যে নামটি প্রকৃত বিশ্বাসের জন্য জরুরি
এক মহিলা একজন যিহোবার সাক্ষীকে বলেন: “আপনারা যীশুকেও মানেন না আর মুক্তির মূল্য হিসাবে দেওয়া তাঁর রক্তেও বিশ্বাস করেন না।” আরেকজন লোক খুব জোরের সঙ্গে বলেছিলেন: “আপনারা নিজেদের যিহোবার সাক্ষী বলেন, কিন্তু আমি যীশুর সাক্ষী।”
সাধারণত লোকেরা মনে করেন, যিহোবার সাক্ষীরা যীশুকে বিশ্বাস করে না কিংবা তাঁকে সম্মানও করে না। কিন্তু, সত্যটি কী?
এটি সত্য যে যিহোবার সাক্ষীরা যিহোবার নামকে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।a ব্রাজিলের একজন সাক্ষী ইটামার বলেন: “যে মুহূর্তে আমি ঈশ্বরের নাম জেনেছিলাম সেই সময় থেকে আমার জীবনই বদলে গিয়েছে। প্রথমবার যখন আমি এটি পড়েছিলাম, তখন আমার মনে হয়েছিল যেন আমি এখনই গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠেছি। যিহোবা নামটি আমাকে শিহরিত করেছিল, আমি রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম; এটি আমাকে নাড়া দিয়েছিল।” কিন্তু তিনি আরও বলেন: “একই সঙ্গে আমি যীশুকেও ভীষণ ভালবাসি।”
হ্যাঁ, যিহোবার সাক্ষীরা খুব ভাল করে জানেন ও মানেন যে অনন্ত জীবন পাওয়ার জন্য তাদের ‘ঈশ্বরের পুত্ত্রের নামে বিশ্বাস করা’ খুবই জরুরি। (১ যোহন ৫:১৩) কিন্তু ‘যীশুর নামে,’ এই কথাটির অর্থ কী?
যীশুর নামের অর্থ
‘যীশুর নামে,’ এই কথাটি ও এইরকমই অন্য অভিব্যক্তিগুলি খ্রীষ্টীয় গ্রিক শাস্ত্র অর্থাৎ “নূতন নিয়ম”-এ দেখতে পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে, যীশু ও তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে “নাম” শব্দটি ৮০ বারেরও বেশি ব্যবহার করা হয়েছে, তার মধ্যে কেবল প্রেরিত পুস্তকেই প্রায় ৩০ বারের মতো তা রয়েছে। প্রথম শতাব্দীর খ্রীষ্টানেরা যীশুর নামে বাপ্তাইজিত হয়েছিলেন, রোগীদের সুস্থ করেছিলেন, তাঁর নামে শিক্ষা দিয়েছিলেন, তাঁর নামে ডেকেছিলেন, তাঁর নামের জন্য দুঃখভোগ এবং তাঁর নামকে মহিমান্বিত করেছিলেন।—প্রেরিত ২:৩৮; ৩:১৬; ৫:২৮; ৯:১৪, ১৬; ১৯:১৭.
একটি অভিধান অনুসারে, “নাম” শব্দটির জন্য বাইবেলে প্রায়ই যে গ্রিক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তার অর্থ, “কর্তৃত্ব, চরিত্র, পদমর্যাদা, মহিমা, ক্ষমতা, উৎকর্ষ আর এই সমস্তকিছুই একটি নামের সঙ্গে যুক্ত থাকে।” অতএব, যীশুর নামের অর্থ হল সেই মহিমাময় ও বিশাল প্রশাসনিক কর্তৃত্ব যা যিহোবা ঈশ্বর তাঁকে দিয়েছেন। যীশু নিজে বলেছিলেন: “স্বর্গে ও পৃথিবীতে সমস্ত কর্ত্তৃত্ব আমাকে দত্ত হইয়াছে।” (মথি ২৮:১৮) পিতর ও যোহন একজন খঞ্জ ব্যক্তিকে সুস্থ করার পর যিহূদী ধর্মীয় নেতারা জিজ্ঞাসা করেছিলেন: “কি ক্ষমতায় অথবা কি নামে তোমরা এই কর্ম্ম করিয়াছ?” তখন পিতর সাহসের সঙ্গে যীশুর নামে যে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা রয়েছে, তার প্রতি বিশ্বাস প্রকাশ করে বলেছিলেন: “নাসরতীর যীশু খ্রীষ্টের নামে, . . . তাঁহারই গুণে এই ব্যক্তি আপনাদের সম্মুখে সুস্থ শরীরে দাঁড়াইয়া আছে।”—প্রেরিত ৩:১-১০; ৪:৫-১০.
