বর্সিল্লয় নিজের সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে অবগত একজন ব্যক্তি
‘কেন আমি আপনার ভারস্বরূপ হইব?’ ৮০ বছর বয়সি যে-বৃদ্ধ ব্যক্তি ইস্রায়েলের রাজা দায়ূদকে এই কথাগুলো বলেছিলেন, তিনি ছিলেন বর্সিল্লয়। নিঃসন্দেহে, তার ধনসম্পদের কারণে বাইবেল বলে যে, তিনি “এক জন খুব বড় মানুষ” ছিলেন। (২ শমূয়েল ১৯:৩২, ৩৫) বর্সিল্লয় যর্দন নদীর পূর্ব দিকে এক পার্বত্য অঞ্চল গিলিয়দে বাস করতেন।—২ শমূয়েল ১৭:২৭; ১৯:৩১.
বর্সিল্লয় কোন পরিস্থিতিতে দায়ূদকে এই কথাগুলো বলেছিলেন? আর কেনই বা এই বয়স্ক ব্যক্তি এভাবে কথা বলেছিলেন?
রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
দায়ূদ বিপদের মধ্যে ছিলেন। তার ছেলে অবশালোম ‘ইস্রায়েল লোকদের চিত্ত হরণ করিয়া’ সিংহাসন দখল করেছিলেন। এটা স্পষ্ট ছিল যে, অবশালোম তার বাবার প্রতি অনুগত এমন কাউকেই হত্যা করা থেকে পিছপা হবেন না। তাই, দায়ূদ ও তার দাসেরা যিরূশালেম থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। (২ শমূয়েল ১৫:৬, ১৩, ১৪) দায়ূদ যখন যর্দনের পূর্ব দিকে একটা এলাকা মহনয়িমে এসে পৌঁছান, তখন বর্সিল্লয় তাকে সাহায্য করেছিলেন।
বর্সিল্লয় এবং আরও দুজন ব্যক্তি উদারভাবে দায়ূদকে প্রচুর দ্রব্য সরবরাহ করেছিল। এই তিনজন অনুগত প্রজা দেখিয়েছিল যে তারা তার শোচনীয় পরিস্থিতি সম্বন্ধে বুঝতে পেরেছে, যখন তারা দায়ূদ ও তার লোকেদের এই কথা বলেছিল: “লোকেরা প্রান্তরে ক্ষুধিত, শ্রান্ত ও পিপাসিত হইয়াছে।” বর্সিল্লয়, শোবি ও মাখীর, এই তিনজন দায়ূদ ও তার লোকেদেরকে শয্যা, গম, যব, সুজি, ভাজা শস্য, শিম, মসুর, মধু, দধি, মেষ ও অন্যান্য বস্তুগত জিনিস সরবরাহ করার মাধ্যমে সেই চাহিদাগুলো পূরণ করার জন্য তাদের যথাসাধ্য করেছিল।—২ শমূয়েল ১৭:২৭-২৯.
দায়ূদকে সাহায্য করা বিপদজনক ছিল। বৈধ রাজাকে সমর্থন করবে এমন যেকাউকে অবশালোম অদণ্ডিত রাখবেন, এইরকম চিন্তা করা অবান্তর ছিল। তাই, দায়ূদের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে বর্সিল্লয় সাহসী হয়েছিলেন।
পরিস্থিতি পালটে যায়
এর পর পরই অবশালোমের বিদ্রোহী বাহিনী দায়ূদের লোকেদের মুখোমুখি হয়েছিল। সম্ভবত মহনয়িম অঞ্চলের কাছেই ইফ্রয়িমের এক অরণ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। অবশালোমের সেনাবাহিনী পরাজিত হয়েছিল “আর সেই দিন তথায় মহাসংহার হইল।” অবশালোম যদিও পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু শীঘ্রই তাকে হত্যা করা হয়েছিল।—২ শমূয়েল ১৮:৭-১৫.
আবারও দায়ূদ ইস্রায়েলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজা হয়েছিলেন। তার অনুসারীদের আর পলাতক হিসেবে জীবনযাপন করতে হয়নি। অধিকন্তু, দায়ূদের প্রতি তাদের আনুগত্যের কারণে তারা তার কাছ থেকে সম্মান ও কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছিল।
দায়ূদ যখন যিরূশালেমে ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন “গিলিয়দীয় বর্সিল্লয় রোগলীম হইতে নামিয়া আসিয়াছিলেন, তিনি রাজাকে যর্দ্দনের পারে রাখিয়া যাইবার আশয়ে তাঁহার সহিত যর্দ্দন পার হইয়াছিলেন।” সেই সময়ে, বয়স্ক বর্সিল্লয়কে দায়ূদ এই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন: “তুমি আমার সহিত পার হইয়া আইস, আমি তোমাকে যিরূশালেমে আমার সঙ্গে প্রতিপালন করিব।”—২ শমূয়েল ১৯:১৫, ৩১, ৩৩.
নিঃসন্দেহে, দায়ূদ বর্সিল্লয়ের সাহায্যের জন্য অনেক কৃতজ্ঞ ছিলেন। এটা মনে হয় না যে, রাজা কেবল বস্তুগত চাহিদাগুলো জোগানোর মাধ্যমে তার অনুগ্রহের প্রতিদান দিতে চেয়েছিলেন। ধনী বর্সিল্লয়ের সেই ধরনের কোনো সাহায্যের প্রয়োজন ছিল না। দায়ূদ হয়তো সেই বয়স্ক ব্যক্তির প্রশংসনীয় গুণাবলির কারণে তাকে রাজদরবারে পেতে চেয়েছিলেন। সেখানে এক স্থায়ী আসন লাভ করা সম্মানের ব্যাপার হবে, বর্সিল্লয়কে রাজার বন্ধুত্ব উপভোগ করার বিশেষ সুযোগগুলো এনে দেবে।
বিনয় এবং বাস্তবতা
রাজা দায়ূদের আমন্ত্রণের উত্তরে বর্সিল্লয় বলেছিলেন: “আমার আয়ুর আর কত দিন আছে যে, আমি মহারাজের সহিত যিরূশালেমে উঠিয়া যাইব? অদ্য আমার বয়স আশী বৎসর; এখন কি ভাল মন্দের বিশেষ বুঝিতে পারি? যাহা ভোজন করি বা যাহা পান করি, আপনার দাস আমি কি তাহার আস্বাদ বুঝিতে পারি? এখন কি আর গায়ক ও গায়িকাদের গানের শব্দ শুনিতে পাই?” (২ শমূয়েল ১৯:৩৪, ৩৫) এভাবে, বর্সিল্লয় সম্মানপূর্বক সেই আমন্ত্রণকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং এক চমৎকার সুযোগ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু কেন?
বর্সিল্লয়ের সিদ্ধান্তের একটা কারণ হতে পারে তার বার্ধক্য এবং এর সঙ্গে আসা সীমাবদ্ধতাগুলো। বর্সিল্লয় হয়তো মনে করেছিলেন যে, তিনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না। (গীতসংহিতা ৯০:১০) দায়ূদকে সমর্থন করার জন্য তিনি তার যথাসাধ্য করেছিলেন কিন্তু সেইসঙ্গে বার্ধক্য তার সামনে যে-সীমাবদ্ধতাগুলো রেখেছিল, সেগুলো সম্বন্ধেও তিনি অবগত ছিলেন। বর্সিল্লয় মর্যাদা ও বিশিষ্টতা লাভের চিন্তাকে, বাস্তবসম্মতভাবে তার সামর্থ্যকে মূল্যায়ন করা থেকে তাকে বিরত করার সুযোগ দেননি। উচ্চাকাঙ্ক্ষী অবশালোমের বিপরীতে, বর্সিল্লয় বিজ্ঞতার সঙ্গে নম্রতা বা বিনয় প্রদর্শন করেছিলেন।—হিতোপদেশ ১১:২.
বর্সিল্লয়ের সিদ্ধান্তের আরেকটা কারণ হতে পারে, তিনি চেয়েছিলেন যে তার সীমাবদ্ধতাগুলো যেন কোনোভাবেই ঐশিকভাবে নিযুক্ত রাজার কার্যকলাপকে ব্যাহত না করে। বর্সিল্লয় জিজ্ঞেস করেছিলেন: “কেন আপনার এই দাস আমার প্রভু মহারাজের ভারস্বরূপ হইবে?” (২ শমূয়েল ১৯:৩৫) যদিও তিনি তখনও পর্যন্ত দায়ূদকে সমর্থন করেছিলেন কিন্তু বর্সিল্লয় সম্ভবত মনে করেছিলেন যে, অপেক্ষাকৃত কমবয়সি একজন ব্যক্তি সেই কার্যভারগুলো আরও ফলপ্রসূভাবে সম্পন্ন করতে পারবেন। খুব সম্ভবত তার নিজের ছেলেকে নির্দেশ করে বর্সিল্লয় বলেছিলেন: “দেখুন, এই আপনার দাস কিম্হম; এ আমার প্রভু মহারাজের সহিত পার হইয়া যাউক; আপনার যাহা ভাল বোধ হয়, ইহার প্রতি করিবেন।” বিরক্ত হওয়ার পরিবর্তে, দায়ূদ এই প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন। বস্তুতপক্ষে, যর্দন পার হওয়ার আগে দায়ূদ “বর্সিল্লয়কে চুম্বন করিলেন, ও আশীর্ব্বাদ করিলেন।”—২ শমূয়েল ১৯:৩৭-৩৯.
ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন
বর্সিল্লয়ের বিবরণ ভারসাম্য বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে তুলে ধরে। একদিকে, আমাদের পরিচর্যার বিশেষ সুযোগকে প্রত্যাখ্যান করা বা এগুলোর জন্য আকাঙ্ক্ষা করা এড়িয়ে চলা উচিত নয় এই কারণে যে, আমরা এক নির্ঝঞ্ঝাট জীবন চাই অথবা দায়িত্ব নিতে নিজেদের অযোগ্য বলে মনে করি। ঈশ্বর আমাদের ঘাটতি পূরণ করে দিতে পারেন, যদি আমরা শক্তি ও প্রজ্ঞার জন্য তাঁর ওপর নির্ভর করি।—ফিলিপীয় ৪:১৩; যাকোব ৪:১৭; ১ পিতর ৪:১১.
অন্যদিকে, আমাদের নিজেদের সীমাবদ্ধতাগুলো বুঝতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, একজন খ্রিস্টান হয়তো আধ্যাত্মিক কাজে ইতিমধ্যেই অনেক ব্যস্ত রয়েছেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, আরও কার্যভার গ্রহণ করার দ্বারা তিনি তার পরিবারের আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত চাহিদাগুলোকে জোগানোর শাস্ত্রীয় দায়িত্বকে ঝুঁকির মুখে ফেলবেন। এইরকম এক পরিস্থিতিতে, তার জন্য ঠিক এখনই আরও অতিরিক্ত কার্যভার গ্রহণের সুযোগকে প্রত্যাখ্যান করা কি বিনয় ও যুক্তিবাদিতার এক চিহ্ন হবে না?—ফিলিপীয় ৪:৫, NW; ১ তীমথিয় ৫:৮.
বর্সিল্লয় এক চমৎকার উদাহরণ স্থাপন করেন আর আমাদের তা নিয়ে ধ্যান করা উচিত। তিনি ছিলেন অনুগত, সাহসী, উদার এবং বিনয়ী। সর্বোপরি, বর্সিল্লয় নিজের চেয়ে বরং ঈশ্বরের বিষয়গুলোকে প্রথমে রাখার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলেন।—মথি ৬:৩৩.
[১৫ পৃষ্ঠার মানচিত্র]
(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)
দায়ূদকে সাহায্য করার জন্য আশি বছর বয়সি বর্সিল্লয় এক ক্লান্তিকর যাত্রা করেছিলেন
গিলিয়দ
রোগলীম
সুক্কোৎ
মহনয়িম
যর্দন নদী
গিল্গল
যিরীহো
যিরূশালেম
ইফ্রয়িম
[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
কেন বর্সিল্লয় দায়ূদের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন?