অধ্যায় ২৬
একজন ঈশ্বর যিনি “ক্ষমা করার জন্য তৈরি”
১-৩. (ক) গীতরচক দায়ূদ কোন ভারী বোঝা বহন করেছিলেন এবং তিনি তাঁর দুঃখে ভারাক্রান্ত হৃদয়ের জন্য কীভাবে সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছিলেন? (খ) আমরা যখন পাপ করি, তখন ফলস্বরূপ আমরা হয়তো কোন বোঝা বহন করতে পারি কিন্তু যিহোবা আমাদের কী আশ্বাস দেন?
“আমার অপরাধসমূহ আমার মস্তকের উপরে উঠিয়াছে, ভারী বোঝার ন্যায় সে সকল আমার শক্তি অপেক্ষা ভারী,” গীতরচক দায়ূদ লিখেছিলেন। “আমি অবসন্ন ও অতিশয় ক্ষুণ্ণ হইয়াছি।” (গীতসংহিতা ৩৮:৪, ৮) দায়ূদ জানতেন যে, এক দোষী বিবেকের বোঝা কতটা ভারী হতে পারে। কিন্তু, তিনি তার দুঃখে ভারাক্রান্ত হৃদয়ের জন্য সান্ত্বনা পেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, যিহোবা পাপকে ঘৃণা করলেও পাপীকে ঘৃণা করেন না, যদি সেই ব্যক্তি প্রকৃতই অনুতপ্ত হয় এবং পাপের পথকে সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করে। অনুতপ্ত লোকেদের প্রতি যিহোবা যে করুণা দেখাতে চান, তাতে পূর্ণ বিশ্বাস করে দায়ূদ বলেছিলেন: “হে প্রভু [“যিহোবা,” NW], তুমি . . . ক্ষমাবান্ [“ক্ষমা করার জন্য তৈরি,” NW]।”—গীতসংহিতা ৮৬:৫.
২ আমরা যখন পাপ করি, তখন আমরাও হয়তো দুঃখে ভারাক্রান্ত বিবেকের ভারী বোঝা বহন করতে পারি। বিবেকের এইরকম দংশন উপকারী। এটা আমাদের ভুলগুলো সংশোধন করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নিতে পরিচালিত করতে পারে। কিন্তু, অপরাধবোধের দ্বারা অতিরিক্ত জর্জরিত হয়ে পড়ার এক বিপদ রয়েছে। নিজেদের দোষী মনে করা হৃদয় হয়তো নাছোড়বান্দাভাবে মনে করাতে পারে যে, আমরা যত অনুতপ্তই হই না কেন, যিহোবা আমাদের ক্ষমা করবেন না। আমরা যদি অপরাধবোধের দ্বারা “কবলিত” হই, তা হলে শয়তান হয়তো আমাদের হাল ছেড়ে দেওয়াতে ও এই মনে করাতে চেষ্টা করবে যে, যিহোবা আমাদের মূল্যহীন, তাঁকে সেবা করার অযোগ্য বলে মনে করেন।—২ করিন্থীয় ২:৫-১১.
৩ যিহোবার দৃষ্টিভঙ্গি কি আসলে এইরকম? কখনোই না! ক্ষমা হল যিহোবার মহৎ প্রেমের একটা বৈশিষ্ট্য। তাঁর বাক্যে তিনি আমাদের আশ্বাস দেন যে আমরা যখন প্রকৃত ও অন্তর থেকে অনুতাপ প্রকাশ করি, তখন তিনি ক্ষমা করতে ইচ্ছুক। (হিতোপদেশ ২৮:১৩) যিহোবার ক্ষমা লাভ করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব, এইরকম অনুভূতি এড়ানোর জন্য আসুন আমরা পরীক্ষা করে দেখি যে, তিনি কেন এবং কীভাবে ক্ষমা করেন।
যেকারণে যিহোবা “ক্ষমা করার জন্য তৈরি”
৪. যিহোবা আমাদের স্বভাব সম্বন্ধে কী জানেন আর এটা তিনি আমাদের সঙ্গে যেরকম আচরণ করেন, তাতে কীভাবে প্রভাব ফেলে?
