গিলিয়দের ভেষজ নির্যাস মলম যা আরোগ্য করে
বাইবেলের আদিপুস্তক বইয়ের এক পরিচিত বিবরণ, মিশরগামী কয়েকজন ইশ্মায়েলীয় বণিকের কাছে যোষেফের ভাইদের তাকে বিক্রি করে দেওয়ার গল্পটির বিষয় জানায়। বণিকদের দল গিলিয়দ থেকে আসছিল আর উটগুলো গুগ্গুলু বা ভেষজ নির্যাস এবং অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল। (আদিপুস্তক ৩৭:২৫) এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ ইঙ্গিত করে যে, গিলিয়দ থেকে নিয়ে আসা ভেষজ নির্যাস প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যে অত্যন্ত কাম্য বস্তু ছিল ও এটাকে এর আরোগ্যকর বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্য মূল্যবান বলে মনে করা হতো।
কিন্তু কয়েক শতাব্দী পর, ভাববাদী যিরমিয় দুঃখের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলেন: “গিলিয়দে কি তরুসার নাই?” (যিরমিয় ৮:২২) কী যিরমিয়কে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে প্রণোদিত করেছিল? তরুসার বা ভেষজ নির্যাস কী? আজকে আরোগ্য লাভের জন্য উপকারজনক কোনো ভেষজ নির্যাস কি রয়েছে?
বাইবেলের সময়ে ভেষজ নির্যাস
ভেষজ নির্যাস হল এক সাধারণ অভিব্যক্তি, যা বিভিন্ন গাছপালা ও ঝোপঝাড় থেকে নিঃসৃত এক সুগন্ধি এবং সাধারণভাবে তৈলাক্ত ও রজন দ্রব্যকে বর্ণনা করে। ধূপে ও পারফিউমগুলোতে ব্যবহৃত ভেষজ নির্যাস থেকে প্রস্তুতকৃত তেল ছিল প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের জগতের বিলাস দ্রব্যগুলোর মধ্যে একটা। পবিত্র অভিষেকার্থ তেলের উপাদানগুলোর ও ইস্রায়েলীয়রা মিশর থেকে বের হয়ে আসার কিছু পরেই আবাসে ব্যবহৃত ধূপের মধ্যে এটার নাম পাওয়া যায়। (যাত্রাপুস্তক ২৫:৬; ৩৫:৮) এ ছাড়া, এই ভেষজ তেল অত্যন্ত ব্যয়বহুল সেই উপহারগুলোর মধ্যেও ছিল যেগুলো শিবার রানি রাজা শলোমনের জন্য নিয়ে এসেছিলেন। (১ রাজাবলি ১০:২, ১০) নিজেকে পারস্যরাজ অহশ্বেরশের সামনে উপস্থিত করার পূর্বে “ছয় মাস সুগন্ধি” বা ভেষজ তেল দিয়ে ইষ্টেরের সৌন্দর্যচর্চা ও অঙ্গসংস্কার বা ম্যাসাজ করা হয়েছিল।—ইষ্টের ১:১; ২:১২.
যদিও এই ভেষজ তেল মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছিল, কিন্তু গিলিয়দের ভেষজ নির্যাস প্রতিজ্ঞাত দেশেই পাওয়া যেত কারণ গিলিয়দ যর্দন নদীর ঠিক পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ছিল। কুলপতি যাকোব ভেষজ নির্যাসকে ‘দেশের প্রশংসিত দ্রব্যের’ একটা বলে বিবেচনা করেছিলেন আর তিনি এটাকে এক উপঢৌকন হিসেবে মিশরে পাঠিয়েছিলেন। (আদিপুস্তক ৪৩:১১) আর ভাববাদী যিহিষ্কেল ভেষজ নির্যাসকে সেই পণ্যদ্রব্যের তালিকাভুক্ত করেছিলেন যেগুলো যিহূদা ও ইস্রায়েল সোরে রপ্তানি করেছিল। (যিহিষ্কেল ২৭:১৭) ভেষজ নির্যাস এটার নির্দিষ্ট ঔষধি সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্য সুপরিচিত ছিল। প্রাচীন সাহিত্যগুলো বিশেষ করে ক্ষতকে সারিয়ে তোলার ক্ষেত্রে এই মলমের আরোগ্য ও পুনরুদ্ধার করার শক্তির বিষয়ে প্রায়ই উল্লেখ করে।
