তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন
তিনি বিচক্ষণতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন
অবীগল সেই যুবকের চোখে-মুখে আতঙ্ক লক্ষ করেছিলেন। সেই যুবক খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল, আর তা উপযুক্ত কারণেই। ভয়ংকর বিপদ এগিয়ে আসছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে, প্রায় ৪০০ জন যোদ্ধা, অবীগলের স্বামী নাবলের পরিবারের প্রত্যেক পুরুষ সদস্যকে হত্যা করার সংকল্প নিয়ে এগিয়ে আসছিল। কেন?
এই সমস্ত কিছুর কারণ ছিলেন নাবল। তিনি যথারীতি নিষ্ঠুর ও উদ্ধত ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু, এই সময়ে তিনি ভুল ব্যক্তিকে—অনুগত ও সুপ্রশিক্ষিত সৈন্যদলের প্রিয় সেনাপতিকে—অপমান করেছিলেন। সেইজন্য নাবলের যুবক কর্মীদের মধ্যে একজন—সম্ভবত একজন মেষপালক—এই আস্থা নিয়ে অবীগলের কাছে এসেছিল যে, অবীগল তাদেরকে রক্ষা করার জন্য একটা উপায় বের করবেন। কিন্তু, এক সৈন্যদলের সামনে একজন মহিলা কী-ই বা করতে পারেন?
প্রথমে, আসুন আমরা এই উল্লেখযোগ্য মহিলা সম্বন্ধে আরেকটু জানার চেষ্টা করি। অবীগল কে ছিলেন? কীভাবে এই সংকটের শুরু হয়েছিল? আর তার বিশ্বাসের উদাহরণ থেকে আমরা কী শিখতে পারি?
“সুবুদ্ধি ও সুবদনা”
অবীগল ও নাবল উত্তম যুগল ছিল না। নাবল অবীগলের চেয়ে ভালো সাথি খুঁজে পেতে পারতেন না আর অবীগলের এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল, যার মতো খারাপ লোক খুব কমই ছিল। এটা ঠিক যে, সেই ব্যক্তির প্রচুর টাকাপয়সা ছিল। এই কারণে তিনি নিজেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে ভাবতেন, কিন্তু অন্যেরা তাকে কীভাবে দেখত? বাইবেলের আর কোনো চরিত্রকে এতটা অবজ্ঞাপূর্ণ আখ্যা দেওয়া হয়েছে কি না, তা খুঁজে পাওয়া কঠিন। তার নামের অর্থ হচ্ছে “মূর্খ” বা “বোকা।” তার বাবা-মা কি তাকে তার জন্মের সময় এইরকম নাম দিয়েছিল, নাকি তার আচরণের জন্য পরবর্তী সময়ে তিনি এই নাম পেয়েছিলেন? তিনি যেভাবেই এই নাম পেয়ে থাকুন না কেন, তিনি তার নাম অনুযায়ীই আচরণ করেছিলেন। নাবল “কঠিন ও দুর্বৃত্ত” ছিলেন। একজন অত্যাচারী ও মাতাল, যাকে সবাই ভয় পেত ও অপছন্দ করত।—১ শমূয়েল ২৫:২, ৩, ১৭, ২১, ২৫.
অবীগল ছিলেন একেবারে আলাদা। তার নামের অর্থ হচ্ছে, “আমার বাবা আনন্দিত হয়েছেন।” অনেক বাবা এক সুন্দরী মেয়ের জন্য গর্বিত বোধ করেন, কিন্তু একজন বিজ্ঞ বাবা তার সন্তানের অন্তরের সৌন্দর্য দেখে আরও বেশি আনন্দিত হন। প্রায়ই দেখা যায় যে, বাহ্যিক সৌন্দর্যের অধিকারী একজন ব্যক্তি বিচক্ষণতা, প্রজ্ঞা, সাহস অথবা বিশ্বাসের মতো গুণাবলি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তাকে বুঝতে ব্যর্থ হন। কিন্তু, অবীগলের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। বাইবেল বলে যে, তিনি বিচক্ষণ বা ‘সুবুদ্ধি ও সুবদনা ছিলেন।’—১ শমূয়েল ২৫:৩.
