অধ্যায় ৫
সৃজনীশক্তি—‘আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর নির্মাতা’
১, ২. সূর্য কীভাবে যিহোবার সৃজনীশক্তি প্রদর্শন করে?
আপনি কি কখনও এক শীতের রাতে আগুনের সামনে দাঁড়িয়েছেন? আপনি হয়তো বিকীর্ণ উষ্ণতা উপভোগ করার জন্য আগুনের শিখা থেকে একেবারে সঠিক দূরত্বে হাত রেখেছিলেন। আপনি যদি হাত বেশি কাছে রাখতেন, তা হলে তাপ অসহনীয় হয়ে উঠত। আবার যদি বেশি দূরে রাখতেন, তা হলে শীতের রাতের বাতাস আপনাকে ঘিরে ধরত ও আপনি ঠাণ্ডা অনুভব করতেন।
২ এমন এক “আগুন” রয়েছে, যা দিনে আমাদের চামড়াকে গরম রাখে। সেই “আগুন” প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার দূর থেকে জ্বলছে!a এত দূর থেকেও সূর্য আপনাকে এর তাপ অনুভব করাতে সমর্থ, তা হলে এর কতই না শক্তি রয়েছে! কিন্তু পৃথিবী ওই বিশাল তাপমান পারমাণবিক অগ্নিকুণ্ড থেকে একেবারে সঠিক দূরত্ব বজায় রেখে কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে। যদি বেশি কাছে থাকত, তা হলে পৃথিবীর জল বাষ্প হয়ে যেত; আর বেশি দূরে হলে তা জমে বরফ হয়ে যেত। কোনো এক দিকে চরম হলেই আমাদের গ্রহ প্রাণহীন হয়ে পড়ত। সূর্যের আলো পৃথিবীতে জীবনের জন্য অপরিহার্য হওয়া ছাড়াও এটা বিশুদ্ধ ও ফলপ্রদ আর সেইসঙ্গে পরম আনন্দ দান করে।—উপদেশক ১১:৭.
যিহোবা ‘জ্যোতিষ্ক ও সূর্য্য রচনা করিয়াছেন’
৩. সূর্য কোন গুরুত্বপূর্ণ সত্য সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেয়?
৩ তা সত্ত্বেও, বেশির ভাগ লোক সূর্যকে হালকাভাবে দেখে, যদিও তাদের জীবন এর ওপর নির্ভর করে। এভাবে, সূর্য আমাদের যা শিক্ষা দিতে পারে, তারা তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়। যিহোবার সম্বন্ধে বাইবেল বলে: “তুমিই জ্যোতিষ্ক ও সূর্য্য রচনা করিয়াছ।” (গীতসংহিতা ৭৪:১৬) হ্যাঁ, সূর্য ‘আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর নির্মাতা’ যিহোবার সম্মান নিয়ে আসে। (গীতসংহিতা ১৯:১; ১৪৬:৬, NW) এটা আকাশের অগণিত জ্যোতিষ্কমণ্ডলী, যেগুলো যিহোবার সৃষ্টি করার অপরিমেয় শক্তি সম্বন্ধে আমাদের শিক্ষা দেয়, সেগুলোর মধ্যে শুধু একটা। আসুন আমরা এগুলোর কয়েকটাকে আরও ভালভাবে পরীক্ষা করি এবং তারপর পৃথিবী ও এর মধ্যে গড়ে ওঠা জীবনের দিকে মনোযোগ দিই।
“উর্দ্ধ্বদিকে চক্ষু তুলিয়া দেখ”
৪, ৫. সূর্য কতটা শক্তিশালী ও কতটা বিশাল কিন্তু অন্য নক্ষত্রগুলোর সঙ্গে এটাকে কীভাবে তুলনা করা যায়?
