“নীরব থাকিবার কাল”
“ক থা হল রূপোর মতো আর নীরব থাকা হল সোনার মতো।” একটা পুরোনো প্রবাদ বলে, যেটা প্রাচ্যের বলে কথিত আছে। ব্রুয়ার্স ডিকশনারি অভ্ ফ্রেজ আ্যন্ড ফেইব্ল্ অনুসারে, এর ইব্রীয় সমরূপ প্রবাদ হল: “একটি কথার মূল্য যদি এক শেকল হয়, তাহলে নীরব থাকার মূল্য দুই শেকল।” আর প্রাচীন ইস্রায়েলের বিজ্ঞ রাজা শলোমন লিখেছিলেন: “সকল বিষয়েরই সময় আছে, ও আকাশের নীচে সমস্ত ব্যাপারের কাল আছে। . . . নীরব থাকিবার কাল ও কথা কহিবার কাল।”—উপ. ৩:১, ৭.
তাহলে, কখন কথা বলার পরিবর্তে নীরব থাকা উপযুক্ত? “নীরব” শব্দটি বাইবেলে প্রায়ই পাওয়া যায়। যে-প্রসঙ্গে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, তা জীবনের অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে নীরব থাকার যৌক্তিকতা সম্বন্ধে প্রকাশ করে। আসুন আমরা নীরব থাকাকে সম্মান দেখানোর এক চিহ্ন, বিচক্ষণতার প্রমাণ এবং ধ্যান করার এক সহায়ক হিসেবে আরও ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখি।
সম্মান দেখানোর এক চিহ্ন
নীরব থাকা হল সম্মান বা শ্রদ্ধা দেখানোর এক চিহ্ন। ভাববাদী হবক্কূক বলেছিলেন: “সদাপ্রভু আপন পবিত্র মন্দিরে আছেন; সমস্ত পৃথিবী তাঁহার সম্মুখে নীরব থাক।” (হবক্. ২:২০) সত্য উপাসকদের ‘সদাপ্রভুর পরিত্রাণের প্রত্যাশা করিতে, নীরবে অপেক্ষা করিতে’ হবে। (বিলাপ ৩:২৬) গীতরচক গেয়েছিলেন: “সদাপ্রভুর নিকটে নীরব হও, তাঁহার অপেক্ষায় থাক; যে আপন পথে কৃতকার্য্য হয়, তাহার বিষয়ে, যে ব্যক্তি কুসঙ্কল্প করে, তাহার বিষয়ে রুষ্ট হইও না।”—গীত. ৩৭:৭.
আমরা কি কোনো কথা না বলেই যিহোবার প্রশংসা করতে পারি? মাঝে মাঝে আমরা কি সৃষ্টির সৌন্দর্য দেখে এতটাই বিস্ময়াভিভূত হয়ে যাই না যে, আমরা বাক্রুদ্ধ হয়ে যাই? এইরকম চমৎকার বিষয় নিয়ে চিন্তা করা কি মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে প্রশংসা করার এক উপায় নয়? গীতরচক দায়ূদ এই কথাগুলো বলার দ্বারা তার একটি গীত শুরু করেছিলেন: “হে ঈশ্বর, সিয়োনে নীরবে তোমার প্রশংসা করা হয়; আমাদের সব মানত তোমার উদ্দেশে পূরণ করা হবে।”—গীত. ৬৫:১, বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারসন।
যিহোবা যেমন আমাদের সম্মান পাওয়ার যোগ্য, তেমনই তাঁর বাক্যগুলোও আমাদের সম্মান পাওয়ার যোগ্য। উদাহরণস্বরূপ, ঈশ্বরের ভাববাদী মোশি ইস্রায়েল জাতির উদ্দেশে তার বিদায়ি বক্তৃতা দেওয়ার সময়, তিনি ও যাজকরা উপস্থিত সকলকে এই বলে পরামর্শ দিয়েছিলেন: “নীরব হও . . . অতএব তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভুর রবে অবধান করিবে।” ইস্রায়েল সন্তানেরা যখন ঈশ্বরের ব্যবস্থা পাঠ করার জন্য একত্রিত হতো, তখন এমনকী ইস্রায়েলীয় ছোটো ছেলেমেয়েদেরও তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হতো। “তুমি লোকদিগকে, পুরুষ, স্ত্রী, বালক-বালিকা . . . সকলকে একত্র করিবে,” মোশি বলেছিলেন, “যেন তাহারা . . . শিক্ষা পায়।”—দ্বিতীয়. ২৭:৯, ১০; ৩১:১১, ১২.
