অধ্যায় পাঁচ
“এক চমৎকার মহিলা”
১, ২. (ক) রূৎ কী ধরনের কাজ করছিলেন? (খ) রূৎ ঈশ্বরের ব্যবস্থা এবং তাঁর লোকেদের কোন ইতিবাচক দিকটা জানতে পেরেছিলেন?
রূৎ সারাদিনে জড়ো করা যবের শিষের পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসে আছেন। বৈৎলেহমের চারপাশে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে আর এরই মধ্যে বেশিরভাগ মজুর সামনের পাহাড়ের ওপর তাদের ছোটো নগরটার দ্বারের দিকে ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছে। সেই সকাল থেকে সারাদিন খাটনির পর রূৎ কতটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, তা আমরা কল্পনা করতে পারি। তবুও তিনি একটা ছোটো লাঠি অথবা শস্য মাড়ানোর যন্ত্র দিয়ে শস্য ঝেড়েই চলেছেন। সবচেয়ে বড়ো কথা হল, তিনি যেমনটা আশা করেছিলেন, তার চেয়ে দিনটা বেশ ভালোই কেটেছে।
২ অবশেষে, এই বিধবার পরিস্থিতি কি ভালো হতে শুরু করেছিল? আমরা আগের অধ্যায়ে যেমন দেখেছি, তিনি তার শাশুড়ি নয়মীর এতটাই অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন যে, তিনি তার সঙ্গে থাকার এবং তার ঈশ্বর যিহোবাকে নিজের ঈশ্বর করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রিয়জনদের মৃত্যুতে হারিয়ে এই দুই নারী মোয়াব থেকে বৈৎলেহমে এসেছিলেন আর মোয়াবীয় রূৎ দরিদ্র ইস্রায়েলীয় ও বিদেশিদের জন্য যিহোবার ব্যবহারিক ও মর্যাদাপূর্ণ ব্যবস্থা সম্বন্ধে জানতে পেরেছিলেন। আর এখন তিনি দেখেছেন যে, যিহোবার কিছু লোক, যারা ব্যবস্থা অনুসারে চলত এবং সেটার দ্বারা প্রশিক্ষিত হতো, তারা কিছুটা আধ্যাত্মিকতা ও দয়া দেখিয়েছিল, যা তার ব্যথিত হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল।
৩, ৪. (ক) বোয়স কীভাবে রূৎকে উৎসাহ দিয়েছিলেন? (খ) আজকের অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে রূতের উদাহরণ কীভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারে?
৩ এইরকম একজন ব্যক্তি ছিলেন বোয়স। তিনি ছিলেন একজন বয়স্ক ধনী ব্যক্তি, যার জমিতে রূৎ শস্য কুড়াচ্ছিলেন। তিনি আজ রূতের প্রতি পিতার মতো বিবেচনা দেখিয়েছেন। তিনি নয়মীর যত্ন নিয়েছেন বলে এবং সত্য ঈশ্বর যিহোবার পক্ষের নীচে আশ্রয় খুঁজেছেন বলে বোয়স তাকে যে-প্রশংসাসূচক কথাগুলো বলেছিলেন, সেগুলো স্মরণ করে রূৎ মনে মনে খুশি হয়েছিলেন।—পড়ুন, রূতের বিবরণ ২:১১-১৪.
৪ তা সত্ত্বেও, রূৎ হয়তো তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করেছিলেন। স্বামী ও সন্তানহীনা এক নিঃস্ব বিদেশিনি হিসেবে, তিনি কীভাবে নয়মী ও নিজের ভরণ-পোষণ জোগাবেন? শস্য কুড়িয়ে কি তাদের চলবে? তার বৃদ্ধ বয়সে কে তাকে দেখবে? এই ধরনের দুশ্চিন্তার কারণে তিনি যদি উদ্বিগ্ন হয়েও থাকেন, তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আজকের অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে অনেকেই এই ধরনের উদ্বেগের সঙ্গে লড়াই করে। এই ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে রূতের বিশ্বাস কীভাবে তাকে সাহায্য করেছিল তা যখন আমরা শিখব, তখন আমরা অনুকরণ করার মতো অনেক কিছু খুঁজে পাব।
কাদের নিয়ে একটা পরিবার গঠিত হয়?
