“তোমার পরিকল্পনা সফল হবে”
দায়ূদ তার রচিত একটা গীতে প্রার্থনা করেছিলেন: “হে ঈশ্বর, আমাতে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ সৃষ্টি কর, আমার অন্তরে সুস্থির আত্মাকে নূতন করিয়া দেও। তোমার পরিত্রাণের আনন্দ আমাকে পুনরায় দেও, ইচ্ছুক আত্মা দ্বারা আমাকে ধরিয়া রাখ।” (গীতসংহিতা ৫১:১০, ১২) বৎশেবার সঙ্গে পাপ করার পর, অনুতপ্ত দায়ূদ এখানে যা সঠিক, তা করার জন্য তার হৃদয়কে পরিষ্কৃত করার এবং তার মধ্যে আত্মা বা মানসিক প্রবণতা দেওয়ার জন্য যিহোবা ঈশ্বরের কাছে বিনতি করেছিলেন।
যিহোবা কি আসলেই আমাদের মধ্যে এক নতুন হৃদয় সৃষ্টি করেন, এমনকি আমাদের মধ্যে এক নতুন ও ইচ্ছুক আত্মা দেন? কিংবা এক বিশুদ্ধ হৃদয় কি এমন কিছু, যা অর্জন ও সুরক্ষা করার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা করতে হয়? “সদাপ্রভুই চিত্তের পরীক্ষা করেন” কিন্তু আমাদের হৃদয়ে কী হচ্ছে না হচ্ছে, সেই বিষয়ে পরীক্ষা করার জন্য তিনি নিজেকে কতটা জড়িত করেন? (হিতোপদেশ ১৭:৩; যিরমিয় ১৭:১০) আমাদের জীবন, উদ্দেশ্যগুলো ও কার্যকলাপকে তিনি কতটা প্রভাবিত করেন?
হিতোপদেশ ১৬ অধ্যায়ের প্রথম নয়টি পদ আমাদের দেখায় যে, কীভাবে আমরা আমাদের জীবনকে ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণের অধীনে নিয়ে আসতে পারি, যাতে ‘আমাদের পরিকল্পনা সফল হয়।’ (হিতোপদেশ ১৬:৩, বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারসন) ১০ থেকে ১৫ পদ একজন রাজা বা শাসকের দায়িত্ব সম্বন্ধে মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করে।
“মনে মনে নানা সঙ্কল্প”—কার দ্বারা?
“মনুষ্য মনে মনে নানা সঙ্কল্প করে,” হিতোপদেশ ১৬:১ক পদ বলে। স্পষ্টতই, ‘মনে মনে নানা সঙ্কল্প করা’ আমাদের দায়িত্ব। যিহোবা অলৌকিকভাবে আমাদের হৃদয়কে প্রস্তুত করেন না অথবা আমাদের এক ইচ্ছুক আত্মা প্রদানও করেন না। তাঁর বাক্য বাইবেল থেকে সঠিক জ্ঞান অর্জন করার, আমরা যা শিখি সেগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার এবং আমাদের চিন্তাভাবনাকে তাঁর চিন্তাভাবনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা করতে হবে।—হিতোপদেশ ২:১০, ১১.
কিন্তু, “বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ” ও ‘নূতন আত্মার’ জন্য দায়ূদের অনুরোধ দেখায় যে, তিনি তার পাপপূর্ণ প্রবণতা ও তার হৃদয়কে পরিষ্কৃত করার জন্য ঐশিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। অসিদ্ধ হওয়ায় আমরা হয়তো ‘মাংসের কার্য্য সকলে’ রত হওয়ার জন্য প্রলোভিত হতে পারি। (গালাতীয় ৫:১৯-২১) ‘[আমাদের] পৃথিবীস্থ আপন আপন অঙ্গ সকল যথা, বেশ্যাগমন, অশুচিতা, মোহ, কুঅভিলাষ, এবং লোভ মৃত্যুসাৎ’ করার জন্য যিহোবার সাহায্য প্রয়োজন। (কলসীয় ৩:৫) আমরা যেন প্রলোভনগুলোর বশীভূত হওয়া এড়াতে ও আমাদের হৃদয় থেকে পাপপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো দূর করতে পারি, সেই কারণে তাঁর সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করা কতই না গুরুত্বপূর্ণ!