৪ যিহোবা আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো জানেন। গীতসংহিতা ১০৩:১৪ পদ বলে, “তিনিই আমাদের গঠন জানেন; আমরা যে ধূলিমাত্র, ইহা তাঁহার স্মরণে আছে।” তিনি ভুলে যান না যে, আমরা ধূলি থেকে সৃষ্ট, অসিদ্ধতার ফলে আমাদের বিভিন্ন দুর্বলতা রয়েছে। তিনি “আমাদের গঠন” জানেন এই অভিব্যক্তিটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, বাইবেল যিহোবাকে একজন কুম্ভকারের সঙ্গে আর আমাদেরকে তাঁর তৈরি মাটির পাত্রগুলোর সঙ্গে তুলনা করে।a (যিরমিয় ১৮:২-৬) মহান কুম্ভকার আমাদের দুর্বল পাপী স্বভাব এবং আমরা তাঁর নির্দেশনার প্রতি যেভাবে সাড়া দিই বা সাড়া দিতে ব্যর্থ হই, সেই অনুযায়ী আমাদের সঙ্গে আচরণ করেন।
৫. রোমীয় পুস্তক পাপের দৃঢ়মুষ্টি সম্বন্ধে কীভাবে বর্ণনা করে?
৫ পাপ কতটা শক্তিশালী, তা যিহোবা জানেন। তাঁর বাক্য পাপকে এক প্রচণ্ড শক্তি হিসেবে বর্ণনা করে, যেটা মানুষকে এর মারাত্মক দৃঢ়মুষ্টিতে আবদ্ধ করে রেখেছে। পাপের এই দৃঢ়মুষ্টি কতটা শক্ত? রোমীয় পুস্তকে, প্রেরিত পৌল ব্যাখ্যা করেন: আমরা “পাপের অধীন,” যেমন সৈন্যরা সেনাপতির অধীন (রোমীয় ৩:৯); পাপ মানবজাতির ওপরে রাজার মতো “রাজত্ব” করেছে (রোমীয় ৫:২১); এটা আমাদের ভিতরে ‘বাস’ করে (রোমীয় ৭:১৭, ২০); এর “ব্যবস্থা” আমাদের মধ্যে কাজ করে চলেছে, মূলত আমাদের জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। (রোমীয় ৭:২৩, ২৫) পাপ আমাদের অসিদ্ধ মাংসকে কতই না জোরালোভাবে আঁকড়ে ধরে আছে!—রোমীয় ৭:২১, ২৪.
৬, ৭. (ক) যারা পাপের দরুণ পীড়িত হৃদয়ে যিহোবার করুণা লাভ করার চেষ্টা করে, তাদের তিনি কীভাবে দেখেন? (খ) কেন আমাদের ঈশ্বরের করুণাকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়?
৬ তাই, যিহোবা জানেন যে আমাদের পক্ষে সম্পূর্ণ বাধ্য থাকা সম্ভব নয়, তা আমরা যত আন্তরিকভাবেই তাঁর প্রতি থাকার চেষ্টা করি না কেন। তিনি প্রেমের সঙ্গে আমাদের আশ্বাস দেন যে, আমরা যখন পাপের দরুণ পীড়িত হৃদয়ে তাঁর করুণা খোঁজার চেষ্টা করি, তখন তিনি ক্ষমা করবেন। গীতসংহিতা ৫১:১৭ পদ বলে: “ঈশ্বরের গ্রাহ্যবলি ভগ্ন আত্মা; হে ঈশ্বর, তুমি ভগ্ন ও চূর্ণ অন্তঃকরণ তুচ্ছ করিবে না।” অপরাধবোধের ভারে “ভগ্ন ও চূর্ণ” হৃদয় যিহোবা কখনোই অগ্রাহ্য করবেন না বা ফিরিয়ে দেবেন না।
৭ কিন্তু এর মানে কি এই যে, আমরা আমাদের পাপী স্বভাবকে পাপ করার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ঈশ্বরের করুণাকে হালকাভাবে নিতে পারি? অবশ্যই না! যিহোবা শুধু আবেগের দ্বারা পরিচালিত হন না। তাঁর করুণার সীমা আছে। যিহোবা তাদের কোনোভাবেই ক্ষমা করবেন না, যারা অনুতাপ না দেখিয়ে স্বেচ্ছায় কঠিন হৃদয়ে পাপ করে চলে। (ইব্রীয় ১০:২৬) অন্যদিকে, তিনি যখন পাপের দরুণ পীড়িত এক হৃদয় দেখেন, তখন তিনি ক্ষমা করার জন্য তৈরি। এখন আসুন আমরা যিহোবার প্রেমের এই চমৎকার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার জন্য বাইবেলে ব্যবহৃত কয়েকটা সুস্পষ্ট ভাষা বিবেচনা করে দেখি।
যিহোবা কতটা সম্পূর্ণভাবে ক্ষমা করেন?
