পৃথিবীতে যীশুর জীবনের শেষ দিনগুলিতে ফিরে যাওয়া
সময়টি হল সা.কা. ৩৩ সালের যিহূদী নিশান মাসের সপ্তম দিন। কল্পনা করুন যে আপনি রোমীয় প্রদেশ যিহূদিয়ায় ঘটনাগুলি প্রত্যক্ষ করছেন। যীশু খ্রীষ্ট ও তাঁর শিষ্যেরা যিরীহো ও এর উর্বর সবুজ সমারোহ ত্যাগ করে ধূলিময়, আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে ক্লান্তিভরে হাঁটছেন। বাৎসরিক নিস্তারপর্ব উদ্যাপনের জন্য অন্যান্য আরও অনেক ভ্রমণকারী যিরূশালেমের উদ্দেশে তাদের পথে রয়েছেন। কিন্তু, এই ক্লান্তিকর আরোহণ নয়, খ্রীষ্টের শিষ্যদের মনে তার চাইতেও আরও বেশি কিছু রয়েছে।
যিহূদীরা আকুলভাবে একজন মশীহের অপেক্ষা করে আছেন, যিনি তাদের রোমীয় যোঁয়ালি থেকে স্বস্তি দিতে পারেন। অনেকে নাসারতের যীশুকে সেই দীর্ঘ-প্রতীক্ষিত পরিত্রাতা হিসাবে বিশ্বাস করেন। সাড়ে তিন বছর ধরে তিনি ঈশ্বরের রাজ্য সম্বন্ধে বলে এসেছেন। তিনি অসুস্থদের সুস্থ করেছেন এবং ক্ষুধার্তদের খাদ্য যুগিয়েছেন। হ্যাঁ, বাস্তবিকই তিনি লোকেদের সান্ত্বনা দিয়েছেন। কিন্তু ধর্মীয় নেতারা তাদের প্রতি যীশুর উত্তপ্ত ভর্ৎসনার কারণে বিরক্ত এবং তাঁকে হত্যা করার জন্য মরিয়া হয়ে আছে। তথাপি উদ্দেশ্যপূর্ণভাবেই তিনি সেই শুষ্ক রাস্তা ধরে তাঁর শিষ্যদের আগে আগে হেঁটে চলেছেন।—মার্ক ১০:৩২.
সামনেই জৈতুন পর্বতের পিছনে যখন সূর্য অস্ত যেতে থাকে, যীশু ও তাঁর সঙ্গীরা বৈথনিয়া গ্রামে এসে পৌঁছান, যেখানে তারা পরবর্তী ছয়টি রাত কাটাবেন। সেখানে তাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য, তাদের প্রিয় বন্ধুরা লাসার, মরিয়ম এবং মার্থা রয়েছেন। সন্ধ্যাটি তপ্ত যাত্রার ক্লান্তি থেকে শীতল স্বস্তি প্রদান করে এবং ৮ই নিশান থেকে বিশ্রামবারের শুরুকে চিহ্নিত করে।—যোহন ১২:১, ২.
৯ই নিশান
বিশ্রামবারের পর, যিরূশালেম কর্মতৎপরতায় পরিপূর্ণ। নিস্তারপর্বের জন্য ইতিমধ্যেই হাজার হাজার দর্শক সেই শহরে একত্রিত হয়েছে। কিন্তু যে কোলাহলপূর্ণ হইচই আমরা শুনছি বছরের এই সময়টিতে সাধারণত তা কিছুটা অস্বাভাবিক। কৌতূহলী জনতা নগরের প্রবেশদ্বারের সরু রাস্তাগুলির দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। জনাকীর্ণ দ্বারগুলি দিয়ে যখন তারা ধাক্কাধাক্কি করে বের হয়, কী এক দৃশ্যই না তাদের সম্মুখে পড়ে! অনেক উল্লসিত লোক বৈৎফগী থেকে আসা রাস্তা ধরে এসে জৈতুন পর্বতের উপর থেকে নেমে আসছে। (লূক ১৯:৩৭) এই সমস্ত কিছুর উদ্দেশ্য কী?
ওই দেখুন! নাসারতের যীশু গর্দভ শাবকের পিঠে চড়ে আসছেন। লোকেরা তাঁর সম্মুখে রাস্তায় তাদের বস্ত্র পেতে দেয়। অন্যেরা সবেমাত্র কাটা খর্জ্জুর-পত্র দোলাতে থাকে এবং আনন্দের সাথে চিৎকার করে বলে: “ধন্য তিনি, যিনি প্রভুর [“যিহোবার,” “NW”] নামে আসিতেছেন, যিনি ইস্রায়েলের রাজা।”—যোহন ১২:১২-১৫.