৪ আপনি হয়তো জানেন যে আমাদের সূর্য হল একটা নক্ষত্র। এটাকে রাতে আমরা যে-নক্ষত্রগুলো দেখি, সেগুলোর চেয়ে বড় মনে হয় কারণ সেগুলোর তুলনায় এটা বেশ কাছে। এটা কতটা শক্তিশালী? সূর্যের কেন্দ্রস্থলে এর তাপমাত্রা প্রায় ১,৫০,০০,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আপনি যদি সূর্যের কেন্দ্রস্থল থেকে একটা আলপিনের মাথার সমান টুকরো নিয়ে পৃথিবীতে রাখতে পারতেন, তা হলে আপনি সেই ক্ষুদ্র তাপের উৎসের ১৪০ কিলোমিটারের মধ্যে নিরাপদে দাঁড়াতে পারতেন না! প্রতি সেকেন্ডে, সূর্য যে-শক্তি নির্গত করে তা কোটি কোটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের সমান।
৫ সূর্য এতটাই বিশাল যে, তাতে আমাদের পৃথিবীর সমান ১৩,০০,০০০-রও বেশি গ্রহ ধরবে। সূর্য কি অস্বাভাবিক রকমের বড় এক নক্ষত্র? না, জ্যোতির্বিদরা এটাকে হলুদ বামন বলে। প্রেরিত পৌল লিখেছিলেন যে, “তেজ সম্বন্ধে একটী নক্ষত্র হইতে অন্য নক্ষত্র ভিন্ন।” (১ করিন্থীয় ১৫:৪১) তিনি জানতে পারেননি যে, সেই অনুপ্রাণিত বাক্যগুলো কতটা সত্য। এমন এক বিরাট নক্ষত্র রয়েছে যে, এটাকে যদি ঠিক সূর্যের অবস্থানে স্থাপন করা হতো, তা হলে আমাদের পৃথিবী এটার ভিতরে থাকত। আরেকটা প্রকাণ্ড নক্ষত্রকে যদি একই অবস্থানে স্থাপন করা হতো, তা হলে সেটা শনি গ্রহে গিয়ে ঠেকত, যদিও সেই গ্রহটা পৃথিবী থেকে এত দূরে যে, একটা মহাকাশযানের সেখানে পৌঁছাতে চার বছর লেগেছিল, যেটা একটা শক্তিশালী বন্দুক থেকে ছোড়া গুলির চেয়ে ৪০ গুণ বেশি বেগে ভ্রমণ করেছিল!
৬. বাইবেল কীভাবে দেখায় যে, মানুষ যা দেখতে পায় সেটার চেয়েও নক্ষত্রদের সংখ্যা আরও ব্যাপক?
৬ নক্ষত্রগুলোর আকারের চেয়ে আরও বিস্ময়কর হল সেগুলোর সংখ্যা। সত্যি বলতে কী, বাইবেল জানায় যে, নক্ষত্রদের সংখ্যা অগণিত আর এগুলো “সমুদ্রের বালি” গণনা করার মতোই কঠিন। (যিরমিয় ৩৩:২২) এই উক্তি ইঙ্গিত করে যে, খালি চোখে যত নক্ষত্র দেখা যায় সেটার চেয়ে আরও অনেক অনেক বেশি নক্ষত্র রয়েছে। একজন বাইবেল লেখক যেমন, যিরমিয় যদি রাতের আকাশে তাকাতেন ও দৃশ্যমান নক্ষত্রগুলো গণনা করার চেষ্টা করতেন, তা হলে তিনি শুধু তিন হাজার বা এর কিছু বেশি নক্ষত্র গণনা করতে পারতেন কারণ পরিষ্কার এক রাতে মানুষ খালি চোখে ততগুলো নক্ষত্রই গণনা করতে পারে। সেই সংখ্যা হয়তো শুধু একমুঠো বালির মধ্যে থাকা বালুকণার সংখ্যার সমান হতো। কিন্তু, বাস্তবে নক্ষত্রগুলোর সংখ্যা সমুদ্রের বালির মতোই অসংখ্য।b কে এই সংখ্যা গণনা করতে পারে?
৭. (ক) আমাদের মিল্কিওয়ে ছায়াপথে প্রায় কতগুলো নক্ষত্র রয়েছে আর সেটা কতটা বিরাট সংখ্যা? (খ) জ্যোতির্বিদরা যে ছায়াপথের সংখ্যা নির্ধারণ করাকে কঠিন বলে মনে করে, তা কেন তাৎপর্যপূর্ণ আর এটা যিহোবার সৃজনীশক্তি সম্বন্ধে আমাদের কী শেখায়?