এক অসুস্থ জাতির জন্য ভেষজ নির্যাস
তাহলে কেন যিরমিয় এই প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন যে, “গিলিয়দে কি তরুসার নাই”? তা বোঝার জন্য, আমাদেরকে সেই সময়ের ইস্রায়েল জাতির দিকে ফিরে তাকাতে হবে। পূর্বে, ভাববাদী যিশাইয় তাদের শোচনীয় আধ্যাত্মিক অবস্থা সম্বন্ধে এক স্পষ্ট বিবরণ দিয়েছিলেন: “পায়ের তালু অবধি মস্তক পর্য্যন্ত কোন স্থানে স্বাস্থ্য নাই; কেবল আঘাত ও প্রহারচিহ্ন ও নূতন ক্ষত; তাহা টেপা কি বাঁধা যায় নাই।” (যিশাইয় ১:৬) তাদের করুণ অবস্থাকে উপলব্ধি করার ও আরোগ্য লাভের চেষ্টা করার পরিবর্তে, সেই জাতি ক্রমাগত তাদের বিপথগামী পথে চলেছিল। তার সময়ে, যিরমিয় শুধু এই বিলাপই করতে পেরেছিলেন: “তাহারা সদাপ্রভুর বাক্য অগ্রাহ্য করিয়াছে, তবে তাহাদের জ্ঞান কি প্রকার?” তারা যদি কেবল যিহোবার কাছে ফিরে আসত, তাহলে তিনি তাদেরকে আরোগ্য করতেন। “গিলিয়দে কি তরুসার নাই?” ভাবিয়ে তোলার মতো কী এক প্রশ্ন!—যিরমিয় ৮:৯.
আজকের জগৎ বিভিন্নভাবে ‘আঘাত ও প্রহারচিহ্ন ও নূতন ক্ষতে’ পূর্ণ। লোকেরা দারিদ্র্য, অন্যায়, স্বার্থপরতা এবং দয়ার অভাবের দ্বারা কষ্ট পাচ্ছে আর এই সমস্তেরই কারণ ঈশ্বর ও প্রতিবেশীর প্রতি প্রেম শীতল হয়ে গিয়েছে। (মথি ২৪:১২; ২ তীমথিয় ৩:১-৫) জাতি, উপজাতিগত পটভূমি অথবা বয়সের কারণে অনেকে পরিত্যক্ত বলে মনে করে। এ ছাড়া, দুর্ভিক্ষ, অসুস্থতা, যুদ্ধ আর মৃত্যুও তাদের যন্ত্রণাকে বৃদ্ধি করে। যিরমিয়ের মতোই অনেক আন্তরিক বিশ্বাসীরা ভেবে থাকে যে, যারা কষ্টভোগ করছে তাদের আবেগগত ও আধ্যাত্মিক ক্ষত বেঁধে দেওয়ার জন্য ‘গিলিয়দের তরুসার’ আদৌ আছে কি না।
সুসমাচার যা আরোগ্য করে
যিশুর দিনেও, নম্র ব্যক্তিদের মনে এই একই প্রশ্ন ছিল। কিন্তু এটাকে উত্তরবিহীন রাখা হয়নি। সা.কা. ৩০ সালের শুরুতে নাসরতের সমাজগৃহে, যিশু এই বলে যিশাইয়ের পুস্তক থেকে পাঠ করেছিলেন “নম্রগণের কাছে সুসমাচার প্রচার করিতে সদাপ্রভু আমাকে অভিষেক করিয়াছেন; তিনি আমাকে প্রেরণ করিয়াছেন, যেন আমি ভগ্নান্তঃকরণ লোকদের ক্ষত বাঁধিয়া দিই।” (যিশাইয় ৬১:১) এরপর সান্ত্বনার এক বার্তা জানানোর কার্যভারসহ, নিজেকে মশীহ হিসেবে তুলে ধরে যিশু নিজের প্রতি এই বাক্যগুলোকে প্রয়োগ করেছিলেন।—লূক ৪:১৬-২১.