৮. যিহোবা যখন আমাদের ক্ষমা করেন, তখন মূলত তিনি কী করেন আর এটা আমাদের কোন আস্থা রাখতে সাহায্য করে?
৮ অনুতপ্ত দায়ূদ বলেছিলেন: “আমি তোমার কাছে আমার পাপ স্বীকার করিলাম, অপরাধ আর গোপন করিলাম না, . . . তাহাতে তুমি আমার পাপের অপরাধ মোচন করিলে।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) (গীতসংহিতা ৩২:৫) “মোচন করিলে” অভিব্যক্তিটি যে-ইব্রীয় শব্দ থেকে অনুবাদ করা হয়েছে, সেটার মূল অর্থ “উঠিয়ে নেওয়া” বা “বহন করা।” এখানে এটার ব্যবহার “অপরাধবোধ, পাপ, অন্যায়” সরিয়ে ফেলার অর্থকে বোঝায়। অতএব, যিহোবা মূলত দায়ূদের পাপগুলো উঠিয়ে নিয়েছিলেন ও সেগুলো বহন করে দূরে সরিয়ে ফেলেছিলেন। নিঃসন্দেহে এটা দায়ূদ যে-অপরাধবোধ বয়ে বেড়াচ্ছিলেন, সেটাকে হালকা করেছিল। (গীতসংহিতা ৩২:৩) আমাদেরও ঈশ্বরের ওপর পূর্ণ আস্থা রয়েছে, যিনি সেই সমস্ত ব্যক্তির পাপগুলো বহন করেন, যারা যিশুর মুক্তির মূল্যরূপ বলিদানের ওপর বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাঁর ক্ষমা পাওয়ার চেষ্টা করে।—মথি ২০:২৮.
৯. যিহোবা আমাদের পাপগুলো আমাদের কাছ থেকে কতটা দূরে সরিয়ে দেন?
৯ দায়ূদ যিহোবার ক্ষমা বর্ণনা করার জন্য আরেকটা প্রাণবন্ত অভিব্যক্তি ব্যবহার করেছিলেন: “পশ্চিম দিক্ হইতে পূর্ব্ব দিক্ যেমন দূরবর্ত্তী, তিনি আমাদের হইতে আমাদের অপরাধ সকল তেমনি দূরবর্ত্তী করিয়াছেন।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) (গীতসংহিতা ১০৩:১২) পশ্চিম থেকে পূর্ব দিক কতদূর? এক অর্থে পূর্ব দিক সবসময়ই পশ্চিম দিক থেকে সর্বাধিক দূরবর্তী; এই দুই বিন্দু কখনোই এক হতে পারে না। একজন পণ্ডিত ব্যক্তি উল্লেখ করেছিলেন যে, এই অভিব্যক্তিটির মানে “যতটা সম্ভব দূরে; আমরা যতটা কল্পনা করতে পারি ততটা দূর।” দায়ূদের অনুপ্রাণিত কথাগুলো আমাদের বলে যে যিহোবা যখন ক্ষমা করেন, তখন তিনি আমাদের পাপগুলো আমরা যতটা কল্পনা করতে পারি ততটা দূরে সরিয়ে দেন।
১০. যিহোবা যখন আমাদের পাপগুলো ক্ষমা করেন, তখন কেন আমাদের এইরকম মনে করা উচিত নয় যে, এই পাপগুলোর দাগ আমাদের বাকি জীবন বয়ে বেড়াতে হবে?