৭ যিশাইয় ৪০:২৬ পদ উত্তর দেয়: “ঊর্দ্ধ্বদিকে চক্ষু তুলিয়া দেখ, ঐ সকলের সৃষ্টি কে করিয়াছে? তিনি বাহিনীর ন্যায় সংখ্যানুসারে তাহাদিগকে বাহির করিয়া আনেন, সকলের নাম ধরিয়া তাহাদিগকে আহ্বান করেন।” গীতসংহিতা ১৪৭:৪ পদ বলে: “তিনি তারাগণের সংখ্যা গণনা করেন।” “তারাগণের সংখ্যা” কত? এটা কোনো সহজ প্রশ্ন নয়। জ্যোতির্বিদরা অনুমান করে যে, শুধু আমাদের মিল্কিওয়ে ছায়াপথেই ১০,০০০ কোটিরও বেশি তারা বা নক্ষত্র রয়েছে।c কিন্তু আমাদের ছায়াপথ হল, অনেক ছায়াপথের মধ্যে শুধু একটা আর সেগুলোর অনেকগুলোতে এমনকি আরও বেশি নক্ষত্র রয়েছে। কতগুলো ছায়াপথ রয়েছে? কিছু জ্যোতির্বিদ অনুমান করে যে, ৫,০০০ কোটি। অন্যেরা হিসেব করেছেন যে, ১২,৫০০ কোটির মতো থাকতে পারে। মানুষ ছায়াপথের সঠিক সংখ্যাই নির্ধারণ করতে পারে না, সেগুলোতে যে শত শত কোটি নক্ষত্র রয়েছে সেটার কথা উল্লেখ নাই বা করা হল। তবে, যিহোবা সেই সংখ্যা জানেন। অধিকন্তু, তিনি প্রতিটা নক্ষত্রকে নিজস্ব নাম দেন!
৮. (ক) আপনি কীভাবে মিল্কিওয়ে ছায়াপথের আকার ব্যাখ্যা করবেন? (খ) কীসের মাধ্যমে যিহোবা গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করেন?
৮ ছায়াপথগুলোর আকার সম্বন্ধে চিন্তা করলে আমাদের সশ্রদ্ধ ভয় আরও বেড়ে যেতে পারে। মিল্কিওয়ে ছায়াপথের আয়তন প্রায় ১,০০,০০০ আলোকবর্ষ প্রশস্ত। এমন একটা আলোকরশ্মির কথা চিন্তা করুন, যেটা প্রতি সেকেন্ডে ৩,০০,০০০ কিলোমিটার পথ পরিভ্রমণ করে। সেই রশ্মির আমাদের ছায়াপথ আড়াআড়িভাবে পার হতে ১,০০,০০০ বছর লাগবে! আর কিছু ছায়াপথ রয়েছে, যেগুলোর আকার আমাদের ছায়াপথের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বড়। বাইবেল বলে যে, যিহোবা এই বিশাল আকাশমণ্ডলকে “বিস্তার” করছেন যেন সেগুলো সামান্য কাপড়। (গীতসংহিতা ১০৪:২) এ ছাড়া, তিনি এই সৃষ্ট বস্তুগুলোর গতিবিধিও নিয়ন্ত্রণ করেন। মহাকাশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা থেকে বড় বড় ছায়াপথ, সবকিছুই ভৌত নিয়ম অনুযায়ী চলে, যা ঈশ্বর তৈরি ও কার্যকর করেছেন। (ইয়োব ৩৮:৩১-৩৩) এই কারণে, বিজ্ঞানীরা গ্রহ-নক্ষত্রের নির্ভুল গতিবিধিকে এক জটিল নৃত্যের প্রণয়ন-কলার সঙ্গে তুলনা করেছেন! এখন, তা হলে যিনি এই বস্তুগুলো সৃষ্টি করেছেন, তাঁর সম্বন্ধে চিন্তা করুন। আপনি কি এইরকম অপরিমেয় সৃজনীশক্তিসম্পন্ন ঈশ্বরকে সশ্রদ্ধ ভয় পান না?
