অধ্যায় ২৮
“একমাত্র তুমিই অনুগত”
১, ২. কেন বলা যেতে পারে যে, রাজা দায়ূদ আনুগত্যহীনতার সঙ্গে অপরিচিত ছিলেন না?
রাজা দায়ূদ আনুগত্যহীনতার সঙ্গে অপরিচিত ছিলেন না। এক পর্যায়ে তার বিশৃঙ্খল রাজত্ব গুপ্তচক্রান্তে আক্রান্ত হয়েছিল, তার নিজ জাতির লোকেরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল। এ ছাড়া, এমন কিছু ব্যক্তি দায়ূদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, যাদের আমরা তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী বলে মনে করতাম। দায়ূদের প্রথম স্ত্রী মীখলের কথা বিবেচনা করুন। প্রথম প্রথম তিনি “দায়ূদকে প্রেম” করতেন, কোনো সন্দেহ নেই যে, রাজা হিসেবে তার দায়িত্ব পালনে তিনি তাকে সাহায্য করতেন। কিন্তু, পরে তিনি তাকে “মনে মনে তুচ্ছ করিলেন,” এমনকি দায়ূদকে “অসারচিত্ত লোক” হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন।—১ শমূয়েল ১৮:২০; ২ শমূয়েল ৬:১৬, ২০.
২ আরেকজন ছিলেন দায়ূদের ব্যক্তিগত উপদেষ্টা অহীথোফল। তার পরামর্শকে এতটাই মূল্যবান মনে করা হতো যেন তা ছিল সরাসরি যিহোবার কাছ থেকে আসা বাক্য। (২ শমূয়েল ১৬:২৩) কিন্তু, পরে এই নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি রাজদ্রোহী হয়েছিলেন এবং দায়ূদের বিরুদ্ধে এক সংগঠিত বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন। আর সেই ষড়যন্ত্রের প্ররোচক কে ছিলেন? দায়ূদের নিজের ছেলে, অবশালোম! সেই ধূর্ত সুবিধাবাদী ‘ইস্রায়েল লোকেদের চিত্ত হরণ করিয়া’ নিজেকে এক বিদ্রোহী রাজা হিসেবে দাবি করেছিলেন। অবশালোমের বিদ্রোহ এতটাই তীব্র হয়েছিল যে, রাজা দায়ূদ নিজ জীবনের জন্য পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।—২ শমূয়েল ১৫:১-৬, ১২-১৭.
৩. দায়ূদের কোন আস্থা ছিল?
৩ এমন কেউ কি ছিলেন না, যিনি দায়ূদের প্রতি অনুগত ছিলেন? সমস্ত বিপদের মধ্যেও দায়ূদ জানতেন যে, এইরকম একজন অবশ্যই আছেন। তিনি কে? যিহোবা ঈশ্বর ছাড়া অন্য আর কেউ নন। যিহোবার বিষয়ে দায়ূদ বলেছিলেন: “তুমি দয়াবানের [“অনুগত ব্যক্তির,” NW] সহিত সদয় [“আনুগত্যের সঙ্গে,” NW] ব্যবহার করিবে।” (২ শমূয়েল ২২:২৬) আনুগত্য কী এবং কীভাবে যিহোবা এই গুণের সবচেয়ে বড় উদাহরণ স্থাপন করেন?
আনুগত্য কী?
৪, ৫. (ক) “আনুগত্য” কী? (খ) আনুগত্য কীভাবে বিশ্বস্ততার চেয়ে আলাদা?