আমরা কি অন্যদেরকে তাদের হৃদয়ে “নানা সঙ্কল্প” করতে সাহায্য করতে পারি? “কেহ কেহ অবিবেচনার কথা বলে, খড়্গাঘাতের মত,” বাইবেল বলে, “কিন্তু জ্ঞানবানদের জিহ্বা স্বাস্থ্যস্বরূপ।” (হিতোপদেশ ১২:১৮) কখন আমাদের জিহ্বা অন্যদের জন্য স্বাস্থ্যস্বরূপ হয়? কেবলমাত্র তখনই, যখন আমাদের “জিহ্বার উত্তর সদাপ্রভু হইতে হয়” অর্থাৎ যখন আমরা বাইবেলের সত্য সম্বন্ধে সঠিক কথা বলি।—হিতোপদেশ ১৬:১খ.
“অন্তঃকরণ সর্ব্বাপেক্ষা বঞ্চক, তাহার রোগ অপ্রতিকার্য্য,” বাইবেল বলে। (যিরমিয় ১৭:৯) আমাদের রূপক হৃদয়ের অজুহাত দেখানোর এবং আত্মপ্রতারণা করার প্রবণতা রয়েছে। এই বিপদ সম্বন্ধে সতর্ক করে প্রাচীন ইস্রায়েলের রাজা শলোমন বলেন: “মানুষের সমস্ত পথ নিজের দৃষ্টিতে বিশুদ্ধ; কিন্তু সদাপ্রভুই আত্মা সকল তৌল করেন।”—হিতোপদেশ ১৬:২.
আত্মপ্রিয় মনোভাব হয়তো আমাদের ভুলগুলোর জন্য অজুহাত দেখাতে, আমাদের ব্যক্তিত্বের অনাকাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যগুলোকে লুকাতে এবং আমাদের নিজেদের মন্দতাকে তুচ্ছ করতে চালিত করে। কিন্তু, যিহোবার সঙ্গে প্রতারণা করা যায় না। তিনি আত্মা সকল তৌল করেন। একজন ব্যক্তির আত্মা হল তার প্রবল মানসিক প্রবণতা এবং তা হৃদয়ের সঙ্গে যুক্ত। এটার গড়ে ওঠা অনেকটা নির্ভর করে রূপক হৃদয়ের কাজের ওপর, যার অন্তর্ভুক্ত এই ধরনের বিষয় যেমন, আমাদের চিন্তাভাবনা, আবেগঅনুভূতি ও উদ্দেশ্যগুলো। আত্মা হল এমন কিছু, যা ‘যিনি চিত্তের পরীক্ষা করেন,’ তিনি তৌল করেন এবং তাঁর বিচার পক্ষানুরাগ ও পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত। আমরা আমাদের আত্মাকে রক্ষা করে বিজ্ঞ হই।
“তোমার কার্য্যের ভার সদাপ্রভুতে অর্পণ কর”
পরিকল্পনা করার সঙ্গে চিন্তা করার প্রক্রিয়া—আমাদের হৃদয়ের এক কাজ—জড়িত। সাধারণত বিভিন্ন পরিকল্পনা অনুসরণ করেই কাজ করা হয়ে থাকে। আমরা কি আমাদের প্রচেষ্টায় সফল হব? শলোমন বলেন: “তুমি যা-ই কর না কেন তার ভার সদাপ্রভুর ওপর ফেলে দাও; তাতে তোমার পরিকল্পনা সফল হবে।” (হিতোপদেশ ১৬:৩) আমরা যাই করি না কেন তার ভার যিহোবাতে ফেলে দেওয়ার বা অর্পণ করার অর্থ হল তাঁর ওপর নির্ভর করা, তাঁর ওপর আস্থা রাখা, তাঁর কর্তৃত্বের বশীভূত হওয়া—রূপকভাবে বলতে গেলে, আমাদের কাঁধের ভার নামিয়ে তাঁর কাঁধে অর্পণ করা। গীতরচক গেয়েছিলেন: “তোমার গতি সদাপ্রভুতে অর্পণ কর, তাঁহাতে নির্ভর কর, তিনিই কার্য্য সাধন করিবেন।”—গীতসংহিতা ৩৭:৫.
