বাইবেলের দৃষ্টিভঙ্গি
পশুপাখিদের সঙ্গে নিষ্ঠুরতা—এটা কি অন্যায়?
মধ্য আমেরিকার এক খেলার মাঠে সবাই একটা লাল ও একটা সাদা মোরগের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। লাল মোরগটার পায়ে একটা ধারাল ব্লেড বাঁধা ছিল আর ওটা সাদা মোরগটার ওপর ঝাপিয়ে পড়তেই জনতা চিৎকার করে ওঠে। একজন রেফারি সেই মোরগ দুটোকে ওঠান। সাদা মোরগটা ততক্ষণে নিথর হয়ে গেছে, মরে গেছে আর রক্তে রক্তে ভরে গেছে। আর এরপরই মোরগ লড়াই শেষ হয়ে যায়।
দক্ষিণ ফিলিপাইনে, দুটো ঘোড়াকে লড়াইয়ের জন্য লেলিয়ে দেওয়া হয়। এই লড়াইয়ে ঘোড়াগুলো দাঁত দিয়ে একটা আরেকটার কানে, গলায়, নাকে এবং দেহের বিভিন্ন জায়গায় কামড়াবে আর দর্শকেরা এই বীভৎস দৃশ্য খুব মজা করে দেখবেন। দুটো ঘোড়াই হয়তো জীবিত অবস্থায় মল্লভূমি থেকে ফিরে আসবে কিন্তু তাদের মধ্যে অন্তত একটা হয়তো পঙ্গু হয়ে যাবে নয়তো বা অন্ধ হয়ে যাবে বা কোন আঘাতের কারণে একসময় মারাই যাবে।
রাশিয়ায় দুটো কুকুর একটা আরেকটাকে আক্রমণ করছে। কিছু সময়ের মধ্যেই তাদের চোখ বেরিয়ে আসে, কান ছিঁড়ে যায়, তাদের একটা দুটো পা ভেঙে যায় আর শরীরের ক্ষত থেকে অঝোরে রক্ত পড়তে থাকে।
শত শত বছর ধরে মানুষ খেলাধুলোর নামে পশুপাখিকে লড়াইয়ে নামিয়েছে কিন্তু প্রায়ই এর পেছনে মূল কারণ হল জুয়াখেলা। এছাড়াও এই নিষ্ঠুরতার মধ্যে রয়েছে ষাঁড়ের লড়াই, শিয়াল শিকার করা আর সেইসঙ্গে মাকড়সার লড়াই। এছাড়া, বিজ্ঞানের নামেও অনেক পশুপাখির ওপর অত্যাচার করা হয়ে থাকে। আর জেনেশুনে বা না জেনেই হোক, অগণিত পশুপাখি তাদের মনিবের অত্যাচার-অবহেলার শিকার হয়।
কোন কোন দেশে, এমন কিছু আইন প্রণয়ন করা হয়েছে যাতে লোকেরা পশুপাখির সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে ও তাদের ওপর অত্যাচার না করে। বিগত ১৬৪১ সালে, ম্যাসাচুসেটস্ বে কলোনি এই সম্বন্ধে “দ্যা বডি অফ লিবারটিস্” নামে আইন প্রণয়ন করেছিল, যেটা জানায়: “কেউই অবোধ প্রাণীদের প্রতি কোন রকম অত্যাচার অথবা নিষ্ঠুর আচরণ করবেন না কারণ পশুপাখি মানুষের কাজে আসে।” তখন থেকেই পশুপাখির সঙ্গে যেন নিষ্ঠুর ব্যবহার না করা হয় তারজন্য আইন প্রণয়ন করা হয়েছে এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংঘ গড়ে তোলা হয়েছে।
তারপরও, যেমন ওপরে বলা হয়েছে অনেকে যারা পশুপাখির লড়াইকে উৎসাহ দেন, তারা মনে করেন না যে তারা পশুপাখির সঙ্গে কোনরকম নিষ্ঠুর ব্যবহার করছেন। কেউ কেউ দাবি করেন যে তারা পশুপাখিকে ভালবাসেন অথচ সেগুলোকে তারা নিষ্ঠুরভাবে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলেন। মোরগ লড়াই পছন্দ করেন এমন লোকেরা বলেন যে আমাদের মোরগের আয়ু লম্বা। বাকি মোরগদের তো লোকেরা রান্না করে খেয়ে নেয়—মিথ্যে সান্ত্বনার কত বড়ই না অজুহাত!
নিষ্ঠুরতা কেন অন্যায়?
ঈশ্বর আমাদের উপকারের জন্য পশুপাখিদের দিয়েছেন। বাইবেলের নীতি অনুযায়ী আমরা খাদ্য ও বস্ত্রের জন্য অথবা আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য পশুপাখি হত্যা করতে পারি। (আদিপুস্তক ৩:২১; ৯:৩; যাত্রাপুস্তক ২১:২৮) কিন্তু, জীবন ঈশ্বরের কাছে পবিত্র। জীবনের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য আমাদের পশুপাখিদের ওপর কর্তৃত্ব করার সময় অবশ্যই ভেবেচিন্তে তা করতে হবে। বাইবেল নিম্রোদ নামে একজন ব্যক্তির সম্বন্ধে নিন্দার সঙ্গে বলে, যে শুধু মজা করার জন্য পশুপাখি এবং হয়তো মানুষও হত্যা করতো।—আদিপুস্তক ১০:৯.