৪ ইব্রীয় শাস্ত্রে “আনুগত্য” শব্দটি যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তা হল দয়া, যেটা যতক্ষণ পর্যন্ত না এই বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রেমের সঙ্গে এটার প্রতি আসক্ত থাকে। এর সঙ্গে বিশ্বস্ততার চেয়ে আরও বেশি কিছু জড়িত। কারণ একজন ব্যক্তি হয়তো কেবল কর্তব্যবোধের তাগিদে বিশ্বস্ত হতে পারেন। এর বিপরীতে, আনুগত্যের মূলে রয়েছে প্রেম।a এ ছাড়া, “বিশ্বস্ত” শব্দটি জড় বস্তুগুলোর ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, গীতরচক চাঁদকে ‘গগনস্থ বিশ্বস্ত সাক্ষি’ বলেছিলেন কারণ প্রতিদিন রাতের বেলা এটাকে দেখা যায়। (গীতসংহিতা ৮৯:৩৭) কিন্তু, চাঁদকে অনুগত বলে বর্ণনা করা যায় না। কেন? কারণ আনুগত্য হল প্রেমের এক অভিব্যক্তি, যা জড় বস্তুগুলো প্রদর্শন করতে পারে না।
চাঁদকে এক বিশ্বস্ত সাক্ষি বলা হয়েছে কিন্তু একমাত্র বুদ্ধিমান জীবিত প্রাণীরাই প্রকৃতপক্ষে যিহোবার আনুগত্য প্রতিফলিত করতে পারে
৫ শাস্ত্রীয় অর্থে আনুগত্য হল আবেগপূর্ণ। এর প্রদর্শন ইঙ্গিত করে যে, যে-ব্যক্তি এই গুণটা দেখান এবং যার প্রতি দেখানো হয়েছে, তাদের দুজনের মধ্যে একটা সম্পর্ক রয়েছে। এইরকম আনুগত্য পরিবর্তনশীল নয়। এটা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো নয়, যা পরিবর্তনশীল বাতাসের দ্বারা চালিত হয়। এর বিপরীতে, আনুগত্য বা অনুগত প্রেমের সেই দৃঢ়তা ও শক্তি রয়েছে, যা কঠিনতম বাধাগুলো অতিক্রম করতে পারে।
৬. (ক) মানুষের মধ্যে আনুগত্য কতটা দুর্লভ এবং এটা বাইবেলে কীভাবে উল্লেখ করা আছে? (খ) আনুগত্যের অন্তর্ভুক্ত কী, তা জানার সবচেয়ে ভাল উপায় কী এবং কেন?
৬ এটা ঠিক যে, এইরকম আনুগত্য আজকে বলতে গেলে দেখাই যায় না। প্রায়ই, ঘনিষ্ঠ সঙ্গীরা একে অন্যের “সর্ব্বনাশ” করে। আমরা এমন অনেক স্বামী-স্ত্রীর কথা শুনি, যারা তাদের সাথিদের ফেলে চলে গেছে আর তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। (হিতোপদেশ ১৮:২৪; মালাখি ২:১৪-১৬) বিশ্বাঘাতকতাপূর্ণ কাজ এত বেশি দেখা যায় যে, আমরা হয়তো ভাববাদী মীখার কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করতে পারি: “পৃথিবী হইতে সাধু [“অনুগত ব্যক্তি,” NW] উচ্ছিন্ন হইয়াছে।” (মীখা ৭:২) যদিও মানুষেরা প্রায়ই প্রেমপূর্ণ-দয়া দেখাতে ব্যর্থ হয়, তবুও আনুগত্য উল্লেখযোগ্যভাবে যিহোবার বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে। সত্যি বলতে কী, আনুগত্যের অন্তর্ভুক্ত কী তা একেবারে যথাযথভাবে শেখার সবচেয়ে ভাল উপায় হল, যিহোবা তাঁর প্রেমের এই চমৎকার বৈশিষ্ট্যটা কীভাবে প্রদর্শন করেন, সেটা পরীক্ষা করা।
যিহোবার অতুলনীয় আনুগত্য
৭, ৮. কীভাবে বলা যেতে পারে যে, একা যিহোবাই হলেন অনুগত?
৭ যিহোবার সম্বন্ধে বাইবেল বলে: “একা তুমিই সাধু [“অনুগত,” NW]।” (গীতসংহিতা ১৫:৪) তা কীভাবে হতে পারে? মানুষ ও দূতেরা কি মাঝে মাঝে উল্লেখযোগ্য আনুগত্য দেখায়নি? (ইয়োব ১:১; প্রকাশিত বাক্য ৪:৮) আর যিশু খ্রিস্ট সম্বন্ধেই বা কী বলা যায়? তিনি কি ঈশ্বরের প্রধান ‘সাধু [‘অনুগত ব্যক্তি,’ NW]’ নন? (গীতসংহিতা ১৬:১০) তা হলে কীভাবে বলা যেতে পারে যে, একা যিহোবাই হলেন অনুগত?