কিন্তু, আমাদের পরিকল্পনাগুলো সফল হওয়ার জন্য সেগুলো অবশ্যই ঈশ্বরের বাক্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হবে এবং সঠিক উদ্দেশ্যগুলো থেকে উদ্ভূত হতে হবে। অধিকন্তু, আমাদের সাহায্য ও সমর্থনের জন্য যিহোবার কাছে প্রার্থনা করা এবং বাইবেলের উপদেশ অনুসরণ করার জন্য বিবেকবুদ্ধি খাটিয়ে আমাদের যথাসাধ্য করা উচিত। বিশেষভাবে আমরা যখন বিভিন্ন পরীক্ষা বা সমস্যার মুখোমুখি হই, তখন ‘সদাপ্রভুতে আমাদের ভার অর্পণ করা’ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ‘তিনিই আমাদিগকে ধরিয়া রাখিবেন।’ বস্তুতপক্ষে, ‘তিনি কখনও ধার্ম্মিককে বিচলিত হইতে দিবেন না।’—গীতসংহিতা ৫৫:২২.
“সদাপ্রভু সকলই স্ব স্ব উদ্দেশ্যে করিয়াছেন”
যিহোবার ওপর আমাদের কাজের ভার অর্পণ করার ফল আর কী হবে? “সদাপ্রভু সকলই স্ব স্ব উদ্দেশ্যে করিয়াছেন,” বিজ্ঞ রাজা বলেন। (হিতোপদেশ ১৬:৪ক) নিখিলবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা একজন উদ্দেশ্যপরায়ণ ঈশ্বর। আমরা যা-ই করি না কেন, সেটা যখন তাঁর ওপর অর্পণ করি, তখন আমাদের জীবন উদ্দেশ্যপূর্ণ ও অর্থপূর্ণ কাজে পরিপূর্ণ হয়, নিষ্ফল বা অসার হয় না। আর এই পৃথিবী এবং এর মানুষের জন্য যিহোবার উদ্দেশ্য চিরস্থায়ী। (ইফিষীয় ৩:১১) তিনি পৃথিবী গঠন করেছিলেন এবং এটাকে “বাসস্থানার্থে” সৃষ্টি করেছিলেন। (যিশাইয় ৪৫:১৮) অধিকন্তু, তিনি আদিতে এই পৃথিবীতে মানবজাতির জন্য যে-উদ্দেশ্য করেছিলেন, তা বাস্তব হবেই হবে। (আদিপুস্তক ১:২৮) সত্য ঈশ্বরের প্রতি উৎসর্গীকৃত এক জীবন কখনো শেষ হবে না এবং চিরকাল অর্থপূর্ণ থাকবে।
যিহোবা “দুষ্টকেও দুর্দ্দশাদিনের নিমিত্ত” সৃষ্টি করেছেন। (হিতোপদেশ ১৬:৪খ) তিনি দুষ্টদের সৃষ্টি করেননি কারণ “তাঁহার কর্ম্ম সিদ্ধ।” (দ্বিতীয় বিবরণ ৩২:৪) কিন্তু, তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের অস্তিত্বে আসতে ও থাকতে দিয়েছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি তাঁর প্রতিকূল বিচার কার্যকর করা উপযুক্ত বলে বিবেচনা করেন। উদাহরণস্বরূপ, যিহোবা মিসরের রাজা ফরৌণকে বলেছিলেন: “আমি এই জন্যই তোমাকে স্থাপন করিয়াছি, যেন আমার প্রভাব তোমাকে দেখাই ও সমস্ত পৃথিবীতে আমার নাম কীর্ত্তিত হয়।” (যাত্রাপুস্তক ৯:১৬) দশটা আঘাত এবং লোহিত সাগরে ফরৌণ ও তার বাহিনীর ধ্বংস নিশ্চিতভাবেই ঈশ্বরের অতুলনীয় ক্ষমতার স্মরণীয় প্রদর্শন।
এ ছাড়া, যিহোবা বিষয়গুলোকে এমন উপায়ে পরিচালনা করতে পারেন যে, দুষ্টরা অজান্তে তাঁর উদ্দেশ্যের জন্য কাজ করে। গীতরচক বলেছিলেন: “মনুষ্যের ক্রোধ তোমার স্তব করিবে; তুমি [সদাপ্রভু] ক্রোধের অবশেষ দ্বারা কটিবন্ধন করিবে।” (গীতসংহিতা ৭৬:১০) যিহোবা হয়তো তাঁর দাসদের প্রতি তাঁর শত্রুদেরকে ক্রোধ প্রকাশ করতে দিতে পারেন—কিন্তু শুধুমাত্র সেই পর্যন্ত, যতটুকু তাঁর লোকেদের শাসন করার জন্য আবশ্যক আর এভাবে তিনি তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেন। অতিরিক্তটুকু যিহোবা নিজের ওপর নিয়ে নেন।
