জগদ্ব্যাপী ঘৃণার অবসান
কমবেশী দুহাজার বছর আগে, একটি সংখ্যালঘু দল ঘৃণার শিকার হয়ে পড়ে। প্রাথমিক খ্রীষ্টানদের প্রতি রোমীয়দের আচরণ কেমন ছিল, সে বিষয়ে টার্টুলিয়ান ব্যাখ্যা দেন: “যদি আকাশ থেকে বৃষ্টির ধারা না নামে, যদি ভূমিকম্প হয়, দুর্ভিক্ষ অথবা মহামারীর যদি সূচনা দেখা দেয়, তৎক্ষণাৎ কলরব শুরু হত ‘খ্রীষ্টানদের সিংহদের সামনে ফেলে দাও!’”
ঘৃণার পাত্র হওয়া সত্ত্বেও, প্রাথমিক খ্রীষ্টানেরা অবিচারের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ন হওয়ার মনোভাবকে দমন করেছিল। তাঁর বিখ্যাত পর্বতে দত্ত উপদেশে যীশু খ্রীষ্ট বলেছিলেন: “তোমরা শুনিয়াছ, উক্ত হইয়াছিল, “তোমার প্রতিবাসীকে প্রেম করিবে,” এবং ‘তোমার শত্রুকে দ্বেষ করিবে’। কিন্তু আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, তোমরা আপন আপন শত্রুদিগকে প্রেম করিও, এবং যাহারা তোমাদিগকে তাড়না করে, তাহাদের জন্য প্রার্থনা করিও।”—মথি ৫:৪৩, ৪৪.
যিহূদীদের মৌখিক রীতিনীতি অনুসারে ‘শত্রুদের ঘৃণা’ করাই ছিল সঠিক পন্থা। যাইহোক, যীশু বলেছিলেন যে আমরা যেন অবশ্যই আমাদের শত্রুদের ভালবাসি, শুধুমাত্র আমাদের বন্ধুদের নয়। এটি পালন করা কষ্টকর, কিন্তু অসম্ভব নয়। একজন শত্রুকে প্রেম করার অর্থ এই নয় যে তার সকল কাজকর্ম এবং তার পন্থাকে আমরা পছন্দ করি। মথির বিবরণে যে গ্রীক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তা আগাপে থেকে গৃহীত, তা এমন এক প্রেমের বর্ণনা দেয় যা নীতি অনুসারে কাজ করে। এক ব্যক্তি যে আগাপে, অর্থাৎ নীতি অনুসারে প্রেম প্রদর্শন করে, সে শত্রুর প্রতি উত্তম আচরণ করে, এমনকি যে তার প্রতি ঘৃণা ও অন্যায় আচরণ করে। কেন? কারণ খ্রীষ্টকে অনুকরণ করার পথ এবং ঘৃণার মনোভাবকে জয় করার এটিও হল একটি মাত্র পথ। একজন গ্রীক পন্ডিত বলেন: “[আগাপে] আমাদের রেগে ওঠার ও তিক্ততার জন্মগত প্রবনতাকে জয় করতে সক্ষম করে।” কিন্তু বর্তমানের এই ঘৃণায় জর্জরিত জগতে কি তা কার্যকারী হবে?
এটা স্বীকার্য যে যারা খ্রীষ্টান বলে দাবী করে, তারা সকলেই খ্রীষ্টের উদাহরণকে অনুসরণ করে চলতে স্থিরসঙ্কল্প নয়। সম্প্রতি রুয়ান্ডায় সম্প্রদায় দলগুলির দ্বারা যে বর্বর দুষ্কার্য ঘটেছে, তাদের অধিকাংশ সদস্যরাই কিন্তু খ্রীষ্টান বলে দাবী করে। পিলার ডিএজ এসপেলোসিন নামে পরিচিত একজন রোমান ক্যাথলিক নান্, যিনি রুয়ান্ডায় ২০ বৎসর কাজ করেছিলেন, পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে একটি ঘটনার বিবরণ দেন। এক ব্যক্তি তার গির্জার দিকে একটি বরশা নিয়ে আসছিল যেটা সে অবশ্যই ব্যবহার করছিল। সেই নান্টি তাকে জিজ্ঞাসা করে: “তুমি এখানে কি করছ, যাকে পারছ, তাকেই মারছ? খ্রীষ্টের কথা কি চিন্তা কর না?” সেই ব্যক্তিটি দাবি করে যে, সে খ্রীষ্টের বিষয়ে ভাবে এবং গির্জার ভিতরে যায় এবং হাঁটু গেড়ে বসে ঐকান্তিকভাবে তার ধারাবাহিক প্রার্থনা করতে থাকে। কিন্তু যখন সে তা শেষ করে, তখন সে আবার সেই হত্যা কার্যে লিপ্ত হয়। নান্ স্বীকার করেন যে, “এটা দেখায় যে আমরা সঠিকভাবে খ্রীষ্টের উপদেশাবলি শেখাচ্ছি না।” যাই হোক, এই ধরনের ব্যর্থতার অর্থ এই নয় যে যীশুর বার্তার মধ্যে কোন ত্রুটি ছিল। যারা সত্য খ্রীষ্টতত্ত্বকে অনুশীলন করে চলে, তারা ঘৃণাকে জয় করতে পারে।
কনসেনট্রেশন শিবিরের মধ্যে ঘৃণাকে জয় করা
ম্যাক্স লিবস্টার ছিলেন একজন সাধারণ যিহূদী, যিনি ব্যাপক ধ্বংসের মধ্যে থেকে জীবন্ত রক্ষা পেয়েছিলেন। যদিও তার পদবীর অর্থ হল “প্রিয়পাত্র”, কিন্তু তিনি অত্যধিক ঘৃণা দেখেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে নাৎসি জার্মানীতে তিনি প্রেম ও ঘৃণার বিষয়ে শিক্ষিত হন।
“১৯৩০ এর দশকের সময়ে জার্মানীর ম্যানহীমের কাছে আমি বড় হয়েছি। হিটলার বলেন যে যিহূদীরা হল ধনী মুনাফাখোর, যারা জার্মানীর লোকেদের শোষণ করছিল। কিন্তু আসল বিষয় হল যে, আমার বাবা ছিলেন একজন নগণ্য মুচি। যাইহোক, নাৎসিদের প্রচারের প্রভাবের ফলে প্রতিবাশীরাও আমাদের প্রতি দৌরাত্ম্যপূর্ণ আচরণ দেখাতে শুরু করে। যখন আমি কিশোর ছিলাম, তখন একজন গ্রামবাসী জোর করে আমার কপালে শুকরের রক্ত লেপে দিয়েছিল। এই ব্যাপক অপমান শুধুমাত্র ভবিষ্যতে কী ধরনের দিন আসবে তারই ইঙ্গিত দেয়। ১৯৩৯ সালে গেসটাপো আমাকে বন্দী করে এবং আমার সব কিছু জিনিস বাজেয়াপ্ত করে নেয়।
১৯৪০ এর জানুয়ারি থেকে শুরু করে ১৯৪৫ এর মে পর্যন্ত আমি পাঁচটি ভিন্ন কনশেনট্রেশন শিবিরে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম চালাই: স্যাচসেনহোসেন, নিউএনগেমে, অসউইটস, বুনা এবং বুকেনওয়াল্ড। আমার বাবাকেও স্যাচসেনহোসেনে পাঠান হয় যেখানে প্রবল শীতের ফলে ১৯৪০ সালে তার মৃত্যু হয়। আমি নিজে তার মৃতদেহ কবরখানায় নিয়ে যাই, যেখানে ইতিমধ্যেই স্তুপাকার হয়ে আরও মৃতদেহ পড়ে ছিল। সবশুদ্ধ আমার পরিবারের আটজন সেই শিবিরে মারা যায়।
কয়েদীদের মধ্যে এসএস প্রহরীদের থেকে কেপোস-দের বেশী ঘৃণা করা হত। কেপোস-রা ছিল কয়েদী যারা এস এস-দের সাথে সহযোগিতা করে বলে, বিশেষ কিছু সুবিধা ভোগ করত। তাদের খাদ্য বিতরণের কার্যভার পদে নিযুক্ত করা হয়েছিল এবং অন্যান্য বন্দীদের নির্দয়ভাবে তারা মারত। প্রায়ই তারা অন্যায়্যভাবে এবং স্বেচ্ছাচারী আচরণ করত। আমি মনে করি এসএস এবং কেপোস উভয়দের আমার ঘৃণা করা অনেক কারণ ছিল কিন্তু কারাবাসকালে আমি শিখেছিলাম যে ঘৃণার চেয়ে প্রেম হল আরও অধিক শক্তিশালী।
যিহোবার সাক্ষীরা যারা বন্দী ছিল, তাদের বীরত্বপূর্ন সহিষ্ণুতা আমাকে দৃঢ়নিশ্চিত করেছিল যে তাদের এই বিশ্বাস হল শাস্ত্রভিত্তিক—এবং আমি নিজেও একজন সাক্ষী হয়ে যাই। আরনেস্ট ওয়েয়ার নামে একজন সাক্ষী যার সাথে আমার নিউএনগেমের কনসেন্ট্রশন শিবিরে পরিচয় হয়, সে আমাকে খ্রীষ্টের মনোভাব গড়ে তুলতে প্রেরণা দেয়। বাইবেল আমাদের জানায় যে ‘যখন তার নিন্দা করা হত, তিনি পরিবর্তে প্রতিনিন্দা করতেন না। যখন তিনি দুঃখভোগ করতেন, তখন তর্জন করতেন না, কিন্তু তাঁহার উপরে ভার রাখতেন যিনি ন্যায় অনুসারে বিচার করেন।’ (১ পিতর ২:২৩) আমি তা করার চেষ্টা করি এবং সকল প্রতিশোধের ভার ঈশ্বরের হাতে অর্পণ করি যিনি সকলের ন্যয়বিচার করেন।
“যে বছরগুলি আমি শিবিরে কাটিয়েছিলাম, তা আমাকে শিখিয়েছিল যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে লোকেরা যে নোংরা কাজ করে, তার মূলে রয়েছে অজ্ঞতা। এমনকি এস এস প্রহরীরা সবাই মন্দ ছিল না—সেখানে একজন ছিল যে আমার জীবন রক্ষা করেছিল। একবার ডাইরিয়ায় আমি আক্রান্ত হয়ে পড়ি এবং কর্মস্থল থেকে শিবির পর্যন্ত যাওয়ার শক্তি আমার ছিল না। পরের দিন সকালে আমাকে অসউইটসের গ্যাস চেম্বারে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু একজন এসএস প্রহরী, যে জার্মানীর সেই একই অঞ্চল থেকে আসে যেখান থেকে আমি আসি সে, আমার স্বপক্ষে কথা বলেছিল। সে আমার জন্য এস এস ক্যাফেটারিয়াতে একটা কাজের ব্যবস্থা করেছিল যেখানে আমি কিছুটা বিশ্রাম পাই যতক্ষণ না আমি সুস্থ হয়ে উঠি। এক দিন সে আমার কাছে স্বীকার করে: “ম্যাক্স, আমি মনে করি যে আমি একটি অতি দ্রুতগতিতে ধাবমান এক ট্রেনে যাত্রা করছি এবং যেটি আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। যদি আমি লাফিয়ে পড়ি, তাহলে নির্ঘাত মৃত্যু। আর যদি ট্রেনে থাকি, তাহলে পিষে যাব!’
“এই লোকেদের প্রেমের প্রয়োজন ছিল, যেমন আমারও প্রয়োজন ছিল। বস্তুতপক্ষে, প্রেম এবং সমবেদনা, তার সাথে ঈশ্বরের প্রতি আমার বিশ্বাস, যা আমাকে এই ভগ্ন পরিস্থিতি এবং মৃত্যুর হুমকির সাথে সহ্য করতে সমর্থ করেছিল। একথা বলা অন্যায় হবে যে আমি অক্ষত অবস্থায় রক্ষা পেয়েছিলাম, কিন্তু আমার মানসিক ক্ষতচিহ্ন খুব অল্পই ছিল।”
পঞ্চাশ বছর বাদেও ম্যাক্স যে সস্নেহ এবং করুণা দেখিয়ে থাকে, তা তার মুখের কথার সত্যতাকে অলঙ্কারপূর্ণ ভাষায় ব্যক্ত করে। ম্যাক্সের ঘটনাটি অদ্বিতীয় কিছু নয়। ঘৃণাকে জয় করার তার একটা দৃঢ় কারণ ছিল—তিনি খ্রীষ্টকে অনুকরণ করতে চেয়েছিলেন। অন্যান্যেরা যারা তাদের জীবন শাস্ত্রীয় মতে পরিচালনা করে থাকে, তারাও একইভাবে আচরণ করেছে। ফ্রান্সের একজন যিহোবার সাক্ষী, সিমোন বলেছিলেন যে নিঃস্বার্থ প্রেম কী, তা তিনি কিভাবে শিখেছিলেন।
আমার মা এমা, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগেই যিহোবার সাক্ষী হয়েছিলেন, তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন যে লোকেরা অজ্ঞানতার ফলে বেশিরভাগ মন্দ কাজ করে। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন যে প্রত্যুত্তরে যদি আমরা তাদের ঘৃণা করি, তাহলে আমরা সত্য খ্রীষ্টান নই, যেহেতু যীশু বলেছিলেন যে আমরা যেন আমাদের শত্রুদেরও ভালবাসি এবং যারা আমাদের নির্যাতন করে, তাদের জন্যও যেন প্রার্থনা করি।—মথি ৫:৪৪.
