বাইবেল জীবনকে পরিবর্তন করে
কেন এক মহিলা, যার বয়স ৬০-এর কোঠায়, তিনি মূর্তির সাহায্যে উপাসনা করা বন্ধ করেন? কেন এক শিন্টো পুরোহিত তার মন্দিরে সেবা করা ছেড়ে দিয়ে একজন যিহোবার সাক্ষি হন? কীভাবে একজন মহিলা, যাকে জন্ম দেওয়ার পর তার বাবা-মা দত্তক নেওয়ার জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেই কষ্ট কাটিয়ে উঠতে পারেন? আসুন, এক এক করে তাদের অভিজ্ঞতা পড়ে দেখি।
“আমি আর মূর্তির দাসত্বে নেই।”—আবা দান্সু
জন্ম: ১৯৩৮ সাল
দেশ: বেনিন
ইতিহাস: মূর্তির সাহায্যে উপাসনা করতেন
আমার অতীত: আমি সো-চাহুই নামে এক গ্রামে বড়ো হয়ে উঠি, যেটা একটা ঝিলের ধারে থাকা জলাজমিতে অবস্থিত। আমার গ্রামের লোকেরা মাছ ধরে আর গরু, মোষ, ছাগল, মেষ, শূকর ও পাখি পোষে। এখানে কোনো রাস্তা নেই, তাই লোকেরা যাতায়াত করার জন্য নৌকা ও ডোঙা ব্যবহার করে। লোকেরা সাধারণত কাঠ ও ঘাস দিয়ে বাড়ি তৈরি করে, তবে কেউ কেউ ইট দিয়েও বাড়ি তৈরি করে। এখানকার বেশিরভাগ লোকই খুব গরিব। কিন্তু তারপরও, শহর এলাকার মতো এখানে ততবেশি অপরাধ হয় না।
ছোটোবেলায় আমার দিদি ও আমাকে আমার বাবা এমন এক জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, যেখানে আমাদের পরম্পরাগত কিছু রীতিনীতি শেখানো হত। সেখানে আমাদের এমন কিছু মূর্তির উপাসনা করাও শেখানো হয়েছিল, যেগুলোর মধ্যে অলৌকিক শক্তি রয়েছে কিংবা কোনো দেবতা বাস করে বলে বিশ্বাস করা হয়। বড়ো হয়ে আমি ইয়োরুবা সংস্কৃতির লোকদের মতোই ডুডুওয়া দেবের উপাসনা করতে শুরু করি। তার জন্য আমি একটা মন্দির তৈরি করি আর নিয়মিতভাবে কচু, খেজুর গাছের তেল, শামুক, মুরগি, ঘুঘু ও আরও অন্যান্য ধরনের পশুপাখি বলি হিসেবে উৎসর্গ করতে শুরু করি। সেগুলো খুবই দামি ছিল এবং সেগুলো কিনতে প্রায় আমার সমস্ত টাকাপয়সাই শেষ হয়ে যেত।
বাইবেল যেভাবে আমার জীবনকে পরিবর্তন করেছে: বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করার পর আমি শিখি, যিহোবাই হলেন একমাত্র সত্য ঈশ্বর। আমি এও শিখি যে, তিনি চান না, আমরা মূর্তির মাধ্যমে উপাসনা করি। (যাত্রাপুস্তক ২০:৪, ৫; ১ করিন্থীয় ১০:১৪) তখন আমি বুঝতে পারি, আমাকে কী করতে হবে। আমার বাড়িতে প্রতিমাপূজার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যত জিনিস ছিল এবং যত ছবি ছিল, আমি সেই সবই ফেলে দিই। তারপর, আমি ভবিষ্যৎ বলে দেয় এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা আর ধর্মীয় রীতিনীতি এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেওয়া বন্ধ করে দিই।
এই ধরনের পরিবর্তন করা আমার পক্ষে সহজ ছিল না, তা-ও আবার আমার বয়স যখন ৬০-এর কোঠায়। আমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা আমার বিরোধিতা করত এবং আমাকে নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করত। কিন্তু, আমি যিহোবার কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি আমাকে সঠিক কাজ করার শক্তি দেন। হিতোপদেশ ১৮:১০ পদের কথাগুলো থেকে আমি সান্ত্বনা পেয়েছিলাম, যেখানে বলা আছে: “সদাপ্রভুর নাম দৃঢ় দুর্গ; ধার্ম্মিক তাহারই মধ্যে পলাইয়া রক্ষা পায়।”