যদিও যিহোবা তাঁর নম্র দাসদের সমর্থন করেন কিন্তু গর্বিত ও উদ্ধতদের বিষয়ে কী বলা যায়? “যে কেহ হৃদয়ে গর্ব্বিত, সে সদাপ্রভুর ঘৃণাস্পদ,” ইস্রায়েলের রাজা বলেন। “হস্তে হস্ত দিলেও সে অদণ্ডিত থাকিবে না।” (হিতোপদেশ ১৬:৫) যারা “হৃদয়ে গর্বিত,” তারা হয়তো পরস্পরকে সমর্থন করায় এক হতে পারে কিন্তু তারা শাস্তি এড়াতে পারবে না। তাই, আমরা যতই জ্ঞানী বা যোগ্য হই না কেন অথবা আমাদের যে-বিশেষ সুযোগগুলোই থাকুক না কেন, নম্রতার আত্মা গড়ে তোলার মাধ্যমে আমরা বিজ্ঞ হই।
“সদাপ্রভুর ভয়ে”
পাপে জন্ম লাভ করায় আমরা স্বভাবতই ভুল করি। (রোমীয় ৩:২৩; ৫:১২) মন্দ পথে পরিচালিত করবে এমন পরিকল্পনাগুলো করা এড়ানোর জন্য কী আমাদের সাহায্য করবে? হিতোপদেশ ১৬:৬ পদ বলে: “দয়া ও সত্যে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হয়, আর সদাপ্রভুর ভয়ে মনুষ্য মন্দ হইতে সরিয়া যায়।” যদিও তাঁর দয়া বা প্রেমপূর্ণ-দয়া ও সত্যতার দ্বারা যিহোবা আমাদের পাপের প্রায়শ্চিত করেন বা তা দূর করে দেন, কিন্তু যিহোবার প্রতি ভয়ই আমাদেরকে পাপ করা থেকে বিরত করে। ঈশ্বরের জন্য ভালবাসা ও তাঁর প্রেমপূর্ণ-দয়ার প্রতি উপলব্ধিবোধ ছাড়াও আমরা যে তাঁকে অসন্তুষ্ট করে ফেলার ব্যাপারে ভয় গড়ে তুলি, তা কতই না গুরুত্বপূর্ণ!
ঈশ্বরের প্রতি ভয় তখনই আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করে, যখন আমরা ঈশ্বরের ভয়ংকর শক্তির জন্য শ্রদ্ধা ও সম্মান গড়ে তুলি। সৃষ্টির মধ্যে তাঁর যে-শক্তি প্রতিফলিত হয়, তা নিয়ে একটু চিন্তা করুন! ঈশ্বরের সৃষ্টির কাজে যে-শক্তি প্রকাশিত হয়েছে, তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া কুলপতি ইয়োবকে তার চিন্তাভাবনা পুনঃসমন্বয় করতে সাহায্য করেছিল। (ইয়োব ৪২:১-৬) তাঁর লোকেদের সঙ্গে যিহোবার আচরণের বিবরণগুলো সম্বন্ধে আমরা যখন পড়ি ও চিন্তা করি, যেমনটা বাইবেলে লিপিবদ্ধ রয়েছে, তখন আমরা কি একইভাবে প্রভাবিত হই না? গীতরচক গেয়েছিলেন: “চল, ঈশ্বরের ক্রিয়া সকল দেখ; মনুষ্য-সন্তানদের বিষয়ে তিনি স্বকর্ম্মে ভয়াবহ।” (গীতসংহিতা ৬৬:৫) যিহোবার প্রেমপূর্ণ-দয়া হালকা করে দেখার মতো কোনো বিষয় নয়। ইস্রায়েলীয়রা যখন ‘বিদ্রোহী হইয়া তাঁহার পবিত্র আত্মাকে শোকাকুল করিত, তাহাতে সদাপ্রভু ফিরিয়া তাহাদের শত্রু হইলেন, আপনি তাহাদের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন।’ (যিশাইয় ৬৩:১০) অন্যদিকে, “মানুষের পথ যখন সদাপ্রভুর সন্তোষজনক হয়, তখন তিনি তাহার শত্রুদিগকেও তাহার প্রণয়ী করেন [“তার সংগে শান্তিতে বাস করান,” বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারসন]।” (হিতোপদেশ ১৬:৭) যিহোবার প্রতি ভয় কত সুরক্ষাই না করে!