১০ আপনি কি কখনও একটা হালকা রংয়ের কাপড় থেকে দাগ উঠানোর চেষ্টা করেছেন? হয়তো আপনার প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও দাগটা রয়ে যায়। লক্ষ করুন যে, যিহোবা ক্ষমা সম্বন্ধে তাঁর সামর্থ্যের বিষয়ে কীভাবে বর্ণনা করেন: “তোমাদের পাপ সকল সিন্দুরবর্ণ হইলেও হিমের ন্যায় শুক্লবর্ণ হইবে; লাক্ষার ন্যায় রাঙ্গা হইলেও মেষলোমের ন্যায় হইবে।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) (যিশাইয় ১:১৮) “সিন্দুরবর্ণ” শব্দটা উজ্জ্বল লাল রংকে নির্দেশ করে।b “লাক্ষা” ছিল রঞ্জক পদার্থের একটা গাঢ় রং। আমরা নিজেরা চেষ্টা করে কখনোই পাপের দাগকে উঠাতে পারি না। কিন্তু যিহোবা সিন্দুরবর্ণ ও লাক্ষার মতো পাপগুলোকে মুছে দিতে এবং সেগুলোকে হিম বা অরঞ্জিত মেষলোমের মতো সাদা করতে পারেন। যিহোবা যখন আমাদের পাপ ক্ষমা করেন, তখন আমাদের এইরকম মনে করা উচিত নয় যে, এই পাপগুলোর দাগ আমাদের বাকি জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
১১. কোন অর্থে যিহোবা আমাদের পাপগুলো তাঁর পিছনে ফেলে দেন?
১১ কৃতজ্ঞতার এক মর্মস্পর্শী গান, যা হিষ্কিয় এক মারাত্মক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রচনা করেছিলেন, তাতে তিনি যিহোবাকে বলেছিলেন: “তুমি ত আমার সমস্ত পাপ তোমার পশ্চাতে ফেলিয়াছ।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) (যিশাইয় ৩৮:১৭) এখানে যিহোবাকে এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যিনি একজন অনুতপ্ত পাপীর পাপগুলো তুলে নিচ্ছেন এবং সেগুলো তাঁর পিছনে ফেলে দিচ্ছেন, যেখানে তিনি সেগুলোকে আর ফিরে দেখেন না বা আর মনে রাখেন না। একটা উৎস অনুযায়ী, যে-ধারণা দেওয়া হয়েছে সেটাকে হয়তো এভাবে প্রকাশ করা যেতে পারে: “তুমি [আমার পাপগুলো] এমন করেছ যেন সেগুলো কখনো করাই হয়নি।” তা কি আশ্বাসদায়ক নয়?
১২. ভাববাদী মীখা কীভাবে দেখান যে যিহোবা যখন ক্ষমা করেন, তখন তিনি আমাদের পাপগুলো স্থায়ীভাবে সরিয়ে দেন?
১২ পুনর্স্থাপনের এক প্রতিজ্ঞায়, ভাববাদী মীখা তার এই দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশ করেছিলেন যে যিহোবা তাঁর অনুতপ্ত লোকেদের ক্ষমা করবেন: “কে তোমার তুল্য ঈশ্বর? . . . আপন অধিকারের অবশিষ্টাংশের অধর্ম্মের প্রতি উপেক্ষাকারি! . . . হাঁ, তুমি আপন লোকদের সমস্ত পাপ সমুদ্রের অগাধ জলে নিক্ষেপ করিবে।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) (মীখা ৭:১৮, ১৯) বাইবেলের সময়ে যারা জীবিত ছিল তাদের জন্য এই কথাগুলোর অর্থ কী ছিল, তা ভেবে দেখুন। কোনো কিছু যখন “সমুদ্রের অগাধ জলে” ফেলে দেওয়া হয়েছিল, তখন সেটা পুনরুদ্ধার করার কি কোনো সম্ভাবনা ছিল? এভাবে মীখার কথাগুলো দেখায় যে যিহোবা যখন ক্ষমা করেন, তখন তিনি আমাদের পাপগুলো স্থায়ীভাবে সরিয়ে দেন।
১৩. “আমাদের ঋণ সকল ক্ষমা কর,” যিশুর এই কথাগুলোর মানে কী?
১৩ যিহোবার ক্ষমা সম্বন্ধে বর্ণনা করার জন্য যিশু ঋণদাতা ও ঋণীর বিষয়ে এক দৃষ্টান্ত ব্যবহার করেন। (মথি ১৮:২৩-৩৫) এ ছাড়া, তিনি আমাদের এই প্রার্থনা করার জন্যও উৎসাহিত করেন: “আমাদের অপরাধ [“ঋণ,” পাদটীকা] সকল ক্ষমা কর।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) (মথি ৬:১২) তাই, আমরা যখন পাপ করি, তখন যিহোবার কাছে “ঋণী” হই। যে-গ্রিক ক্রিয়া পদ “ক্ষমা” হিসেবে অনুবাদিত হয়েছে, সেটার অর্থ সম্বন্ধে একটি তথ্যগ্রন্থ বলে: “কোনোরকম দাবি না করে ঋণ মওকুফ করে দেওয়া বা পরিত্যাগ করা।” তাই যিহোবা যখন ক্ষমা করেন, তখন এক অর্থে তিনি সেই ঋণ বাতিল করে দেন, যেটা আমাদের কাছ থেকে আদায় করা হতো। এভাবে অনুতপ্ত পাপীরা সান্ত্বনা পেতে পারে। যিহোবা যে-ঋণ বাতিল করে দিয়েছেন, তা তিনি আর কখনোই দাবি করবেন না!—গীতসংহিতা ৩২:১, ২.
১৪. “তোমাদের পাপ মুছিয়া ফেলা হয়,” এই উক্তি কোন চিত্র তুলে ধরে?
১৪ প্রেরিত ৩:১৯ পদে যিহোবার ক্ষমা সম্বন্ধে আরও বর্ণনা করা হয়েছে: “অতএব তোমরা মন ফিরাও, ও ফির, যেন তোমাদের পাপ মুছিয়া ফেলা হয়।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) শেষ অংশটুকু যে-গ্রিক ক্রিয়া পদ থেকে অনুবাদ করা হয়েছে, সেটার মানে “নিশ্চিহ্ন করা, . . . বাতিল করা বা ধ্বংস করে দেওয়া” হতে পারে। কিছু পণ্ডিত ব্যক্তির মতানুযায়ী, যে-রূপক অর্থ প্রকাশিত হয়েছে তা হল, হাতের লেখা ঘষে তুলে ফেলা। এটা কীভাবে সম্ভব ছিল? প্রাচীনকালে সাধারণত যে-কালি ব্যবহার করা হতো, তা কার্বন, আঠা ও জলের একটা মিশ্রণ থেকে তৈরি হতো। এইরকম কালি দিয়ে লেখার পর পরই একজন ব্যক্তি একটা ভিজা স্পঞ্জ দিয়ে লেখাগুলো ঘষে তুলে ফেলতে পারত। এখানেই যিহোবার করুণার এক চমৎকার চিত্র রয়েছে। তিনি যখন আমাদের পাপ ক্ষমা করেন, তখন তিনি যেন এক টুকরো স্পঞ্জ নেন ও সেগুলোকে ঘষে তুলে ফেলেন।
যিহোবা চান যেন আমরা জানি যে তিনি “ক্ষমা করার জন্য তৈরি”
১৫. যিহোবার সম্বন্ধে আমরা কী জানি বলে তিনি চান?