“এক অত্যন্ত কষ্টকর পরিস্থিতির কথা আমার মনে পড়ে, যা আমার এই দৃঢ়বিশ্বাসকে পরীক্ষায় ফেলেছিল। ফ্রান্সের উপর নাৎসি দখলের সময়ে, যে বহুতলবিশিষ্ট বাড়িটিতে থাকতাম, সেখানে আমার মাকে এক প্রতিবেশীর হাতে অনেক লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়। তিনি গেস্টাপোদের কাছে মার বিরূদ্ধে অভিযোগ করেন, যার ফলে মাকে দুবছরের জন্য জার্মানীর কনসেনট্রেশন শিবিরে থাকতে হয় যেখানে তিনি প্রায় মৃতবৎ হয়ে গিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে ফ্রান্সের পুলিসরা, মহিলাটি জার্মানীর সাথে সহভাগীতা করছে বলে অভিযোগমূলক পত্রে মাকে সাক্ষর করতে বলেন। কিন্তু মা তা করতে অস্বীকার করেন এই বলে যে ‘ঈশ্বর হলেন বিচারক এবং ভাল ও মন্দের পুরষ্কারদাতা তিনিই।’ কয়েক বছর পরে সেই প্রতিবেশিটি মারাত্মক ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়ে পরেন। তার এই অসময়ের প্রতি কটাক্ষপাত না করে, আমার মা তার জীবনের শেষ মাসগুলিকেও যতদুর সম্ভব আরামদায়ক করে তুলেছিল। ঘৃণার উপরে প্রেমের এই জয়ের কথা আমি কখনও ভুলতে পারব না।
এই দুটি দৃষ্টান্তই ব্যাখ্যা দেয় যে অবিচারের সামনেও নীতিগত প্রেম কিভাবে কার্যকারী হয়। তবুও বাইবেল নিজেই জানায় যে “প্রেম করিবার কাল ও দ্বেষ করিবার কাল” আছে। (উপদেশক ৩:১, ৮) তা কিভাবে সম্ভব?
ঘৃণা করবার কাল
ঈশ্বর সকল প্রকারের ঘৃণার প্রতি দোষারোপ করেন না। যীশু খ্রীষ্টের বিষয়ে বাইবেল বলে: “তুমি ধার্মিকতাকে প্রেম, ও দুষ্টতাকে ঘৃণা করিয়াছ।” (ইব্রীয় ১:৯) যাইহোক, দুষ্টতাকে ঘৃণা করা এবং যে ব্যক্তি অন্যায় কাজ করে, তাকে ঘৃণা করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
যীশু প্রেম ও ঘৃণার বিষয়ে সঠিক সমতা দেখিয়েছিলেন। তিনি ভণ্ডামিকে ঘৃণা করতেন, কিন্তু কপটদের সাহায্য করতে চেষ্টা করেন যাতে তারা তাদের চিন্তাধারার পরিবর্তন করতে পারে। (মথি ২৩:২৭, ২৮; লূক ৭:৩৬-৫০) তিনি দৌরাত্ম্যকে নিন্দা করতেন, কিন্তু যারা তাকে বধ করেছিল, তাদের জন্য তিনি প্রার্থনা করেছিলেন। (মথি ২৬:৫২; লূক ২৩:৩৪) যদিও এই জগৎ তাঁকে অকারণে ঘৃণা করেছিল, তথাপি তিনি তাঁর নিজের জীবন দেন সেই একই জগতের জন্য, যাতে করে তারা জীবন পায়। (যোহন ৬:৩৩, ৫১; ১৫:১৮, ২৫) নীতিগত প্রেম এবং ঈশ্বরীয় ঘৃণার এক নিখুঁত উদাহরণ তিনি রেখে গেছেন।
অবিচার হয়ত আমাদের মধ্যে ঘৃণা মিশ্রিত ক্রোধের উদ্রেক করতে পারে, ঠিক যেমন যীশুর ক্ষেত্রে ঘটেছিল। (লূক ১৯:৪৫, ৪৬) যাইহোক, খ্রীষ্টানদের কিন্তু নিজেদের হাতে প্রতিশোধ নেওয়ার কোন অধিকার নেই। “মন্দের পরিশোধে কাহারও মন্দ করিও না”, পৌল রোমীয় খ্রীষ্টানদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। “যদি সাধ্য হয়, তোমাদের যতদূর হাত থাকে, মনুষ্যমাত্রের সহিত শান্তিতে থাক। প্রতিশোধ লইও না . . . তুমি মন্দের দ্বারা পরাজিত হইও না, কিন্তু উত্তমের দ্বারা মন্দকে পরাজয় কর।” (রোমীয় ১২:১৭-২১) যখন আমরা ব্যক্তিগতভাবে ঘৃণা প্রদর্শন করি না, অথবা অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করি না, তখন প্রেমই জয়লাভ করে।