“নিজ শক্তিতে পৃথিবী গঠন করিয়াছেন”
৯, ১০. আমাদের সৌরজগৎ, বৃহস্পতি গ্রহ, পৃথিবী ও চাঁদের অবস্থান থেকে যিহোবার শক্তি কীভাবে স্পষ্ট হয়?
৯ যিহোবার সৃজনীশক্তি আমাদের গৃহ, এই পৃথিবীতে স্পষ্ট দেখা যায়। তিনি পৃথিবীকে এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে খুবই যত্নের সঙ্গে স্থাপন করেছেন। অনেক বিজ্ঞানী মনে করে যে, আমাদের এই জীবন-বহনকারী গ্রহের সঙ্গে তুলনা করলে, অনেক ছায়াপথই বেঁচে থাকার অনুপযোগী বলে প্রমাণিত হতে পারে। আমাদের মিল্কিওয়ে ছায়াপথের বেশির ভাগ অংশই জীবন ধারণ করার উপযোগী করে তৈরি করা হয়নি। ছায়াপথের কেন্দ্রস্থল নক্ষত্রে ভরা। তাপ বিকিরণ অত্যন্ত বেশি এবং সচরাচরই নক্ষত্রগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। ছায়াপথের বহিঃস্থ সীমাগুলোতে জীবনের জন্য অপরিহার্য অনেক উপাদান নেই। আমাদের সৌরজগৎ এই উভয় চরম অবস্থার মধ্যবর্তী স্থানে উপযুক্তভাবে স্থাপিত।
১০ পৃথিবী এক দূরবর্তী ও সেইসঙ্গে বিরাটকায় রক্ষক, বৃহস্পতি গ্রহ থেকে উপকার লাভ করে। পৃথিবীর আকারের চেয়ে এক হাজার গুণেরও বেশি বড় এই বৃহস্পতি গ্রহ প্রচুর মহাকর্ষীয় প্রভাব নির্গত করে। এর ফল কী হয়? এটা মহাশূন্যে গতিশীল বস্তুগুলোকে শোষণ করে বা ভিন্ন পথে পরিচালিত করে। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে বলে যে, যদি বৃহস্পতি গ্রহ না থাকত, তা হলে পৃথিবীকে আঘাতকারী ভারী ভারী প্রক্ষিপ্ত বস্তুর বর্ষণ বর্তমানের চেয়ে ১০,০০০ গুণ বেশি তীব্র হতো। আমাদের গৃহ পৃথিবী এর নিকটবর্তী এক অসাধারণ উপগ্রহ থেকে উপকার লাভ করে আর সেটা হল চাঁদ। সৌন্দর্যের এক বস্তু ও “রাতের আলো” ছাড়াও, চাঁদ পৃথিবীকে এক অবিচল, স্থির গতিপথে ধরে রেখেছে। সেই গতিপথই পৃথিবীকে স্থায়ী ও আগে থেকে নির্দিষ্ট ঋতুগুলো এনে দেয়—যা এখানকার জীবনের জন্য আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দান।
১১. পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল কীভাবে এক রক্ষামূলক ঢাল হিসেবে কাজ করার জন্য গঠিত?
১১ পৃথিবীর গঠনের প্রতিটা দিকে যিহোবার সৃজনীশক্তি স্পষ্ট হয়। বায়ুমণ্ডলের কথা চিন্তা করুন, যেটা এক রক্ষামূলক ঢাল হিসেবে কাজ করে। সূর্য স্বাস্থ্যকর ও মারাত্মক দুই ধরনের রশ্মিই নির্গত করে। যখন মারাত্মক রশ্মিগুলো পৃথিবীর ওপরের বায়ুমণ্ডলে আঘাত করে, তখন সেগুলো সাধারণ অক্সিজেনগুলোকে ওজোনে পরিণত করে। এর ফলস্বরূপ, সৃষ্ট ওজোন স্তর ওই বেশির ভাগ রশ্মিগুলোকে শোষণ করে। বস্তুত, আমাদের গ্রহ নিজস্ব রক্ষামূলক আবরণ সহ গঠিত!