“ধার্ম্মিকতার সহিত অল্পও ভাল, তথাপি অন্যায়ের সহিত প্রচুর আয় ভাল নয়,” বিজ্ঞ রাজা বলেন। (হিতোপদেশ ১৬:৮) হিতোপদেশ ১৫:১৬ পদ বলে: “সদাপ্রভুর ভয়ের সহিত অল্পও ভাল, তবু উদ্বেগের সহিত প্রচুর ধন ভাল নয়।” এক ধার্মিক পথে থাকার জন্য ঈশ্বরের প্রতি সশ্রদ্ধ ভয় থাকা অপরিহার্য।
“মনুষ্যের মন আপন পথের বিষয় সঙ্কল্প করে”
মানুষকে নৈতিক দিক দিয়ে স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছিল, তারা ভাল-মন্দ বাছাই করতে সমর্থ। (দ্বিতীয় বিবরণ ৩০:১৯, ২০) আমাদের রূপক হৃদয়ের বিভিন্ন বিকল্প বিবেচনা করার এবং সেগুলোর মধ্যে থেকে এক বা একাধিক বিষয়ে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার ক্ষমতা রয়েছে। বাছাই করা যে আমাদের নিজেদের দায়িত্ব, তা ইঙ্গিত করে শলোমন বলেন: “মনুষ্যের মন আপন পথের বিষয় সঙ্কল্প করে।” তা করার পর, “সদাপ্রভু তাহার পাদবিক্ষেপ স্থির করেন।” (হিতোপদেশ ১৬:৯) যিহোবা যেহেতু আমাদের পদক্ষেপকে পরিচালনা করতে পারেন, তাই আমরা যদি ‘আমাদের পরিকল্পনা সফল করায়’ তাঁর সাহায্য খুঁজি, তা হলে আমরা বিজ্ঞতার সঙ্গে কাজ করছি।
আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ করেছি যে, হৃদয় হল বঞ্চক এবং মিথ্যা যুক্তি করতে সমর্থ। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি হয়তো পাপ করে ফেলতে পারেন এবং তার হৃদয় হয়তো অজুহাতের আশ্রয় নিতে পারে। তার পাপপূর্ণ পথ পরিত্যাগ করার পরিবর্তে এই ব্যক্তি হয়তো যুক্তি করতে পারেন যে, ঈশ্বর প্রেমময়, দয়ালু, করুণাময় ও ক্ষমাশীল। এই ধরনের একজন ব্যক্তি মনে মনে বলেন: “ঈশ্বর ভুলিয়া গিয়াছেন, তিনি মুখ লুকাইয়াছেন, কখনও দেখিবেন না।” (গীতসংহিতা ১০:১১) কিন্তু, ঈশ্বরের করুণার অপব্যবহার করা অনুপযুক্ত এবং বিপদজনক।
“খাটি তরাজু ও নিক্তি সদাপ্রভুরই”
একজন মানুষের হৃদয় ও কার্যকলাপ থেকে মনোযোগ পরিবর্তিত করে একজন রাজার প্রতি নির্দেশ করে শলোমন বলেন: “রাজার ওষ্ঠে ঐশিক বিচারাজ্ঞা থাকে, বিচারে তাঁহার মুখ সত্যলঙঘন করিবে না।” (হিতোপদেশ ১৬:১০) এটা নিশ্চিতভাবেই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত রাজা যিশু খ্রিস্টের প্রতি সত্য হবে। এই পৃথিবীর ওপর তাঁর শাসন ঐশিক ইচ্ছার সঙ্গে মিল রেখে হবে।
ন্যায়বিচার ও ধার্মিকতার উৎসকে শনাক্ত করে বিজ্ঞ রাজা বলেন: “খাটি তরাজু ও নিক্তি সদাপ্রভুরই; থলিয়ার বাটখারা সকল তাঁহার কৃত বস্তু।” (হিতোপদেশ ১৬:১১) যিহোবা খাঁটি তরাজু বা দাঁড়িপাল্লা ও নিক্তি জোগান। এই ধরনের মানদণ্ড একজন রাজার নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী নির্ধারিত হবে না। পৃথিবীতে থাকাকালীন যিশু বলেছিলেন: “আমি আপনা হইতে কিছুই করিতে পারি না; যেমন শুনি তেমনি বিচার করি; আর আমার বিচার ন্যায্য, কেননা আমি আপনার ইচ্ছা পূর্ণ করিতে চেষ্টা করি না, কিন্তু আমার প্রেরণকর্ত্তার ইচ্ছা পূর্ণ করিতে চেষ্টা করি।” আমরা সেই পুত্রের কাছ থেকে নিখুঁত ন্যায়বিচার আশা করতে পারি, যাঁকে পিতা ‘সমস্ত বিচার-ভার দিয়াছেন।’—যোহন ৫:২২, ৩০.