১৫ আমরা যখন এই বিভিন্ন দৃষ্টান্ত নিয়ে চিন্তা করি, তখন কি এটা স্পষ্ট হয় না যে, যিহোবা চান যেন আমরা জানি যে তিনি যতক্ষণ আমাদেরকে অকপটভাবে অনুতপ্ত হতে দেখেন, ততক্ষণ সত্যিই ক্ষমা করার জন্য তৈরি? আমাদের এই ভেবে ভয় পাওয়ার দরকার নেই যে, তিনি এই পাপগুলোর জন্য ভবিষ্যতে আমাদের দোষী করবেন। অন্যভাবেও এটা দেখানো হয়েছে যে, বাইবেল যিহোবার মহা করুণা সম্বন্ধে প্রকাশ করে: তিনি যখন ক্ষমা করেন, তখন তিনি ভুলে যান।
“আমি . . . তাহাদের পাপ আর স্মরণে আনিব না”
১৬, ১৭. বাইবেল যখন বলে যে, যিহোবা আমাদের পাপগুলো ভুলে যান, তখন এর মানে কী এবং আপনি কেন এইরকম উত্তর দেন?
১৬ যারা নতুন চুক্তির অধীন তাদের বিষয়ে যিহোবা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন: “আমি তাহাদের অপরাধ ক্ষমা করিব, এবং তাহাদের পাপ আর স্মরণে আনিব না।” (যিরমিয় ৩১:৩৪) এটার মানে কি এই যে, যিহোবা যখন ক্ষমা করেন তখন তিনি সেই পাপগুলোকে আর মনে করতে পারেন না? অবশ্যই না। বাইবেল আমাদের দায়ূদ সহ এমন অনেক ব্যক্তির পাপ সম্বন্ধে বলে, যাদের যিহোবা ক্ষমা করেছিলেন। (২ শমূয়েল ১১:১-১৭; ১২:১৩) তারা যে-ভুলগুলো করেছিল, সেগুলো যিহোবার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। তাদের পাপ এবং সেইসঙ্গে তাদের অনুতপ্ত হওয়া ও ঈশ্বরের ক্ষমা পাওয়ার নথি, আমাদের উপকারের জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে। (রোমীয় ১৫:৪) তা হলে, বাইবেল যখন বলে যে যিহোবা যাদের ক্ষমা করেন তাদের পাপগুলো আর “স্মরণে” আনেন না, তখন আসলে কী বোঝায়?
১৭ যে-ইব্রীয় ক্রিয়া পদকে “স্মরণে আনিব” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে, তা অতীতকে পুনরায় মনে করার চেয়েও আরও বেশি কিছুকে ইঙ্গিত করে। থিওলজিক্যাল ওয়ার্ডবুক অফ দি ওল্ড টেস্টামেন্ট উল্লেখ করে যে, এটা “সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার অতিরিক্ত অর্থকে” অন্তর্ভুক্ত করে। অতএব, এই অর্থে পাপ ‘স্মরণ করা’ পাপীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে। (হোশেয় ৯:৯) কিন্তু ঈশ্বর যখন বলেন যে, “তাহাদের পাপ আর স্মরণে আনিব না,” তখন তিনি আমাদের আশ্বাস দিচ্ছেন যে, একবার তিনি অনুতপ্ত পাপীদের ক্ষমা করার পর, তাদের সেই পাপগুলোর জন্য ভবিষ্যতে তিনি তাদের বিরুদ্ধে আর কোনো পদক্ষেপ নেবেন না। (যিহিষ্কেল ১৮:২১, ২২) অতএব, যিহোবা এই অর্থে ভুলে যান যে, তিনি বার বার আমাদের অভিযুক্ত করার বা শাস্তি দেওয়ার জন্য আমাদের পাপগুলোকে স্মরণে আনেন না। এটা জানা কি সান্ত্বনাদায়ক নয় যে, আমাদের ঈশ্বর ক্ষমা করেন এবং ভুলে যান?
পরিণতিগুলো সম্বন্ধে কী বলা যায়?
১৮. ক্ষমা করার মানে কেন এই নয় যে, একজন অনুতপ্ত পাপী তার ভুলের সমস্ত পরিণতি থেকে রেহাই পায়?