৮ প্রথমত, মনে রাখবেন যে আনুগত্য হল প্রেমের একটা বৈশিষ্ট্য। যেহেতু, “ঈশ্বর প্রেম”—তিনি হলেন এই গুণের মূর্ত প্রতীক—তাই যিহোবার চেয়ে আর কে এতটা সম্পূর্ণভাবে আনুগত্য প্রদর্শন করতে পারে? (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) (১ যোহন ৪:৮) এটা সত্যি যে, দূতেরা ও মানুষেরা ঈশ্বরের গুণগুলো প্রতিফলিত করতে পারে কিন্তু সর্বোচ্চ অর্থে একমাত্র যিহোবাই হলেন অনুগত। “অনেক দিনের বৃদ্ধ” হিসেবে, তিনি পার্থিব বা স্বর্গীয় অন্য যেকোনো প্রাণীর চেয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রেমপূর্ণ-দয়া প্রদর্শন করে আসছেন। (দানিয়েল ৭:৯) অতএব, যিহোবা হলেন আনুগত্যের মূল সত্তা। তিনি এমনভাবে এই গুণ প্রদর্শন করেন, যা অন্য আর কোনো প্রাণীর সঙ্গে মেলে না। কয়েকটা উদাহরণ বিবেচনা করুন।
৯. কীভাবে যিহোবা “আপনার সমস্ত কার্য্যে অনুগত”?
৯ যিহোবা “আপনার সমস্ত কার্য্যে দয়াবান্ [“অনুগত,” NW]।” (গীতসংহিতা ১৪৫:১৭) কীভাবে? গীতসংহিতা ১৩৬ অধ্যায় একটা উত্তর দেয়। সেখানে যিহোবার বেশ কিছু রক্ষামূলক কাজ সম্বন্ধে উল্লেখ করা আছে, যেগুলোর মধ্যে লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে ইস্রায়েলীয়দের নাটকীয় উদ্ধারের কথা রয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল যে, এই গীতের প্রতিটা পদ এই বাক্যাংশের দ্বারা জোরালো হয়েছে: “তাঁহার দয়া [“প্রেমপূর্ণ-দয়া,” NW] [অথবা আনুগত্য] অনন্তকালস্থায়ী।” এই গীত ২৮৯ পৃষ্ঠার ধ্যানের জন্য প্রশ্নগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আপনি যখন ওই পদগুলো পড়বেন, তখন যিহোবা কত বিভিন্ন উপায়ে যে তাঁর লোকেদের প্রতি প্রেমপূর্ণ-দয়া দেখিয়েছেন, তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। হ্যাঁ, যিহোবা তাঁর বিশ্বস্ত দাসদের সাহায্যের আবেদনগুলো শুনে এবং নিরূপিত সময়ে পদক্ষেপ নিয়ে তাদের প্রতি আনুগত্য দেখান। (গীতসংহিতা ৩৪:৬) তাঁর দাসদের জন্য যিহোবার অনুগত প্রেম ততক্ষণ পর্যন্ত অটল থাকে, যতক্ষণ তারা তাঁর প্রতি আনুগত্য বজায় রাখে।
১০. যিহোবা তাঁর মানগুলোর বিষয়ে কীভাবে আনুগত্য প্রদর্শন করেন?