আজকে, কেউ কেউ হয়তো ভাবতে পারে যে, এইরকম একজন বুদ্ধিমতী যুবতী কেন এক পাষণ্ডকে বিয়ে করেছিলেন। মনে রাখবেন যে, বাইবেলের সময়ে অনেক বিয়ে বাবা-মা ঠিক করত। বাবা-মা বিয়ে ঠিক না করলেও, তাদের সম্মতিকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হতো। অবীগলের বাবা-মা কি নাবলের ধনসম্পদ ও বিশিষ্টতার বিষয়ে শুনে মুগ্ধ হয়ে এখানে বিয়ে দিতে চেয়েছিল কিংবা সেই বিয়ে ঠিক করেছিল? নাকি তারা দরিদ্রতার চাপে তা করেছিল? কারণ যা-ই হোক না কেন, নাবলের টাকাপয়সা তাকে এক উত্তম স্বামী করে তোলেনি।
বিজ্ঞ বাবা-মায়েরা তাদের ছেলে-মেয়েদের সতর্কভাবে শিক্ষা দিয়ে থাকে, যেন তারা বিয়ের প্রতি এক মর্যাদাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখে। তারা তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে কারো টাকাপয়সা দেখে তাকে বিয়ে করতে জোরাজুরি করে না কিংবা অল্পবয়সেই তাদেরকে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ভূমিকা ও দায়িত্বগুলো গ্রহণ করার জন্য ডেটিং করতে চাপ দেয় না। (১ করিন্থীয় ৭:৩৬) যা-ই হোক, এই বিষয়গুলো ভাবার কোনো সুযোগ অবীগলের আর ছিল না। কারণ যা-ই থাকুক না কেন, নাবলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল আর এক কঠিন পরিস্থিতিতে তার সর্বোত্তমটুকু করার জন্য তিনি দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলেন।
“তিনি তাহাদিগকে লাঞ্ছনা করিলেন”
নাবল অবীগলের পরিস্থিতিকে আগের চেয়ে আরও কঠিন করে তুলেছিলেন। যে-ব্যক্তিকে তিনি অপমান করেছিলেন, তিনি ছিলেন দায়ূদ। দায়ূদ ছিলেন যিহোবার একজন বিশ্বস্ত দাস, যাকে ভাববাদী শমূয়েল অভিষিক্ত করেছিলেন আর এর মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন যে, শৌলের পরে রাজা হিসেবে ঈশ্বর তাকেই মনোনীত করেছিলেন। (১ শমূয়েল ১৬:১, ২, ১১-১৩) ঈর্ষান্বিত ও ঘাতক রাজা শৌলের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর সময়, দায়ূদ তার ৬০০ জন অনুগত যোদ্ধার সঙ্গে প্রান্তরে বাস করছিলেন।
নাবল মায়োনে বাস করতেন, কিন্তু কর্মিলের কাছাকাছি জায়গায় কাজ করতেন এবং সম্ভবত সেখানেই তার জমিজায়গা ছিল।a এই নগরগুলোতে ঘাসে-ঢাকা উঁচু এলাকা ছিল, যেগুলো মেষ পালনের জন্য উপযুক্ত আর নাবল ৩০০০ মেষের মালিক ছিলেন। কিন্তু, এর আশেপাশের এলাকা অনাবাদি ছিল। দক্ষিণে বিশাল পারণ প্রান্তর বিস্তৃত ছিল। পূর্বদিকে, লবণ সমুদ্রের দিকে যাওয়ার রাস্তা নির্জন পতিত ভূমির মধ্যে দিয়ে বিস্তৃত হয়েছিল, যেখানে অনেক গিরিখাত ও গুহা ছিল। এই অঞ্চলগুলোতে বেঁচে থাকার জন্য দায়ূদ ও তার লোকেদের সংগ্রাম করতে হয়েছিল, কোনো সন্দেহ নেই যে, তাদেরকে খাদ্য অন্বেষণ করতে এবং অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল। প্রায়ই তাদের সঙ্গে সেই যুবকদের দেখা হতো, যারা ধনী ব্যক্তি নাবলের মেষপালক হিসেবে কাজ করত।