জনতা যখন যিরূশালেমের নিকটবর্তী হয়, যীশু নগরটির দিকে দৃষ্টিপাত করেন ও গভীরভাবে বিচলিত হন। তিনি রোদন করতে শুরু করেন আর আমরা তাঁকে ভাববাণী করতে শুনি যে এই নগরটি ধ্বংস হবে। এর অল্প সময় পরই যখন যীশু মন্দিরে উপস্থিত হন তিনি জনতাকে শিক্ষা দেন এবং অন্ধ ও খঞ্জ লোকেরা যারা তাঁর কাছে আসে, তাদের সুস্থ করেন।—মথি ২১:২৪; লূক ১৯:৪১-৪৪, ৪৭.
এটি প্রধান যাজক ও অধ্যাপকদের অলক্ষিত থাকে না। যীশুর আশ্চর্য কাজ ও জনতার আনন্দোল্লাস দেখে তারা কতই না বিরক্ত হন! তাদের ক্রোধ গুপ্ত রাখতে অসমর্থ হয়ে ফরীশীরা দাবি করেন: “গুরো, আপনার শিষ্যদিগকে ধমক্ দিউন।” “আমি তোমাদিগকে বলিতেছি,” যীশু উত্তর দেন, “ইহারা যদি চুপ করিয়া থাকে, প্রস্তর সকল চেঁচাইয়া উঠিবে।” চলে যাওয়ার পূর্বে যীশু মন্দিরের মধ্যে বাণিজ্যিক কাজকর্মগুলি লক্ষ্য করেন।—লূক ১৯:৩৯, ৪০; মথি ২১:১৫, ১৬; মার্ক ১১:১১.
১০ই নিশান
যীশু ভোরবেলা মন্দিরে উপস্থিত হন। আগের দিন তিনি তাঁর পিতা, যিহোবা ঈশ্বরের উপাসনাকে জঘন্য বাণিজ্যকরণের কারণে ক্ষিপ্ত না হয়ে পারেননি। তাই, মন্দিরে যারা ক্রয়-বিক্রয় করছিল তাদের তিনি পূর্ণ উদ্যোগ সহকারে বের করতে আরম্ভ করেন। তারপর তিনি লোভী পোদ্দারদের মেজ ও কপোত বিক্রয়কারীদের আসন উল্টে ফেলেন। “লেখা আছে,” যীশু বলেন, “‘আমার গৃহ প্রার্থনাগৃহ বলিয়া আখ্যাত হইবে,’ কিন্তু তোমরা ইহা ‘দস্যুগণের গহ্বর’ করিতেছ।”—মথি ২১:১২, ১৩.
প্রধান যাজক, অধ্যাপক এবং লোকেদের প্রধানেরা যীশুর কাজ ও প্রকাশ্য শিক্ষার সম্মুখে স্থির থাকতে পারল না। তাঁকে হত্যা করার জন্য তারা কতই না উৎসুক! কিন্তু তারা জনতার কারণে নিশ্চল হয়ে রইল কারণ লোকেরা যীশুর শিক্ষায় মুগ্ধ এবং তারা ‘সকলে একাগ্র মনে তাঁহার কথা শুনিতে’ লাগল। (লূক ১৯:৪৭, ৪৮) যখন সন্ধ্যা হতে থাকে, যীশু ও তাঁর সঙ্গীরা রাতের উত্তম বিশ্রামের জন্য বৈথনিয়াতে ফিরে যাওয়ার সময় মনোরম হাঁটা উপভোগ করেন।
১১ই নিশান
সময়টি খুব ভোর আর যীশু ও তাঁর শিষ্যেরা ইতিমধ্যেই যিরূশালেমে যাওয়ার রাস্তায় অবস্থিত জৈতুন পর্বত অতিক্রম করেছেন। যখন তারা মন্দিরে উপস্থিত হন, প্রধান যাজক ও প্রাচীনবর্গ যীশুর মুখোমুখি হওয়ার জন্য তৎপর হয়। মন্দিরের পোদ্দার ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে তাঁর পদক্ষেপ, তাদের মনে সম্পূর্ণ সজীব রয়েছে। তাঁর শত্রুরা বিদ্বেষপূর্ণভাবে দাবি করে: “তুমি কি ক্ষমতায় এই সকল করিতেছ? আর কেই বা তোমাকে এই ক্ষমতা দিয়াছে?” “আমিও তোমাদিগকে একটী কথা জিজ্ঞাসা করিব,” যীশু প্রতিবাদ করেন। “তাহা যদি আমাকে বল, তবে কি ক্ষমতায় এ সকল করিতেছি, তাহা আমিও তোমাদিগকে বলিব। যোহনের বাপ্তিস্ম কোথা হইতে হইয়াছিল? স্বর্গ হইতে না মনুষ্য হইতে?” একত্রে জড়ো হয়ে বিরোধিরা যুক্তি করে: “যদি বলি স্বর্গ হইতে, তাহা হইলে এ আমাদিগকে বলিবে, তবে তোমরা তাঁহাকে বিশ্বাস কর নাই কেন? আর যদি বলি, মনুষ্য হইতে, লোকসাধারণকে ভয় করি; কারণ সকলে যোহনকে ভাববাদী বলিয়া মানে।” হতবিহ্বল হয়ে তারা নির্লিপ্তভাবে উত্তর দেয়: “আমরা জানি না।” যীশু শান্তভাবে সাড়া দেন: “তবে আমিও কি ক্ষমতায় এ সকল করিতেছি, তোমাদিগকে বলিব না।”—মথি ২১:২৩-২৭.