যীশু না কৈসর কাকে বিশ্বাস করবেন?
কিন্তু যীশুর নামে এইধরনের বিশ্বাস আছে বলে দাবি করা সহজ নয়। কারণ যীশু তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন যে তারা ‘তাঁহার নাম প্রযুক্ত সমুদয় জাতির দ্বেষের পাত্র’ হবেন। (মথি ২৪:৯) কেন? কারণ যীশুর নাম তাঁর পদমর্যাদাকে বোঝায় যে তিনি ঈশ্বরের মনোনীত শাসক, রাজাদের রাজা, যাঁর প্রতি সমুদয় জাতির বশ্যতা স্বীকার করা উচিত কিন্তু তা করার জন্য তারা প্রস্তুত নন অথবা তারা তা করতেও চান না।—গীতসংহিতা ২:১-৭.
যীশুর দিনেও ধর্মীয় নেতারা যীশুর প্রতি বশ্যতা স্বীকার করতে চাননি। তারা বলেছিলেন: “কৈসর ছাড়া আমাদের অন্য রাজা নাই” আর এই কথা বলে তারা ঈশ্বরের পুত্রকে অস্বীকার করেছিলেন। (যোহন ১৯:১৩-১৫) পরিবর্তে, তারা কৈসরের নামের উপর অর্থাৎ কৈসর ও তার রাজতন্ত্রের ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বের প্রতি বিশ্বাস রেখেছিলেন। এমনকি তারা যীশুকে হত্যা পর্যন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যাতে তাদের স্থান ও পদমর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে।—যোহন ১১:৪৭-৫৩.
যীশুর মৃত্যুর বেশ কিছু শতাব্দী পর, অনেকে যারা নিজেদের খ্রীষ্টান বলে দাবি করতেন, যিহূদী নেতাদের মতো মনোভাব দেখিয়েছিলেন। এই তথাকথিত খ্রীষ্টানেরা রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উপর তাদের বিশ্বাস রেখেছিলেন এবং এদের দ্বন্দ্ব-কলহে জড়িয়ে পড়েছিলেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, একাদশ শতাব্দীতে যাজকসম্প্রদায় বেকার সৈনিকদের নিয়ে মিলিসিয়া ক্রিস্টি বা খ্রীষ্টান বীরগণ নামে একটি সংঘ গড়ে তোলার পর “যাজকসম্প্রদায়, ধার্মিক যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব খ্রীষ্টীয় জগতের রাষ্ট্রগুলির সরকারের কাছ থেকে নিজেদের হাতে তুলে নেয়। আর এই ধার্মিক যুদ্ধগুলির জন্য তারা খ্রীষ্টান বীরগণ নামক সংঘকে ব্যবহার করেছিল।” (দি অক্সফোর্ড হিস্টোরি অফ খ্রীস্টানিটি) বিবরণটি আরও জানায় যে পোপের জোরালো উপদেশ শুনে যারা ক্রুসেডে অংশ নিয়েছিলেন এমন বেশিরভাগ লোকেরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে ক্রুসেডে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে “তারা ঈশ্বরের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছেন এবং পরমদেশে তাদের স্থান নিশ্চিত করেছেন।”
কেউ কেউ হয়তো যুক্তি দেখাতে পারেন যে যীশুর বাধ্য থেকেও রাজনীতি আর যুদ্ধে অংশ নেওয়া যায়। তারা হয়তো মনে করতে পারেন যে খ্রীষ্টানদের কর্তব্য হল সব ধরনের মন্দ বিষয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা আর সেইজন্য যদি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে তাও করা উচিত। কিন্তু প্রাথমিক খ্রীষ্টানরাও কি এইরকমই মনে করতেন?