যিহোবার সাক্ষিদের সভায় যোগ দেওয়াও আমার জন্য উপকারজনক ছিল। সেখানে গিয়ে আমি দেখি যে, তারা একে অন্যকে কতটা ভালোবাসে। আর আমি এও দেখি, তারা বাইবেলের উচ্চ নৈতিক মান অনুযায়ী চলার জন্য অনেক প্রচেষ্টা করে। আর সেই বিষয়টা আমার মন ছুঁয়ে যায়। তখন আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে যাই যে, যিহোবার সাক্ষিরাই সত্য ধর্ম পালন করে।
আমি যেভাবে উপকৃত হয়েছি: বাইবেলের নীতিগুলো কাজে লাগানোর ফলে আমার সন্তানদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আরও ভালো হয়েছে। আর আমার মনে হয় যেন আমার কাঁধ থেকে এক ভারি বোঝা সরানো হয়েছে। আমি অপদার্থ মূর্তিগুলোর পিছনে আমার সমস্ত টাকাপয়সা খরচ করে ফেলতাম, যেগুলো থেকে আমি কোনো উপকার পাইনি। কিন্তু, এখন আমি যিহোবার উপাসনা করি, তিনিই আমাদের সমস্ত সমস্যা চিরকালের জন্য দূর করে দেবেন। (প্রকাশিত বাক্য ২১:৩, ৪) আমি খুব খুশি যে, আমি আর মূর্তির দাসত্বে নেই বরং আমি যিহোবার দাসত্ব করি! যিহোবাই আমাকে প্রকৃত নিরাপত্তা ও সুরক্ষা জুগিয়েছেন।
“আমি ছোটো থেকেই ঈশ্বরকে খুঁজছিলাম।”—শিনজি সাতো
জন্ম: ১৯৫১ সাল
দেশ: জাপান
ইতিহাস: শিন্টো পুরোহিত
আমার অতীত: আমি ফুকুওকাতে অবস্থিত এক ছোটো গ্রামে বড়ো হয়ে উঠি। আমার বাবা-মা খুবই ধার্মিক ছিলেন আর তারা আমাকে ছোটো থেকেই শিন্টো ধর্মের দেব-দেবীর উপাসনা করতে শিখিয়েছিলেন। ছোটো থেকেই আমি চিন্তা করতাম যে, আমি কীভাবে মুক্তি লাভ করতে পারি এবং আমার খুব ইচ্ছা হত, আমি যেন কষ্টের মধ্যে থাকা লোকদের সাহায্য করি। আমার মনে আছে, প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা করার সময় আমাদের শিক্ষক একদিন ক্লাসের সবাইকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, আমরা বড়ো হয়ে কী হতে চাই। আমার বেশিরভাগ সহপাঠীই ঠিক করে নিয়েছিল যে, তারা বড়ো হয়ে কী হবে, যেমন একজন বৈজ্ঞানিক, ইত্যাদি। তবে আমি বলি, আমার স্বপ্ন হল ঈশ্বরের সেবা করা। সেটা শুনে সবাই হেসে ওঠে।
হাই স্কুল শেষ করার পর, আমি ধর্মীয় শিক্ষকদের জন্য এক স্কুলে ভরতি হই। প্রশিক্ষণ চলাকালীন একজন শিন্টো পুরোহিতের সঙ্গে আমার দেখা হয়, যিনি তার অবসর সময়ে একটা কালো রঙের বই পড়তেন। একদিন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “সাতো, তুমি জান, এটা কোন বই?” আমি আগে থেকেই সেই বইটি লক্ষ করেছিলাম, তাই আমি বলি, “এটা বাইবেল।” তিনি বলেন, “যে-কেউ একজন শিন্টো পুরোহিত হতে চায়, তাকে এই বইটি পড়তেই হবে।”
সেটা শোনামাত্র আমি সঙ্গেসঙ্গে বেরিয়ে পড়ি আর একটি বাইবেল কিনে আনি। আমি বাইবেলটিকে আমার চোখের সামনে একটা বইয়ের তাকে রাখি আর সেটির খুব ভালোভাবে যত্ন নিই। তবে, আমি আমার স্কুলের কাজে এতই ব্যস্ত থাকতাম যে, আমি বাইবেল পড়ার জন্য একটুও সময় বের করিনি। প্রশিক্ষণ শেষ করার পর আমি একটা মন্দিরে পুরোহিত হিসেবে কাজ করতে শুরু করি। তখন আমার ছোটোবেলার স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল।
সেখানে গিয়ে আমি দ্রুত বুঝতে পেরে যাই যে, শিন্টো পুরোহিতেরা তেমন ছিল না, যেমনটা আমি ভেবেছিলাম। বেশিরভাগ পুরোহিতেরা অন্যদের প্রতি খুব-একটা ভালোবাসা কিংবা চিন্তা দেখাত না। আবার অনেকের তো বিশ্বাসেরই অভাব ছিল। আমার চেয়ে উচ্চপদস্থ এক পুরোহিত আমাকে এত দূর পর্যন্ত বলেন: “এখানে সফল হতে চাইলে বিশ্বাস নিয়ে কথা বলা যাবে না।”
