“প্রজ্ঞা আশ্রয়”
“সুবর্ণ অপেক্ষা প্রজ্ঞালাভ কেমন উত্তম। রৌপ্য অপেক্ষা বিবেচনালাভ বরণীয়,” হিতোপদেশ ১৬:১৬ পদ বলে। কেন প্রজ্ঞা এত মূল্যবান? কারণ “প্রজ্ঞা আশ্রয়, ধনও আশ্রয় বটে, কিন্তু জ্ঞানের উৎকৃষ্টতা এই যে, প্রজ্ঞা আপন অধিকারীর জীবন রক্ষা করে।” (উপদেশক ৭:১২) কিন্তু, কীভাবে প্রজ্ঞা আপন অধিকারীর জীবন রক্ষা করে?
ঈশ্বরীয় প্রজ্ঞা অর্জন অর্থাৎ ঈশ্বরের বাক্য বাইবেল সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান লাভ এবং এর সঙ্গে মিল রেখে কাজ করা, আমাদেরকে যিহোবার অনুমোদিত পথে চলতে সাহায্য করে। (হিতোপদেশ ২:১০-১২) প্রাচীন ইস্রায়েলের রাজা শলোমন বলেন: “দুষ্ক্রিয়া হইতে সরিয়া যাওয়াই সরলদের রাজপথ; যে আপন পথ রক্ষা করে, সে প্রাণ বাঁচায়।” (হিতোপদেশ ১৬:১৭) হ্যাঁ, প্রজ্ঞা দুষ্ক্রিয়া বা মন্দ পথ থেকে আপন অধিকারীদের উদ্ধার করে এবং তাদের জীবন রক্ষা করে! হিতোপদেশ ১৬:১৬-৩৩ পদের ছোট ছোট প্রজ্ঞার বাক্য আমাদের মনোভাব, কথাবার্তা ও কার্যকলাপের ওপর ঈশ্বরীয় প্রজ্ঞার ইতিবাচক প্রভাব সম্বন্ধে দেখায়।a
‘নম্রাত্মা হোন’
ব্যক্তিরূপে মূর্ত প্রজ্ঞা বলে: “অহঙ্কার, দাম্ভিকতা . . . আমি ঘৃণা করি।” (হিতোপদেশ ৮:১৩) দাম্ভিকতা ও প্রজ্ঞা পুরোপুরি বিপরীত বিষয়। আমাদেরকে প্রজ্ঞার সঙ্গে মিল রেখে কাজ করতে হবে এবং উদ্ধত মনোভাব গড়ে না তোলার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষভাবে সেই সময়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, যদি আমরা জীবনের কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করে থাকি অথবা খ্রিস্টীয় মণ্ডলীতে আমাদেরকে আস্থা সহকারে কোনো দায়িত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়ে থাকে।
“বিনাশের পূর্ব্বে অহঙ্কার,” হিতোপদেশ ১৬:১৮ পদ সতর্ক করে, “পতনের পূর্ব্বে মনের গর্ব্ব।” নিখিলবিশ্বের সবচেয়ে বড় বিনাশ—ঈশ্বরের একজন সিদ্ধ আত্মিক পুত্র, যে নিজেকে শয়তান দিয়াবলে পরিণত করেছিল, তার পতন—সম্বন্ধে বিবেচনা করুন। (আদিপুস্তক ৩:১-৫; প্রকাশিত বাক্য ১২:৯) তার বিনাশের আগে সে কি গর্বিত মনোভাব প্রকাশ করেনি? বাইবেল এই বিষয়টা নির্দেশ করে, যখন এটি বলে যে, একজন নতুন শিষ্যকে খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করা উচিত নয়, ‘পাছে তিনি গর্ব্বান্ধ হইয়া দিয়াবলের বিচারে পতিত হন।’ (১ তীমথিয় ৩:১, ২, ৬) অন্যদের অহংকারী মনোভাবকে উৎসাহিত করার ও সেইসঙ্গে আমাদের নিজেদের মধ্যেও তা গড়ে তোলার সুযোগ না দেওয়ার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা কতই না গুরুত্বপূর্ণ!