যীশুর শত্রুরা এইবার তাঁকে এমন কিছু বলার দ্বারা ফাঁদে ফেলতে চেষ্টা করছে যাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায়। “কৈসরকে কর দেওয়া বিধেয় কি না?” তারা জিজ্ঞাসা করে। “সেই করের মুদ্রা আমাকে দেখাও,” উত্তরে যীশু বলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করেন: “এই মূর্ত্তি ও এই নাম কাহার?” “কৈসরের,” তারা বলে। তাদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়ে, সকলে যেন শুনতে পায় এমন স্পষ্টভাবে যীশু বলেন: “তবে কৈসরের যাহা যাহা, কৈসরকে দেও, আর ঈশ্বরের যাহা যাহা, ঈশ্বরকে দেও।”—মথি ২২:১৫-২২.
অখণ্ডনীয় যুক্তির দ্বারা তাঁর শত্রুদের নীরব করে দিয়ে যীশু এখন জনতা ও তাঁর শিষ্যদের সম্মুখে তাঁর অসন্তোষ ব্যক্ত করেন। অধ্যাপক ও ফরীশীদের প্রতি তাঁর নির্ভীক ভর্ৎসনাগুলি শুনুন। “তাহাদের কর্ম্মের মত কর্ম্ম করিও না,” তিনি বলেন, “কেননা তাহারা বলে, কিন্তু করে না।” সাহসের সাথে তিনি তাদের উপর ধারাবাহিক কিছু বিপর্যয়ের কথা ঘোষণা করেন, তাদের অন্ধ পথ-দর্শক ও কপটী বলে চিহ্নিত করেন। “সর্পেরা, কালসর্পের বংশেরা,” যীশু বলেন, “তোমরা কেমন করিয়া বিচারে নরকদণ্ড এড়াইবে?”—মথি ২৩:১-৩৩.
এই তিক্ত নিন্দাগুলি বোঝায় না যে যীশু অন্যদের উত্তম বিষয়গুলির প্রতি অন্ধ। পরে তিনি মন্দিরের ভাণ্ডারে লোকেদের অর্থ রাখতে দেখেন। একজন অভাবী বিধবা তার সমগ্র জীবনোপায়—দুটি ক্ষুদ্র মুদ্রা যার মূল্য খুবই কম সেগুলি রাখছেন, তা দেখা কতই না মর্মস্পর্শী! আন্তরিক উপলব্ধি দেখিয়ে যীশু উল্লেখ করেন যে আসলে, যারা “আপন আপন অতিরিক্ত ধন হইতে” প্রচুর পরিমাণে দান করেছিল, তাদের সকলের চেয়ে সেই বিধবা অনেক বেশি রেখেছিলেন। তাঁর কোমল করুণার দরুণ যীশু, একজন ব্যক্তি যা করতে সমর্থ তার প্রতি গভীর উপলব্ধি দেখান।—লূক ২১:১-৪.