এটা কতই না উপযুক্ত যে, যিহোবার আধুনিক দিনের উপাসকরাও সম্মানপূর্বক সেই নির্দেশনাগুলো শুনে থাকে, যেগুলো তারা বড়ো বড়ো সম্মেলনসহ খ্রিস্টীয় সমাবেশগুলোতে লাভ করে থাকে! বাইবেলের গুরুত্বপূর্ণ সত্যগুলো যখন মঞ্চ থেকে তুলে ধরা হয়, তখন যদি আমরা অহেতুক একে অন্যের সঙ্গে কথা বলি, তাহলে সেটা কি ঈশ্বরের বাক্য ও তাঁর সংগঠনের প্রতি অসম্মান দেখানো হবে না? কার্যক্রম চলাকালীন সময়টা হল নীরব থাকার ও শোনার সময়।
এমনকী কারো সঙ্গে একান্তে কথা বলার সময়ও, একজন উত্তম শ্রোতা হওয়া সম্মান দেখানোর এক চিহ্ন। উদাহরণস্বরূপ, কুলপতি ইয়োব তার দোষারোপকারীদের বলেছিলেন: “আমাকে শিক্ষা দেও, আমি নীরব হইব।” তারা যখন কথা বলেছিল, তখন ইয়োব নীরব হয়ে শুনতে ইচ্ছুক ছিলেন। আর যখন তার কথা বলার পালা এসেছিল, তখন তিনি অনুরোধ করেছিলেন: “নীরব হও; আমাকে ছাড়, আমিই বলি।”—ইয়োব ৬:২৪; ১৩:১৩.
বিচক্ষণতার প্রমাণ
বাইবেল বলে: “যে ওষ্ঠ দমন করে, সে বুদ্ধিমান” বা বিচক্ষণ। “বুদ্ধিমান” বা বিচক্ষণ ব্যক্তি “নীরব হইয়া থাকে।” (হিতো. ১০:১৯; ১১:১২) যিশু নীরব থাকার দ্বারা কত চমৎকারভাবে বিচক্ষণতা প্রদর্শন করেছিলেন, তা বিবেচনা করুন। তাঁর শত্রুদের দ্বারা সৃষ্ট এক প্রতিকূল পরিবেশে কথা বলে যে কোনো কার্যকারী উদ্দেশ্য সাধিত হবে না তা বুঝতে পেরে “যীশু নীরব রহিলেন।” (মথি ২৬:৬৩) পরবর্তীকালে, পীলাতের সামনে বিচারের সময়, যিশু “কিছুই উত্তর করিলেন না।” বিচক্ষণতার সঙ্গে তিনি তাঁর প্রকাশ্য কাজগুলোকেই এর পক্ষে কথা বলতে দিয়েছিলেন।—মথি ২৭:১১-১৪.
আমাদের জন্যও সেই সময়ে ওষ্ঠকে দমন করা বিজ্ঞতার কাজ, বিশেষত যখন আমরা রেগে যাই। “যে ক্রোধে ধীর, সে বড় বুদ্ধিমান” বা বিচক্ষণ, একটা প্রবাদ বলে, “কিন্তু আশুক্রোধী অজ্ঞানতা তুলিয়া ধরে।” (হিতো. ১৪:২৯) এক কঠিন পরিস্থিতিতে সঙ্গেসঙ্গে উত্তর দেওয়া এমন বেপরোয়া কথাবার্তায় পরিণত হতে পারে, যেটার জন্য পরে আপশোস করতে হয়। এইরকম পরিস্থিতিতে, আমাদের কথাবার্তা হয়তো মূর্খতাপূর্ণ বলে মনে হতে পারে আর এর ফলে আমাদের মনের শান্তি হয়তো বিঘ্নিত হতে পারে।
দুষ্ট লোকেদের উপস্থিতিতে আমাদের ওষ্ঠকে দমন করা হল বিচক্ষণতার কাজ। আমাদের পরিচর্যায় উপহাসকদের মুখোমুখি হলে, নীরব থাকা হয়তো এক উপযুক্ত উত্তর হতে পারে। অধিকন্তু, যখন আমাদের সহছাত্রছাত্রী বা সহকর্মীরা অশ্লীল কৌতুক বা নোংরা কথাবার্তা বলে, তখন তাতে সমর্থন প্রকাশ না করার জন্য নীরব থাকাই কি মাঝে মাঝে বিজ্ঞতার কাজ নয়? (ইফি. ৫:৩) গীতরচক লিখেছিলেন, “যাবৎ আমার সাক্ষাতে দুর্জ্জন থাকে, আমি মুখে জাল্তি বাঁধিয়া রাখিব।”—গীত. ৩৯:১.