“বরং দীনহীনদের সহিত নম্রাত্মা হওয়া ভাল, তবু অহঙ্কারীদের সহিত লুট বিভাগ করা ভাল নয়,” হিতোপদেশ ১৬:১৯ পদ বলে। এটা যে এক উত্তম পরামর্শ, তা প্রাচীন বাবিলের রাজা নবূখদ্নিৎসরের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে। তিনি অহংকারী হয়ে দূরা সমস্থলীতে এক বিশাল প্রতিমা—যেটা সম্ভবত স্বয়ং তাকে প্রতিনিধিত্ব করেছিল—স্থাপন করেছিলেন। এই মূর্তিটা হয়তো অনেক উঁচু একটা ভিত্তির ওপর বসানো হয়েছিল আর এর ফলে সেটা ২৭ মিটার পর্যন্ত উঁচুতে উঠে গিয়েছিল। (দানিয়েল ৩:১) এই বিশাল স্মৃতিস্তম্ভটা নবূখদ্নিৎসরের সাম্রাজ্যের এক প্রভাব বিস্তারকারী প্রতীক ছিল। যদিও দীর্ঘ ও উঁচু বস্তুগুলো—যেমন সেই মূর্তি ও সেইসঙ্গে স্মৃতিস্তম্ভ, চূড়াসহ সুউচ্চ ভবন ও গগনস্পর্শী অট্টালিকাগুলো—হয়তো মানুষকে অভিভূত করতে পারে কিন্তু ঈশ্বরের ক্ষেত্রে তেমনটা হয় না। গীতরচক গেয়েছিলেন: “সদাপ্রভু উচ্চ, তথাপি অবনতের প্রতি দৃষ্টি রাখেন, কিন্তু” উচ্চকে বা “গর্ব্বিতকে দূর হইতে জানেন।” (গীতসংহিতা ১৩৮:৬) বস্তুতপক্ষে, “মনুষ্যদের মধ্যে যাহা উচ্চ, তাহা ঈশ্বরের সাক্ষাতে ঘৃণিত।” (লূক ১৬:১৫) তাই, আমাদের পক্ষে ‘উচ্চ উচ্চ বিষয় ভাবিবার’ চেয়ে বরং ‘অবনত বিষয় সকলের সহিত আকর্ষিত হওয়া’ আরও ভাল।—রোমীয় ১২:১৬.
‘অন্তর্দৃষ্টি’ সহকারে ও ‘বিশ্বাস জন্মানোর’ মতো করে কথা বলুন
প্রজ্ঞা অর্জন করা কীভাবে আমাদের কথাবার্তাকে প্রভাবিত করে? বিজ্ঞ রাজা আমাদের বলেন: “যে বাক্যে মন দেয় [“অন্তর্দৃষ্টি দেখায়,” NW], সে মঙ্গল পায়; এবং যে সদাপ্রভুতে নির্ভর করে, সে ধন্য। বিজ্ঞচিত্ত বুদ্ধিমান বলিয়া আখ্যাত হয়; এবং ওষ্ঠের মাধুরী পান্ডিত্যের বৃদ্ধি করে [“বিশ্বাস জন্মায়,” NW]। বিবেচনা [“অন্তর্দৃষ্টি,” NW] বিবেচকের পক্ষে জীবনের উনুই; কিন্তু অজ্ঞানতা অজ্ঞানদের শাস্তি। জ্ঞানবানের হৃদয় তাহার মুখকে বুদ্ধি দেয় [“অন্তর্দৃষ্টি দেখানোর কারণ হয়,” NW], তাহার ওষ্ঠে পাণ্ডিত্য যোগায় [“বিশ্বাস জন্মায়,” NW]।”—হিতোপদেশ ১৬:২০-২৩.