এইবার যীশু শেষবারের মত মন্দির পরিত্যাগ করছেন। তাঁর শিষ্যদের কয়েকজন এর উৎকর্ষ সম্বন্ধে এই বলে মন্তব্য করেন যে এটি “কেমন সুন্দর সুন্দর প্রস্তরে ও নিবেদিত দ্রব্যে সুশোভিত।” তাদের বিস্মিত করে দিয়ে যীশু উত্তর দেন: “এমন সময় আসিতেছে, যখন ইহার একখানি পাথর অন্য পাথরের উপরে থাকিবে না, সমস্তই ভূমিসাৎ হইবে।” (লূক ২১:৫, ৬) জনাকীর্ণ নগরের মধ্য দিয়ে যীশুকে অনুসরণ করার সময়ে প্রেরিতেরা চিন্তা করতে থাকেন, তিনি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন।
এর অল্প কিছু সময় পর, যীশু ও তাঁর প্রেরিতেরা বসেন আর জৈতুন পর্বতের প্রশান্ত ও স্নিগ্ধ পরিবেশ উপভোগ করেন। যখন তারা যিরূশালেম ও এর মন্দিরের জাঁকজমকপূর্ণ দৃশ্য দেখতে থাকেন, তখন পিতর, যাকোব, যোহন এবং আন্দ্রিয় যীশুর বিস্ময়কর ভাববাণীর স্পষ্ট ব্যাখ্যা জানতে চান। “আমাদিগকে বলুন দেখি” তারা বলেন, “এই সকল ঘটনা কখন হইবে? আর আপনার আগমনের এবং যুগান্তের চিহ্ন কি?”—মথি ২৪:৩; মার্ক ১৩:৩, ৪.
উত্তরে মহান শিক্ষক এক প্রকৃত লক্ষণীয় ভবিষ্যদ্বাণী করেন। তিনি চরম যুদ্ধ, ভূমিকম্প, খাদ্যাভাব এবং মহামারী সম্বন্ধে ভাববাণী করেন। যীশু আরও ভাববাণী করেন যে সমস্ত পৃথিবীতে রাজ্যের সুসমাচার প্রচারিত হবে। “তখন” তিনি সতর্ক করেন, “এরূপ মহাক্লেশ উপস্থিত হইবে, যেরূপ জগতের আরম্ভ অবধি এ পর্য্যন্ত কখনও হয় নাই, কখনও হইবেও না।”—মথি ২৪:৭, ১৪, ২১; লূক ২১:১০, ১১.
যখন যীশু ‘তাঁর আগমনের চিহ্নের’ অন্যান্য দিকগুলি সম্বন্ধে বলেন, চার জন প্রেরিত মনোযোগের সাথে তা শুনতে থাকেন। তিনি ‘জাগিয়া থাকার’ প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। কেন? “কেননা,” তিনি বলেন, “তোমাদের প্রভু কোন্ দিন আসিবেন, তাহা তোমরা জান না।”—মথি ২৪:৪২; মার্ক ১৩:৩৩, ৩৫, ৩৭.
যীশু ও তাঁর প্রেরিতদের জন্য এটি একটি অবিস্মরণীয় দিন। বাস্তবিকপক্ষে, তাঁর গ্রেপ্তার, পরীক্ষা ও মৃত্যুদণ্ডের পূর্বে এটিই তাঁর প্রকাশ্য পরিচর্যার শেষ দিন। যেহেতু সন্ধ্যা হয়ে আসছে, তাই তারা বৈথনিয়ায় ফিরে যাওয়ার অল্প দূরত্ব অতিক্রম করতে পাহাড়ের উপর দিয়ে যাত্রা শুরু করেন।
১২ এবং ১৩ই নিশান
১২ই নিশান যীশু একান্তে তাঁর শিষ্যদের সাথে কাটান। তিনি বুঝতে পারেন যে ধর্মীয় নেতারা তাঁকে হত্যা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে আর তাদের তিনি পরবর্তী সন্ধ্যায় তাঁর নিস্তারপর্ব উদ্যাপনকে ব্যাহত করতে দিতে চান না। (মার্ক ১৪:১, ২) পরের দিন ১৩ই নিশান, লোকেরা নিস্তারপর্বের চূড়ান্ত আয়োজনে ব্যস্ত। অপরাহ্নের প্রথম দিকে, যিরূশালেমের এক উপরের কুঠরিতে তাদের জন্য নিস্তারপর্বের ভোজ প্রস্তুত করতে যীশু, পিতর ও যোহনকে পাঠান। (মার্ক ১৪:১২-১৬; লূক ২২:৮) সূর্যাস্তের অল্প কিছুক্ষণ আগে যীশু ও তাঁর অপর দশ জন প্রেরিত, তাদের শেষ নিস্তারপর্ব উদ্যাপনের জন্য সেখানে তাদের সাথে মিলিত হন।
১৪ই নিশান, সূর্যাস্তের পর
জৈতুন পর্বতের উপর যখন পূর্ণ চন্দ্র ওঠে, যিরূশালেম গোধুলির মৃদু আলোয় আবৃত হয়। একটি বড় সুবিন্যস্ত কক্ষে, যীশু ও অপর ১২ জন একটি সুসজ্জিত টেবিলের চারিদিকে হেলান দিয়ে বসে আছেন। “আমার দুঃখভোগের পূর্ব্বে তোমাদের সহিত আমি এই নিস্তারপর্ব্বের ভোজ ভোজন করিতে একান্তই বাঞ্ছা করিয়াছি,” তিনি বলেন। (লূক ২২:১৪, ১৫) অল্প কিছুক্ষণ পর প্রেরিতেরা যীশুকে উঠতে ও তাঁর উপরের বস্ত্র এক পাশে রাখতে দেখে আশ্চর্য হন। একটি গামছা ও এক পাত্র জল নিয়ে তিনি তাদের পা ধুয়ে দিতে আরম্ভ করেন। বিনয়ী পরিচর্যার কী এক অবিস্মরণীয় শিক্ষা!—যোহন ১৩:২-১৫.