৫, ৬. (ক) বোয়সের জমিতে প্রথম দিনে রূৎ কতটা শস্য কুড়াতে পেরেছিলেন? (খ) রূৎকে দেখে নয়মী কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন?
৫ শস্য ঝেড়ে সেগুলো জড়ো করার পর রূৎ দেখেছিলেন যে, তিনি প্রায় এক ঐফা যব কুড়িয়েছেন। এর ওজন ছিল প্রায় ১৪ কিলোগ্রাম! তিনি হয়তো সেই যব কাপড়ে বেঁধে মাথায় তুলে সন্ধ্যার অন্ধকারে বৈৎলেহমের দিকে রওনা দিয়েছিলেন।—রূৎ. ২:১৭.
৬ নয়মী তার প্রিয় পুত্রবধূকে দেখে খুশি হয়েছিলেন এবং রূতের কাছে যবের ভারী বোঝা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বোয়স তার মজুরদের জন্য যে-খাবার দিয়েছিলেন, তা থেকে রূৎ খানিকটা বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছিলেন আর তারা দু-জনে মিলে সেই সাধারণ খাবার খেয়েছিলেন। নয়মী জিজ্ঞেস করেছিলেন: “তুমি অদ্য কোথায় কুড়াইয়াছ? কোথায় কর্ম্ম করিয়াছ? যে ব্যক্তি তোমার তত্ত্ব লইয়াছেন, তিনি ধন্য হউন।” (রূৎ. ২:১৯) নয়মী রূৎকে মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন; রূতের ভারী বোঝা প্রমাণ দেয় যে, কেউ এই বিধবা যুবতীকে লক্ষ করেছিলেন এবং তার প্রতি দয়া দেখিয়েছিলেন।
৭, ৮. (ক) বোয়সের দেখানো দয়াকে নয়মী কার কাছ থেকে প্রাপ্ত দয়া বলে দেখেছিলেন এবং কেন? (খ) রূৎ আর কোন উপায়ে তার শাশুড়ির প্রতি অনুগত প্রেম দেখিয়েছিলেন?
৭ তারা দু-জন কথা বলতে শুরু করেছিলেন এবং রূৎ নয়মীকে বলেছিলেন যে, বোয়স তার প্রতি কেমন দয়া দেখিয়েছিলেন। খুশি হয়ে নয়মী বলেছিলেন: “তিনি সেই সদাপ্রভুর আশীর্ব্বাদ লাভ করুন, যিনি জীবিত ও মৃতদের প্রতি দয়া নিবৃত্ত করেন নাই।” (রূৎ. ২:২০) তিনি বোয়সের দেখানো দয়াকে যিহোবার কাছ থেকে প্রাপ্ত দয়া হিসেবে দেখেছিলেন, যিনি তাঁর দাসদেরকে উদার হতে উৎসাহ দেন এবং তারা যে-দয়া দেখায়, সেটার পুরস্কার দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন।a—পড়ুন, হিতোপদেশ ১৯:১৭.
৮ রূৎকে যাতে ছেদকদের হয়রানির শিকার না হতে হয়, সেইজন্য বোয়সের যুবতী দাসীদের সঙ্গে থাকার এবং তারই জমিতে শস্য কুড়ানোর বিষয়ে তার প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য নয়মী তাকে অনুরোধ করেছিলেন। রূৎ তার কথা শুনেছিলেন। এ ছাড়া, তিনি ‘আপন শাশুড়ীর সহিত বাস করিলেন।’ (রূৎ. ২:২২, ২৩) সেই কথাগুলোর মধ্যে আমরা আবারও রূতের অনুগত প্রেম দেখতে পাই, যেটার জন্য তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন। রূতের উদাহরণ, আমাদের নিজেদেরকে জিজ্ঞেস করতে পরিচালিত করে, আমরা আমাদের প্রিয়জনদের অনুগতভাবে সমর্থন করার এবং যখন প্রয়োজন তখন সাহায্য করার দ্বারা পারিবারিক বন্ধনকে সম্মান করি কি না। যিহোবা সবসময় এই ধরনের অনুগত প্রেম লক্ষ করেন।
আমাদের যে-ধরনের পরিবারই থাকুক না কেন, রূৎ ও নয়মীর উদাহরণ সেটার প্রতি আমাদের উপলব্ধি দেখানোর কথা মনে করিয়ে দেয়
৯. রূৎ ও নয়মীর কাছ থেকে পরিবারের বিষয়ে আমরা কী শিখতে পারি?