১০ এ ছাড়াও, যিহোবা তাঁর মানগুলোর প্রতি অটল থেকে তাঁর দাসদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। অস্থির প্রকৃতির কিছু মানুষ, যারা শুধু খেয়ালখুশি ও আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাদের বিপরীতে কোনটা সঠিক ও কোনটা ভুল, সেই বিষয়ে যিহোবা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্ত হন না। হাজার হাজার বছর ধরে প্রেতচর্চা, প্রতিমাপূজা ও হত্যা সম্বন্ধীয় বিষয়গুলো সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অপরিবর্তনীয় রয়ে গেছে। তিনি তাঁর ভাববাদী যিশাইয়ের মাধ্যমে বলেছিলেন, “তোমাদের বৃদ্ধ বয়স পর্য্যন্ত আমি যে সেই থাকিব।” (যিশাইয় ৪৬:৪) অতএব, আমরা আস্থা রাখতে পারি যে, ঈশ্বরের বাক্যে পাওয়া স্পষ্ট নৈতিক নির্দেশনা মেনে চলার দ্বারা আমরা উপকার পাব।—যিশাইয় ৪৮:১৭-১৯.
১১. যিহোবা তাঁর প্রতিজ্ঞার প্রতি বিশ্বস্ত, তা দেখানোর জন্য কিছু উদাহরণ দিন।
১১ এ ছাড়া, যিহোবা তাঁর প্রতিজ্ঞাগুলোর প্রতি বিশ্বস্ত থেকেও আনুগত্য প্রদর্শন করেন। তিনি কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করলে, তা পরিপূর্ণ হয়। তাই যিহোবা বলেছিলেন: “আমার মুখনির্গত বাক্য . . . নিষ্ফল হইয়া আমার কাছে ফিরিয়া আসিবে না, কিন্তু আমি যাহা ইচ্ছা করি, তাহা সম্পন্ন করিবে, এবং যে জন্য তাহা প্রেরণ করি, সে বিষয়ে সিদ্ধার্থ হইবে।” (যিশাইয় ৫৫:১০, ১১) যিহোবা তাঁর বাক্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার মাধ্যমে তাঁর লোকেদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। তিনি তাদের এমন কিছুর জন্য ব্যগ্রভাবে অপেক্ষা করান না, যে-বিষয়টা তিনি ঘটাবেন বলে মনস্থ করেননি। এই বিষয়ে যিহোবার সুনাম এতটাই নিখুঁত যে, তাঁর দাস যিহোশূয় বলতে পেরেছিলেন: “সদাপ্রভু ইস্রায়েলকুলের কাছে যে সকল মঙ্গলবাক্য বলিয়াছিলেন, তাহার মধ্যে একটী বাক্যও নিষ্ফল হইল না; সকলই সফল হইল।” (যিহোশূয়ের পুস্তক ২১:৪৫) তাই, আমরা আস্থা রাখতে পারি যে, আমরা কখনোই হতাশ হব না এই কারণে যে, যিহোবা তাঁর প্রতিজ্ঞাগুলো পূর্ণ করতে ব্যর্থ হবেন।—যিশাইয় ৪৯:২৩; রোমীয় ৫:৫.
১২, ১৩. কোন কোন অর্থে যিহোবার প্রেমপূর্ণ-দয়া “অনন্তকালস্থায়ী”?
১২ আগে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, বাইবেল আমাদের বলে যিহোবার প্রেমপূর্ণ-দয়া “অনন্তকালস্থায়ী।” (গীতসংহিতা ১৩৬:১) তা কীভাবে? একটা অর্থে যে, যিহোবা স্থায়ীভাবে পাপের ক্ষমা করেন। ২৬ অধ্যায়ে যেমন আলোচনা করা হয়েছে, একজন ব্যক্তির অতীতের যে-ভুলগুলো ক্ষমা করা হয়েছে, সেগুলোকে যিহোবা আর স্মরণে আনেন না। যেহেতু, “সকলেই পাপ করিয়াছে এবং ঈশ্বরের গৌরববিহীন হইয়াছে,” তাই আমাদের প্রত্যেকের যিহোবার প্রেমপূর্ণ-দয়া যে অনন্তকালস্থায়ী, সেইজন্য কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।—রোমীয় ৩:২৩.