১২. বায়ুমণ্ডলীয় জলচক্র কীভাবে যিহোবার সৃজনীশক্তিকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে?
১২ সেটা আমাদের বায়ুমণ্ডলের শুধু একটা দিক, বিভিন্ন গ্যাসের এক জটিল মিশ্রণ ভূপৃষ্ঠের ওপরে বা কাছাকাছি থাকা প্রাণীদের অস্তিত্বে থাকার জন্য যথোপযুক্তভাবে উপযোগী। বায়ুমণ্ডলের আশ্চর্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে জলচক্র। প্রতি বছর সূর্য বাষ্পীভবনের মাধ্যমে পৃথিবীর মহাসমুদ্র ও সমুদ্রগুলো থেকে ৪,০০,০০০ ঘন কিলোমিটার জল তুলে নেয়। জল মেঘ গঠন করে, যা বায়ুমণ্ডলীয় বায়ুর মাধ্যমে দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এই জল পরিশ্রুত ও বিশোধিত হয়ে বৃষ্টি, তুষার ও বরফের আকারে পড়ে জলের ভাণ্ডারগুলোকে আবারও পূর্ণ করে। এটা ঠিক উপদেশক ১:৭ পদে বলা কথাগুলোর মতো: “জলস্রোত সকল সমুদ্রে প্রবেশ করে, তথাচ সমুদ্র পূর্ণ হয় না; জলস্রোত সকল যে স্থানে যায়, সেই স্থানে পুনরায় চলিয়া যায়।” একমাত্র যিহোবাই এইরকম একটা চক্র সৃষ্টি করতে পারেন।
১৩. পৃথিবীর উদ্ভিদ ও মাটিতে আমরা সৃষ্টিকর্তার শক্তির কোন প্রমাণ দেখি?
১৩ আমরা যেখানেই জীবন দেখি, সেখানেই সৃষ্টিকর্তার শক্তির প্রমাণ দেখতে পাই। ৩০ তলা ভবনের চেয়েও উঁচু রেডউড প্রজাতির বিরাটকায় গাছগুলো থেকে শুরু করে অনুবীক্ষণীয় উদ্ভিদ জগৎ, যা সমুদ্রে জন্মে এবং আমাদের গ্রহণের জন্য এগুলো যে-বেশির ভাগ অক্সিজেন সরবরাহ করে, সেগুলোর মধ্যে যিহোবার সৃজনীশক্তি স্পষ্ট দেখা যায়। মাটিও বিভিন্ন রকমের জীবন্ত বস্তুর দ্বারা পূর্ণ—কীট, ছত্রাক ও জীবাণু, সবগুলো একসঙ্গে জটিল উপায়ে কাজ করে আর তা গাছগুলোকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। উপযুক্তভাবেই, বাইবেল বলে যে, মাটির শক্তি রয়েছে।—আদিপুস্তক ৪:১২.
১৪. এমনকি ক্ষুদ্র পরমাণুতে কোন সুপ্ত শক্তি রয়েছে?
১৪ নিঃসন্দেহে, যিহোবা “নিজ শক্তিতে পৃথিবী গঠন করিয়াছেন।” (যিরমিয় ১০:১২) ঈশ্বরের শক্তি এমনকি তাঁর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সৃষ্টির মধ্যেও স্পষ্ট। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, দশ লক্ষ পরমাণু পাশাপাশি রাখলেও তা মানুষের একটা চুলের সমান পুরু হবে না। আর এমনকি একটা পরমাণুকে যদি ১৪ তলাবিশিষ্ট বিল্ডিংয়ের সমান প্রসারিত করা হয়, তা হলে এর নিউক্লিয়াস সেই বিল্ডিংয়ের সাত তলায় অবস্থিত সামান্য লবণের একটা কণার আকার হতো। অথচ, সেই অতি ক্ষুদ্র নিউক্লিয়াসই ভয়ংকর শক্তির উৎস, যা এক পারমাণবিক বিস্ফোরণের সময় নির্গত হয়!
“শ্বাসবিশিষ্ট সকলেই”
১৫. বিভিন্ন বন্য পশুদের সম্বন্ধে বলে, ইয়োবকে যিহোবা কোন শিক্ষা দিয়েছিলেন?