ঘৃণাবিহীন এক জগৎ
যদি পৃথিবীব্যাপী ঘৃণার অবসান ঘটাতে হয়, তাহলে লক্ষ লক্ষ মানুষের পরীখাস্বরূপ মনোভাবের পরিবর্তন আনতে হবে। তা কিভাবে সম্পাদন করা যেতে পারে? অধ্যাপক আরভিন স্টাব নিম্নলিখিত সুপারিশ করেছেন: “আমরা তাদের আঘাত করি, যাদের আমরা ছোট করে দেখি, আর যারা সাহায্য করে, তাদের উপরে তুলে ধরি। যেসব লোকেদের আমরা সাহায্য করি, তাদের যখন আমরা আরও বড় করে দেখি এবং সাহায্য করার দ্বারা যখন সন্তোষ খুঁজে পাই, তখন আমরা নিজেদের আরও যত্নবান ও সাহায্যকারীরূপে খুঁজে পাই। আমাদের লক্ষ্য সকলের মধ্যে একটি এমন হওয়া উচিত যে এমন একটি সমাজ তৈরি করা যেখানে অন্যদের জন্য সর্ব্বোতকৃষ্ট কিছু সম্পাদন করা যায়”—মন্দের শিকড়গুলি (ইংরাজি)।
আরেক কথায়, ঘৃণার অবসান ঘটানোর জন্য প্রয়োজন এমন একটি সমাজ তৈরি করার, যেখানে লোকেরা শিখবে কিভাবে একে অপরকে সাহায্য করার দ্বারা প্রেম করতে হয়, এমন একটা সমাজ যেখানে লোকেরা কুসংস্কার, জাতীয়তাবাদ, বর্ণবৈষম্যতার জন্য ঘৃণাকে ভুলে যায়। এমন একটি সমাজ কি বাস্তবে আছে? এমন একজন ব্যক্তির অভিজ্ঞতার কথা বিবেচনা করুন যিনি চীনেতে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ে ব্যক্তিগতভাবে ঘৃণার শিকার হয়েছিলেন।
“যখন সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু হয়েছিল, তখন আমাদের শিখানো হয়েছিল যে ‘শ্রেনী সংগ্রামের’ ক্ষেত্রে আপোষ করার কোন স্থান নেই। ঘৃণা ছিল অতি সাধারণ মনোভাব। আমি একজন রেডগার্ড হয়ে যাই এবং সর্বত্র শ্রেণী শত্রুদের খুঁজতে থাকি—এমনকি আমার নিজের পরিবারের মধ্যেও। যদিও আমি তখন একজন কিশোর ছিলাম, তথাপি আমি ঘরে খোঁজার কাজ করতাম, ‘প্রতিক্রিয়ামূলক শিক্ষার’ কোন প্রমাণ আছে কিনা তার অন্বেষণ করতাম। আমি এমন একটি জনসভাও পরিচালনা করি, যেখানে আমি একজন বিরোধী বিপ্লবীর ব্যক্তির বিষয়ে নালিশ করেছিলাম। অবশ্যই, এইসব অভিযোগগুলি রাজনৈতিক কারণের চাইতে কখন কখন ব্যক্তিগত বিদ্বেষের ফলে হত।
“আমি বহু ব্যক্তিকে দেখেছিলাম—যুবক এবং বৃদ্ধ, পুরুষ এবং নারী—যাদের শারীরিকভাবে যাতনা দেওয়া হত, যেগুলি ক্রমাগতভাবে আরও নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিল। আমার স্কুলের একজন শিক্ষক—যিনি উত্তম ব্যক্তি ছিলেন, তাকে একজন অপরাধীর মত রাস্তায় হাঁটানো হয়। দুমাস পরে আমার স্কুলের আর একজন অতি সম্মানীয় শিক্ষককে সুজাউ নদীতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং আমার ইংরাজি শিক্ষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। আমি মর্মাহত এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম। এরা