প্রজ্ঞা আমাদেরকে অন্তর্দৃষ্টি সহকারে ও বিশ্বাস জন্মানোর মতো করে কথা বলতে সাহায্য করে। কেন? কারণ যে-ব্যক্তি হৃদয়ে বিজ্ঞ, তিনি কোনো বিষয়ে ‘মঙ্গল পাইবার’ চেষ্টা করেন এবং ‘সদাপ্রভুতে নির্ভর করেন।’ আমরা যখন অন্যদের মধ্যে মঙ্গল বা ভাল কিছু খোঁজার প্রচেষ্টা করি, তখন আমরা সম্ভবত তাদের সম্বন্ধে আরও বেশি প্রশংসনীয় কথা বলি। রূঢ় ও তর্কপ্রবণ হওয়ার পরিবর্তে, আমাদের কথাবার্তা মধুর ও বিশ্বাস জন্মানোর মতো হয়। অন্যদের পরিস্থিতিগুলো সম্বন্ধে অন্তর্দৃষ্টি দেওয়া আমাদেরকে বুঝতে সাহায্য করে যে, তারা হয়তো কতখানি কষ্ট ভোগ করছে এবং কীভাবে তারা এর সঙ্গে সফলভাবে মোকাবিলা করছে।
প্রজ্ঞার দ্বারা প্রভাবিত কথাবার্তা তখনও অতীব গুরুত্বপূর্ণ, যখন আমাদের রাজ্যের প্রচার ও শিষ্য তৈরির কাজের বিষয়টা আসে। আমরা যখন অন্যদেরকে ঈশ্বরের বাক্য শিক্ষা দিই, তখন আমাদের উদ্দেশ্য কেবল শাস্ত্রীয় তথ্য জানানোই নয়। বরং, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তি বিশেষদের হৃদয়ে পৌঁছানো। এর জন্য, বিশ্বাস জন্মানোর মতো করে কথা বলা প্রয়োজন। প্রেরিত পৌল তার সহযোগী তীমথিয়কে সেই বিষয়গুলো করে চলতে বলেছিলেন, যেগুলো সম্বন্ধে তিনি ‘প্রমাণ জ্ঞাত হইয়াছিলেন [‘নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেছিলেন,’ বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারসন]।’—২ তীমথিয় ৩:১৪, ১৫.
“বিশ্বাস জন্মানো” শব্দগুলোর জন্য ব্যবহৃত গ্রিক শব্দটির অর্থ হল, “যুক্তি বা নৈতিক চিন্তার প্রভাবের দ্বারা মনের পরিবর্তন আনা,” ই. ভাইনের আ্যন এক্সপোজিটরি ডিকশনারি অভ্ দ্যা নিউ টেস্টামেন্ট ওয়ার্ডস বলে। যে-প্রত্যয় উৎপাদনকারী যুক্তিগুলো আমাদের শ্রোতার মনকে পরিবর্তন করার দিকে চালিত করে, তা তুলে ধরার জন্য সেই ব্যক্তির চিন্তাভাবনা, আগ্রহ, পরিস্থিতি ও পটভূমি সম্বন্ধে অন্তর্দৃষ্টি থাকা প্রয়োজন। কীভাবে আমরা এই ধরনের অন্তর্দৃষ্টি লাভ করতে পারি? শিষ্য যাকোব উত্তর দেন: ‘শ্রবণে সত্বর, কথনে ধীর হও।’ (যাকোব ১:১৯) আমরা শ্রোতাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করার মাধ্যমে এবং তিনি যা-বলেন, তাতে সতর্কভাবে মনোযোগ দেওয়ার মাধ্যমে তার হৃদয়ে কী রয়েছে, সেই সম্বন্ধে জানতে পারি।