৯ রূৎ ও নয়মী কি সত্যিই একটা পরিবারের মতো ছিল? কেউ কেউ মনে করে, একটা “আসল” পরিবার গড়ে তোলার জন্য স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, ঠাকুরমা-ঠাকুরদা ও আরও অনেকের ভূমিকা থাকা দরকার। কিন্তু, রূৎ ও নয়মীর উদাহরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যিহোবার দাসেরা তাদের হৃদয় উজাড় করে দিয়ে সবচেয়ে ছোটো পরিবারকেও আন্তরিকতা, দয়া ও প্রেম দিয়ে ভরিয়ে দিতে পারে। আপনি কি আপনার পরিবারকে মূল্যবান বলে মনে করেন? যিশু তাঁর অনুসারীদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, খ্রিস্টীয় মণ্ডলী এমনকী তাদের জন্যও পরিবার হয়ে উঠতে পারে, যাদের কেউ নেই।—মার্ক ১০:২৯, ৩০.
“তিনি আমাদের মুক্তিকর্ত্তা জ্ঞাতিদের মধ্যে এক জন”
১০. নয়মী কীভাবে রূৎকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন?
১০ এপ্রিল মাসের যব কাটার সময় থেকে জুন মাসের গম কাটার সময় পর্যন্ত, রূৎ বোয়সের জমিতে শস্য কুড়িয়েছিলেন। সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নয়মী নিশ্চয়ই এটাও চিন্তা করতে শুরু করেছিলেন যে, তিনি তার প্রিয় পুত্রবধূর জন্য আর কী করতে পারেন। মোয়াবে থাকাকালীন নয়মী ধরেই নিয়েছিলেন, তিনি আর রূতের বিবাহ দিতে পারবেন না। (রূৎ. ১:১১-১৩) কিন্তু, এখন তিনি অন্যকিছু চিন্তা করতে শুরু করেন। তিনি রূতের কাছে গিয়ে তাকে বলেছিলেন: “তোমার যাহাতে মঙ্গল হয়, এমন বিশ্রামস্থান আমি কি তোমার জন্য চেষ্টা করিব না?” (রূৎ. ৩:১) সেই সময়ে রীতি ছিল, বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের জন্য সাথি খুঁজে দেবে আর রূৎ সত্যিই নয়মীর মেয়ে হয়ে উঠেছিলেন। তিনি রূতের জন্য “বিশ্রামস্থান” অর্থাৎ সেই নিরাপত্তা ও সুরক্ষা খুঁজতে চেয়েছিলেন, যা একটা ঘর ও একজন স্বামী দিতে পারেন। কিন্তু নয়মী কী করতে পারেন?
১১, ১২. (ক) নয়মী যখন বোয়সকে ‘মুক্তিকর্ত্তা জ্ঞাতি’ বলে সম্বোধন করেছিলেন, তখন তিনি ঈশ্বরের ব্যবস্থার অন্তর্গত কোন প্রেমময় ব্যবস্থা সম্বন্ধে বলছিলেন? (খ) তার শাশুড়ির পরামর্শের প্রতি রূৎ কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন?