সবাই সহৃদয় ব্যক্তি ছিলেন। তাদের সাথে এমন আচরণ করা ছিল ভুল! সেজন্য আমি রেড গার্ডের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দি। আমি মনে করি না যে চীনে ঘৃণার এই সূচনা, তা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এই শতাব্দী বহু ঘৃণার অভিব্যক্তি দেখেছে। যাইহোক, আমি স্থিরনিশ্চিত, যে প্রেম ঘৃণাকে জয় করতে পারে। এটা আমি নিজের ক্ষেত্রেও দেখেছি। যখন আমি যিহোবার সাক্ষীদের সাথে মেলামেশা করতে আরম্ভ করি, তখন তারা বিভিন্ন জাতি ও পটভূমিকার লোকেদের প্রতি যে প্রকৃত প্রেম প্রদর্শন করেছিল, তা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি সেই সময়ের প্রতি দৃষ্টি রাখি, যখন বাইবেলের প্রতিজ্ঞানুসারে সকল ব্যক্তি একে অপরকে প্রেম করতে শিখবে।”
হ্যাঁ, যিহোবার সাক্ষীদের আন্তর্জাতিক সমিতি তার প্রমাণ দেয় যে ঘৃণার অবসান ঘটতে পারে। তাদের পটভূমিকা যাই হোক না কেন, সাক্ষীরা কুসংস্কারকে পারস্পারিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে সরিয়ে ফেলার কঠোর প্রচেষ্টা করছে এবং সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবাদ এবং বর্ণ বৈষম্যের যে কোন চিহ্নকে অপসারিত করছে। তাদের সাফল্যের একটি ভিত্তি হল তারা নীতিগত প্রেম প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে যীশুকে অনুকরণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাদের আর একটি ভিত্তি হল যে তারা যে কোন অবিচারই সহ্য করুক না কেন, সমাধানের জন্য তারা ঈশ্বরের রাজ্যের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ঘৃণাহীন জগতের জন্য ঈশ্বরের রাজ্যই হল নিশ্চিৎ সমাধান, এমন এক জগৎ যেখানে এমনকি ঘৃণা করার জন্য মন্দ কোন জিনিস থাকবে না। বাইবেলে বর্ণিত “নূতন আকাশমণ্ডলের”, অর্থাৎ স্বর্গীয় সরকার অবিচার হতে মুক্ত এক পৃথিবীর নিশ্তয়তা দেয়। এটি “নূতন পৃথিবীর”, অর্থাৎ নতুন মানব সমাজের উপরে শাসন করবে, যারা একে অপরকে প্রেম করতে শিক্ষিত হয়ে উঠবে। (২ পিতর ৩:১৩; যিশাইয় ৫৪: ১৩) এই শিক্ষাপদ্ধতি ইতিমধ্যেই কাজ করছে, যেমন ম্যাক্স, শিমোন এবং অন্যান্যেরা সে বিষয়ে সাক্ষ্য দেন। এটা জগৎব্যাপী ঘৃণা এবং এর কারণগুলিকে সরানোর এক পূর্বাভাষ মাত্র।
তার ভাববাদী যিশাইয়ের মাধ্যমে যিহোবা তার ফলের বিষয়ে বর্ণনা দেন: “সে সকল আমার পবিত্র পর্ব্বতের কোন স্থানে হিংসা কিম্বা বিনাশ করিবে না; কারণ সমুদ্র যেমন জলে আচ্ছন্ন, তেমনি পৃথিবী সদাপ্রভু-বিষয়ক জ্ঞানে পরিপূর্ণ হইবে।” (যিশাইয় ১১:৯) ঈশ্বর নিজে ঘৃণার অবসান হয়েছে বলে ঘোষণা করবেন। আর তখন তা হবে প্রেম প্রদর্শনের প্রকৃত সময়।
[Pictures on page 7]
নাৎসিরা ম্যাক্স লিস্টারের বাম হাতে একটি কয়েদি সংখ্যার ছাপ এঁকে দিয়েছিল।
[৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
শীঘ্রই ঘৃণা হবে অতীতের বিষয়