এসব দেখে-শুনে আর শিন্টো ধর্মের কথা চিন্তা করে আমি হতাশ হয়ে পড়ি। কিন্তু তারপরও, আমি মন্দিরে কাজ করতে থাকি আর এর পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মে কী শেখায়, তা নিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করি। কিন্তু, আমি কোনোটার মধ্যেও ভালো কিছু খুঁজে পাইনি। আমি বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে যতবেশি পরীক্ষা করতাম, ততবেশি নিরাশ হয়ে যেতাম। সেই সময় আমার মনে হয়, সত্য ধর্ম বলে কিছুই নেই।
বাইবেল যেভাবে আমার জীবনকে পরিবর্তন করেছে: ১৯৮৮ সালে আমার এক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর সঙ্গে দেখা হয় আর তিনি আমাকে বাইবেল পড়ার জন্য উৎসাহিত করেন। তখন আমার সেই শিন্টো পুরোহিতের কথা মনে পড়ে যায়, যিনি আমাকে বহু বছর আগে এটাই করতে বলেছিলেন। তাই, আমি বাইবেল পড়ার সিদ্ধান্ত নিই। বাইবেল পড়া শুরু করতে না করতে, আমি ওটাতে একেবারে ডুবে যাই। কখনো কখনো পড়তে পড়তে সকাল হয়ে যেত আর আমি বুঝতেই পারতাম না।
বাইবেলে লেখা কথাগুলো আমাকে এটিতে উল্লেখিত ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে অনুপ্রাণিত করে। আমি মথি ৬:৯-১৩ পদে থাকা নমুনা প্রার্থনা অনুযায়ী প্রার্থনা করতে শুরু করি। পুরোহিত হিসেবে কাজ করা সত্ত্বেও প্রতি দু-ঘণ্টা অন্তর অন্তর আমি সেই প্রার্থনাটা করতাম।
বাইবেল পড়তে পড়তে আমার মনে অনেক প্রশ্ন জেগে ওঠে। ততদিন আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল আর আমি জানতাম, যিহোবার সাক্ষিরা লোকদের বাইবেল সম্বন্ধে শেখায় কারণ তারা একসময় আমার স্ত্রীকে দেখা করতে এসেছিল। আমি এক যিহোবার সাক্ষিকে খুঁজে পাই আর তাকে একের-পর-এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে থাকি। তিনি আমার প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর বাইবেল থেকে দিচ্ছিলেন আর এই বিষয়টা আমার মন ছুঁয়ে যায়। তারপর, তিনি আমাকে কয়েক জন যিহোবার সাক্ষির সঙ্গে দেখা করিয়ে দেন, যাতে আমি বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করতে পারি।
তার কিছুসময় পরই আমি যিহোবার সাক্ষিদের সভায় যেতে শুরু করি। সেই সময় আমি খেয়াল করিনি, তবে আগে আমি যাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছিলাম, তারাও সেখানে ছিল। তারা এমনকী এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে কথা বলে এবং আমাকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে সাহায্য করে।
সেই সভাগুলো থেকে আমি শিখি, ঈশ্বর চান যেন স্বামীরা তাদের পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসে এবং তাদের সম্মান করে। সেই সময় পর্যন্ত আমি এই মন্দিরের কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকতাম যে, আমি আমার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে সময় দিতে পারতাম না। তখন আমার হঠাৎ করে মনে হয় যে, মন্দিরে উপাসনা করতে আসা লোকদের কথা তো আমি মন দিয়ে শুনতাম কিন্তু আমার স্ত্রীর মনের কথা আমি এক বারও শুনিনি।
বাইবেল অধ্যয়ন করতে করতে আমি যিহোবা সম্বন্ধে অনেক কিছু শিখি, যেগুলো আমাকে তাঁর নিকটবর্তী করে। যেমন বিশেষ করে, রোমীয় ১০:১৩ পদের কথাগুলো আমার মন ছুঁয়ে যায়, যেখানে বলা আছে: “যে-কেউ যিহোবার নামে ডাকবে, সে রক্ষা পাবে।” আমি ছোটো থেকেই ঈশ্বরকে খুঁজছিলাম আর এখন অবশেষে, আমি তাঁকে খুঁজে পাই!