প্রেরিত পৌলের অন্যদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মানোর অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। (প্রেরিত ১৮:৪) এমনকি তার বিরোধীদের মধ্যে একজন, দীমীত্রিয় নামে এক স্বর্ণকার স্বীকার করেছিলেন: “কেবল এই ইফিষে নয়, প্রায় সমস্ত এশিয়ায় এই পৌল বিস্তর লোককে প্রবৃত্তি দিয়া [“বিশ্বাস জন্মিয়ে,” বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারসন] ফিরাইয়াছে।” (প্রেরিত ১৯:২৬) তার প্রচার কাজের কার্যকারিতার জন্য পৌল কি নিজে কৃতিত্ব নিয়েছিলেন? কখনোই না। তিনি তার প্রচারকে ‘[ঈশ্বরের] আত্মার ও পরাক্রমের প্রদর্শন’ বলে বিবেচনা করেছিলেন। (১ করিন্থীয় ২:৪, ৫) আমাদেরও যিহোবার পবিত্র আত্মার সাহায্য রয়েছে। যেহেতু আমরা যিহোবার ওপর নির্ভর করি, তাই আমরা যখন আমাদের পরিচর্যায় অন্তর্দৃষ্টি সহকারে ও বিশ্বাস জন্মানোর মতো করে কথা বলার প্রচেষ্টা করি, সেই সময়ে তাঁর সাহায্য পাওয়ার বিষয়ে আস্থা রাখতে পারি।
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে যিনি “বিজ্ঞচিত্ত,” তাকে “বুদ্ধিমান” বলা হয়েছে! (হিতোপদেশ ১৬:২১) হ্যাঁ, অন্তর্দৃষ্টি তাদের পক্ষে “জীবনের উনুই,” যাদের তা রয়েছে। কিন্তু অজ্ঞান বা মূর্খদের বিষয়ে কী বলা যায়? তারা “প্রজ্ঞা ও উপদেশ তুচ্ছ করে।” (হিতোপদেশ ১:৭) যিহোবার কাছ থেকে শাসন প্রত্যাখ্যান করার দ্বারা তারা কী ফল উৎপন্ন করে? আগে যেমন বলা হয়েছে, শলোমন বলেন: “অজ্ঞানতা অজ্ঞানদের শাস্তি।” (হিতোপদেশ ১৬:২২) তারা আরও শাস্তি বা শাসন লাভ করে, প্রায়ই তা চরম ভর্ৎসনার আকারে। এ ছাড়া, মূর্খ ব্যক্তিরা নিজেদের জন্য কষ্ট, লজ্জা, রোগব্যাধি আর এমনকি অকালমৃত্যুও নিয়ে আসে।
আমাদের কথাবার্তার ওপর প্রজ্ঞার আরও গঠনমূলক প্রভাব সম্বন্ধে নির্দেশ করে ইস্রায়েলের রাজা বলেন: “মনোহর বাক্য মৌচাকের ন্যায়; তাহা প্রাণের পক্ষে মধুর, অস্থির পক্ষে স্বাস্থ্যকর।” (হিতোপদেশ ১৬:২৪) মধু যেমন মিষ্টি এবং একজন ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে শীঘ্রই শক্তি জোগায়, তেমনই মনোহর বাক্য উৎসাহজনক ও সতেজতাদায়ক। এ ছাড়া, মধু একজন ব্যক্তির জন্য স্বাস্থ্যকর, আরোগ্যজনক উপাদান ও উত্তম। মনোহর বাক্যও সেইরকমই; সেগুলো আধ্যাত্মিকভাবে স্বাস্থ্যকর।—হিতোপদেশ ২৪:১৩, ১৪.