যীশু কিন্তু জানেন যে এই ব্যক্তিদের মধ্যে একজন—ঈষ্করিয়োতীয় যিহূদা—ধর্মীয় নেতাদের কাছে তাঁকে সমর্পণ করার জন্য ইতিমধ্যেই ব্যবস্থা করে ফেলেছে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি অত্যন্ত দুঃখার্ত হয়ে পড়েন। “তোমাদের মধ্যে এক জন আমাকে সমর্পণ করিবে,” তিনি প্রকাশ করেন। এই কথায় প্রেরিতেরা অত্যন্ত দুঃখিত হন। (মথি ২৬:২১, ২২) নিস্তারপর্ব উদ্যাপনের পর, যীশু যিহূদাকে বলেন: “যাহা করিতেছ, শীঘ্র কর।”—যোহন ১৩:২৭.
যিহূদা চলে যাওয়ার পর, যীশু তাঁর আসন্ন মৃত্যু স্মরণ করার জন্য এক ভোজের প্রবর্তন করেন। তিনি একটি তাড়ীশূন্য রুটি নেন, প্রার্থনায় ধন্যবাদ ব্যক্ত করেন, এটি ভাঙেন ও ১১ জনকে ভোজনে অংশ নিতে নির্দেশ দেন। “ইহা আমার শরীর,” তিনি বলেন, “যাহা তোমাদের নিমিত্ত দেওয়া যায়, ইহা আমার স্মরণার্থে করিও।” এরপর তিনি অমিশ্রিত দ্রাক্ষারসের পানপাত্রটি নেন। সেটি আশীর্বাদ করার পর, তিনি তাদের মধ্যে সেটি বিতরণ করে তাদের সেখান থেকে পান করতে বলেন। যীশু আরও বলেন: “ইহা আমার রক্ত, নূতন নিয়মের রক্ত, যাহা অনেকের জন্য, পাপমোচনের নিমিত্ত, পাতিত হয়।”—লূক ২২:১৯, ২০; মথি ২৬:২৬-২৮.
সেই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধ্যায়, যীশু তাঁর বিশ্বস্ত প্রেরিতদের অনেক মূল্যবান শিক্ষা দেন আর এগুলির মধ্যে একটি হল ভ্রাতৃপ্রেমের গুরুত্ব। (যোহন ১৩:৩৪, ৩৫) তিনি তাদের আশ্বস্ত করেন যে তারা এক “সহায়,” অর্থাৎ পবিত্র আত্মা লাভ করবেন। এটি তিনি তাদের যা কিছু বলেছিলেন পুনরায় তা স্মরণ করিয়ে দেবে। (যোহন ১৪:২৬) পরে সন্ধ্যার সময় যীশুকে তাদের নিমিত্ত ঐকান্তিকভাবে প্রার্থনা করতে শুনে তারা নিশ্চয় খুবই উৎসাহিত হন। (যোহন ১৭ অধ্যায়) প্রশংসা গান করার পর, তারা উপরের কুঠরি ত্যাগ করেন এবং মধ্য-রাতের শীতল আবহাওয়ার মধ্যে যীশুকে অনুসরণ করেন।
কিদ্রোণ স্রোত পার হওয়ার সময়ে যীশু ও তাঁর প্রেরিতেরা তাদের একটি প্রিয় স্থান, গেৎশিমানী বাগানের দিকে যাত্রা করেন। (যোহন ১৮:১, ২) তাঁর প্রেরিতেরা যখন অপেক্ষা করেন, যীশু প্রার্থনা করার জন্য সামান্য দূরে যান। তাঁকে সাহায্যের জন্য ঈশ্বরের কাছে আন্তরিক আবেদন করার সময়ে তাঁর সেই মানসিক চাপ বর্ণনাতীত। (লূক ২২:৪৪) যদি তিনি ব্যর্থ হন, তাহলে তাঁর প্রিয় স্বর্গীয় পিতার উপর যে কলঙ্ক আসবে সেই সম্বন্ধে চিন্তা করাই তাঁর জন্য চরম যন্ত্রণাদায়ক।
যখন ঈষ্করিয়োতীয় যিহূদা খড়গ, যষ্টি এবং মশালসহ বিস্তর লোক নিয়ে উপস্থিত হয়, যীশু সবেমাত্র তাঁর প্রার্থনা শেষ করেছেন। “রব্বি, নমস্কার,” যিহূদা বলে আর যীশুকে আগ্রহপূর্বক চুম্বন করে। যীশুকে গ্রেপ্তার করার জন্য সেই লোকেদের কাছে এটি সংকেতস্বরূপ ছিল। হঠাৎ পিতর তার তরবারি বের করেন এবং মহাযাজকের দাসের একটি কান কেটে ফেলেন। “তোমার খড়গ পুনরায় স্বস্থানে রাখ,” লোকটির কান সুস্থ করার সময় যীশু বলেন। “কেননা যে সকল লোক খড়গ ধারণ করে, তাহারা খড়গ দ্বারা বিনষ্ট হইবে।”—মথি ২৬:৪৭-৫২.