এত কিছু শেখার পর আমার মনে হয়, আমার মন্দিরে যাওয়া ঠিক হবে না। প্রথমে আমার চিন্তা হয়েছিল যে, আমি যদি শিন্টো ধর্ম ছেড়ে চলে যাই, তা হলে অন্যেরা কী ভাববে। কিন্তু, আমি অনেক আগে থেকেই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম যে, আমি যদি সত্য ঈশ্বরকে কোথাও খুঁজে পাই, তা হলে আমি এই ধর্মটা ছেড়ে দেব। তাই, ১৯৮৯ সালের শুরুর দিকে আমি আমার মনের কথা শোনার সিদ্ধান্ত নিই। আর আমি এই বিশ্বাস নিয়ে মন্দির ছেড়ে দিই যে, যিহোবা আমার যত্ন নেবেন।
মন্দির ছেড়ে চলে আসা সহজ ছিল না। আমার চেয়ে উচ্চপদস্থ পুরোহিতেরা আমার সমালোচনা করেন এবং আমাকে জোর করেন, যাতে আমি কাজ ছেড়ে না দিই। তবে, আমার বাবা-মাকে বিষয়টা জানানো এর চেয়ে আরও বেশি কঠিন ছিল। তাদের বাড়িতে দেখা করতে যাওয়ার সময় আমি এত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম যে, রাস্তার মাঝখানে আমার বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গিয়েছিল, আমার পা আর এগোচ্ছিল না। তাই, আমি মাঝে মাঝে থেমে যিহোবার কাছে শক্তি চেয়ে প্রার্থনা করছিলাম।
আমি যখন বাবা-মায়ের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছোই, তখন এই বিষয়ে কথা বলতে আমি প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়। শেষে, অনেক প্রার্থনা করার পর আমি আমার বাবাকে সবকিছু খুলে বলি। আমি তাকে বলি যে, আমি সত্য ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছি এবং তাঁর সেবা করার জন্য আমি শিন্টো ধর্ম ছাড়তে চলেছি। এটা শুনে আমার বাবা আকাশ থেকে পড়ে যান এবং খুবই দুঃখী হয়ে পড়েন। তারপর, আমার অন্যান্য আত্মীয় সেখানে এসে আমার মন পরিবর্তন করার চেষ্টা করে। আমি আমার পরিবারকে কষ্ট দিতে চাইনি, তবে আমি এও জানতাম যে, যিহোবাকে সেবা করাটাই হল সঠিক। সময়ের সঙ্গেসঙ্গে আমার পরিবার আমার সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়।
মন্দির ছেড়ে চলে আসার পরও আমি সেটার বিষয়েই ভাবতে থাকতাম। কারণ আমার কাছে মন্দিরে সেবা করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি সেটাকে ভুলে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করি কিন্তু আমি যেদিকেই তাকাতাম, সেদিকেই এমন কিছু দেখতে পেতাম, যেগুলো আমাকে আমার পুরোনো জীবনধারার কথা মনে করিয়ে দিত।
সেইসব থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমি দুটো কাজ করেছিলাম। প্রথমত, আমার বাড়িতে শিন্টো ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যা-কিছু ছিল, সেই সমস্ত কিছু আমি খুঁজে বের করি এবং পুড়িয়ে দিই। সেগুলোর মধ্যে ছিল বইপত্র, ছবি এবং দামি দামি জিনিসপত্র ছিল, যেগুলো আমি আমার কালেকশনে রেখেছিলাম। আর দ্বিতীয়ত, আমি যতবেশি সম্ভব যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে সময় কাটাতাম। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে এবং তাদের সাহায্যে আমি ধীরে ধীরে আমার আগেকার জীবনধারার কথা ভাবা বন্ধ করতে পারি।