সেই পরিশ্রমী সৈন্যরা এই মেষপালকদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করেছিল? তারা চাইলে যখন-তখন মেষ চুরি করতে পারত কিন্তু তারা এইরকম কিছুই করেনি। এর পরিবর্তে, তারা নাবলের মেষপাল ও দাসদের রক্ষা করেছিল। (১ শমূয়েল ২৫:১৫, ১৬) মেষ ও মেষপালকরা অনেক বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল। সেই সময়ে অনেক শিকারি ছিল। আর ইস্রায়েলের দক্ষিণ সীমান্ত কাছেই ছিল বলে বাইরের চোরডাকাতরা প্রায়ই আক্রমণ করত।b
সেই প্রান্তরে এত এত লোকের জন্য খাবার জোগানো এক বিরাট দায়িত্ব ছিল। তাই, একদিন দায়ূদ সাহায্য চেয়ে নাবলের কাছে দশজন বার্তাবাহককে পাঠিয়েছিলেন। দায়ূদ বিজ্ঞতার সঙ্গে সময় বাছাই করেছিলেন। সেটা ছিল লোমচ্ছেদনের উৎসবের সময়, যখন উদারতা প্রদর্শন ও ভোজনপান করা ছিল এক প্রথা। এ ছাড়া, দায়ূদ শব্দ বাছাইয়ের ব্যাপারেও বেশ সতর্ক ছিলেন, সম্বোধন করার সময় ভদ্রতাপূর্ণ অভিব্যক্তিগুলো ব্যবহার করেছিলেন। এমনকী তিনি নিজেকে ‘আপন পুত্ত্র দায়ূদ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন, যেটি সম্ভবত সম্মানপূর্বক এক স্বীকারোক্তি ছিল যে, নাবল তার চেয়ে বড়ো ছিলেন। কিন্তু, নাবল কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন?—১ শমূয়েল ২৫:৫-৮.
তিনি ক্রোধে ফেটে পড়েছিলেন! “তিনি তাহাদিগকে লাঞ্ছনা করিলেন,” এই কথাগুলো বলেই প্রবন্ধের শুরুতে উল্লেখিত যুবক ব্যক্তি অবীগলকে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিল। কৃপণ স্বভাবের নাবল তার দামি রুটি, জল ও বধ করা পশুর মাংসের জন্য চিৎকার করে অভিযোগ করেছিলেন। তিনি দায়ূদকে এক তুচ্ছ ব্যক্তি হিসেবে উপহাস করেছিলেন এবং তাকে এক পলাতক দাসের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। নাবলের দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো শৌলের মতো ছিল, যিনি দায়ূদকে ঘৃণা করতেন। এই দুই ব্যক্তির মধ্যে কারোরই যিহোবার মতো দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। ঈশ্বর দায়ূদকে ভালোবাসতেন এবং তাকে একজন বিদ্রোহী দাস হিসেবে নয় কিন্তু ইস্রায়েলের ভাবী রাজা হিসেবে দেখেছিলেন।—১ শমূয়েল ২৫:১০, ১১, ১৪.