তাঁর পরিচর্যার সময়কালজুড়ে, যিশু উদ্যোগের সঙ্গে ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করেছিলেন। (মথি ৪:১৭) পর্বতেদত্ত উপদেশে, তিনি উৎপীড়িত ব্যক্তিদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তাদের পরিস্থিতি পরিবর্তিত হবে: “ধন্য তোমরা, যাহারা এক্ষণে রোদন কর, কারণ তোমরা হাসিবে।” (লূক ৬:২১) ঈশ্বরের রাজ্য আসার বিষয়—আশার এক বার্তা—ঘোষণা করার দ্বারা যিশু ‘ভগ্নান্তঃকরণ লোকদের ক্ষত বাঁধিয়া দিয়াছিলেন।’
আমাদের দিনেও “রাজ্যের সুসমাচার” ঠিক একইরকম সান্ত্বনাদায়ক। (মথি ৬:১০; ৯:৩৫) উদাহরণ হিসেবে, রজার ও লিলিয়ানের বিষয়টা বিবেচনা করুন। ১৯৬১ সালের জানুয়ারি মাসে তারা প্রথম অনন্তজীবন সম্বন্ধীয় ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞার বিষয়ে শিখেছিলেন আর তাদের কাছে তা উপশমকারী ভেষজ নির্যাসের মতোই ছিল। “আমি যা শিখছিলাম তা চিন্তা করে আমি রান্নাঘরের চারদিকে নেচে বেড়িয়েছিলাম। আমি খুবই সুখী ছিলাম,” লিলিয়ান স্মরণ করেন। রজার, যিনি সেই সময়ে দশ বছর ধরে আংশিক পক্ষঘাতগ্রস্ত ছিলেন, তিনি আরও বলেন, “পুনরুত্থান এবং সমস্ত যন্ত্রণা ও অসুস্থতার অবসানের বিষয়ে এক অপূর্ব আশার কারণে আমি প্রচুর আনন্দ, বেঁচে থাকার আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলাম।”—প্রকাশিত বাক্য ২১:৪.
১৯৭০ সালে তারা তাদের ১১ বছর বয়সের ছেলেকে মৃত্যুতে হারানোর কষ্ট ভোগ করেছিল। কিন্তু তারা হতাশায় ডুবে যায়নি। তারা ব্যক্তিগতভাবে অনুভব করেছিল যে, যিহোবা “ভগ্নচিত্তদিগকে সুস্থ করেন, তাহাদের ক্ষত সকল বাঁধিয়া দেন।” (গীতসংহিতা ১৪৭:৩) তাদের আশা তাদেরকে সান্ত্বনা জুগিয়েছিল। এখন প্রায় ৫০ বছর ধরে, ঈশ্বরের আসন্ন রাজ্যের সুসমাচার তাদের জন্য শান্তি ও পরিতৃপ্তি নিয়ে এসেছে।
এক আরোগ্য যা লাভ করা এখনও বাকি রয়েছে
তাহলে আজকে কি ‘গিলিয়দের তরুসার’ বা ভেষজ নির্যাস রয়েছে? হ্যাঁ, আজকে এখনও আধ্যাত্মিক ভেষজ নির্যাস রয়েছে। রাজ্যের সুসমাচারের দ্বারা প্রদত্ত সান্ত্বনা ও আশা ভগ্নচিত্ত লোকেদের ক্ষত বেঁধে দিতে সক্ষম। আপনি কি এই ধরনের আরোগ্যের অভিজ্ঞতা লাভ করতে চান? আপনাকে যা করতে হবে তা হল, ঈশ্বরের বাক্যের সান্ত্বনাদায়ক বার্তার প্রতি আপনার হৃদয় খুলে দিন ও এটির দ্বারা আপনার জীবনকে পূর্ণ হতে দিন। লক্ষ লক্ষ লোক ইতিমধ্যেই তা করেছে।
ভেষজ নির্যাসের দ্বারা এই আরোগ্য লাভ, প্রচুর স্বস্তি পাওয়ার এক পূর্বাভাস প্রদান করে যা এখনও আসতে বাকি রয়েছে। সেই সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে যখন যিহোবা ঈশ্বর অনন্তজীবনের কথা মাথায় রেখে “জাতিগণের আরোগ্য” সাধন করবেন। সেই সময়ে, “নগরবাসী কেহ বলিবে না, আমি পীড়িত।” হ্যাঁ, আজকেও ‘গিলিয়দের তরুসার’ বা ভেষজ নির্যাস রয়েছে!—প্রকাশিত বাক্য ২২:২; যিশাইয় ৩৩:২৪. (w১০-E ০৬/০১)
[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচারের আরোগ্য করার শক্তি আজকেও ভগ্ন চিত্ত ব্যক্তিদের যন্ত্রণাকে ক্রমাগত লাঘব করে চলেছে