আমি যেভাবে উপকৃত হয়েছি: আগে আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের সময় দিতাম না আর এই কারণে তারা খুবই একা হয়ে যেত। কিন্তু, স্বামীদের বাইবেল যা করতে বলে, সেই অনুযায়ী আমি যখন তাদের জন্য সময় বের করি, তখন একে অন্যের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। কিছুসময় পর, আমার স্ত্রীও আমার সঙ্গে যিহোবার সেবা করতে শুরু করে। আমাদের ছেলে ও আমাদের জামাই-মেয়ে, আমরা সবাই এখন একত্রে সত্য উপাসনা করছি।
আমার ছোটোবেলার স্বপ্ন ছিল ঈশ্বরের সেবা করা এবং অন্যদের সাহায্য করা। তবে এখন আমি বুঝতে পারি, আমি যা চেয়েছি, তার চেয়ে আরও বেশি কিছু পেয়েছি। আমি বলে বোঝাতে পারব না, আমি যিহোবার প্রতি কতটা কৃতজ্ঞ।
“আমার জীবনে কিছু-একটার অভাব রয়েছে।”—লিনেট হটিং
জন্ম: ১৯৫৮
দেশ: দক্ষিণ আফ্রিকা
ইতিহাস: পরিত্যক্ত হওয়ার কষ্ট
আমার অতীত: আমার জন্ম জর্মিস্টন শহরে হয়, যেখানে অনেক খনি ছিল। সেখানকার লোকজন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছিল এবং সেখানে খুব-একটা অপরাধ হত না। আমার বাবা-মায়ের মনে হয়, তারা আমাকে বড়ো করে তুলতে পারবেন না। তাই, আমি যখন শুধুমাত্র ১৪ দিনের ছিলাম, তখন তারা আমাকে দত্তক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আমাকে এক দম্পতি দত্তক নেন, যারা আমাকে খুব ভালোবাসতেন এবং আমি তাদেরকেই আমার মা-বাবা হিসেবে দেখতাম। কিন্তু তারপরও, আমি যখন আসল ঘটনাটা জানতে পারি, তখন নিজের বাবা-মায়ের কাছ থেকে পরিত্যক্ত হওয়ার কারণে আমার প্রচণ্ড কষ্ট হয়। তখন থেকে আমাকে যারা দত্তক নিয়েছিলেন, তারা আমার কাছে অজানা বলে মনে হয় আর মনে হয়, তারা আমাকে ভালোভাবে বোঝেন না।
প্রায় ১৬ বছর বয়সে আমি বারে যেতে শুরু করি। সেখানে আমি আমার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে নাচতাম আর লাইভ মিউজিক শুনতাম। ১৭ বছর বয়সে আমি সিগারেট খাওয়া ধরি। আমি ধূমপান বিজ্ঞাপনের মডেলদের দেখতাম আর ঠিক তাদের মতোই ছিমছাম হতে চেয়েছিলাম। ১৯ বছর বয়সে আমি জোহানেসবার্গ শহরে কাজ করতে শুরু করি আর খুব তাড়াতাড়ি খারাপ বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে যাই। কিছুসময় যেতে-না-যেতেই আমি খারাপ ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করি, আরও বেশি সিগারেট খেতে শুরু করি এবং ছুটির দিনগুলো প্রচুর মদ খেয়ে কাটাতে শুরু করি।
তারপরও, আমি শারীরিকভাবে পরিশ্রমী ছিলাম। আমি নিয়মিত এরোবিক্স করতাম এবং স্কোয়াশ ও ফুটবল খেলতাম। এ ছাড়া, আমি প্রচুর পরিশ্রম করে কম্পিউটার জগতে নিজের এক সুনাম তৈরি করেছিলাম। এর ফলে, আমি প্রচুর টাকাপয়সা অর্জন করেছিলাম আর লোকেরা আমাকে একজন সফল ব্যক্তি হিসেবে দেখত। কিন্তু, বাস্তবে আমি খুশি ছিলাম না, আমি আমার জীবনের কথা চিন্তা করে খুবই নিরাশ হয়ে গিয়েছিলাম। মনে মনে আমি জানতাম, আমার জীবনে কিছু-একটার অভাব রয়েছে।