দায়ূদের পাঠানো দূতেরা যখন ফিরে এসে তাকে সংবাদ দিয়েছিল, তখন তিনি প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন। “তোমরা প্রত্যেক জন খড়্গ বাঁধ,” তিনি আদেশ দিয়েছিলেন। সশস্ত্র হয়ে দায়ূদ তার ৪০০ জন লোককে নিয়ে আক্রমণ করার জন্য রওনা হয়েছিলেন। তিনি নাবলের পরিবারের প্রত্যেক পুরুষ সদস্যকে উচ্ছিন্ন করার শপথ নিয়েছিলেন। (১ শমূয়েল ২৫:১২, ১৩, ২১, ২২) দায়ূদের ক্রোধ যুক্তিযুক্ত ছিল, কিন্তু তিনি যেভাবে তা প্রকাশ করেছিলেন সেটা ভুল ছিল। বাইবেল বলে: “মনুষ্যের ক্রোধ ঈশ্বরের ধার্ম্মিকতার অনুষ্ঠান করে না।” (যাকোব ১:২০) কিন্তু, কীভাবে অবীগল তার পরিবারকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন?
“ধন্য তোমার সুবিচার”
এক অর্থে, ইতিমধ্যেই আমরা অবীগলকে এই গুরুতর ভুলকে সংশোধন করার উদ্দেশ্যে প্রথমে পদক্ষেপ নিতে দেখেছি। তার স্বামী নাবলের বিপরীতে, তিনি শুনতে ইচ্ছুক ছিলেন। সেই যুবক দাস, নাবল সম্বন্ধে বলেছিল: “তিনি এমন পাষণ্ড যে, তাঁহাকে কোন কথা কহিতে পারা যায় না।”c (১ শমূয়েল ২৫:১৭) দুঃখের বিষয় যে, নাবল নিজেকে এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে ভাবতেন যে, তিনি কারো কথা শুনতে ইচ্ছুক ছিলেন না। এই ধরনের ঔদ্ধত্য আমাদের দিনেও প্রায়ই দেখা যায়। কিন্তু সেই যুবক জানত যে, অবীগল ছিলেন ভিন্ন স্বভাবের আর কোনো সন্দেহ নেই যে, এই কারণেই সমস্যাটা নিয়ে সে অবীগলের কাছেই এসেছিল।
অবীগল চিন্তা করেছিলেন এবং শীঘ্র পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। আমরা পড়ি, “অবীগল আর দেরি করলেন না।” এই ঘটনার বর্ণনায় বাইবেল বার বার [বা “চার বার”] উল্লেখ করে যে, অবীগল শীঘ্র পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বা তিনি ‘দেরি করেননি।’ তিনি দায়ূদ ও তার লোকেদের জন্য প্রচুর উপহার প্রস্তুত করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল রুটি, দ্রাক্ষারস, মেষ, ভাজা শস্য, শুষ্ক দ্রাক্ষাফল ও ডুমুর-চাক। এটা স্পষ্ট যে, অবীগলের কাছে কী কী ছিল, তা তিনি ভালোভাবেই জানতেন এবং তার পরিবারের পুরো দায়দায়িত্ব তার ওপরই ছিল, ঠিক সেই গুণবতী স্ত্রীর মতো, যার সম্বন্ধে পরবর্তী সময়ে হিতোপদেশ বইয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। (হিতোপদেশ ৩১:১০-৩১) তিনি আগেই তার কিছু দাসের হাতে জিনিসগুলো পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ও পরে তিনি একা গিয়েছিলেন। আমরা পড়ি, “কিন্তু সে আপন স্বামী নাবলকে তাহা জানাইল না।”—১ শমূয়েল ২৫:১৮, বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারসন, ১৯.