সমস্ত কিছু খুব দ্রুত ঘটতে থাকে! যীশুকে গ্রেপ্তার করা হয় ও তাঁকে বাঁধা হয়। ভয় পেয়ে ও বিভ্রান্ত হয়ে প্রেরিতেরা তাদের প্রভুকে পরিত্যাগ করেন ও পালিয়ে যান। প্রাক্তন মহাযাজক হাননের কাছে যীশুকে পাঠানো হয়। এরপর তাঁকে বিচারের জন্য, তৎকালীন মহাযাজক কায়াফার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সকালের প্রথম দিকে, মহাসভা যীশুর উপর মিথ্যাভাবে ঈশ্বরনিন্দার অভিযোগ আনে। পরে, কায়াফা তাকে রোমীয় রাজ্যপাল পন্তীয় পীলাতের কাছে পাঠান। তিনি যীশুকে গালীলের শাসক, হেরোদ আন্তিপাসের কাছে পাঠান। হেরোদ ও তাঁর রক্ষীরা যীশুকে বিদ্রূপ করেন। তারপর তাকে আবার পীলাতের কাছে পাঠানো হয়। যীশু যে নির্দোষ তা পীলাতের দ্বারা নিশ্চিত হয়। কিন্তু যিহূদী ধর্মীয় নেতারা যীশুকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য তাকে চাপ দেয়। অনেক মৌখিক ও শারীরিক দুর্ব্যবহারের পর, যীশুকে গল্গথা নামক স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তাঁকে নির্মমভাবে এক যাতনাদণ্ডে বিদ্ধ করা হয় এবং তিনি এক নিদারুণ যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু বরণ করেন।—মার্ক ১৪:৫০-১৫:৩৯; লূক ২৩:৪-২৫.
যীশুর মৃত্যু যদি তাঁর জীবনের এক স্থায়ী সমাপ্তি আনত, তাহলে ইতিহাসে তা সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হত। আনন্দের বিষয় যে সেইরকম হয়নি। সা.কা. ৩৩ সালের ১৬ই নিশান তিনি মৃতদের মধ্য থেকে উত্থিত হয়েছেন দেখে তাঁর শিষ্যেরা বিস্ময়াভিভূত হয়েছিলেন। সেই সময়ের মধ্যে ৫০০ জনেরও বেশি লোক যীশু যে আবার জীবিত, সেই সত্যতা প্রতিপাদন করতে পেরেছিলেন। আর তাঁর পুনরুত্থানের ৪০ দিন পর, বিশ্বস্ত অনুগামীদের একটি দল তাঁকে স্বর্গারোহণ করতে দেখেছিলেন।—প্রেরিত ১:৯-১১; ১ করিন্থীয় ১৫:৩-৮.
যীশুর জীবন এবং আপনি
এটি আপনাকে—বস্তুতপক্ষে আমাদের প্রত্যেককে কিভাবে প্রভাবিত করে? হ্যাঁ, যীশুর পরিচর্যা, মৃত্যু ও পুনরুত্থান, যিহোবা ঈশ্বরকে মহিমান্বিত করে এবং তাঁর মহান উদ্দেশ্য সম্পন্ন করার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। (কলসীয় ১:১৮-২০) সেগুলি আমাদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ কারণ, যীশুর বলিদানের ভিত্তিতে আমরা আমাদের পাপের ক্ষমা পাই এবং এর মাধ্যমে যিহোবা ঈশ্বরের সাথে আমাদের এক ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে।—যোহন ১৪:৬; ১ যোহন ২:১, ২.