সেই রাজা, যিনি যিহোবাকে প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁর কাছ থেকে আরও কী আশা করা যেতে পারে? “দুষ্ট আচরণ রাজাদের ঘৃণাস্পদ,” ইস্রায়েলের রাজা বলেন, “কারণ ধার্ম্মিকতায় সিংহাসন স্থির থাকে।” (হিতোপদেশ ১৬:১২) মশীহ রাজ্য ঈশ্বরের ধার্মিক নীতিগুলোর দ্বারা পরিচালিত। ‘দুষ্টতার সিংহাসনের’ সঙ্গে এটির কোনো মিত্রতা নেই।—গীতসংহিতা ৯৪:২০; যোহন ১৮:৩৬; ১ যোহন ৫:১৯.
একজন রাজার অনুগ্রহ অর্জন
একজন মহান রাজার প্রজাদের কীভাবে সাড়া দেওয়া উচিত? শলোমন বলেন: “ধর্ম্মশীল ওষ্ঠাধর রাজগণের প্রিয়, তাঁহারা ন্যায়বাদীকে ভালবাসেন। রাজার ক্রোধ মৃত্যুর দূতগণের ন্যায়; কিন্তু জ্ঞানবান লোক তাহা শান্ত করে।” (হিতোপদেশ ১৬:১৩, ১৪) আজকে যিহোবার উপাসকরা এই বাক্যগুলো হৃদয়ে গ্রহণ করে এবং নিজেদেরকে রাজ্যের প্রচার ও শিষ্য তৈরির কাজে ব্যস্ত রাখে। (মথি ২৪:১৪; ২৮:১৯, ২০) তারা জানে যে, তাদের ওষ্ঠাধরকে এই উপায়ে ব্যবহার করা মশীহ রাজা যিশু খ্রিস্টের সন্তুষ্টি নিয়ে আসে। একজন ক্ষমতাবান মানব রাজার অসন্তোষ প্রতিরোধ করা এবং তার অনুগ্রহ লাভ করার চেষ্টা করা নিশ্চিতভাবেই বিজ্ঞতার কাজ। তা হলে, মশীহ রাজার অনুমোদন লাভের চেষ্টা করা আরও কতই না বিজ্ঞতার কাজ!
“রাজার মুখের দীপ্তিতে জীবন,” শলোমন বলে চলেন, “তাঁহার অনুগ্রহ অন্তিম বর্ষার মেঘ।” (হিতোপদেশ ১৬:১৫) ‘রাজার মুখের দীপ্তির’ অর্থ তার অনুগ্রহ, ঠিক যেমন ‘সদাপ্রভুর মুখের দীপ্তি’ ঐশিক অনুগ্রহকে ইঙ্গিত করে। (গীতসংহিতা ৪৪:৩; ৮৯:১৫) মেঘ যেমন বৃষ্টির নিশ্চয়তা দেয়, যা ফসলকে পাকতে সাহায্য করে, তেমনই একজন রাজার অনুগ্রহ ভাল বিষয়গুলো আসার প্রমাণস্বরূপ। মশীহ রাজার অধীনে জীবন আশীর্বাদ ও সমৃদ্ধিতে পূর্ণ হবে, যেমনটা রাজা শলোমনের শাসনকালে ক্ষুদ্র আকারে হয়েছিল।—গীতসংহিতা ৭২:১-১৭.
সূর্যের নীচে প্রত্যেকটা বিষয়ের ওপর ঈশ্বরের রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করার সময় আসুন আমরা আমাদের হৃদয়কে পরিষ্কৃত করতে তাঁর সাহায্য খুঁজি। এ ছাড়া, আসুন আমরা যিহোবাতে আস্থা রাখি ও ঈশ্বরীয় ভয় গড়ে তুলি। তা হলেই আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারব যে, ‘আমাদের পরিকল্পনা সফল হবে।’—হিতোপদেশ ১৬:৩.
[১৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
কোন অর্থে যিহোবা “দুষ্টকেও দুর্দ্দশাদিনের নিমিত্ত” সৃষ্টি করেছেন?