১৫ যিহোবার সৃজনীশক্তির আরেকটা জীবন্ত প্রমাণ পৃথিবীর প্রাণীজগতের প্রাচুর্যের মধ্যে রয়েছে। গীতসংহিতা ১৪৮ অধ্যায় এমন অনেক কিছুকে তালিকাভুক্ত করে, যেগুলো যিহোবার প্রশংসা করে আর ১০ পদ ‘বন্য পশু ও সমস্ত গ্রাম্য পশুদের’ অন্তর্ভুক্ত করে। মানুষের কেন সৃষ্টিকর্তাকে সশ্রদ্ধ ভয় করা উচিত, তা দেখানোর জন্য যিহোবা একবার ইয়োবকে এই পশুগুলো সম্বন্ধে বলেছিলেন যেমন সিংহ, জেব্রা, বুনো ষাঁড়, বেহেমোৎ (বা জলহস্তী) ও লিবিয়াথন (স্পষ্টতই কুমির)। আসল বিষয়টা কী ছিল? কোনো মানুষ যদি এই শক্তিশালী, ভয়ংকর ও পোষ মানানো যায় না এমন প্রাণীদের ভয় পায়, তা হলে এগুলোর সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার কেমন বোধ করা উচিত?—ইয়োব, ৩৮-৪১ অধ্যায়।
১৬. যিহোবার সৃষ্ট কিছু পাখির কোন বিষয়টা আপনাকে মুগ্ধ করে?
১৬ গীতসংহিতা ১৪৮:১০ পদ ‘উড্ডীয়মান পক্ষী সকলের’ কথাও উল্লেখ করে। শুধু একবার বৈচিত্র্যের কথা চিন্তা করুন! ইয়োবকে যিহোবা উটপাখির কথা বলেছিলেন, যেটা “অশ্বকে ও তদারোহীকে পরিহাস করে।” বাস্তবিকপক্ষে, এই আড়াই মিটার লম্বা পাখি উড়তে না পারলেও, ঘন্টায় ৬৫ কিলোমিটার বেগে দৌড়াতে পারে, একটা পদক্ষেপে সাড়ে চার মিটার পর্যন্ত পথ অতিক্রম করে! (ইয়োব ৩৯:১৩, ১৮) অন্যদিকে, অ্যালব্যাট্রস পাখি এর জীবনের বেশির ভাগ সময় সমুদ্রের ওপরে বাতাসে কাটায়। এক প্রাকৃতিক বিমান হিসেবে এই পাখির পাখার প্রসারতার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ মিটার। এটা পাখা না ঝাঁপটিয়ে একবারে কয়েক ঘন্টা উঁচুতে শূন্যে উড়ন্ত অবস্থায় থাকতে পারে। এর বিপরীতে, মাত্র ৫ সেন্টিমিটার লম্বা বি হামিংবার্ড বিশ্বের সবচেয়ে ছোট পাখি। এটা প্রতি সেকেন্ডে ৮০ বার পর্যন্ত পাখা ঝাঁপটাতে পারে! ছোট্ট ডানাওয়ালা হামিংবার্ডগুলো রত্নের মতো চকচক করে, যেগুলো হেলিকপ্টারের মতো বাতাসে ভেসে থাকতে ও এমনকি পিছনের দিকে উড়তে পারে।
১৭. নীল তিমি কত বড় আর যিহোবার প্রাণীজগতের সৃষ্টি সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করার পর স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কোন উপসংহারে পৌঁছানো উচিত?