খ্রীষ্টীয় শতাব্দী (ইংরাজি) পত্রিকার একটি প্রবন্ধ বলে: “প্রাথমিক খ্রীষ্টানেরা কখনও সেনাবাহিনীতে যোগ দেননি।” এটি ব্যাখ্যা করে যে সা.কা. ১৭০-১৮০ সালের মধ্যে এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না যা দেখায় যে খ্রীষ্টানেরা সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। প্রবন্ধটি আরও বলে: “অনেক সময় কেটে যাওয়ার পরই খ্রীষ্টানেরা সামরিক কাজে অংশ না নেওয়ার জন্য তাদের সংকল্পকে ধীরে ধীরে বদলাতে থাকেন।”
এর পরিণতি কী হয়েছে? “যুদ্ধে অংশ নেওয়ার কারণে খ্রীষ্টধর্মের সুনাম যতখানি নষ্ট হয়েছে, এর চেয়ে বেশি আর কোন কিছুতে হয়নি। আর এর ফলে তাদের ও ন-খ্রীষ্টানদের মধ্যে আর কোন পার্থক্য থাকেনি,” খ্রীষ্টীয় শতাব্দী পত্রিকার প্রবন্ধটি উল্লেখ করে। “খ্রীষ্টানেরা একদিকে তাদের অমায়িক পরিত্রাতার উপর বিশ্বাস রেখেছেন, অন্যদিকে সমস্ত ধর্মীয় কিংবা জাতিগত যুদ্ধকে খোলাখুলিভাবে সমর্থন করেছেন। আর এটি তাদের বিশ্বাসের উপর খুবই খারাপ প্রভাব ফেলেছে।”
আজকে প্রাথমিক খ্রীষ্টানদের মতো চলা
আজকে প্রাথমিক খ্রীষ্টানদের চমৎকার উদাহরণ অনুসারে চলা কি সম্ভব? এই শতাব্দীর যিহোবার সাক্ষীরা দেখিয়েছেন যে তা সম্ভব। তাদের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে, হলোকাস্ট এডুকেশনাল ডাইজেস্ট পত্রিকার সম্পাদক বলেছিলেন: “কোন যিহোবার সাক্ষীই কখনও যুদ্ধে যাবেন না। . . . জগতের সব ক্ষমতাবান ব্যক্তির বিশ্বাস যদি তাদের মতো হতো, তাহলে কখনও [দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ] হতো না।”
সাম্প্রতিক কালের আঞ্চলিক সংঘর্ষগুলির বিষয়েও একই কথা বলা যেতে পারে যেমন উত্তর আয়ারল্যান্ডে ঘটেছিল। কয়েক বছর আগে, একজন যিহোবার সাক্ষী বেলফাস্ট শহরের একটি প্রটেস্টান্ট এলাকায় ঘরে ঘরে প্রচার করছিলেন। কথা বলতে বলতে যখন গৃহকর্তা জানতে পারেন যে এই সাক্ষী আগে একজন ক্যাথলিক ছিলেন, তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: “আপনি যখন ক্যাথলিক ছিলেন, তখন কি আই আর এ [আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি]-কে সমর্থন করতেন?” সাক্ষী বুঝতে পারেন যে তিনি প্রচণ্ড রেগে যেতে পারেন কারণ তিনি একজন ক্যাথলিককে খুন করতে যাওয়ার সময় বন্দুক সমেত ধরা পড়েন আর মাত্র কয়েকদিন হল তিনি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। তাই সেই সাক্ষী উত্তর দিয়েছিলেন: “আমি এখন আর ক্যাথলিক নই। আমি একজন যিহোবার সাক্ষী। একজন সত্য খ্রীষ্টান হওয়ায় আমি কখনই কাউকে হত্যা করব না তা সে সরকারের জন্যই হোক বা মানুষের জন্যই হোক।” এই কথায় গৃহকর্তা তার সঙ্গে হাত মেলান এবং বলেন: “হত্যা করা অন্যায়। আপনারা খুব ভাল কাজ করছেন। আর এটা করে চলুন।”
যীশুর নামে বিশ্বাস রাখার অর্থ