তার মানে কি এই যে, অবীগল তার স্বামীর ন্যায্য মস্তকপদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছিলেন? কখনোই না। নাবল যিহোবার একজন অভিষিক্ত দাসের বিরুদ্ধে মন্দ আচরণ করেছিলেন, যে-আচরণ সম্ভবত নাবলের পরিবারের অনেক নিরীহ সদস্যের মৃত্যু ঘটাতে পারত। অবীগল যদি পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হতেন, তাহলে এমনটা কি হতে পারে যে, তিনি তার স্বামীর অপরাধের অংশী হতেন? তা হোক বা না হোক, অবীগলকে তার স্বামীর প্রতি বশীভূত হওয়ার চেয়ে বরং ঈশ্বরের প্রতি বশীভূত হওয়াকে অগ্রাধিকার দিতে হতো।
শীঘ্র, দায়ূদ ও তার লোকেদের সঙ্গে অবীগলের দেখা হয়। আবারও তিনি তাদেরকে দেখামাত্র তাড়াতাড়ি তার গর্দভ থেকে নামেন ও দায়ূদের সামনে প্রণিপাত করেন। (১ শমূয়েল ২৫:২০, ২৩) এরপর তিনি তার মনের কথা দায়ূদকে খুলে বলেন, তার স্বামী ও তার পরিবারের হয়ে সনির্বন্ধভাবে ক্ষমা ভিক্ষা করেন। কোন বিষয়টা তার কথাগুলোকে কার্যকারী করে তুলেছিল?
তিনি সমস্যার দায়ভার নিজের ওপর নিয়েছিলেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য দায়ূদের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তিনি যুক্তিযুক্তভাবে স্বীকার করেছিলেন যে, তার স্বামীর নামের অর্থ অনুযায়ী তার স্বামী মূর্খ ছিলেন আর এই কথার দ্বারা সম্ভবত ইঙ্গিত করছিলেন যে, এইরকম একজন ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া দায়ূদের জন্য মর্যাদাহানিকর হবে। তিনি যিহোবার প্রতিনিধি হিসেবে দায়ূদের ওপর আস্থা রেখেছিলেন আর এভাবে স্বীকার করেছিলেন যে, দায়ূদ ‘সদাপ্রভুরই জন্য যুদ্ধ’ করছিলেন। এ ছাড়া, তিনি এও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, তিনি দায়ূদ ও তার রাজত্ব সম্বন্ধীয় যিহোবার প্রতিজ্ঞার বিষয়ে জানতেন, কারণ তিনি বলেছিলেন: “সদাপ্রভু . . . আপনাকে ইস্রায়েলের উপরে অধ্যক্ষপদে নিযুক্ত করিবেন।” অধিকন্তু, তিনি দায়ূদকে এমন কোনো পদক্ষেপ না নিতে জোরালোভাবে অনুরোধ করেছিলেন, যেটা হয়তো দায়ূদকে রক্তপাতের দোষে দোষী করতে পারে অথবা পরবর্তী সময়ে ‘শোকের হেতু’ হতে পারে, যে-কথার দ্বারা স্পষ্টতই, বিবেকের দংশনকে বুঝিয়েছিলেন। (১ শমূয়েল ২৫:২৪-৩১) কতই না সদয় ও মর্মস্পর্শী কথা!
এই কথা শুনে, দায়ূদ কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন? অবীগল যা-কিছু নিয়ে এসেছিলেন, তিনি সেগুলো গ্রহণ করেছিলেন ও বলেছিলেন: “ধন্য ইস্রায়েলের ঈশ্বর সদাপ্রভু, যিনি অদ্য আমার সহিত সাক্ষাৎ করাইতে তোমাকে প্রেরণ করিলেন। আর ধন্য তোমার সুবিচার, এবং ধন্যা তুমি, কারণ অদ্য তুমি রক্তপাত . . . লইতে আমাকে নিবৃত্ত করিলে।” সাহস করে শীঘ্র তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন বলে দায়ূদ অবীগলের প্রশংসা করেছিলেন এবং স্বীকার করেছিলেন যে, অবীগল তাকে রক্তপাতের দোষ থেকে নিবৃত্ত করেছেন। তিনি অবীগলকে বলেছিলেন, “তুমি কুশলে ঘরে যাও,” ও সেইসঙ্গে নম্রভাবে এই কথা যুক্ত করেছিলেন: “আমি তোমার রবে কর্ণপাত . . . করিলাম।”—১ শমূয়েল ২৫:৩২-৩৫.