ঈশ্বর যে পশুপাখিদের জন্য চিন্তা করেন তা যীশু এই কথাগুলো বলে জানিয়েছিলেন: “পাঁচটী চড়াই পাখী কি দুই পয়সায় বিক্রয় হয় না? আর তাহাদের মধ্যে একটীও ঈশ্বরের দৃষ্টিগোচরে গুপ্ত নয়।” (লূক ১২:৬) যখন একটা দুষ্টতাপূর্ণ নগরের লোকেরা অনুতপ্ত হয়েছিলেন তখন ঈশ্বর সেটাকে আর ধ্বংস করেননি আর তিনি নিজে বলেছিলেন: “আমি কি নীনবীর প্রতি, ঐ মহানগরের প্রতি, দয়ার্দ্র হইব না? তথায় এমন এক লক্ষ বিংশতি সহস্রের অধিক মনুষ্য আছে, . . . অনেক পশুও আছে।” (যোনা ৪:১১) স্পষ্টতই, তিনি পশুপাখিদেরকে কেবল খেয়ালখুশি মতো ব্যবহার করতে এবং যখন ইচ্ছা তখন ফেলে দেওয়ার মতো বস্তু হিসাবে দেখেন না।
ইস্রায়েলীয়দের ব্যবস্থা দেওয়ার সময়, ঈশ্বর তাদেরকে পশুপাখিদের ঠিক করে যত্ন নেওয়ার জন্য শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যেন তারা পথহারা পশুকে তার মনিবের কাছে ফিরিয়ে দেয় এবং বিপদাপন্ন পশুকে সাহায্য করে। (যাত্রাপুস্তক ২৩:৪, ৫) মানুষের মতো পশুপাখিরাও বিশ্রামবার থেকে উপকৃত হতো। (যাত্রাপুস্তক ২৩:১২) গবাদি পশুর সঙ্গে সঠিক ব্যবহার করার জন্যও ব্যবস্থা ছিল। (দ্বিতীয় বিবরণ ২২:১০; ২৫:৪) সুতরাং এটা স্পষ্ট যে পশুপাখিদের যত্ন নেওয়া ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো কিন্তু তাদের শোষণ করা হতো না।
হিতোপদেশ ১২:১০ পদ পরিষ্কারভাবে ঈশ্বরের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করে: “ধার্ম্মিক আপন পশুর প্রাণের বিষয় চিন্তা করে; কিন্তু দুষ্টদের করুণা নিষ্ঠুর।” একটা বাইবেল কমেন্টারি এই পদটাকে এইভাবে বলেন: “একজন ধার্মিক ব্যক্তি এমনকি নির্বাক পশুপাখির প্রতিও দয়া দেখান কিন্তু একজন দুষ্ট ব্যক্তি মনে মনে ভাবেন যে তিনি খুবই দয়ালু কিন্তু তিনি নিষ্ঠুর প্রকৃতির হন।”—উইলিয়াম মেকডোনাল্ড দ্বারা প্রণীত বিলিভার্স্ বাইবেল কমেন্টারি।
ধার্মিক ব্যক্তিরা পশুপাখিদের ভালবাসেন, তাদের ভাল করে দেখাশোনা করেন, তাদের প্রয়োজন সম্বন্ধে জানার চেষ্টা করেন। একজন দুষ্ট ব্যক্তি হয়তো মুখে বলে যে পশুপাখিদের সে খুব ভালবাসে কিন্তু প্রয়োজনের সময়ও সে “করুণা”-র বদলে নিষ্ঠুরতাই দেখায়। তার কাজগুলোই বলে দেয় যে তার মনে করুণা নেই সে শুধু তার লাভের কথাই ভাবে। পয়সা রোজগারের জন্য যারা পশুপাখিদেরকে লড়াই করার জন্য লেলিয়ে দেয় তাদের জন্য এই কথা কতই না সত্যি!
পশুদের জন্য মুক্তি
এটা সত্যি যে ঈশ্বরের আদি উদ্দেশ্য ছিল যেন মানুষ ‘সমুদ্রের মৎস্যগণের উপরে, আকাশের পক্ষিগণের উপরে, এবং ভূমিতে গমনশীল যাবতীয় জীবজন্তুর উপরে কর্ত্তৃত্ব করে।’ (আদিপুস্তক ১:২৮) তিনি কখনই চাননি যে পশুপাখিদের সঙ্গে নিষ্ঠুরতা করা হোক। পশুপাখির উপর অমানবীয় আচরণ চিরকাল থাকবে না। আমাদের এটা বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে ঈশ্বর সমস্ত দুর্দশাকে শেষ করবেন। কিন্তু কিভাবে?
ঈশ্বর প্রতিজ্ঞা করেন যে তিনি দুষ্ট ও নিষ্ঠুর লোকেদের ধ্বংস করবেন। (হিতোপদেশ ২:২২) পশুপাখিদের সম্বন্ধে হোশেয় ২:১৮ বলে: “সেই দিন আমি লোকদের নিমিত্ত মাঠের পশু, আকাশের পক্ষী ও ভূমির সরীসৃপ সকলের সহিত নিয়ম করিব; . . . ও তাহাদিগকে নিশ্চিন্তে শয়ন করাইব।” শান্তি আর সুখের সেই পৃথিবীতে বাস করা কতই না চমৎকার হবে যখন শুধু মানুষই নয় কিন্তু পশুপাখিরাও আনন্দের সঙ্গে বেঁচে থাকবে!
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
ফ্রান্সিসকো গোয়ার চিত্র “এক গ্রামে ষাঁড়ের লড়াই”