১৩ কিন্তু, একই সময়ে অন্য অর্থেও যিহোবার প্রেমপূর্ণ-দয়া অনন্তকালস্থায়ী। তাঁর বাক্য বলে যে, ধার্মিক ব্যক্তি “জলস্রোতের তীরে রোপিত বৃক্ষের সদৃশ হইবে, যাহা যথাসময়ে ফল দেয়, যাহার পত্র ম্লান হয় না; আর সে যাহা কিছু করে, তাহাতেই কৃতকার্য্য হয়।” (গীতসংহিতা ১:৩) একটা ফলবতী গাছের কথা কল্পনা করুন, যেটার পাতা কখনোই ম্লান হয় না! একইভাবে, আমরা যদি ঈশ্বরের বাক্যে প্রকৃত আনন্দ পাই, তা হলে আমাদের জীবনও দীর্ঘ, শান্তিপূর্ণ ও ফলপ্রসূ হবে। যিহোবা আনুগত্যের সঙ্গে তাঁর বিশ্বস্ত দাসদের যে-আশীর্বাদগুলো দান করেন, সেগুলো অনন্তকালস্থায়ী। বাস্তবিকই, যিহোবা যে-ধার্মিক নতুন জগৎ নিয়ে আসবেন, সেখানে বাধ্য মানবজাতি অনন্তকাল ধরে তাঁর প্রেমপূর্ণ-দয়া উপভোগ করবে।—প্রকাশিত বাক্য ২১:৩, ৪.
যিহোবা “আপন অনুগত ব্যক্তিদের পরিত্যাগ করেন না”
১৪. কীভাবে যিহোবা তাঁর দাসদের আনুগত্যের প্রতি উপলব্ধি দেখান?
১৪ যিহোবা বার বার তাঁর আনুগত্য দেখিয়েছেন। যেহেতু যিহোবা নিখুঁতভাবে সংগতি বজায় রাখেন, তাই তিনি তাঁর বিশ্বস্ত দাসদের প্রতি যে-আনুগত্য দেখান, তা কখনোই হ্রাস পায় না। গীতরচক লিখেছিলেন: “আমি যুবক ছিলাম, এখন বৃদ্ধ হইয়াছি, কিন্তু ধার্ম্মিককে পরিত্যক্ত দেখি নাই, তাহার বংশকে খাদ্য ভিক্ষা করিতে দেখি নাই। কেননা সদাপ্রভু ন্যায়বিচার ভালবাসেন; তিনি আপন সাধুগণকে [“অনুগত ব্যক্তিদের,” NW] পরিত্যাগ করেন না।” (গীতসংহিতা ৩৭:২৫, ২৮) সত্যিই, সৃষ্টিকর্তা হিসেবে যিহোবা আমাদের উপাসনা পাওয়ার যোগ্য। (প্রকাশিত বাক্য ৪:১১) কিন্তু, যিহোবা অনুগত বলে, আমাদের বিশ্বস্ত কাজগুলোকে তিনি মূল্যবান বলে গণ্য করেন।—মালাখি ৩:১৬, ১৭.
১৫. ইস্রায়েলের সঙ্গে যিহোবার আচরণ কীভাবে তাঁর আনুগত্যকে তুলে ধরে, তা ব্যাখ্যা করুন।
১৫ যিহোবা তাঁর প্রেমপূর্ণ-দয়ার কারণে, তাঁর লোকেরা যখনই দুর্দশায় পড়ে তখনই বার বার তাদের সাহায্য করেন। গীতরচক আমাদের বলেন: “তিনি আপন সাধুগণের [“অনুগত ব্যক্তিদের,” NW] প্রাণ রক্ষা করেন, দুষ্টগণের হস্ত হইতে তাহাদিগকে উদ্ধার করেন।” (গীতসংহিতা ৯৭:১০) ইস্রায়েল জাতির সঙ্গে তাঁর আচরণের কথা বিবেচনা করুন। লোহিত সাগরের মধ্যে দিয়ে তাদের অলৌকিক উদ্ধারের পর, ইস্রায়েলীয়রা যিহোবার উদ্দেশে একটা গান গেয়ে ঘোষণা করেছিল: “তুমি যে লোকদিগকে মুক্ত