ্ড ১৩, পৃষ্ঠা ১২১ থেকে উদ্ধৃতি করেছিল: “কারো ‘সুস্বাস্থ্য’ কামনা করতে মদের গ্লাস ব্যবহার করার এই প্রথা খুব সম্ভবত দেব-দেবী ও মৃত ব্যক্তিদের উদ্দেশে পান করার প্রাচীন ধর্মীয় আচারঅনুষ্ঠান থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। গ্রিক ও রোমীয়রা খাবার খাওয়ার সময়ে তাদের দেব-দেবীর উদ্দেশে মদ্যজাতীয় পানীয় ঢালত এবং আনুষ্ঠানিক ভোজগুলোতে সেই দেব-দেবী ও মৃত ব্যক্তিদের উদ্দেশে তা পান করত।” সেই এনসাইক্লোপিডিয়া আরও বলেছিল: “এক ধরনের বলিদান হিসেবে পান করার এই প্রথাগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকলেও এটা নিশ্চয়ই জীবিত ব্যক্তিদের জন্য শুভকামনা করে পান করা হতো।”
এই প্রথা কি এখনও বলবৎ রয়েছে? ১৯৯৫ সালের ইন্টারন্যাশনাল হ্যান্ডবুক অন আ্যলকোহল আ্যন্ড কালচার বলে: “[টোস্টিং] সম্ভবত প্রাচীনকালে দেব-দেবীর উদ্দেশে বলিদান হিসেবে মদ্যজাতীয় পানীয় ঢালার প্রথার এক অনাধ্যাত্মিক নিদর্শন, যেখানে দেব-দেবীর উদ্দেশে এক পবিত্র তরল পদার্থ উৎসর্গ করা হতো: রক্ত অথবা মদ আর এটার বিনিময়ে এক শুভকামনা অর্থাৎ ‘দীর্ঘজীবি হও!’ অথবা ‘তোমার স্বাস্থ্যের উদ্দেশে!’ এই সংক্ষিপ্ত কথাগুলো বলে এক প্রার্থনা করা হতো।”
এটা ঠিক যে, কোনো একটা বস্তু, নকশা অথবা প্রথার উৎপত্তি যদি প্রাচীন মিথ্যা ধর্ম থেকে হয়ে থাকে বা সেটার সঙ্গে মিল থাকে, তার মানে সবসময়ই এটা বোঝায় না যে, একজন সত্য উপাসকের জন্য এই ধরনের জিনিস ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। ডালিমের বিষয়টা বিবেচনা করুন। একটি সুপরিচিত বাইবেল এনসাইক্লোপিডিয়া উল্লেখ করে: “ডালিমও পৌত্তলিক ধর্মগুলোতে এক পবিত্র প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে হয়।” তা সত্ত্বেও, ঈশ্বর মহাযাজকের বস্ত্রের আঁচলায় বা কিনারায় সুতোর তৈরি দাড়িম বা ডালিম দিতে এবং শলোমনের মন্দিরে পিতলের স্ভম্ভগুলোতে ডালিমের নকশা করতে বলেছিলেন। (যাত্রাপুস্তক ২৮:৩৩; ২ রাজাবলি ২৫:১৭) এ ছাড়া, এক সময়ে বিয়ের আংটিরও ধর্মীয় তাৎপর্য ছিল। কিন্তু, আজকে অধিকাংশ লোক তা জানে না আর তাই বিয়ের আংটিকে কেবলমাত্র একজন ব্যক্তি যে বিবাহিত, সেটার প্রতীক হিসেবে দেখে থাকে।
তা হলে, ধর্মীয় কার্যকলাপের সঙ্গে মদের ব্যবহার সম্বন্ধে কী বলা যায়? উদাহরণস্বরূপ, শিখিমের বাল উপাসকরা এক সময়ে “আপনাদের দেবতার মন্দিরে গিয়া ভোজন পান করিয়া,” গিদিয়োনের ছেলে “অবীমেলককে শাপ দিল।” (বিচারকর্ত্তৃগণের বিবরণ ৯:২২-২৮) আপনার কি মনে হয়, যিহোবার প্রতি অনুগত একজন ব্যক্তি এই ধরনের পানসভায় যোগ দিতেন, সম্ভবত অবীমেলককে শাপ দেওয়ার জন্য কোনো মিথ্যা দেবতার কাছে শক্তির জন্য প্রার্থনা করতেন? ইস্রায়েলে যখন অনেকে যিহোবার বিদ্রোহ করেছিল এমন এক সময় সম্বন্ধে বর্ণনা করে আমোষ বলেছিলেন: “তাহারা সমস্ত বেদির কাছে . . . শয়ন করে, ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত লোকদের দ্রাক্ষারস আপনাদের ঈশ্বরের গৃহে পান করে।” (আমোষ ২:৮) মদকে দেব-দেবীর উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত দ্রব্য হিসেবে ঢালা অথবা শুধুমাত্র পান করা যা-ই হোক না কেন, সত্য উপাসকরা কি তাতে অংশ নিয়েছিল? (যিরমিয় ৭:১৮) অথবা একজন সত্য উপাসক কি মদের গ্লাস ওপরে তুলে ধরবেন এবং কেউ যেন ঐশিক শক্তি লাভ করতে পারে সেইজন্য বা তার এক সুখী ভবিষ্যতের জন্য প্রার্থনা করবেন?