“একটী পথ” সম্বন্ধে সতর্ক থাকুন, ‘যাহা সরল মনে হয়’
“একটী পথ আছে, যাহা মানুষের দৃষ্টিতে সরল,” শলোমন বলেন, “কিন্তু তাহার পরিণাম মৃত্যুর পথ।” (হিতোপদেশ ১৬:২৫) এটা হল মিথ্যা যুক্তি এবং ঐশিক আইনের বিপরীত এক পথে অনুধাবন করার বিরুদ্ধে এক সতর্কবাণী। অসিদ্ধ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে একটা নির্দিষ্ট পথকে হয়তো সঠিক বলে মনে হতে পারে কিন্তু তা হয়তো আসলে ঈশ্বরের বাক্যের ধার্মিক নীতিগুলোর বিরুদ্ধে হয়ে থাকে। অধিকন্তু, শয়তান হয়তো এই ধরনের প্রতারণা বৃদ্ধি করতে পারে, যাতে একজন ব্যক্তি সেই পথ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, যেটাকে তিনি সঠিক বলে মনে করেন কিন্তু আসলে এটা মৃত্যুর দিকে চালিত করে।
বিজ্ঞ ও বোধগম্যতাপূর্ণ এক হৃদয়ের এবং ঈশ্বরের বাক্যের জ্ঞানের দ্বারা জ্ঞানালোকিত এক বিবেকের চেয়ে আত্মপ্রতারণার বিরুদ্ধে ভাল সুরক্ষা আর কিছু থাকতে পারে না। যখন জীবনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার বিষয় আসে—তা সেটা নৈতিকতা, উপাসনা অথবা অন্য যেকোনো বিষয়েই হোক না কেন—আত্মপ্রতারণার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার সর্বোত্তম উপায় হল, ভাল ও মন্দ সম্বন্ধে ঈশ্বরের মানগুলোর দ্বারা পরিচালিত হওয়া।
“শ্রমীর ক্ষুধাই তাহাকে পরিশ্রম করায়”
“শ্রমীর ক্ষুধাই তাহাকে পরিশ্রম করায়,” বিজ্ঞ রাজা বলে চলেন, “বস্তুতঃ তাহার মুখ তাহাকে পীড়াপীড়ি করে।” (হিতোপদেশ ১৬:২৬) শলোমন বলছেন যে, খাদ্যের জন্য একজন শ্রমিকের আকাঙ্ক্ষাই ‘তাহাকে পরিশ্রম করাইতে পারে’ কারণ ক্ষুধাই “তাহাকে পীড়াপীড়ি করে” বা অনুপ্রাণিত করে। স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা যেমন, খাদ্যের জন্য আমাদের আকাঙ্ক্ষা আমাদেরকে উৎপাদনশীল হতে অনুপ্রাণিত করতে পারে। এই ধরনের এক আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে গঠনমূলক। কিন্তু, কী হবে যদি উপযুক্ত আকাঙ্ক্ষাকে এতটাই বৃদ্ধি পেতে দেওয়া হয় যে সেটা লোভে পরিণত হয়ে যায়? ফলাফল ঠিক সেইরকমই হয়ে থাকে, যখন শিবিরে রান্নার জন্য ব্যবহৃত ক্ষুদ্র আগুনের শিখা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা দাবানলে পরিণত হলে যা ঘটে। লোভ হল অনিয়ন্ত্রিত আকাঙ্ক্ষা এবং তা ধ্বংসাত্মক। বিপদ সম্বন্ধে উপলব্ধি করে একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি এমনকি তার গঠনমূলক আকাঙ্ক্ষাকেও নিয়ন্ত্রণে রাখেন।
‘মন্দ পথে যাইও’ না
আমাদের মুখ থেকে আসা কথাবার্তা জ্বলন্ত আগুনের মতো ধ্বংসাত্মক হতে পারে। অন্যদের দোষ খোঁজার ও তাদের সম্বন্ধে গুজব ছড়ানোর ক্ষতিকর প্রভাব সম্বন্ধে বর্ণনা করতে গিয়ে শলোমন বলেন: “পাষণ্ড খনন করিয়া অনিষ্ট তোলে, তাহার ওষ্ঠে যেন জ্বলন্ত অঙ্গার থাকে। কুটিল ব্যক্তি বিবাদ খুলিয়া দেয়, পরীবাদক মিত্রভেদ জন্মায়।”—হিতোপদেশ ১৬:২৭, ২৮.