“দেখুন, আপনার এই দাসী”
তারা চলে যাওয়ার পর, অবীগল সেই সাক্ষাতের কথা ভুলতে পারেননি; কিংবা বিশ্বস্ত ও সদয় ব্যক্তি দায়ূদের এবং তিনি যার সঙ্গে বিবাহিত ছিলেন, সেই অত্যাচারী ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করতে ব্যর্থ হননি। কিন্তু, অবীগল সেই চিন্তাতেই মগ্ন থাকেননি। আমরা পড়ি: “পরে অবীগল নাবলের নিকটে আসিল।” হ্যাঁ, তিনি খুবই দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হয়ে তার স্বামীর কাছে ফিরে এসেছিলেন, যাতে স্ত্রী হিসেবে তার ভূমিকা যথাসাধ্যভাবে পালন করতে পারেন। দায়ূদ ও তার লোকেদেরকে তিনি যে-উপহার দিয়েছিলেন, সেই বিষয়টা তার স্বামীকে তার জানাতে হয়েছিল। তার স্বামীর তা জানার অধিকার ছিল। এ ছাড়া, তার স্বামীকে সেই বিপদ সম্বন্ধেও জানাতে হয়েছিল, যে-বিপদকে প্রতিহত করা হয়েছে আর নাবল যদি সেই বিষয়টা অন্য কারো কাছ থেকে শুনতেন, তাহলে তা আরও বেশি লজ্জাজনক হতো। কিন্তু, সেই মুহূর্তে অবীগল নাবলকে তা বলতে পারেননি। নাবল রাজভোজের মতো ভোজনে মগ্ন ছিলেন ও অতিরিক্ত মত্ত হয়ে ছিলেন।—১ শমূয়েল ২৫:৩৬.
আবারও সাহস ও বিচক্ষণতা দেখিয়ে, অবীগল পরের দিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন, যতক্ষণ না নাবলের মদের নেশা কেটে যায়। সেই সময়ে নাবল হয়তো অবীগলের কথা শোনার অবস্থায় থাকবেন, কিন্তু নাবলের বদমেজাজের কারণে অবীগলের অবস্থা আরও বেশি বিপদজনকও হতে পারে। তবুও, অবীগল তার কাছে গিয়ে পুরো ঘটনা বলেছিলেন। কোনো সন্দেহ নেই যে, তিনি আশা করেছিলেন, নাবল ক্রোধে ফেটে পড়বেন, হয়তো হিংস্রও হয়ে উঠবেন। কিন্তু এর পরিবর্তে, তিনি চুপচাপ, স্থিরভাবে সেখানে বসে ছিলেন।—১ শমূয়েল ২৫:৩৭.
এই ব্যক্তির সমস্যাটা কী ছিল? “তাহার অন্তর মধ্যে হৃদয় ম্রিয়মাণ হইল, এবং সে প্রস্তরবৎ হইয়া পড়িল।” সম্ভবত, তিনি কোনো ধরনের স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু, দশ দিন পর তিনি মারা গিয়েছিলেন—আর স্পষ্টতই তা শারীরিক অসুস্থতার কারণে নয়। “সদাপ্রভু নাবলকে আঘাত করাতে সে মরিয়া গেল।” (১ শমূয়েল ২৫:৩৮) এই ন্যায্য মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে অবীগলের বিবাহের সেই দীর্ঘ দুঃস্বপ্ন দূর হয়ে গিয়েছিল। আজকে, যদিও যিহোবা অলৌকিকভাবে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেন না, কিন্তু এই বিবরণটি হচ্ছে এক উপযুক্ত অনুস্মারক যে, ঘরোয়া অত্যাচার বা দুর্ব্যবহারের কোনো ঘটনাই তাঁর দৃষ্টি এড়ায় না। যিহোবা তাঁর নিজ উপযুক্ত সময়ে, সবসময় ন্যায়বিচার সম্পাদন করবেন।
দুঃস্বপ্নতুল্য সেই বিবাহ থেকে মুক্তি পাওয়া ছাড়াও, অবীগল আরেকটা আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন। দায়ূদ যখন নাবলের মৃত্যুর খবর পেয়েছিলেন, তখন তিনি বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য বার্তাবাহকদের পাঠিয়েছিলেন। অবীগল উত্তরে বলেছিলেন, “দেখুন, আপনার এই দাসী আমার প্রভুর দাসদের পা ধোয়াইবার দাসী।” স্পষ্টতই, দায়ূদের স্ত্রী হওয়ার প্রত্যাশায় তিনি বদলে যাননি; তিনি এমনকী নিজেকে দায়ূদের দাসদের দাসী হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন! এরপর আমরা আবারও পড়ি যে, এবারে তিনি দায়ূদের কাছে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে শীঘ্র করেছিলেন বা দেরি করেননি।—১ শমূয়েল ২৫:৩৯-৪২.