বাইবেল যেভাবে আমার জীবনকে পরিবর্তন করেছে: বাইবেল অধ্যয়ন করার পর আমি শিখি যে, যিহোবা প্রেমের ঈশ্বর। আর আমি এও শিখি যে, তিনি আমাদেরকে তাঁর বাক্য বাইবেল দেওয়ার মাধ্যমে তাঁর প্রেম দেখিয়েছেন। এটি ঠিক একটা ব্যক্তিগত চিঠির মতো, যা তিনি আমাদের নির্দেশনা দেওয়ার জন্য লিখেছেন। (যিশাইয় ৪৮:১৭, ১৮) আমি বুঝতে পারি যে, যিহোবার এই প্রেমপূর্ণ নির্দেশনা থেকে আমি যদি উপকার পেতে চাই, তা হলে আমাকে আমার জীবনে বেশ কয়েকটা বড়ো পরিবর্তন করতে হবে।
প্রথমত, আমাকে খারাপ বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা করা বন্ধ করতে হত। আমি হিতোপদেশ ১৩:২০ পদের কথাগুলো মনের মধ্যে গেঁথে নিই, যেটা বলে: “জ্ঞানীদের সহচর হও, জ্ঞানী হইবে; কিন্তু যে হীনবুদ্ধিদের বন্ধু, সে ভগ্ন হইবে।” বাইবেলের এই নীতি আমাকে পুরোনো বন্ধুবান্ধব ছেড়ে দিয়ে যিহোবা সাক্ষিদের মধ্য থেকে নতুন বন্ধু খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিল।
আবার অন্যদিকে, সিগারেটের প্রতি আমার আসক্তি কাটিয়ে ওঠা আমার পক্ষে খুবই কঠিন ছিল। সেটা কাটিয়ে উঠতে না উঠতে আমি আরেকটা সমস্যার মুখোমুখি হই। সিগারেট ছাড়তে গিয়ে আমার ওজন ১৩.৬ কিলোর (৩০ পাউন্ড) চেয়েও বেশি বেড়ে যায়! সেটা জানার পর আমার আত্মসম্মানে এক বড়ো ধাক্কা লাগে আর সেই ওজন কম করতে আমার প্রায় দশ বছর লেগে যায়। কিন্তু আমি জানতাম, সেই সময় আমার জন্য সিগারেট ছাড়াটাই সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। তাই, আমি যিহোবার কাছে প্রার্থনা করতে থাকি আর তিনি আমাকে প্রয়োজনীয় শক্তি দেন।
আমি যেভাবে উপকৃত হয়েছি: এখন আমি স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে ভালো আছি। এ ছাড়া, আমি সুখী কারণ আমি আর এই জগতে কেরিয়ার, সামাজিক পদমর্যাদা ও টাকাপয়সার পিছনে ছুটে বেড়াই না। এর পরিবর্তে, আমি অন্যদের কাছে বাইবেলের সত্য জানাতে পেরে অনেক খুশি। এর ফলে, তিন জন মহিলা, যারা আগে আমার সঙ্গে কাজ করতেন, তারা এখন যিহোবার সেবা করেন। আর আমার স্বামীও আমার সঙ্গে যিহোবার সেবা করছেন। আমাকে দত্তক নেওয়া বাবা-মা মারা যাওয়ার আগেই আমি তাদের বাইবেলের এই প্রতিজ্ঞা সম্বন্ধে জানাতে পেরেছিলাম যে, ঈশ্বর একদিন এই পৃথিবীকে পরমদেশে পরিণত করবেন এবং মৃত ব্যক্তিরা আবারও জীবন ফিরে পাবে।
আমার নিজের বাবা-মা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন বলে আমার কষ্ট হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু যিহোবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর আমি সেই কষ্ট কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। এখন আমি এমন এক পরিবারের অংশ হতে পেরেছি, যা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে। আর সেই পরিবারে আমি অনেক মা, বাবা, ভাই ও বোনকে পেয়েছি।—মার্ক ১০:২৯, ৩০.
[ছবি]
আমি দেখেছি যে, যিহোবার সাক্ষিরা একে অন্যকে কতটা ভালোবাসে
[ছবি]
এটা হল সেই শিন্টো মন্দির, যেখানে আমি একসময় উপাসনা করতাম