যে-ব্যক্তি তার সহমানবের সুনামকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করেন, তিনি “পাষণ্ড।” আমাদের অন্যদের মধ্যে ভাল বিষয় খোঁজার চেষ্টা করা উচিত এবং তাদের সম্বন্ধে এমন বিষয় বলা উচিত, যার ফলে অন্যেরা তাদেরকে সম্মান করতে পারে। আর যারা ক্ষতিকর গুজব ছড়ায়, তাদের কথায় কান দেওয়ার বিষয়ে কী বলা যায়? তাদের কথাবার্তা সহজেই ভিত্তিহীন সন্দেহ উৎপন্ন করতে পারে, বন্ধুদের মধ্যে ভাঙন তৈরি করতে এবং মণ্ডলীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে। প্রজ্ঞা আমাদেরকে তাদের কথায় মনোযোগ না দিতে চালিত করবে।
যে-প্রলুব্ধকর শক্তি এক ব্যক্তিকে ভুল পথ অনুসরণ করতে চালিত করতে পারে, সেই সম্বন্ধে সতর্ক করে শলোমন বলেন: “অত্যাচারী প্রতিবাসীকে লোভ দেখায়, এবং তাহাকে মন্দ পথে লইয়া যায়। যে চক্ষু মুদ্রিত করে, সে কুটিল বিষয়ের সঙ্কল্প করিবার জন্যই করে, যে ওষ্ঠ সঙ্কুচিত করে, সে দুষ্কর্ম্ম সিদ্ধ করে।”—হিতোপদেশ ১৬:২৯, ৩০.
অত্যাচার বা দৌরাত্ম্য কি সত্য উপাসকদের ওপর এর লোভী বা প্রলুব্ধকর শক্তি প্রয়োগ করে? আজকে অনেক লোক “কুটিল বিষয়ের সঙ্কল্প করিবার” জন্য প্রলুব্ধ হয়েছে। তারা দৌরাত্ম্যমূলক কাজ বৃদ্ধি বা সাধন করে। দৌরাত্ম্যে এই ধরনের সরাসরি অংশগ্রহণ করা এড়িয়ে চলাকে আমরা হয়তো তেমন কঠিন বলে মনে করি না। কিন্তু, অতি সূক্ষ্ম উপায়ে এর প্রতি আকৃষ্ট হওয়া সম্বন্ধে কী বলা যায়? লক্ষ লক্ষ লোক কি এমন আমোদপ্রমোদ ও খেলাধুলা উপভোগ করতে প্ররোচিত হয় না, যেগুলো দৌরাত্ম্যকে তুলে ধরে? শাস্ত্রীয় সতর্কবাণীটি স্পষ্ট: “জ্ঞানীদের সহচর হও, জ্ঞানী হইবে; কিন্তু যে হীনবুদ্ধিদের বন্ধু, সে ভগ্ন হইবে।” (হিতোপদেশ ১৩:২০) ঈশ্বরীয় প্রজ্ঞা কতই না সুরক্ষা জোগায়!