১১ রূৎ যখন প্রথম বোয়সের বিষয়ে উল্লেখ করেছিলেন, তখন নয়মী বলেছিলেন: “সেই ব্যক্তি আমাদের নিকট-সম্বন্ধীয়, তিনি আমাদের মুক্তিকর্ত্তা জ্ঞাতিদের মধ্যে এক জন।” (রূৎ. ২:২০) এটার মানে কী? ঈশ্বর ইস্রায়েলীয়দের জন্য যে-ব্যবস্থা দিয়েছিলেন, তার মধ্যে দরিদ্র অথবা মৃত্যুতে প্রিয়জনদের হারিয়ে যে-পরিবারগুলো সমস্যায় পড়েছিল, তাদের জন্য এক প্রেমময় ব্যবস্থা ছিল। একজন নারী যদি সন্তানহীনা অবস্থায় বিধবা হয়ে যেতেন, তাহলে এটা তার জন্য খুবই হতাশাজনক হতো কারণ ভাবী প্রজন্মের কাছে তার স্বামীর নাম ও উত্তরাধিকার মুছে যাবে। কিন্তু, ঈশ্বরের ব্যবস্থা অনুসারে তার স্বামীর ভাই এই বিধবাকে বিবাহ করতে পারতেন, যাতে তিনি একজন বংশধরের জন্ম দিতে পারেন, যে তার মৃত স্বামীর নাম বহন করবে এবং পরিবারের সম্পত্তির দেখাশোনা করবে।b—দ্বিতীয়. ২৫:৫-৭.
১২ নয়মী রূতের কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন, তিনি কীভাবে এইরকম একটা বিবাহের ব্যবস্থা করবেন। আমরা কল্পনা করতে পারি যে, বড়ো বড়ো চোখ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রূৎ তার শাশুড়ির কথা শুনছেন। রূতের কাছে তখনও ইস্রায়েলের ব্যবস্থা নতুন ছিল; আর বেশিরভাগ রীতিনীতি তখনও বেশ অপরিচিত ছিল। তা সত্ত্বেও, নয়মীর প্রতি তার এত সম্মান ছিল যে, তিনি তার প্রত্যেকটা কথা মন দিয়ে শুনেছিলেন। নয়মী তাকে যে-পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেটা হয়তো তার কাছে অদ্ভুত ও লজ্জাজনক, এমনকী কিছুটা অপমানজনক বলে মনে হয়েছিল, তবুও তিনি রাজি হয়েছিলেন। নম্রভাবে তিনি বলেছিলেন: “তুমি যাহা বলিতেছ, সে সমস্তই আমি করিব।”—রূৎ. ৩:৫.
১৩. বয়স্ক ব্যক্তিদের পরামর্শ শোনার ব্যাপারে আমরা রূতের কাছ থেকে কী শিখি? (এ ছাড়া, ইয়োব ১২:১২ পদ দেখুন।)
১৩ কখনো কখনো অল্পবয়সিদের জন্য সেই ব্যক্তিদের পরামর্শ শোনা কষ্টকর বলে মনে হতে পারে, যারা বয়স্ক ও বেশি অভিজ্ঞ। এমনটা মনে করা সহজ যে, ছোটোরা যে-প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সমস্যার মুখোমুখি হয়, তা বয়স্করা ভালোভাবে বুঝতে পারে না। রূতের নম্র উদাহরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যারা আমাদের ভালোবাসে ও হৃদয় থেকে আমাদের ভালো চায়, আমাদের সেই বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রজ্ঞার কথা শোনা খুবই পুরস্কারদায়ক হতে পারে। (পড়ুন, গীতসংহিতা ৭১:১৭, ১৮.) কিন্তু, নয়মী কী পরামর্শ দিয়েছিলেন আর তা শোনার ফলে রূৎ কি সত্যিই উপকৃত হয়েছিলেন?
খামারে রূৎ
১৪. খামার বলতে কী বোঝায় আর এখানে কী করা হতো?
১৪ সেই সন্ধ্যায় রূৎ খামারে গিয়েছিলেন, যেটা ছিল এক শক্ত, সমতল জায়গা যেখানে চাষিরা তাদের শস্য মাড়াই করার ও ঝাড়ার জন্য নিয়ে যেত। প্রধানত পাহাড়ের ঢাল অথবা উঁচু কোনো স্থান বেছে নেওয়া হতো, যেখানে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জোরে জোরে বাতাস বইতে থাকে। শস্যকে তুষ থেকে আলাদা করার জন্য মজুররা বড়ো ত্রিশূল অথবা বেলচায় করে তুষসুদ্ধ শস্যকে বাতাসে উড়ায়, যাতে ভারী দানা মাটিতে এসে পড়ে আর অপেক্ষাকৃত হালকা তুষ উড়ে যায়।
১৫, ১৬. (ক) সন্ধ্যা বেলা বোয়স খামারে তার কাজ শেষ করার পর সেখানে যা ঘটেছিল তা বর্ণনা করুন। (খ) বোয়স কীভাবে লক্ষ করলেন যে, রূৎ তার পায়ের কাছে শুয়ে আছেন?