১৭ গীতসংহিতা ১৪৮:৭ পদ বলে যে, এমনকি “প্রকাণ্ড জলচর সকল” যিহোবার প্রশংসা করে। নীল তিমির কথা চিন্তা করুন, যেটাকে এই গ্রহের সবচেয়ে বড় প্রাণী হিসেবে মনে করা হয়। মহাসমুদ্রে বাসকারী এই “প্রকাণ্ড” প্রাণী ৩০ মিটার বা এর বেশি লম্বা হতে পারে। এর ওজন ৩০টা পূর্ণবয়স্ক হাতির একটা পালের সমান হতে পারে। শুধু এর জিহ্বার ওজনই একটা হাতির সমান। এর হৃৎপিণ্ডের আকার একটা ছোট গাড়ির সমান। এই বিরাট অঙ্গ প্রতি মিনিটে মাত্র ৯ বার স্পন্দিত হয়—এর বিপরীতে হামিংবার্ডের হৃৎপিণ্ড প্রতি মিনিটে ১,২০০ বার স্পন্দিত হয়। নীল তিমির অন্তত একটা রক্তবাহী শিরা এত বড় যে, একটি বাচ্চা এর ভিতর দিয়ে হামাগুড়ি দিতে পারবে। নিশ্চিতভাবে, আমাদের হৃদয় সেই পরামর্শকে প্রতিধ্বনিত করতে পরিচালিত হয়, যা দিয়ে গীতসংহিতার বই শেষ হয়: “শ্বাসবিশিষ্ট সকলেই সদাপ্রভুর প্রশংসা করুক।”—গীতসংহিতা ১৫০:৬.
যিহোবার সৃজনীশক্তি থেকে শেখা
১৮, ১৯. যিহোবা এই পৃথিবীতে যে-জীবন্ত বস্তুগুলো সৃষ্টি করেছেন, তা কতটা বৈচিত্র্যময় এবং সৃষ্টি তাঁর সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধে আমাদের কী শেখায়?
১৮ যিহোবার নিজ সৃজনীশক্তি ব্যবহার করা থেকে আমরা কী শিখি? আমরা সৃষ্টির বৈচিত্র্য দেখে বিস্মিত। একজন গীতরচক বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন: “হে সদাপ্রভু, তোমার নির্ম্মিত বস্তু কেমন বহুবিধ! . . . পৃথিবী তোমার সম্পত্তিতে পরিপূর্ণ।” (গীতসংহিতা ১০৪:২৪) কতই না সত্য! জীববিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে জীবন্ত বস্তুর ১০ লক্ষেরও বেশি প্রজাতি শনাক্ত করেছে; তবে এই ধারণা বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন যেমন, কেউ বলে ১ কোটি আবার কেউ কেউ বলে ৩ কোটি বা আরও বেশি। একজন মানব শিল্পীর সৃজনশীলতা হয়তো কখনও কখনও ফুরিয়ে যেতে পারে। এর বিপরীতে, যিহোবার সৃজনশীলতা—নতুন নতুন ও বৈচিত্র্যময় জিনিস উদ্ভাবন ও সৃষ্টি করার বিষয়ে তাঁর শক্তি—স্পষ্টতই অশেষ।
১৯ যিহোবার সৃজনীশক্তির ব্যবহার আমাদেরকে তাঁর সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধে শেখায়। “সৃষ্টিকর্তা” শব্দটিই যিহোবাকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্তকিছু থেকে পৃথক করে, যেখানে সবই হল “সৃষ্টি।” এমনকি যিহোবার একজাত পুত্র, যিনি সৃষ্টি করার সময় “কার্য্যকারী” [“সুদক্ষ কর্মী,” NW] হিসেবে কাজ করেছিলেন, তাঁকে কখনও বাইবেলে সৃষ্টিকর্তা বলা হয়নি। (হিতোপদেশ ৮:৩০; মথি ১৯:৪) বরং, তিনি হলেন “সমুদয় সৃষ্টির প্রথমজাত।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) (কলসীয় ১:১৫) সৃষ্টিকর্তা হিসেবে যিহোবার অবস্থান তাঁকে তাঁর ঐকান্তিক সার্বভৌম শক্তি সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ওপর ব্যবহার করার সহজাত অধিকার দেয়।—রোমীয় ১:২০; প্রকাশিত বাক্য ৪:১১.
২০. কোন অর্থে যিহোবা তাঁর পার্থিব সৃষ্টি সম্পূর্ণ করার সময় থেকে বিশ্রাম নিয়েছেন?