করিয়াছ, তাহাদিগকে নিজ দয়াতে [“প্রেমপূর্ণ-দয়াতে,” অথবা “অনুগত প্রেমে,” পাদটীকা, NW] চালাইতেছ।” (যাত্রাপুস্তক ১৫:১৩) লোহিত সাগরে উদ্ধার নিঃসন্দেহে যিহোবার অনুগত প্রেমের একটা কাজ ছিল। তাই, ইস্রায়েলীয়দের মোশি বলেছিলেন: “অন্য সকল জাতি অপেক্ষা তোমরা সংখ্যাতে অধিক, এই জন্য যে সদাপ্রভু তোমাদিগকে স্নেহ করিয়াছেন ও মনোনীত করিয়াছেন, তাহা নয়; কেননা সমস্ত জাতির মধ্যে তোমরা অল্পসংখ্যক ছিলে। কিন্তু সদাপ্রভু তোমাদিগকে প্রেম করেন, এবং তোমাদের পিতৃপুরুষদের কাছে যে দিব্য করিয়াছেন, তাহা রক্ষা করেন, তন্নিমিত্তে সদাপ্রভু বলবান্ হস্ত দ্বারা তোমাদিগকে বাহির করিয়া আনিয়াছেন, এবং দাসগৃহ হইতে, মিসর-রাজ ফরৌণের হস্ত হইতে, তোমাদিগকে মুক্ত করিয়াছেন।”—দ্বিতীয় বিবরণ ৭:৭, ৮.
১৬, ১৭. (ক) ইস্রায়েলীয়রা কোন শোচনীয় উপলব্ধিবোধের অভাব দেখিয়েছিল কিন্তু তবুও কীভাবে যিহোবা তাদের প্রতি সমবেদনা দেখিয়েছিলেন? (খ) কীভাবে বেশির ভাগ ইস্রায়েলীয় দেখিয়েছিল যে তাদের জন্য “আর প্রতীকারের উপায়” নেই এবং এটা আমাদের জন্য কোন সতর্কতামূলক উদাহরণ প্রদান করে?
১৬ অবশ্য, জাতি হিসেবে ইস্রায়েল যিহোবার প্রেমপূর্ণ-দয়ার প্রতি উপলব্ধি দেখাতে ব্যর্থ হয়েছিল কারণ তাদের উদ্ধারের পর “তাহারা পুনঃ পুনঃ [যিহোবার] বিরুদ্ধে পাপ করিল, . . . পরাৎপরের বিদ্রোহী হইল।” (গীতসংহিতা ৭৮:১৭) শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, তারা বার বার বিদ্রোহ করেছিল, যিহোবাকে ত্যাগ করে মিথ্যা দেবতাদের ও পৌত্তলিক রীতিনীতিগুলোর দিকে ফিরেছিল, যা তাদের জন্য অধঃপতন ছাড়া আর কিছুই আনেনি। তারপরও, যিহোবা তাঁর চুক্তি ভঙ্গ করেননি। পরিবর্তে, ভাববাদী যিরমিয়ের মাধ্যমে যিহোবা তাঁর লোকেদের কাছে মিনতি করেছিলেন: “হে বিপথগামিনী ইস্রায়েল, ফিরিয়া আইস; আমি তোমাদের প্রতি ক্রোধদৃষ্টি করিব না; যেহেতু আমি দয়াবান [“অনুগত,” NW]।” (যিরমিয় ৩:১২) কিন্তু, ২৫ অধ্যায়ে যেমন উল্লেখ করা আছে যে, বেশির ভাগ ইস্রায়েলীয় মন পরিবর্তন করেনি। বস্তুত, “তাহারা ঈশ্বরের দূতদিগকে পরিহাস করিত, তাঁহার বাক্য তুচ্ছ করিত, ও তাঁহার ভাববাদিগণকে বিদ্রূপ করিত।” ফল কী হয়েছিল? শেষ পর্যন্ত, “আপন প্রজাদের বিরুদ্ধে সদাপ্রভুর ক্রোধ উত্থিত হইল, অবশেষে আর প্রতীকারের উপায় রহিল না।”—২ বংশাবলি ৩৬:১৫, ১৬.