১৫ রূৎ সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ করছিলেন, মজুররা তাদের সন্ধ্যা বেলার কাজ শেষ করছে। বোয়স নিজের শস্যের ঝাড়ার কাজ দেখাশোনা করছেন, যা এক বিরাট স্তূপের আকার নিয়েছে। প্রাণভরে খাওয়া-দাওয়া করার পর, তিনি তার জমা করা শস্যের স্তূপের একপাশে শুয়ে পড়েন। এটা হয়তো চোর ডাকাতের হাত থেকে তাদের মূল্যবান শস্যকে রক্ষা করার জন্য একটা সাধারণ রীতি ছিল। রূৎ দেখেছিলেন, বোয়স এখন ঘুমাতে যাচ্ছেন। এবার নয়মী যা বলেছিলেন, সেই অনুসারে কাজে করার সময় এসে গিয়েছে।
১৬ রূৎ হামাগুড়ি দিয়ে কাছে যান, তার বুক ধুক ধুক করতে থাকে। তিনি বুঝতে পারেন যে, মানুষটি ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই নয়মী তাকে যেমন বলেছেন, তিনি বোয়সের পায়ের কাছে গিয়ে তার পা অনাবৃত করে সেখানে শুয়ে পড়েন। এরপর তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন। সময় অতিবাহিত হতে থাকে। রূতের সময় যেন আর কাটছে না। শেষপর্যন্ত প্রায় মাঝরাতে বোয়স নড়ে ওঠেন। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে পা ঢাকা দেওয়ার জন্য তিনি উঠে বসেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন যে সেখানে কেউ যেন রয়েছে। বিবরণ বলে, “দেখ, এক স্ত্রী তাঁহার চরণসমীপে শুইয়া আছে।”—রূৎ. ৩:৮.
১৭. যারা দাবি করে যে, রূতের কাজ অনুপযুক্ত ছিল, তারা কোন দুটো সরল সত্যকে উপেক্ষা করে?
১৭ তিনি জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কে গা?” কাঁপা গলায় রূৎ বলে ওঠেন: “আমি আপনার দাসী রূৎ; আপনার এই দাসীর উপরে আপনি নিজ পক্ষ বিস্তার করুন, কারণ আপনি মুক্তিকর্ত্তা জ্ঞাতি।” (রূৎ. ৩:৯) আধুনিক দিনের কিছু অনুবাদক এমনটা দাবি করার চেষ্টা করেন যে, রূতের হাবভাব ও কথায় যৌনতার ইঙ্গিত ছিল কিন্তু তারা দুটো সরল সত্যকে উপেক্ষা করেন। প্রথমত, রূৎ সেই সময়ের রীতিনীতি অনুসারে কাজ করছিলেন, যেগুলোর বেশিরভাগই আজকে আমরা বুঝে উঠতে পারি না। তাই তার কাজকে আজকের দিনের নৈতিকভাবে অধঃপতিত মানগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে ভুল হবে। দ্বিতীয়ত, বোয়স এমনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, যা স্পষ্টভাবে দেখায় যে, তিনি রূতের কাজকে নৈতিকভাবে শুদ্ধ ও খুবই প্রশংসাজনক হিসেবে দেখেছিলেন।
১৮. রূৎকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বোয়স কী বলেছিলেন আর তার প্রেমপূর্ণ-দয়ার কোন দুটো ঘটনা তিনি উল্লেখ করেছিলেন?