একজন “বুদ্ধিমান” বা বিচক্ষণ ব্যক্তি কোনো গোপন বিষয় প্রকাশ করে দেন না। (হিতো. ১১:১২) একজন সত্য খ্রিস্টান অসতর্ক কথাবার্তা বলার দ্বারা গোপন তথ্য ফাঁস করে দেবেন না। বিশেষ করে খ্রিস্টান প্রাচীনরা এই বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকে, যাতে তাদের ওপর মণ্ডলীর সদস্যদের আস্থা বজায় থাকে।
যদিও নীরব থাকার অর্থ হল কোনো কথা না বলা, তবুও এর এক ইতিবাচক প্রভাব থাকতে পারে। ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন ইংরেজ লেখক সিডনি স্মিথ তার সমসাময়িক এক ব্যক্তির সম্বন্ধে লিখেছিলেন: “কখনো কখনো তার ক্ষণিকের নীরবতা, তার কথাবার্তাকে খুবই উপভোগ্য করে তোলে।” প্রকৃতপক্ষে, দুজন বন্ধুর মধ্যে প্রাত্যহিক কথাবার্তার সময় দুজনেরই কথা বলা উচিত। একজন উত্তম কথোপকথনকারী অবশ্যই একজন উত্তম শ্রোতা হবেন।
“বাক্যের বাহুল্যে অধর্ম্মের অভাব নাই,” শলোমন সাবধান করেছিলেন, “কিন্তু যে ওষ্ঠ দমন করে, সে বুদ্ধিমান” বা বিচক্ষণ। (হিতো. ১০:১৯) তাই, যত কম কথা বলা যায়, অবিচক্ষণতা প্রকাশ করার সম্ভাবনা তত কম থাকে। বস্তুতপক্ষে, “মূর্খও নীরব থাকিলে জ্ঞানবান বলিয়া গণিত হয়; যে ওষ্ঠাধর বদ্ধ রাখে, সে বুদ্ধিমান [বলিয়া গণিত]।” (হিতো. ১৭:২৮) তাই, আমরা যেন ‘আমাদের ওষ্ঠাধরের কবাট রক্ষা করিবার’ জন্য যিহোবার কাছে প্রার্থনা করি।—গীত. ১৪১:৩.
ধ্যান করার এক সহায়ক
ধার্মিকতার পথ অনুসরণ করেন এমন একজন সম্বন্ধে শাস্ত্র আমাদেরকে জানায় যে, তিনি ‘ঈশ্বরের ব্যবস্থা দিবারাত্র ধ্যান করেন।’ (গীত. ১:২) এভাবে ধ্যান করার জন্য কোন পরিস্থিতি সবচেয়ে উত্তম?
কুলপতি অব্রাহামের ছেলে ইস্হাক, “সন্ধ্যাকালে ধ্যান করিতে ক্ষেত্রে গিয়াছিলেন।” (আদি. ২৪:৬৩) ধ্যান করার জন্য তিনি এক কোলাহলশূন্য সময় এবং স্থান বেছে নিয়েছিলেন। রাজা দায়ূদ রাতের নীরব প্রহরে ধ্যান করতেন। (গীত. ৬৩:৬) সিদ্ধ পুরুষ যিশু, লোকেদের কলরব থেকে দূরে, পাহাড়ে, প্রান্তরে এবং অন্যান্য নির্জন স্থানে গিয়ে তাঁর একাকী থাকার ও ধ্যান করার প্রয়োজনীয়তা পূরণ করার প্রাণপণ চেষ্টা করতেন।—মথি ১৪:২৩; লূক ৪:৪২; ৫:১৬.
নীরব থাকার উপকারী প্রভাবগুলো উপেক্ষা করা যায় না। নীরব থাকা আমাদেরকে আত্মপরীক্ষা করার উপযুক্ত এক পরিবেশ প্রদান করে, যা আত্মোন্নতির জন্য এক অত্যাবশ্যক চাহিদা। নীরব থাকা মনের শান্তি বৃদ্ধি করতে পারে। কোলাহলশূন্য সময়ে ধ্যান করা আমাদের মধ্যে বিনয়ী মনোভাব ও নম্রতা জাগিয়ে তুলতে এবং জীবনের প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের উপলব্ধিকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
যদিও নীরব থাকা ভালো কিন্তু “কথা কহিবার কাল”-ও রয়েছে। (উপ. ৩:৭) বর্তমানে সত্য উপাসকরা “সমুদয় জগতে” ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করায় ব্যস্ত। (মথি ২৪:১৪) এর ফলে উপাসকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দের কোলাহলও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। (মীখা ২:১২) তাই যেকোনোভাবেই হোক, আসুন আমরা সেই লোকেদের মধ্যে থাকি, যারা উদ্যোগের সঙ্গে রাজ্যের সুসমাচার ঘোষণা করছে এবং ঈশ্বরের চমৎকার কাজগুলো সম্বন্ধে কথা বলছে। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনধারাও যেন এই সচেতনতাকে প্রতিফলিত করে যে, নীরব থাকা কখনো কখনো সোনার মতো।
[৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
আমাদের খ্রিস্টীয় সভাগুলো চলার সময় আমাদের শোনা ও শেখা উচিত
[৪ পৃষ্ঠার চিত্র]
আমাদের পরিচর্যায় খারাপ কথাবার্তার মুখোমুখি হলে নীরব থাকা হয়তো উপযুক্ত উত্তর হতে পারে
[৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
নীরবতা হল ধ্যান করার জন্য সহায়ক