এমনকি মৃত মানবজাতিও প্রভাবিত হয়। যীশুর পুনরুত্থান তাদের ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞাত পরমদেশে পুনরায় জীবনে ফিরিয়ে আনার পথ খুলে দেয়। (লূক ২৩:৩৯-৪৩; ১ করিন্থীয় ১৫:২০-২২) এই বিষয়গুলি সম্বন্ধে যদি আপনি আরও জানতে চান, আমরা আপনাকে ১৯৯৮ সালের ১১ই এপ্রিল, আপনার এলাকায় যিহোবার সাক্ষীদের কিংডম হলে খ্রীষ্টের মৃত্যুর স্মরণার্থক সভায় যোগদান করতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
[৬ পৃষ্ঠার বাক্স]
“দস্যুগণের গহ্বর”
সেই লোভী ব্যবসায়ীরা ঈশ্বরের মন্দিরকে “দস্যুগণের গহ্বর” করে তুলেছে, তা বলার প্রচুর কারণ যীশুর ছিল। (মথি ২১:১২, ১৩) মন্দিরের কর পরিশোধের জন্য যিহূদী ও অন্যান্য দেশ থেকে আগত ধর্মান্তরিতদের বিদেশী মুদ্রা ভাঙিয়ে অনুমোদিত মুদ্রা সংগ্রহ করতে হত। মশীহ যীশুর জীবন ও সময় (ইংরাজি) নামক তার বইয়ে আলফ্রেড এডার্সহিম ব্যাখ্যা করেন যে, পোদ্দাররা নিস্তারপর্বের এক মাস পূর্বে আদার মাসের ১৫ তারিখে সেই প্রদেশে তাদের ব্যবসা চালু করত। আদার মাসের ২৫ তারিখ থেকে তারা আগমনকারী প্রচুর সংখ্যক যিহূদী ও ধর্মান্তরিতদের কাছ থেকে অধিক মুনাফা লাভ করার জন্য যিরূশালেমের মন্দির এলাকায় চলে আসত। প্রত্যেকটি অর্থ বিনিময় করার জন্য নির্দিষ্ট মূল্য আরোপ করে বণিকেরা এক লাভজনক ব্যবসা করত। তাদের দস্যু হিসাবে যীশুর উদ্ধৃতি দেখায় যে তাদের আরোপিত মূল্য এত বেশি ছিল যা কার্যত, দরিদ্রদের কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় করা।
কেউ কেউ তাদের বলিদানের প্রাণী আনতে পারত না। কেউ কেউ যারা আনত তা মন্দিরের একজন পরিদর্শকের দ্বারা পরীক্ষা করাতে হত—মূল্যের বিনিময়ে। অনেক দূর থেকে আনার পর একটি প্রাণী পরিত্যক্ত হওয়ার ঝুঁকি নিতে না চাওয়ার কারণে, অনেকে মন্দিরের দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লেবীয়দের দ্বারা “অনুমোদিত” প্রাণী ক্রয় করত। “অনেক দরিদ্র কৃষকদের অত্যধিক পরিমাণে শোষণ করা হত,” একজন পণ্ডিত বলেন।
প্রমাণ রয়েছে যে একসময়ের মহাযাজক হানন ও তার পরিবারের মন্দিরের ব্যবসায় এক বিশেষ আগ্রহ ছিল। রব্বিদের রচনাগুলি “[মন্দিরে] হাননের পুত্রদের বাজার” সম্বন্ধে বলে। পোদ্দার ও মন্দিরের প্রাঙ্গনে পশু বিক্রয় থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করা, তাদের আয়ের এক প্রধান উৎস ছিল। একজন পণ্ডিত বলেন যে ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করা সম্বন্ধে যীশুর পদক্ষেপের “লক্ষ্য কেবল যাজকদের মর্যাদাহানিই ছিল না বরং তাদের আয়ের উৎসকে খর্ব করাও ছিল।” কারণটি যাই হোক না কেন, তাঁর শত্রুরা নিশ্চিতভাবেই তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল!—লূক ১৯:৪৫-৪৮.