এমন একজন ব্যক্তি সম্বন্ধে কী বলা যায়, যিনি প্রজ্ঞা ও বোধগম্যতা সহকারে জীবনযাপন করেছেন এবং ‘মন্দ পথে যান নাই’? ধার্মিকতার পথে কাটানো এক জীবন ঈশ্বরের চোখে প্রশংসনীয় এবং সম্মান লাভের যোগ্য। “পক্ব কেশ শোভার মুকুট; তাহা ধার্ম্মিকতার পথে পাওয়া যায়,” হিতোপদেশ ১৬:৩১ পদ বলে।
অন্যদিকে, অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধের মধ্যে সুন্দর কিছুই নেই। আদম ও হবার প্রথমজাত ছেলে কয়িন তার ভাই হেবলের ওপর ‘অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়াছিল’ এবং ‘আপন ভ্রাতার বিরুদ্ধে উঠিয়া তাহাকে বধ করিয়াছিল।’ (আদিপুস্তক ৪:১, ২, ৫, ৮) হয়তো এমন সময় আসতে পারে, যখন আমরা উপযুক্ত কারণেই ক্রোধান্বিত হই কিন্তু আমাদের ক্রোধ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে নিজেদের সতর্ক থাকতে হবে। হিতোপদেশ ১৬:৩২ পদ স্পষ্টভাবে বলে: “যে ক্রোধে ধীর, সে বীর হইতেও উত্তম, নিজ আত্মার শাসনকারী নগর-জয়কারী হইতেও শ্রেষ্ঠ।” অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধ কোনো শক্তি অথবা সদ্গুণের চিহ্ন নয়। এটা হল এক দুর্বলতা, যা ‘একজনকে মন্দ পথে লইয়া যায়।’
যখন “সমস্ত নিষ্পত্তি সদাপ্রভু হইতে হয়”
“গুলিবাঁট কোলে ফেলা যায়,” ইস্রায়েলের রাজা বলেন, “কিন্তু তাহার সমস্ত নিষ্পত্তি সদাপ্রভু হইতে হয়।” (হিতোপদেশ ১৬:৩৩) প্রাচীন ইস্রায়েলে যিহোবা মাঝে মাঝে তাঁর ইচ্ছা জানানোর জন্য গুলিবাঁট ব্যবহার করেছিলেন। গুলিবাঁটের গুলি ছিল নুড়ি অথবা কাঠ বা পাথরের ফলক। প্রথমে কোনো বিষয় নিষ্পত্তি করার বা তাঁর সিদ্ধান্তের জন্য যিহোবার কাছে অনুরোধ করা হতো। তারপর গুলিগুলো একটা জামার ভাঁজে ফেলে দেওয়া হতো ও এরপর বের করে আনা হতো। ফলাফলটা ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে বলে মেনে নেওয়া হতো।
যিহোবা তাঁর মনে কী রয়েছে, তা তাঁর লোকেদের জানানোর জন্য এখন আর গুলিবাঁট ব্যবহার করেন না। তিনি তাঁর বাক্য বাইবেলে তাঁর ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। বাইবেলে যা বলা রয়েছে সেই সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান, ঈশ্বরীয় প্রজ্ঞা অর্জনের জন্য অপরিহার্য। তাই, আমাদের এমন একটা দিনও অতিবাহিত হতে দেওয়া উচিত নয়, যেদিন অনুপ্রাণিত শাস্ত্র থেকে পড়া হয়নি।—গীতসংহিতা ১:১, ২; মথি ৪:৪.
[পাদটীকা]
a হিতোপদেশ ১৬:১-১৫ পদের ওপর আলোচনার জন্য ২০০৭ সালের ১৫ই মে প্রহরীদুর্গ পত্রিকার ১৭-২০ পৃষ্ঠা দেখুন।
[৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
কেন প্রজ্ঞা সোনার চেয়ে বেশি মূল্যবান?
[৯ পৃষ্ঠার চিত্র]
আপনি যখন পরিচর্যায় থাকেন, তখন কোন বিষয়টা আপনাকে বিশ্বাস জন্মানোর মতো করে কথা বলতে সাহায্য করে?
[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]
“পাষণ্ড খনন করিয়া অনিষ্ট তোলে”
[১১ পৃষ্ঠার চিত্র]
অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধ একজনকে ‘মন্দ পথে লইয়া যাইতে’ পারে
[১২ পৃষ্ঠার চিত্র]
দৌরাত্ম্যের প্রলুব্ধ করার ক্ষমতা রয়েছে