২০ যিহোবা কি তাঁর সৃজনীশক্তিকে ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়েছেন? বাইবেল বলে যে, যিহোবা যখন সৃষ্টির ষষ্ঠ দিনে তাঁর সৃষ্টিকাজ শেষ করেন, তখন থেকে তিনি “সেই সপ্তম দিনে আপনার কৃত সমস্ত কার্য্য হইতে বিশ্রাম করিলেন।” (আদিপুস্তক ২:২) প্রেরিত পৌল ইঙ্গিত করেছিলেন যে, এই সপ্তম ‘দিন’ হল হাজার হাজার বছর দীর্ঘ কারণ এটা তার দিনেও চলছিল। (ইব্রীয় ৪:৩-৬) কিন্তু “বিশ্রাম” মানে কি এই যে, যিহোবা সম্পূর্ণভাবে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছেন? না, যিহোবা কখনোই কাজ বন্ধ করেন না। (গীতসংহিতা ৯২:৪; যোহন ৫:১৭) তা হলে, তাঁর বিশ্রাম অবশ্যই পৃথিবী সম্বন্ধে তাঁর ভৌত সৃষ্টির কাজ থেকে বিরত হওয়াকে নির্দেশ করে। কিন্তু, তাঁর উদ্দেশ্যগুলো পরিপূর্ণ করার কাজ অবাধে চলছে। পবিত্র শাস্ত্রের অনুপ্রেরণাও এইরকম কাজের অন্তর্ভুক্ত। এমনকি তাঁর কাজ ‘নূতন সৃষ্টির’ উৎপাদনকে অন্তর্ভুক্ত করে, যা ১৯ অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে।—২ করিন্থীয় ৫:১৭.
২১. যিহোবার সৃজনীশক্তি কীভাবে অনন্তকাল জুড়ে বিশ্বস্ত মানুষদের প্রভাবিত করবে?
২১ যিহোবার বিশ্রাম দিন যখন শেষ হবে, তখন তিনি পৃথিবীতে তাঁর সমস্ত কাজ “অতি উত্তম” বলে ঘোষণা করতে পারবেন, যেমন তিনি ষষ্ঠ সৃষ্টি দিনের শেষে বলেছিলেন। (আদিপুস্তক ১:৩১) এরপর তিনি তাঁর অসীম সৃজনীশক্তিকে কীভাবে ব্যবহার করবেন, তা এখনও দেখার বাকি আছে। যাই হোক না কেন, আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে যিহোবার সৃজনীশক্তির ব্যবহার দেখে আমরা সবসময় চমৎকৃত হব। অনন্তকাল জুড়ে, আমরা যিহোবার সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁর সম্বন্ধে আরও বেশি জানব। (উপদেশক ৩:১১) তাঁর সম্বন্ধে আমরা যত বেশি জানব, আমাদের সশ্রদ্ধ ভয় তত বেশি গভীর হবে—আর আমরা আমাদের মহান সৃষ্টিকর্তার আরও নিকটবর্তী হব।
a সেই বিরাট সংখ্যাকে সঠিক অবস্থান থেকে দেখার জন্য, এই বিষয়টা চিন্তা করুন: এমনকি ঘন্টায় ১৬০ কিলোমিটার বেগে দিনে ২৪ ঘন্টা গাড়ি চালিয়েও ওই দূরত্ব অতিক্রম করতে আপনার একশো বছরেরও বেশি সময় লাগবে!
b কেউ কেউ মনে করে যে, বাইবেলের সময়ের লোকেরা অবশ্যই দূরবিনের প্রাথমিক রূপ ব্যবহার করেছে। নতুবা, সেই সময়ের সাধারণ মানুষেরা কীভাবে জানত যে, নক্ষত্রগুলোর সংখ্যা এত ব্যাপক, অসংখ্য? এইরকম ভিত্তিহীন ধারণা বাইবেলের গ্রন্থকার যিহোবাকে সম্মান ও স্বীকৃতি দেয় না।—২ তীমথিয় ৩:১৬.
c ১০,০০০ কোটি নক্ষত্র গণনা করতে আপনার কত সময় লাগবে, তা একবার ভেবে দেখুন। আপনি যদি প্রতি সেকেন্ডে একটা করে নতুন নক্ষত্র গণনা করতে পারতেন—আর তা দিনের ২৪ ঘন্টাই করতেন—তা হলে আপনার ৩,১৭১ বছর লাগত!