এই ঘটনার সমাপ্তি রূপকথার মতো সুখময় ছিল না; দায়ূদের সঙ্গে অবীগলের জীবন সবসময় সমস্যাবিহীন ছিল না। ইতিমধ্যেই দায়ূদ অহীনোয়মের সঙ্গে বিবাহিত ছিলেন এবং বহুবিবাহ নিশ্চয়ই সেই সময়ের বিশ্বস্ত মহিলাদের জন্য অস্বাভাবিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলো নিয়ে আসত। এ ছাড়া, দায়ূদ তখনও রাজা হননি; তাই, রাজা হিসেবে যিহোবাকে সেবা করার আগে তাকে অনেক বাধা ও কষ্ট অতিক্রম করতে হতো। তবে অবীগল দায়ূদকে সারাজীবন সাহায্য ও সমর্থন করেছিলেন, অবশেষে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন আর উপলব্ধি করেছিলেন যে, তার স্বামী তাকে মূল্যবান বলে গণ্য করেন ও তাকে সুরক্ষা প্রদান করেন। এমনকী একবার দায়ূদ তাকে অপহরণকারীদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন! (১ শমূয়েল ৩০:১-১৯) এভাবে, দায়ূদ যিহোবা ঈশ্বরকে অনুকরণ করেছিলেন, যিনি এই ধরনের বিচক্ষণ, সাহসী ও বিশ্বস্ত মহিলাদের ভালোবাসেন ও মূল্যবান বলে গণ্য করেন। (w০৯ ০৭/০১)
[পাদটীকাগুলো]
a এটা সুদূর উত্তরে অবস্থিত সেই বিখ্যাত কর্মিল পর্বত ছিল না কিন্তু দক্ষিণে পারণ প্রান্তরের সীমান্তে অবস্থিত এক নগর ছিল।
b দায়ূদ সম্ভবত মনে করেছিলেন যে, স্থানীয় জমিদার ও তাদের মেষপাল রক্ষা করা ছিল যিহোবা ঈশ্বরের প্রতি করা এক সেবা। সেই সময়ে, যিহোবার উদ্দেশ্য ছিল যে, অব্রাহাম, ইস্হাক ও যাকোবের বংশধররা সেই দেশে বাস করবে। তাই, সেই দেশকে বাইরের আক্রমণকারী ও ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা করা ছিল এক ধরনের পবিত্র সেবা।
c যুবক ব্যক্তি যে-অভিব্যক্তিটি ব্যবহার করেছিল, সেটির আক্ষরিক অর্থ হল, “বলিয়ালের (অপদার্থ) সন্তান।” নাবল সম্বন্ধে বর্ণনা করতে গিয়ে বাইবেলের অন্যান্য অনুবাদ তাকে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরে যে, “তিনি কারও কথা শোনেন না” আর তাই এইরকম বলা যায়, “তার মন পরিবর্তন করানো অসম্ভব।”
[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
তার স্বামী নাবলের বিপরীতে অবীগল এক উত্তম শ্রোতা ছিলেন
[১৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
দায়ূদের সঙ্গে কথা বলার সময় অবীগল নম্রতা, সাহস ও সুবিচার দেখিয়েছিলেন