[৪ পৃষ্ঠার তালিকা]
যীশুর মানব জীবনের শেষ দিনগুলি
সা.কা. ৩৩ সালের নিশান মাস ঘটনাগুলি সর্বমহান পুরুষ*
৭ শুক্রবার যীশু ও তাঁর শিষ্যেরা যিরীহো ১০১, অনু. ১
থেকে যিরূশালেমে যাত্রা করেন
(নিশান ৭ আমাদের সময়সারণী অনুযায়ী, ১৯৯৮
সালের ৫ই এপ্রিল রবিবার পড়ে, যদিও ইব্রীয় দিন
এক সন্ধ্যা থেকে অপর সন্ধ্যা পর্যন্ত গণনা করা হত)
৮ শুক্রবার সন্ধ্যা যীশু ও তাঁর শিষ্যেরা বৈথনিয়ায় এসে ১০১,
পৌঁছান; বিশ্রামবার শুরু হয় অনু. ২-৪
শনিবার বিশ্রামবার (৬ই এপ্রিল, সোমবার, ১৯৯৮) ১০১, অনু. ৪.
৯ শনিবার সন্ধ্যা কুষ্ঠি শিমোনের সাথে ভোজ; মরিয়ম ১০১,
সুগন্ধি দিয়ে যীশুকে অভিষিক্ত করেন; অনু. ৫-৯
অনেকে যীশুকে দেখতে ও তাঁর কথা শুনতে
যিরূশালেম থেকে আসেন
রবিবার যিরূশালেমে বিজয়সূচক প্রবেশ;
মন্দিরে শিক্ষা দেন ১০২
১০ সোমবার ভোরবেলা যিরূশালেমে যাত্রা; ১০৩, ১০৪
মন্দির পরিষ্কার করেন; যিহোবা স্বর্গ থেকে
কথা বলেন
১১ মঙ্গলবার যিরূশালেমে, দৃষ্টান্ত ব্যবহার করে ১০৫ থেকে ১১২,
মন্দিরে শিক্ষা দেন; ফরীশীদের অনু. ১
নিন্দা করেন; বিধবার দানকে লক্ষ্য
করেন; তাঁর ভবিষ্যৎ
আগমনের চিহ্ন দেন
১২ বুধবার শিষ্যদের সাথে বৈথনিয়ায় নিরিবিলি ১১২,
দিন; যিহূদা শত্রুহস্তে সমর্পণের ব্যবস্থা করেন অনু. ২-৪
১৩ বৃহস্পতিবার পিতর ও যোহন যিরূশালেমে নিস্তারপর্বের ১১২,
ভোজ প্রস্তুত করেন; যীশু এবং অনু. ৫ থেকে
অপর দশ জন প্রেরিত সন্ধ্যাবেলায় সেখানে ১১৩, অনু. ১
যান (১১ই এপ্রিল, শনিবার,
১৯৯৮)
১৪ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নিস্তারপর্ব উদ্যাপন; যীশু প্রেরিতদের ১১৩,
পা ধুয়ে দেন; যিহূদা যীশুকে সমর্পণ অনু. ২
করার জন্য বের হয়ে যায়; খ্রীষ্ট তাঁর থেকে ১১৭
মৃত্যুর স্মরণার্থকসভা স্থাপন করেন (সূর্যাস্তের
পর, শনিবার, ১১ই এপ্রিল, ১৯৯৮)
মধ্যরাতের পর গেৎশিমানী বাগানে সমর্পণ ও ১১৮ থেকে ১২০
গ্রেপ্তার; প্রেরিতেরা পলায়ন করেন;
মহাযাজক ও মহাসভার সম্মুখে
বিচার; পিতর যীশুকে অস্বীকার করেন
শুক্রবার সূর্যদয় পুনরায় মহাসভার সম্মুখে; পীলাতের ১২১ থেকে
থেকে সূর্যাস্ত কাছ থেকে হেরোদ, তারপর আবার ১২৭,
পীলাতের কাছে; মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়; অনু. ৭
বিদ্ধ করা হয়; কবর দেওয়া হয়
১৫ শনিবার বিশ্রামবার; পীলাত যীশুর কবর ১২৭,
পাহাড়া দেওয়ার জন্য অনুমতি দেন অনু. ৮-১০
১৬ রবিবার যীশু পুনরুত্থিত হন ১২৮
* এখানে তালিকাবদ্ধ সংখ্যাগুলি সর্বমহান পুরুষ যিনি কখনও জীবিত ছিলেন বইয়ের অধ্যায়গুলিকে চিহ্নিত করে। যীশুর শেষ পরিচর্যা সম্বন্ধে শাস্ত্রীয় উদ্ধৃতিসমৃদ্ধ বিস্তারিত একটি বর্ণনালিপির জন্য ‘ঈশ্বর-নিশ্বসিত প্রত্যেক শাস্ত্রলিপি উপকারী’ (ইংরাজি) বইয়ের ২৯০ পৃষ্ঠা দেখুন। বইগুলি ওয়াচটাওয়ার বাইবেল অ্যান্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটি দ্বারা প্রকাশিত।