১৭ এই ঘটনা থেকে আমরা কী শিখি? যিহোবার আনুগত্য অন্ধ নয় বা এর সঙ্গে প্রতারণাও করা যায় না। এটা ঠিক যে, যিহোবা ‘প্রেমপূর্ণ-দয়াতে মহান’ আর তিনি করুণা দেখিয়ে আনন্দ পান, যদি তা দেখানোর কোনো ভিত্তি থাকে। কিন্তু, একজন পাপী যখন এতটা দুষ্ট প্রমাণিত হয় যাকে আর শুধরানো যাবে না, তখন কী? সেই ক্ষেত্রে, যিহোবা তাঁর নিজ ধার্মিক মানগুলোর সঙ্গে মিল রেখে চলেন এবং প্রতিকূল বিচার করেন। মোশিকে যেমন বলা হয়েছিল যে, “[যিহোবা] কোনোভাবেই শাস্তি থেকে রেহাই দেবেন না।”—যাত্রাপুস্তক ৩৪:৬, ৭, NW.
১৮, ১৯. (ক) যিহোবা যে দুষ্টদের শাস্তি দেন, তা কীভাবে আনুগত্যের একটা কাজ? (খ) যিহোবার যে-দাসেরা মৃত্যু পর্যন্ত তাড়না ভোগ করেছে, তাদের প্রতি যিহোবা কোন উপায়ে তাঁর আনুগত্য প্রদর্শন করবেন?
১৮ দুষ্টদের যে ঈশ্বর শাস্তি দেন সেটাও আনুগত্যের একটা কাজ। কীভাবে? প্রকাশিত বাক্য বইয়ে যিহোবা সপ্ত দূতকে যে-আজ্ঞা দেন, তাতে একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়: “তোমরা যাও, ঈশ্বরের রোষের ঐ সপ্ত বাটি পৃথিবীতে ঢালিয়া দেও।” তৃতীয় দূত যখন তাঁর বাটি “নদনদী ও জলের উনুই সকলের উপর . . . ঢালিলেন,” তখন সেগুলো রক্তে পরিণত হয়েছিল। এরপর সেই দূত যিহোবাকে বলেন: “হে সাধু [“অনুগত ব্যক্তি,” NW], তুমি আছ ও তুমি ছিলে, তুমি ন্যায়পরায়ণ, কারণ এরূপ বিচারাজ্ঞা করিয়াছ; কেননা উহারা পবিত্রগণের ও ভাববাদীদের রক্তপাত করিয়াছিল; আর তুমি উহাদিগকে পানার্থে রক্ত দিয়াছ; তাহারা ইহার যোগ্য।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।)—প্রকাশিত বাক্য ১৬:১-৬.
যিহোবা আনুগত্যের সঙ্গে সেই সমস্ত ব্যক্তিকে স্মরণ ও পুনরুত্থিত করবেন, যারা এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত অনুগত বলে প্রমাণিত হয়েছে
১৯ লক্ষ করে দেখুন যে, বিচারের সেই বার্তা বলার সময় যিহোবাকে দূত “অনুগত ব্যক্তি” বলে উল্লেখ করেছিলেন। কেন? কারণ দুষ্টদের ধ্বংস করে দেওয়ার মাধ্যমে যিহোবা তাঁর দাসদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করছেন, যাদের অনেকেই মৃত্যু পর্যন্ত তাড়না ভোগ করেছে। আনুগত্যের সঙ্গে, যিহোবা এইরকম ব্যক্তিদের তাঁর স্মৃতিতে জীবন্ত রেখেছেন। তিনি এই মৃত বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের আবারও দেখার জন্য আকাঙ্ক্ষা করেন আর বাইবেল নিশ্চিত করে যে, তাঁর উদ্দেশ্য হল পুনরুত্থানের মাধ্যমে তাদের পুরস্কৃত করা। (ইয়োব ১৪:১৪, ১৫) তাঁর অনুগত দাসেরা মারা গেলে যিহোবা তাদের ভুলে যান না। এর বিপরীতে, “তাঁহার সাক্ষাতে সকলেই জীবিত।” (লূক ২০:৩৭, ৩৮) যারা তাঁর স্মৃতিতে আছে তাদের জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য যিহোবার উদ্দেশ্য তাঁর আনুগত্যের জোরালো প্রমাণ।
যিহোবার অনুগত প্রেম পরিত্রাণের পথ খুলে দেয়
২০. কারা ‘দয়াপাত্র’ এবং কীভাবে যিহোবা তাদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন?