১৮ বোয়স কথা বলেন আর নিঃসন্দেহে তার শান্ত, কোমল স্বর রূৎকে আশ্বস্ত করে। তিনি বলেছিলেন: “অয়ি বৎসে, তুমি সদাপ্রভুর আশীর্ব্বাদপাত্রী, কেননা ধনবান কি দরিদ্র কোন যুবা পুরুষের অনুগামিনী না হওয়াতে তুমি প্রথমাপেক্ষা শেষে অধিক সুশীলতা দেখাইলে।” (রূৎ. ৩:১০) ‘প্রথম’ ঘটনা, নয়মীর সঙ্গে ইস্রায়েলে আসা এবং তার যত্ন নেওয়ার মধ্যে রূতের অনুগত প্রেমকে নির্দেশ করে। ‘শেষ’ ঘটনাটা হল, যেটা সবেমাত্র ঘটেছে। বোয়স লক্ষ করেছিলেন যে, রূতের মতো একজন যুবতী সহজেই তার চেয়ে যুবক কোনো ধনী অথবা দরিদ্র ব্যক্তিকে স্বামী হিসেবে বেছে নিতে পারতেন। তা না করে, তিনি শুধুমাত্র নয়মীর প্রতিই নয় কিন্তু সেইসঙ্গে নয়মীর মৃত স্বামীর উদ্দেশেও ভালো কিছু করতে চেয়েছিলেন, যাতে সেই মৃত ব্যক্তির নাম তার নিজের দেশে টিকে থাকে। তাই এটা বোঝা কঠিন নয় যে, কেন বোয়স এই যুবতীর নিঃস্বার্থপরতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
১৯, ২০. (ক) কেন বোয়স সঙ্গেসঙ্গে রূৎকে বিবাহ করেননি? (খ) কীভাবে রূৎ ও তার সুনামের প্রতি বোয়স সদয়ভাব ও বিবেচনা দেখিয়েছিলেন?
১৯ বোয়স আরও বলেন: “এখন বৎসে, ভয় করিও না, তুমি যাহা বলিবে, আমি তোমার জন্য সে সমস্ত করিব; কেননা তুমি যে সাধ্বী [“এক চমৎকার মহিলা,” NW], ইহা আমার স্বজাতীয়দের নগর-দ্বারের সকলেই জানে।” (রূৎ. ৩:১১) রূৎকে বিবাহ করার প্রত্যাশায় বোয়স খুশি হয়েছিলেন; সম্ভবত তাকে তার মুক্তিকর্তা জ্ঞাতি হতে বলায় তিনি পুরোপুরি অবাক হননি। কিন্তু, বোয়স একজন ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন আর তিনি নিজের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতে চাননি। তিনি রূৎকে বলেছিলেন যে, আরেকজন মুক্তিকর্তা জ্ঞাতি আছেন, যিনি নয়মীর মৃত স্বামীর পরিবারের আরও বেশি নিকটাত্মীয়। বোয়স প্রথমে তার কাছে গিয়ে তাকে রূৎকে বিবাহ করার সুযোগ দেবেন।
যেহেতু রূৎ অন্যদের প্রতি দয়া ও সম্মানের সঙ্গে আচরণ করেছিলেন, তাই তিনি সুনাম অর্জন করেছিলেন
২০ বোয়স রূৎকে আবার শুয়ে পড়তে এবং ভোর না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই বিশ্রাম নিতে বলেছিলেন; তারপর তিনি এমনভাবে ফিরে যেতে পারবেন, যাতে কেউ তাকে দেখতে না পায়। তিনি রূতের এবং তার নিজের সুনাম রক্ষা করতে চেয়েছিলেন কারণ লোকেরা হয়তো ভুল করে এমনটা মনে করতে পারে যে, তাদের মধ্যে অনৈতিক কিছু ঘটেছে। রূৎ আবারও বোয়সের পায়ের কাছে শুয়ে পড়েন, হয়তো-বা তার অনুরোধে সদয়ভাবে সাড়া দেওয়ায় এবার কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করেন। এরপর ভোররাতে তিনি উঠে পড়েন। বোয়স তার আবরণীয় বস্ত্রে উপহার হিসেবে অনেকখানি যব দেন আর রূৎ বৈৎলেহমে ফিরে যান।—পড়ুন, রূতের বিবরণ ৩:১৩-১৫.
২১. কোন কারণে রূৎ “এক চমৎকার মহিলা” হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন আর আমরা কীভাবে তার উদাহরণ অনুকরণ করতে পারি?
২১ তিনি যে সবার কাছে “এক চমৎকার মহিলা” হিসেবে পরিচিত, বোয়সের বলা এই কথাগুলো যখন রূৎ চিন্তা করেছিলেন, তখন তিনি কতই-না খুশি হয়েছিলেন! কোনো সন্দেহ নেই যে, যিহোবাকে জানার ও তাঁকে সেবা করার আকাঙ্ক্ষাই তাকে এই সুনাম এনে দিয়েছিল। এ ছাড়া, স্বেচ্ছায় তার কাছে অজানা এমন এক জীবনযাত্রা ও রীতিনীতি মেনে নেওয়ার দ্বারা তিনি নয়মী ও তার লোকেদের প্রতি গভীর দয়া ও অনুভূতি দেখিয়েছিলেন। আমরা যদি রূতের বিশ্বাস অনুকরণ করি, তাহলে আমরাও অন্যদেরকে এবং তাদের জীবনযাত্রা ও রীতিনীতির প্রতি গভীর সম্মান দেখানোর চেষ্টা করব। আমরা যদি তা করি, তাহলে দেখব যে, আমরাও এক সুনাম গড়ে তুলছি।
রূতের জন্য এক বিশ্রামস্থান
২২, ২৩. (ক) বোয়স রূৎকে যে-উপহার দিয়েছিলেন, সেটার অর্থ হয়তো কী ছিল? (এ ছাড়া, পাদটীকা দেখুন।) (খ) নয়মী রূৎকে কী করতে বলেছিলেন?
২২ রূৎ যখন ঘরে ফিরে আসেন, তখন নয়মী তাকে জিজ্ঞেস করেন, “কি হইল [“কে ওখানে,” ইজি-টু-রিড ভারসন]?” সম্ভবত তখনও অন্ধকার থাকায় তিনি এই কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন, কিন্তু সেইসঙ্গে নয়মী এটাও জানতে চেয়েছিলেন যে, রূৎ তখনও একইরকম বিধবা রয়েছেন, না কি তার সামনে বিবাহের সম্ভাবনা রয়েছে। তার ও বোয়সের মধ্যে যা যা ঘটেছিল, সেইসমস্তই রূৎ তাড়াতাড়ি করে তার শাশুড়িকে বলেন। এ ছাড়া, তিনি নয়মীকে উপহার হিসেবে পাওয়া অনেকখানি যব দেন, যা বোয়স তাকে দেওয়ার জন্য বলেছিলেন।c—রূৎ. ৩:১৬, ১৭.
২৩ বুদ্ধি করে, নয়মী রূৎকে সে-দিন শস্য কুড়াতে না গিয়ে শান্ত হয়ে ঘরেই থাকতে বলেন। তিনি রূৎকে আশ্বাস দেন: “সে ব্যক্তি অদ্য এ কর্ম্ম সাঙ্গ না করিয়া বিশ্রাম করিবেন না।”—রূৎ. ৩:১৮.
২৪, ২৫. (ক) বোয়স কীভাবে দেখিয়েছিলেন যে, তিনি একজন ন্যায়নিষ্ঠ ও নিঃস্বার্থপর ব্যক্তি? (খ) রূৎকে কীভাবে আশীর্বাদ করা হয়েছিল?
২৪ বোয়সের বিষয়ে নয়মী ঠিকই বলেছিলেন। শহরের প্রাচীন ব্যক্তিরা সাধারণত যেখানে জড়ো হতেন, সেই নগরদ্বারে গিয়ে তিনি ওই নিকটাত্মীয়ের আসার অপেক্ষায় বসেছিলেন। বোয়স সেই ব্যক্তিকে সাক্ষিদের সামনে সুযোগ দিয়েছিলেন, যাতে তিনি রূৎকে বিবাহ করে একজন মুক্তিকর্তা জ্ঞাতি হিসেবে তার কর্তব্য পালন করেন। কিন্তু সেই ব্যক্তি এই দাবি করে তা প্রত্যাখ্যান করেন যে, তা করা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া তার নিজের অধিকারকে নষ্ট করবে। তখন, নগরদ্বারের সেই সাক্ষিদের সামনে বোয়স বলেন যে, নয়মীর মৃত স্বামী ইলীমেলকের সম্পত্তি কিনে নিয়ে ও ইলীমেলকের ছেলে মহলোনের বিধবা স্ত্রী রূৎকে বিবাহ করে, তিনি একজন মুক্তিকর্তা জ্ঞাতির কর্তব্য পালন করবেন। বোয়স এই আশা সম্বন্ধে ঘোষণা করেন, তা করার দ্বারা ‘সেই মৃত ব্যক্তির অধিকারে তাহার নাম উদ্ধার’ হবে। (রূৎ. ৪:১-১০) বোয়স সত্যিই একজন ন্যায়নিষ্ঠ ও নিঃস্বার্থপর ব্যক্তি ছিলেন।
২৫ বোয়স রূৎকে বিবাহ করেছিলেন। এরপর বাইবেল বলে, “তিনি সদাপ্রভু হইতে গর্ব্ভধারণশক্তি পাইয়া পুত্ত্র প্রসব করিলেন।” বৈৎলেহমের নারীরা নয়মীকে আশীর্বাদ করেছিল এবং রূতের প্রশংসা করে বলেছিল যে, নয়মীর কাছে রূৎ সাত ছেলের চেয়েও আরও বেশি ভালো। আমরা জানি যে, পরে রূতের সন্তান মহান রাজা দায়ূদের পূর্বপুরুষ হয়েছিলেন। (রূৎ. ৪:১১-২২) আর দায়ূদ ছিলেন যিশু খ্রিস্টের পূর্বপুরুষ।—মথি ১:১.d
২৬. রূৎ ও নয়মীর উদাহরণ আমাদেরকে কী মনে করিয়ে দেয়?
২৬ রূতের মতো নয়মীও আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন, যিনি সেই সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো বড়ো করে তুলতে সাহায্য করেছিলেন। এই দুই নারীর জীবনই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, যিহোবা সেই ব্যক্তিদের লক্ষ করেন, যারা তাদের নিজেদের ভরণ-পোষণ জোগানোর জন্য নম্রভাবে পরিশ্রম করেন এবং তাঁর মনোনীত লোকেদের সঙ্গে তাঁকে অনুগতভাবে সেবা করেন। তিনি কখনো বোয়স, নয়মী ও রূতের মতো বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের পুরস্কৃত করা থেকে বিরত হন না।
a নয়মী এটা লক্ষ করেছিলেন যে, যিহোবার দয়া শুধুমাত্র জীবিতদের প্রতিই সীমাবদ্ধ নয়; তা এমনকী মৃতদের প্রতিও প্রযোজ্য। নয়মী তার স্বামী ও দুই ছেলেকে হারিয়েছেন আর রূৎ হারিয়েছেন তার স্বামীকে। নিশ্চিতভাবেই, এই দুই নারীর জীবনে তিন জন পুরুষই গভীর ছাপ ফেলেছিল। নয়মী ও রূতের প্রতি দেখানো যেকোনো দয়া, আসলে সেই মৃত ব্যক্তিদের প্রতি দয়া দেখানোর সমান ছিল, যারা চাইতেন যেন কেউ তাদের এই প্রিয় নারীদের যত্ন নেয়।
b এইরকম একজন বিধবাকে বিবাহ করার অধিকার প্রথমে মৃত ব্যক্তির নিজের ভাইকে দেওয়া হতো আর তা না হলে, নিকটাত্মীয় কোনো পুরুষ তা পেতেন, ঠিক যেমনটা উত্তরাধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে হতো।—গণনা. ২৭:৫-১১.
c বোয়স রূৎকে ছয় [মাণ] যব দিয়েছিলেন, হয়তো-বা এই ইঙ্গিত দিয়ে যে, ছয় দিনের পর যেমন বিশ্রামবার আসে, তেমনই বিধবা হিসেবে তার কষ্টের দিন শীঘ্র শেষ হবে আর তিনিও ঘর, স্বামী নিয়ে ‘বিশ্রাম’ পাবেন। অন্যদিকে, রূৎ হয়তো এতটাই বইতে পারবেন বলে, তিনি সম্ভবত ছয় বেলচা যব দিয়েছিলেন।