কিন্তু, যীশুর নামে বিশ্বাস রাখার মানে কেবল যুদ্ধে অংশ না নেওয়ার চেয়েও বেশি কিছু। এর অর্থ খ্রীষ্টের সমস্ত আজ্ঞা পালন করা। সর্বোপরি, যীশু বলেছিলেন: “আমি তোমাদিগকে যাহা কিছু আজ্ঞা দিতেছি, তাহা যদি পালন কর, তবে তোমরা আমার বন্ধু” আর তাঁর একটি আজ্ঞা হল আমরা যেন “পরস্পর প্রেম” করি। (যোহন ১৫:১৪, ১৭) প্রেম সকলের মঙ্গল চায়। প্রেমে জাতি, ধর্ম ও সামাজিক বিভেদের কোন জায়গা নেই। কিভাবে, যীশু তা করে দেখিয়েছিলেন।
যীশুর দিনে যিহূদীরা শমরীয়দের ঘৃণা করত। কিন্তু, যীশু একজন শমরীয় স্ত্রীলোকের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, ফলে সেই স্ত্রী ও অন্যান্য অনেকে তাঁর নামের উপর বিশ্বাস করেছিলেন। (যোহন ৪:৩৯) যীশু আরও বলেছিলেন যে তাঁর শিষ্যরা তাঁর সাক্ষী হবেন “যিরূশালেমে, সমুদয় যিহূদীয়া ও শমরিয়া দেশে, এবং পৃথিবীর প্রান্ত পর্য্যন্ত।” (প্রেরিত ১:৮) তাঁর জীবনদায়ক বার্তা কেবল যিহূদীদের জন্যই ছিল না। তাই পিতরকে রোমীয় শতপতি কর্ণীলিয়ের কাছে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। অন্য জাতির কারও কাছে যাওয়া যদিও একজন যিহূদীর জন্য ব্যবস্থা বিরোধী ছিল কিন্তু পিতরকে ঈশ্বর দেখিয়েছিলেন যে তার কোন “মনুষ্যকে অপবিত্র কিম্বা অশুচি বলা অনুচিত।”—প্রেরিত ২০:২৮.
যীশুকে অনুকরণ করে যিহোবার সাক্ষীরা অন্তর থেকে লোকেদের—তা তারা যে কোন জাতি, ধর্ম অথবা অর্থনৈতিক পটভূমিরই হোক না কেন—পরিত্রাণের বিষয় শিখতে সাহায্য করেন, যা যীশুর নামের মাধ্যমে আসবে। যীশুর নামের প্রতি বিশ্বাস তাদের ‘মুখে [প্রকাশ্যে] যীশুকে প্রভু বলিয়া স্বীকার করার’ জন্য অনুপ্রাণিত করে। (রোমীয় ১০:৮, ৯) আমরা আপনাকে অনুরোধ করব যে তাদের সাহায্য নিন ও যীশুর নামে বিশ্বাস করতে শিখুন।
যীশুর নামটি অবশ্যই আমাদের মধ্যে সম্মান, শ্রদ্ধা এবং বাধ্যতার অনুভূতিগুলি জাগিয়ে তুলবে। প্রেরিত পৌল বলেছিলেন: “যীশুর নামে স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতালনিবাসীদের ‘সমুদয় জানু পাতিত হয়, এবং সমুদয় জিহ্বা যেন স্বীকার করে’ যে, যীশু খ্রীষ্টই প্রভু, এইরূপে পিতা ঈশ্বর যেন মহিমান্বিত হন।” (ফিলিপীয় ২:১০, ১১) যদিও আজকে পৃথিবীর বেশিরভাগ ব্যক্তিই যীশুর শাসনের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করতে চান না কিন্তু বাইবেল দেখায় যে খুব শীঘ্রই এমন এক সময় আসবে যখন সমস্ত লোককে তা করতে হবে নতুবা তারা ধ্বংস হয়ে যাবেন। (২ থিষলনীকীয় ১:৬-৯) অতএব, আমরা যীশুর সমস্ত আজ্ঞার বাধ্য হই আর তাঁর নামে বিশ্বাস রাখি।
[পাদটীকাগুলো]
a আরও তথ্যের জন্য, ১৯৮৪ সালে ওয়াচটাওয়ার বাইবেল অ্যান্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটি দ্বারা প্রকাশিত ঐশ্বরিক নামটি যা চিরকাল থাকবে (ইংরাজি) ব্রোশারের ২৮-৩১ পৃষ্ঠা দেখুন।
[৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
যীশুর নামের জন্য লক্ষ লক্ষ ব্যক্তি তাদের জীবন দিয়েছেন আর লক্ষ লক্ষ ব্যক্তি জীবন হারিয়েছেন
[৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
যীশু জাতিগত বিদ্বেষ পোষণ করেননি। আপনি কি করেন?