২০ ইতিহাস জুড়ে, যিহোবা বিশ্বস্ত মানুষদের প্রতি উল্লেখযোগ্য আনুগত্য দেখিয়েছেন। সত্যি বলতে কী, হাজার হাজার বছর ধরে, যিহোবা “বিনাশার্থে পরিপক্ব ক্রোধপাত্রদের প্রতি বিপুল সহিষ্ণুতায় ধৈর্য্য” ধরেছেন। কেন? “যেন সেই দয়াপাত্রদের উপরে আপন প্রতাপ-ধন জ্ঞাত করেন, যাহাদিগকে প্রতাপের নিমিত্ত পূর্ব্বে প্রস্তুত করিয়াছেন।” (রোমীয় ৯:২২, ২৩) এই ‘দয়াপাত্ররা’ হল সঠিক প্রবণতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা, যারা খ্রিস্টের রাজ্যে তাঁর সহদায়াদ হওয়ার জন্য পবিত্র আত্মার দ্বারা অভিষিক্ত। (মথি ১৯:২৮) এই দয়াপাত্রদের জন্য পরিত্রাণের পথ খুলে দেওয়ার দ্বারা যিহোবা অব্রাহামের প্রতি অনুগত থেকেছিলেন, যার কাছে তিনি এই প্রতিজ্ঞাত চুক্তিটা করেছিলেন: “তোমার বংশে পৃথিবীর সকল জাতি আশীর্ব্বাদ প্রাপ্ত হইবে; কারণ তুমি আমার বাক্যে অবধান করিয়াছ।”—আদিপুস্তক ২২:১৮.
২১. (ক) যিহোবা কীভাবে ‘বিস্তর লোকের’ প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন, যাদের “মহাক্লেশ” থেকে বেরিয়ে আসার প্রতাশা রয়েছে? (খ) যিহোবার আনুগত্য আপনাকে কী করতে পরিচালিত করে?
২১ যিহোবা ‘বিস্তর লোকের’ প্রতিও একইরকম আনুগত্য দেখান, যাদের “মহাক্লেশ” থেকে বের হয়ে আসার এবং পরমদেশ পৃথিবীতে চিরকাল বেঁচে থাকার প্রত্যাশা রয়েছে। (প্রকাশিত বাক্য ৭:৯, ১০, ১৪) যদিও তাঁর দাসেরা অসিদ্ধ, তবুও যিহোবা আনুগত্যের সঙ্গে তাদের এক পরমদেশ পৃথিবীতে চিরকাল বেঁচে থাকার সুযোগ দিয়েছেন। তিনি কীভাবে তা করেন? মুক্তির মূল্যের মাধ্যমে—যেটা হল যিহোবার আনুগত্যের সবচেয়ে বড় প্রদর্শন। (যোহন ৩:১৬; রোমীয় ৫:৮) যিহোবার আনুগত্য তাদের আকর্ষণ করে, যাদের হৃদয় ধার্মিকতার জন্য ক্ষুধিত। (যিরমিয় ৩১:৩) যিহোবা যে-গভীর আনুগত্য দেখিয়েছেন ও দেখাবেন, সেইজন্য আপনি কি নিজেকে যিহোবার আরও নিকটবর্তী অনুভব করেন না? যেহেতু আমরা যিহোবার নিকটবর্তী হতে চাই, তাই আমরা যেন আনুগত্যের সঙ্গে তাঁকে সেবা করার বিষয়ে আমাদের সংকল্পকে আরও দৃঢ় করে তাঁর প্রেমের প্রতি সাড়া দিই।
a আগ্রহের বিষয় যে, ২ শমূয়েল ২২:২৬ (NW) পদে ‘আনুগত্য’ হিসেবে অনুবাদিত শব্দটিকে অন্যান্য জায়গায় “প্রেমপূর্ণ-দয়া” অথবা “অনুগত প্রেম” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে।