“এই দেখ, ইনিই আমাদের ঈশ্বর”
“এই দেখ, ইনিই আমাদের ঈশ্বর; আমরা ইহাঁরই অপেক্ষায় ছিলাম, ইনি আমাদিগকে ত্রাণ করিবেন; ইনিই সদাপ্রভু [“যিহোবা,” Nw]।”—যিশাইয় ২৫:৯.
১, ২. (ক) কুলপতি অব্রাহামকে যিহোবা কী বলে উল্লেখ করেছিলেন আর এই বিষয়টা আমাদের কী ভাবতে পরিচালিত করে? (খ) কীভাবে বাইবেল আমাদের আশ্বাস দেয় যে, ঈশ্বরের সঙ্গে নিকট সম্পর্ক করা সম্ভব?
“আমার বন্ধু।” স্বর্গ এবং পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা, যিহোবা কুলপতি অব্রাহাম সম্বন্ধে এভাবেই উল্লেখ করেছিলেন। (যিশাইয় ৪১:৮) শুধু কল্পনা করুন—নগণ্য এক মানুষ, নিখিলবিশ্বের সার্বভৌম প্রভুর সঙ্গে বন্ধুত্ব উপভোগ করে! আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, ‘আমার পক্ষে কি ঈশ্বরের এতটা নিকটবর্তী হওয়া সম্ভব?’
২ বাইবেল আমাদের আশ্বাস দেয় যে, ঈশ্বরের সঙ্গে নিকট সম্পর্ক করা সম্ভব। অব্রাহাম এইরকম নিকট সম্পর্ক উপভোগ করেছিলেন কারণ তিনি “ঈশ্বরে বিশ্বাস করিলেন।” (যাকোব ২:২৩) আজকেও, “সরলগণের সহিত” যিহোবার “গূঢ় মন্ত্রণা [“অন্তরঙ্গতা,” NW]” রয়েছে। (হিতোপদেশ ৩:৩২) যাকোব ৪:৮ পদে, বাইবেল আমাদের উৎসাহ দেয়: “ঈশ্বরের নিকটবর্ত্তী হও, তাহাতে তিনিও তোমাদের নিকটবর্ত্তী হইবেন।” স্পষ্টতই, আমরা যদি যিহোবার নিকটবর্তী হওয়ার জন্য পদক্ষেপ নিই, তা হলে তিনি তাতে সাড়া দেবেন। বস্তুত, তিনি আমাদের নিকটবর্তী হবেন। কিন্তু, এই অনুপ্রাণিত কথাগুলোর মানে কি এই যে আমরা—পাপী, অসিদ্ধ মানুষেরা—প্রথমে পদক্ষেপ নেব? অবশ্যই না। আমাদের প্রেমময় ঈশ্বর দুটো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন বলেই যিহোবার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা গড়ে তোলা সম্ভব।—গীতসংহিতা ২৫:১৪, NW.
৩. যিহোবা কোন দুটো পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব উপভোগ করা আমাদের জন্য সম্ভবপর করে তোলে?
৩ প্রথমত, যিহোবা ব্যবস্থা করেছিলেন, যাতে যিশু “অনেকের পরিবর্ত্তে আপন প্রাণ মুক্তির মূল্যরূপে” দেন। (মথি ২০:২৮) সেই মুক্তির মূল্যরূপ বলিদানই আমাদের জন্য ঈশ্বরের নিকটবর্তী হওয়া সম্ভবপর করে তোলে। বাইবেল বলে: “আমরা প্রেম করি, কারণ তিনিই প্রথমে আমাদিগকে প্রেম করিয়াছেন।” (১ যোহন ৪:১৯) হ্যাঁ, ঈশ্বর যেহেতু “প্রথমে আমাদিগকে প্রেম করিয়াছেন,” তাই তিনি তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে আমাদের জন্য ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, যিহোবা আমাদের কাছে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। যেকোনো বন্ধুত্বই আমরা গড়ে তুলি না কেন, সেই বন্ধন একজন ব্যক্তিকে ভালভাবে জানা, তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলোকে সম্মান ও মূল্যবান মনে করার ওপর ভিত্তি করে স্থাপিত। এর অর্থ কী, তা বিবেচনা করুন। যিহোবা যদি একজন গুপ্ত, বোধের অগম্য ঈশ্বর হতেন, তা হলে আমরা কখনোই তাঁর নিকটবর্তী হতে পারতাম না। কিন্তু, নিজেকে অব্যক্ত রাখার পরিবর্তে যিহোবা চান যেন আমরা তাঁকে জানি। (যিশাইয় ৪৫:১৯) তাঁর বাক্য বাইবেলে, তিনি এমন পরিভাষায় নিজেকে প্রকাশ করেন, যা আমরা বুঝতে পারি—যা শুধু প্রমাণ করে না যে, তিনি আমাদের ভালবাসেন সেইসঙ্গে এও প্রমাণ করে যে, তিনি চান যেন আমাদের স্বর্গীয় পিতা হিসেবে আমরা তাঁকে জানি ও ভালবাসি।
৪. যিহোবার গুণগুলো আরও ভাল করে জানলে তাঁর সম্বন্ধে আমরা কেমন অনুভব করব?
৪ আপনি কি কখনও একটি ছোট বাচ্চাকে তার বন্ধুদের তার বাবাকে দেখাতে ও তারপর অকপট আনন্দ ও গর্বের সঙ্গে বলতে শুনেছেন যে, “ওই যে আমার বাবা”? ঈশ্বরের উপাসকদের যিহোবা সম্বন্ধে এই একইরকম অনুভব করার উত্তম কারণ রয়েছে। বাইবেল এমন এক সময় সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করে যখন বিশ্বস্ত লোকেরা বিস্ময়ে চিৎকার করে বলবে: “এই দেখ, ইনিই আমাদের ঈশ্বর।” (যিশাইয় ২৫:৮, ৯) যিহোবার গুণগুলো সম্বন্ধে আমরা যত বেশি অন্তর্দৃষ্টি লাভ করব, তত বেশি অনুভব করব যে আমাদের সবচেয়ে উত্তম পিতা রয়েছে। হ্যাঁ, যিহোবার গুণগুলো উপলব্ধি করা তাঁর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য আমাদের অনেক কারণ জোগায়। তাই আসুন আমরা পরীক্ষা করে দেখি যে, বাইবেল কীভাবে যিহোবার মুখ্য গুণগুলো—শক্তি, ন্যায়বিচার, প্রজ্ঞা ও প্রেম—প্রকাশ করে। এই প্রবন্ধে আমরা এই গুণগুলোর প্রথম তিনটে গুণ নিয়ে আলোচনা করব।
“শক্তিতে মহান্”
৫. কেন এটা উপযুক্ত যে, একা যিহোবাকেই “সর্ব্বশক্তিমান্” বলা হয় এবং কোন কোন উপায়ে তিনি তাঁর মহৎ শক্তি ব্যবহার করেন?
৫ যিহোবা হলেন, “পরাক্রমে [“শক্তিতে,” NW] মহান্।” (ইয়োব ৩৭:২৩) যিরমিয় ১০:৬ পদ বলে: “হে সদাপ্রভু [“যিহোবা,” NW], তোমার তুল্য কেহই নাই; তুমি মহান, তোমার নামও পরাক্রমে মহৎ।” অন্য যেকোনো প্রাণীর বৈসাদৃশ্যে যিহোবার অসীম শক্তি রয়েছে। এই কারণে, একা তাঁকেই “সর্ব্বশক্তিমান্” বলা হয়। (প্রকাশিত বাক্য ১৫:৩) যিহোবা সৃষ্টি করতে, ধ্বংস করতে, রক্ষা করতে এবং পুনর্স্থাপন করতে তাঁর বিস্ময়কর শক্তিকে ব্যবহার করেন। শুধু দুটো উদাহরণ বিবেচনা করুন—তাঁর সৃজনীশক্তি এবং তাঁর প্রতিরক্ষামূলক শক্তি।
৬, ৭. সূর্য কতটা শক্তিশালী এবং এটা কোন একটা গুরুত্বপূর্ণ সত্যের প্রমাণ দেয়?
৬ গ্রীষ্মকালের এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে আপনি যখন বাইরে দাঁড়ান, তখন আপনি আপনার চামড়ায় কেমন অনুভব করেন? সূর্যের উষ্ণতা। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে আপনি যিহোবার সৃজনীশক্তির ফল অনুভব করেন। সূর্য কতটা শক্তিশালী? এর কেন্দ্রস্থলের তাপমাত্রা প্রায় ১,৫০,০০,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আপনি যদি সূর্যের কেন্দ্রস্থল থেকে একটা আলপিনের মাথার সমান টুকরো নিয়ে পৃথিবীতে রাখতে পারতেন, তা হলে আপনি সেই ক্ষুদ্র তাপের উৎসের ১৪০ কিলোমিটারের মধ্যে নিরাপদে দাঁড়াতে পারতেন না! প্রতি সেকেন্ডে, সূর্য যে-শক্তি নির্গত করে তা কোটি কোটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের সমান। কিন্তু পৃথিবী ওই বিশাল তাপমান পারমাণবিক অগ্নিকুণ্ড থেকে একেবারে সঠিক দূরত্ব বজায় রেখে কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে। যদি বেশি কাছে থাকত, তা হলে পৃথিবীর জল বাষ্প হয়ে যেত; আর বেশি দূরে হলে তা জমে বরফ হয়ে যেত। কোনো এক দিকে চরম হলেই আমাদের গ্রহ প্রাণহীন হয়ে পড়ত।
৭ যদিও মানুষের জীবন সূর্যের ওপর নির্ভর করে, তবুও অনেকে এটাকে হালকাভাবে নেয়। আর এর ফলে, সূর্য আমাদের যা শিক্ষা দিতে পারে, তারা তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়। গীতসংহিতা ৭৪:১৬ পদ যিহোবা সম্বন্ধে বলে: “তুমিই জ্যোতিষ্ক ও সূর্য্য রচনা করিয়াছ।” হ্যাঁ, সূর্য ‘আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর নির্মাতা’ যিহোবাকে গৌরবান্বিত করে। (গীতসংহিতা ১৪৬:৬, NW) যদিও, এটা অনেক সৃষ্টির মধ্যে শুধু একটা, যেগুলো যিহোবার অপরিমেয় শক্তি সম্বন্ধে আমাদের শিক্ষা দেয়। যিহোবার সৃজনীশক্তি সম্বন্ধে আমরা যতই জানব, আমাদের সশ্রদ্ধ ভয় ততই গভীর হবে।
৮, ৯. (ক) কোন কোমল চিত্র আমাদের দেখায় যে, যিহোবা তাঁর উপাসকদের রক্ষা করতে এবং যত্ন নিতে চান? (খ) বাইবেলের সময়ের মেষপালক তার মেষের কেমন যত্ন নিতেন এবং এটা আমাদের সর্বমহান মেষপালক সম্বন্ধে কী শেখায়?
৮ এ ছাড়া, যিহোবা তাঁর দাসদের রক্ষা করার ও তাদের যত্ন নেওয়ার জন্যও তাঁর অসীম শক্তিকে ব্যবহার করেন। বাইবেল প্রতিরক্ষামূলক যত্ন সম্বন্ধে যিহোবার প্রতিজ্ঞা বর্ণনা করার জন্য কিছু প্রাণবন্ত অথচ মর্মস্পর্শী ভাষায় বর্ণনা করা চিত্র ব্যবহার করে। উদাহরণ হিসেবে যিশাইয় ৪০:১১ পদ লক্ষ করুন। সেখানে যিহোবা নিজেকে একজন মেষপালকের সঙ্গে ও তাঁর লোকেদের মেষের সঙ্গে তুলনা করেন। আমরা পড়ি: “তিনি মেষপালকের ন্যায় আপন পাল চরাইবেন, তিনি শাবকদিগকে বাহুতে সংগ্রহ করিবেন, এবং কোলে করিয়া বহন করিবেন; দুগ্ধবতী সকলকে তিনি ধীরে ধীরে চালাইবেন।” এই পদে যা বর্ণনা করা হয়েছে, তা কি আপনি মনের চোখ দিয়ে দেখতে পারেন?
৯ গৃহপালিত মেষদের মতো খুব কম জন্তুই অসহায়। বাইবেলের সময়ের মেষপালককে তার মেষদের নেকড়ে, ভল্লুক ও এমনকি সিংহের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সাহসী হতে হতো। (১ শমূয়েল ১৭:৩৪-৩৬; যোহন ১০:১০-১৩) কিন্তু এমন সময়ও ছিল যখন মেষদের রক্ষার জন্য কোমলতা দেখানোর প্রয়োজন হতো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটা মেষ যখন খোঁয়াড় থেকে দূরে বাচ্চা প্রসব করত, তখন মেষপালক কীভাবে সদ্যজাত অসহায় মেষশাবককে সুরক্ষিত রাখতেন? তিনি সম্ভবত বেশ কিছু দিনের জন্য সেটিকে তার “কোলে”—তার ওপরের জামার ভাঁজে—বহন করতেন। কিন্তু, একটা ছোট মেষশাবক কীভাবে পালকের কোলে উঠত? মেষশাবক হয়তো পালকের কাছে আসত আর এমনকি তার পায়ে মৃদু ঠেলা দিত। তবে, পালককেই নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে মেষকে তুলে নিতে ও তার কোলে নিরাপদ স্থানে রাখতে হতো। আমাদের সর্বমহান পালক যে তাঁর দাসদের রক্ষা করতে এবং যত্ন নিতে চান, সেটার কী এক কোমল চিত্র!
১০. যিহোবা বর্তমানে কোন সুরক্ষা জোগান এবং এই ধরনের সুরক্ষা কেন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ?
১০ যিহোবা প্রতিরক্ষার প্রতিজ্ঞা করা ছাড়াও আরও বেশি কিছু করেছেন। বাইবেলের সময়ে, তিনি অলৌকিকভাবে দেখিয়েছিলেন যে তিনি “ভক্তদিগকে পরীক্ষা হইতে উদ্ধার করিতে” সমর্থ। (২ পিতর ২:৯) আজকের দিন সম্বন্ধে কী বলা যায়? আমরা জানি যে, এখন তিনি সমস্ত দুর্দশা থেকে আমাদের সুরক্ষা করার জন্য তাঁর শক্তি ব্যবহার করেন না। কিন্তু, তিনি আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু জোগান আর তা হল আধ্যাত্মিক সুরক্ষা। আমাদের প্রেমময় ঈশ্বর পরীক্ষাগুলো সহ্য করার ও তাঁর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রক্ষার জন্য যা কিছু দরকার, তা দিয়ে সুসজ্জিত করে আমাদের আধ্যাত্মিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করেন। উদাহরণ হিসেবে লূক ১১:১৩ পদ বলে: “তোমরা মন্দ হইয়াও যদি তোমাদের সন্তানদিগকে উত্তম উত্তম দ্রব্য দান করিতে জান, তবে ইহা কত অধিক নিশ্চয় যে, স্বর্গস্থ পিতা, যাহারা তাঁহার কাছে যাচ্ঞা করে, তাহাদিগকে পবিত্র আত্মা দান করিবেন।” যেকোনো পরীক্ষা বা সমস্যার মুখোমুখি আমরা হই না কেন, সেই শক্তিশালী বল আমাদের সেগুলো মোকাবিলা করার সমকক্ষ করে তুলতে পারে। (২ করিন্থীয় ৪:৭) এভাবে যিহোবা আমাদের জীবন রক্ষার জন্য কাজ করেন আর তা শুধু কিছু বছরের জন্য নয় বরং অনন্তকালের জন্য। সেই প্রত্যাশার কথা মাথায় রেখে আমরা হয়তো সত্যিই এই বিধিব্যবস্থার যেকোনো দুঃখকষ্টকে “আপাততঃ . . . লঘুতর” হিসেবে দেখতে পারি। (২ করিন্থীয় ৪:১৭) আমরা কি এমন একজন ঈশ্বরের নিকটবর্তী হব না, যিনি আমাদের জন্য তাঁর শক্তি এত প্রেমের সঙ্গে ব্যবহার করেন?
“সদাপ্রভু ন্যায়বিচার ভালবাসেন”
১১, ১২. (ক) যিহোবার ন্যায়বিচার কেন আমাদের তাঁর নিকটবর্তী করে? (খ) যিহোবার ন্যায়বিচার সম্বন্ধে দায়ূদ কোন উপসংহারে পৌঁছেছিলেন এবং এই অনুপ্রাণিত কথাগুলো কীভাবে আমাদের সান্ত্বনা দিতে পারে?
১১ যিহোবা যা সঠিক ও ন্যায্য তা-ই করেন আর তিনি তা কোনোরকম পক্ষপাতিত্ব না করে সংগতিপূর্ণভাবে করেন। ঐশিক ন্যায়বিচার এক উদাসীন, কঠোর গুণ নয়, যা আমাদের দূরে সরিয়ে দেয় বরং এক চমৎকার গুণ, যা আমাদের যিহোবার নিকটবর্তী করে। বাইবেল এই গুণের হৃদয়গ্রাহী প্রকৃতি সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে। তা হলে, আসুন আমরা তিনটে উপায় দেখি, যেগুলোর মাধ্যমে যিহোবা তাঁর ন্যায়বিচার দেখিয়েছেন।
১২ প্রথমত, যিহোবার ন্যায়বিচার তাঁকে তাঁর দাসদের প্রতি বিশ্বস্ততা ও আনুগত্য দেখাতে পরিচালিত করে। গীতরচক দায়ূদ যিহোবার ন্যায়বিচারের এই দিকটা সরাসরি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তার নিজের অভিজ্ঞতা ও ঈশ্বর যেভাবে কাজ করেন তা পর্যবেক্ষণ করে, দায়ূদ কোন উপসংহারে পৌঁছেছিলেন? তিনি ঘোষণা করেছিলেন: “সদাপ্রভু ন্যায়বিচার ভালবাসেন; তিনি আপন সাধুগণকে [“অনুগত ব্যক্তিদের,” NW] পরিত্যাগ করেন না; তাহারা চিরকাল রক্ষিত হয়।” (গীতসংহিতা ৩৭:২৮) কতই না সান্ত্বনাদায়ক আশ্বাস! যারা আমাদের ঈশ্বরের প্রতি অনুগত তাদের তিনি এক মুহূর্তের জন্য ত্যাগ করবেন না। অতএব, আমরা তাঁর ঘনিষ্ঠতা ও তাঁর প্রেমময় যত্নের ওপর নির্ভর করতে পারি। তাঁর ন্যায়বিচার সেই নিশ্চয়তা দেয়!—হিতোপদেশ ২:৭, ৮.
১৩. যাদের সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য যে যিহোবা চিন্তা করেন, তা কীভাবে ইস্রায়েলকে দেওয়া তাঁর ব্যবস্থায় স্পষ্ট হয়েছে?
১৩ দ্বিতীয়ত, ঐশিক ন্যায়বিচার উৎপীড়িতদের প্রয়োজনের প্রতি অনুভূতিশীল। যাদের সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য যে যিহোবা চিন্তা করেন, তা ইস্রায়েলকে দেওয়া তাঁর ব্যবস্থায় স্পষ্ট। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ব্যবস্থায় অনাথ ও বিধবাদের ভরণপোষণ নিশ্চিত করার বিধান ছিল। (দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১৭-২১) এই পরিবারগুলোর জীবন কতটা কঠিন হতে পারে, তা উপলব্ধি করে যিহোবা নিজেই তাদের পিতৃতুল্য বিচারক ও রক্ষাকর্তা হয়েছিলেন। (দ্বিতীয় বিবরণ ১০:১৭, ১৮) তিনি ইস্রায়েলীয়দের সতর্ক করেছিলেন যে, তারা যদি অসহায় নারী ও শিশুদের নিপীড়ন করে, তা হলে তিনি তাদের কান্না শুনবেন। তিনি বলেছিলেন, “আমার ক্রোধ প্রজ্বলিত হইবে,” যেমন যাত্রাপুস্তক ২২:২২-২৪ পদে লিপিবদ্ধ আছে। ক্রোধ ঈশ্বরের একটা মুখ্য গুণ না হলেও, স্বেচ্ছাকৃত অবিচার করা হলে তিনি ন্যায্য ক্রোধে প্রজ্বলিত হন, বিশেষ করে যখন অসহায় ব্যক্তিরা সেই অবিচারের শিকার হয়।—গীতসংহিতা ১০৩:৬.
১৪. যিহোবার পক্ষপাতহীন মনোভাবের প্রকৃত এক উল্লেখযোগ্য প্রমাণ কী?
১৪ তৃতীয়ত, দ্বিতীয় বিবরণ ১০:১৭ পদে বাইবেল আমাদের আশ্বাস দেয় যে, যিহোবা “কাহারও মুখাপেক্ষা [“পক্ষপাতিত্ব,” NW] করেন না, ও উৎকোচ গ্রহণ করেন না।” ক্ষমতাবান বা প্রভাবশালী অনেক মানুষের বৈসাদৃশ্যে, যিহোবা বস্তুগত ধনসম্পদ বা বাহ্যিক চেহারার দ্বারা প্রভাবিত হন না। তিনি পক্ষপাতশূন্য। তাঁর পক্ষপাতহীন মনোভাবের এক উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হল: অনন্তজীবনের আশা নিয়ে তাঁর সত্য উপাসক হওয়ার সুযোগ কিছু উঁচু শ্রেণীর লোকেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং, প্রেরিত ১০:৩৪, ৩৫ পদ বলে: “ঈশ্বর মুখাপেক্ষা [“পক্ষপাতিত্ব,” NW] করেন না; কিন্তু প্রত্যেক জাতির মধ্যে যে কেহ তাঁহাকে ভয় করে ও ধর্ম্মাচরণ করে, সে তাঁহার গ্রাহ্য হয়।” এই আশা সকলের জন্য, তা তাদের সামাজিক অবস্থান, তাদের চামড়ার রং যা-ই হোক না কেন বা তারা যে-দেশেরই হোক না কেন। এটা কি সর্বোত্তম প্রকৃত ন্যায়বিচার নয়? সত্যিই, যিহোবার ন্যায়বিচার আরও ভালভাবে বোঝা আমাদেরকে তাঁর নিকটবর্তী করে!
‘আহা! ঈশ্বরের প্রজ্ঞা কেমন অগাধ!’
১৫. প্রজ্ঞা কী এবং যিহোবা কীভাবে তা প্রকাশ করেন?
১৫ প্রেরিত পৌল বিস্ময় প্রকাশ করতে পরিচালিত হয়েছিলেন, যা রোমীয় ১১:৩৩ পদে লিপিবদ্ধ করা আছে: “আহা! ঈশ্বরের . . . প্রজ্ঞা ও জ্ঞান . . . কেমন অগাধ!” হ্যাঁ, আমরা যখন যিহোবার অসীম প্রজ্ঞার বিভিন্ন দিক মনোযোগের সঙ্গে চিন্তা করি, তখন আমাদের মধ্যে সশ্রদ্ধ বিস্ময় জেগে উঠবেই। কিন্তু, কীভাবে আমরা এই গুণকে সংজ্ঞায়িত করতে পারি? জ্ঞান, বিচক্ষণতা এবং বোধগম্যতাকে প্রজ্ঞা একত্র করে এবং তারপর সেগুলোকে কাজে লাগায়। তাঁর জ্ঞানের প্রসার ও বোধগম্যতার গভীরতার ওপর নির্ভর করে যিহোবা সবসময় যথাসম্ভব সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত নেন, সেগুলো অনুমেয় সর্বোত্তম কার্যধারার মাধ্যমে পূর্ণ করেন।
১৬, ১৭. যিহোবার সৃষ্টিগুলো কীভাবে তাঁর অসীম প্রজ্ঞার প্রমাণ দেয়? একটা উদাহরণ দিন।
১৬ যিহোবার অসীম প্রজ্ঞার কিছু নির্দিষ্ট প্রমাণ কী? গীতসংহিতা ১০৪:২৪ পদ বলে: “হে সদাপ্রভু, তোমার নির্ম্মিত বস্তু কেমন বহুবিধ! তুমি প্রজ্ঞা দ্বারা সে সমস্ত নির্ম্মাণ করিয়াছ; পৃথিবী তোমার সম্পত্তিতে পরিপূর্ণ।” বাস্তবিকপক্ষে, যিহোবা যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, সেই সম্বন্ধে আমরা যত বেশি জানি, তাঁর প্রজ্ঞা সম্বন্ধে আমরা তত বেশি বিস্মিত হই। শুধু চিন্তা করুন, বিজ্ঞানীরা যিহোবার সৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করে অনেক কিছু জেনেছে! এমনকি বায়োমিমেটিক্স বিদ্যা নামে প্রকৌশলবিদ্যায় একটা ক্ষেত্র রয়েছে, যা প্রকৃতি থেকে পাওয়া নকশাগুলোকে নকল করে।
১৭ উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, আপনি হয়তো আশ্চর্য হয়ে মাকড়সার জালের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন। এটা সত্যিই এক চমৎকার নকশা। দেখতে দুর্বল এমন কিছু সুতা সমানুপাতিকভাবে ইস্পাতের চেয়েও বেশি শক্ত, একটা বুলেটপ্রুফ অন্তর্বাসের তন্তুর চেয়েও বলিষ্ঠ। সেটার অর্থ আসলে কী? এমন একটা মাকড়সার জালের কথা কল্পনা করুন, যা মাছ ধরার নৌকায় ব্যবহৃত একটা জালের সমান বড়। এইরকম একটা জাল এতটাই শক্ত হবে যে, তা একটা যাত্রীবাহী উড়োজাহাজকে পর্যন্ত উড়ন্ত অবস্থায় থামিয়ে দিতে পারে! হ্যাঁ, যিহোবা “প্রজ্ঞা দ্বারা” এই সমস্ত কিছু তৈরি করেছেন।
১৮. যিহোবা তাঁর বাক্য বাইবেল লিপিবদ্ধ করার জন্য যে মানুষকে ব্যবহার করেছেন, সেটার মধ্যে কীভাবে তাঁর প্রজ্ঞা দেখা যায়?
১৮ যিহোবার প্রজ্ঞার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তাঁর বাক্য, বাইবেলে পাওয়া যেতে পারে। এতে পাওয়া বিজ্ঞ পরামর্শ সত্যিই আমাদের বেঁচে থাকার সর্বোত্তম উপায় দেখায়। (যিশাইয় ৪৮:১৭) কিন্তু, যিহোবার অতুলনীয় প্রজ্ঞা বাইবেল যেভাবে লেখা হয়েছিল তাতেও দেখা যায়। কীভাবে? যিহোবা তাঁর প্রজ্ঞা ব্যবহার করে তাঁর বাক্য লিখে রাখার জন্য মানুষদের মনোনীত করেছিলেন। অনুপ্রাণিত বাক্য লেখার জন্য তিনি যদি দূতেদের ব্যবহার করতেন, তা হলে বাইবেলের কি একই আবেদন থাকত? এটা স্বীকার করতেই হবে যে, দূতেরা তাদের উচ্চতর দৃষ্টিকোণ থেকে যিহোবার প্রকৃতি বর্ণনা করতে পারত ও তাঁর প্রতি তাদের ভক্তি প্রকাশ করতে পারত। কিন্তু আমরা কি সিদ্ধ আত্মিক প্রাণীদের, যাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও শক্তি আমাদের চেয়ে অনেক অনেক গুণ শ্রেষ্ঠ, তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একাত্ম হতে পারতাম?
১৯. কোন উদাহরণ দেখায় যে, মনুষ্য লেখকদের ব্যবহার করা বাইবেলকে অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও আবেদনময় করে তোলে?
১৯ মনুষ্য লেখকদের ব্যবহার বাইবেলকে অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও আবেদনময় করে তোলে। এর লেখকরা আমাদের মতো একই অনুভূতিশীল মানুষ ছিল। অসিদ্ধ হওয়ায়, তারা আমাদের মতো একই পরীক্ষা ও চাপের মুখোমুখি হয়েছিল। কিছু ক্ষেত্রে, তারা তাদের অনুভূতি ও লড়াইগুলো সম্বন্ধে নিজেরাই লিখেছে। (২ করিন্থীয় ১২:৭-১০) তাই তারা যে-কথাগুলো লিখেছে, সেগুলো কোনো দূতই প্রকাশ করতে পারত না। উদাহরণ হিসেবে, ৫১ গীতে লিপিবদ্ধ দায়ূদের কথাগুলো বিবেচনা করুন। এই অধ্যায়ের শীর্ষলিখন অনুসারে, দায়ূদ গুরুতর পাপ করার পর এই গীত রচনা করেছিলেন। তিনি তার হৃদয় ঢেলে দিয়েছিলেন, গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন ও ঈশ্বরের ক্ষমা ভিক্ষা চেয়েছিলেন। ২ ও ৩ পদ বলে: “আমার অপরাধ হইতে আমাকে নিঃশেষে ধৌত কর, আমার পাপ হইতে আমাকে শুচি কর। কেননা আমি নিজে আমার অধর্ম্ম সকল জানি; আমার পাপ সতত আমার সম্মুখে আছে।” ৫ পদ লক্ষ করুন: “দেখ, অপরাধে আমার জন্ম হইয়াছে, পাপে আমার মাতা আমাকে গর্ব্ভে ধারণ করিয়াছিলেন।” ১৭ পদ আরও বলে: “ঈশ্বরের গ্রাহ্যবলি ভগ্ন আত্মা; হে ঈশ্বর, তুমি ভগ্ন ও চূর্ণ অন্তঃকরণ তুচ্ছ করিবে না।” আপনি কি লেখকের যন্ত্রণা অনুভব করতে পারছেন না? একজন অসিদ্ধ মানুষ ছাড়া আর কে এইরকম অনুভূতি প্রকাশ করতে পারত?
২০, ২১. (ক) কেন বলা যেতে পারে যে, মনুষ্য লেখকদের ব্যবহার করা সত্ত্বেও বাইবেলে যিহোবার প্রজ্ঞা রয়েছে? (খ) পরের প্রবন্ধে কোন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে?
২০ এইরকম অসিদ্ধ মানুষদের ব্যবহার করে যিহোবা ঠিক তা-ই জুগিয়েছিলেন, যা আমাদের দরকার—একটা নথি, যা “ঈশ্বর-নিশ্বসিত” কিন্তু মানব প্রকৃতিকে ধরে রাখে। (২ তীমথিয় ৩:১৬) হ্যাঁ, ওই লেখকরা পবিত্র আত্মার দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। আর এভাবে তারা নিজেদের নয় বরং, যিহোবার প্রজ্ঞা লিপিবদ্ধ করেছিল। সেই প্রজ্ঞা সম্পূর্ণভাবে নির্ভরযোগ্য। এটা আমাদের প্রজ্ঞা থেকে এতটাই উঁচুতে যে, ঈশ্বর প্রেমের সঙ্গে আমাদের পরামর্শ দেন: “তুমি সমস্ত চিত্তে সদাপ্রভুতে বিশ্বাস কর; তোমার নিজ বিবেচনায় নির্ভর করিও না; তোমার সমস্ত পথে তাঁহাকে স্বীকার কর; তাহাতে তিনি তোমার পথ সকল সরল করিবেন।” (হিতোপদেশ ৩:৫, ৬) ওই বিজ্ঞ পরামর্শ শোনার মাধ্যমে, আমরা সর্বজ্ঞানী ঈশ্বরের নিকটবর্তী হই।
২১ যিহোবার গুণাবলির মধ্যে সবচেয়ে প্রীতিকর ও চমৎকার গুণ হল প্রেম। যিহোবা কীভাবে প্রেম দেখিয়েছেন, তা পরের প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে।
আপনি কি মনে করতে পারেন?
• যিহোবার সঙ্গে আমাদের অন্তরঙ্গতা গড়ে তোলা সম্ভবপর করতে তিনি কোন পদক্ষেপগুলো নিয়েছেন?
• যিহোবার সৃজনীশক্তি ও তাঁর প্রতিরক্ষামূলক শক্তির কিছু উদাহরণ কী?
• কোন কোন উপায়ে যিহোবা তাঁর ন্যায়বিচার অনুশীলন করেন?
• সৃষ্টি ও সেইসঙ্গে বাইবেলের মধ্যে কীভাবে যিহোবার প্রজ্ঞা দেখা যায়?
এই দুটো অধ্যয়ন প্রবন্ধে যে-তথ্যগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, সেগুলো যিহোবার নিকটবর্তী হোন (ইংরেজি) বইয়ের ওপর ভিত্তি করে, যেটি ২০০২/০৩ সালে সারা পৃথিবীতে অনুষ্ঠিত জেলা সম্মেলনগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে।—২০ পৃষ্ঠায় “এটি আমার হৃদয়ের এক শূন্যতাকে ভরিয়ে দিয়েছে” প্রবন্ধটি দেখুন।
[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]
একজন মেষপালকের মতো, যিনি একটি মেষকে কোলে তুলে নেন, যিহোবা তাঁর মেষদের কোমলভাবে যত্ন নেন
[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
বাইবেল যেভাবে লেখা হয়েছে, সেটার মধ্যে যিহোবার প্রজ্ঞা দেখা যায়