আগ্রহের বিষয়টা হল, যিহোবার উপাসকরাও মাঝে মাঝে তাদের হাত ওপরের দিকে তুলে শুভকামনা করেছিল। তারা তাদের হাত সত্য ঈশ্বরের দিকে তুলেছিল। আমরা পড়ি: “শলোমন . . . সদাপ্রভুর যজ্ঞবেদির সম্মুখে দাঁড়াইয়া স্বর্গের দিকে অঞ্জলি বিস্তার করিলেন; আর তিনি কহিলেন, হে সদাপ্রভু, ইস্রায়েলের ঈশ্বর, . . . তোমার তুল্য ঈশ্বর নাই। . . . তুমি . . . তোমার নিবাস-স্থান স্বর্গে . . . শুনিও, এবং শুনিয়া ক্ষমা করিও।” (১ রাজাবলি ৮:২২, ২৩, ৩০) একইভাবে, “ইষ্রা . . . সদাপ্রভুর ধন্যবাদ করিলেন। আর সমস্ত লোক হাত তুলিয়া উত্তর করিল, আমেন, আমেন, এবং মস্তক নমনপূর্ব্বক ভূমিতে মুখ দিয়া সদাপ্রভুর কাছে প্রণিপাত করিল।” (নহিমিয় ৮:৬; ১ তীমথিয় ২:৮) স্পষ্টতই, সেই অনুগত ব্যক্তিরা কোনো ভাগ্য দেবের কাছ থেকে আশীর্বাদ লাভ করার জন্য স্বর্গের দিকে তাদের হাত তোলেনি।—যিশাইয় ৬৫:১১.
আজকে অনেকে যারা টোস্টিংয়ে অংশ নেয়, তারা এভাবে চিন্তা করে না যে, তারা কোনো দেবতার কাছে উত্তর পাওয়ার অথবা আশীর্বাদের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছে কিন্তু সেইসঙ্গে তারা এটাও ব্যাখ্যা করতে পারে না যে, কেন তারা তাদের মদের গ্লাস স্বর্গের দিকে তোলে। তবে তারা যে বিষয়টাকে গুরুগম্ভীরভাবে নেয় না, শুধুমাত্র এই কারণে সত্য খ্রিস্টানরা যে তাদের সেই অঙ্গভঙ্গি অনুকরণ করার বাধ্যবাধকতা বোধ করবে এমন নয়।
এটা সকলেরই জানা যে, যিহোবার সাক্ষিরা অন্যান্য ক্ষেত্রেও অধিকাংশ লোক করে এমন অঙ্গভঙ্গি দেখানো পরিহার করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক লোক জাতীয় প্রতীক অথবা পতাকার সামনে অঙ্গভঙ্গি করে; তারা এই ধরনের অঙ্গভঙ্গি করাকে উপাসনার সঙ্গে জড়িত করে না। সত্য খ্রিস্টানরা যদিও এই ধরনের অঙ্গভঙ্গি করার ব্যাপারে বাধা দেয় না কিন্তু তারা ব্যক্তিগতভাবে সেগুলো করায় অংশ নেয় না। এই ধরনের কোনো অনুষ্ঠান কখন হতে পারে তা জানায়, অনেক সাক্ষি বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করেছে, যাতে অন্যদের অসন্তুষ্ট না করে। যাই হোক না কেন, তারা স্বদেশভক্তির সঙ্গে যুক্ত এমন কোনো অঙ্গভঙ্গি না করার ব্যাপারে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ, যেগুলো বাইবেলের সঙ্গে মিল রাখে না। (যাত্রাপুস্তক ২০:৪, ৫; ১ যোহন ৫:২১) আজকে অনেকেই হয়তো টোস্টিংকে কোনো ধর্মীয় অঙ্গভঙ্গি বলে মনে করে না। তা হলেও, এই বিষয়ে যুক্তিসংগত কারণগুলো রয়েছে যে, কেন খ্রিস্টানরা টোস্টিংয়ে অংশ নেয় না, যেটার এক ধর্মীয় পটভূমি রয়েছে আর এমনকি এখনও যেটাকে এমনভাবে দেখা হতে পারে যেন কোনো আশীর্বাদের জন্য যেমন, একজন অতিমানবিক শক্তির কাছে সাহায্য খোঁজার জন্য ‘স্বর্গের’ কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে।—যাত্রাপুস্তক ২৩:২.