১৮ যিহোবা ক্ষমা করার জন্য তৈরি মানে কি এই যে, একজন অনুতপ্ত পাপী তার ভুলের সমস্ত পরিণতি থেকে রেহাই পায়? কখনোই না। আমরা পাপ করে এই আশা করতে পারি না যে, আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। পৌল লিখেছিলেন: “মনুষ্য যাহা কিছু বুনে তাহাই কাটিবে।” (গালাতীয় ৬:৭) আমরা হয়তো আমাদের কাজের কিছু নির্দিষ্ট পরিণতির মুখোমুখি হতে পারি। এর মানে এই নয় যে, যিহোবা ক্ষমা করার পর আমাদের ওপরে দুদর্শা নিয়ে আসেন। যখন সমস্যা আসে, তখন একজন খ্রিস্টানের এইরকম মনে করা উচিত নয় যে, ‘হয়তো যিহোবা আমাকে আমার অতীত পাপের জন্য শাস্তি দিচ্ছেন।’ (যাকোব ১:১৩) অন্যদিকে, যিহোবা আমাদের ভুল পদক্ষেপগুলোর সমস্ত প্রভাব থেকে আমাদের রক্ষা করেন না। বিবাহবিচ্ছেদ, অবাঞ্ছিত গর্ভ, যৌন সংক্রামক রোগ, নির্ভরযোগ্যতা বা সম্মান হারানো—এই সমস্তকিছু পাপের দুঃখজনক, অপরিহার্য পরিণতি। মনে করে দেখুন যে, বৎশেবা ও ঊরিয়ের প্রতি করা দায়ূদের পাপের জন্য তাকে ক্ষমা করার পর, যিহোবা দায়ূদকে পরবর্তী দুঃখজনক পরিণতিগুলো থেকে রক্ষা করেননি।—২ শমূয়েল ১২:৯-১২.
১৯-২১. (ক) লেবীয় পুস্তক ৬:১-৭ পদে লিপিবদ্ধ আইন কীভাবে অপরাধের শিকার হওয়া ব্যক্তি ও অপরাধীকে উপকৃত করেছিল? (খ) অন্যরা যদি আমাদের পাপের কারণে দুঃখ পেয়ে থাকে, তা হলে আমরা কোন পদক্ষেপ নিলে যিহোবা খুশি হন?
১৯ আমাদের পাপগুলোর হয়তো অতিরিক্ত পরিণতি থাকতে পারে, বিশেষ করে যদি অন্যেরা আমাদের কাজের ফলে দুঃখ পেয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে, লেবীয় পুস্তক ৬ অধ্যায়ের বিবরণ বিবেচনা করুন। মোশির ব্যবস্থা এখানে এমন পরিস্থিতি সম্বন্ধে তুলে ধরে, যেখানে একজন ব্যক্তি লুট করে, ভয় দেখিয়ে বা প্রতারণা করে একজন সহইস্রায়েলীয়র জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেওয়ার দ্বারা এক গুরুতর অন্যায় করেছে। এরপর সেই পাপী তার অপরাধ অস্বীকার করে, এমনকি মিথ্যা দিব্য করার মতো দুঃসাহস দেখায়। এটা এমন এক ঘটনা, যেখানে একজন ব্যক্তির সাক্ষ্য অন্য ব্যক্তির সঙ্গে মেলে না। কিন্তু, পরে সেই দোষী ব্যক্তি বিবেকের দংশনে তার পাপ স্বীকার করে। ঈশ্বরের ক্ষমা পাওয়ার জন্য তাঁকে আরও তিনটে বিষয় করতে হতো: সে যা নিয়েছে সেগুলো ফিরিয়ে দিতে হতো, সে যার কাছ থেকে তা নিয়েছে তাকে চুরি করা জিনিসের আসল মূল্যের শতকরা ২০ ভাগ জরিমানা দিতে হতো এবং দোষার্থক বলি হিসেবে একটা পুং মেষ উৎসর্গ করতে হতো। এরপর, আইনটি বলে: “যাজক সদাপ্রভুর সম্মুখে তাহার নিমিত্তে প্রায়শ্চিত্ত করিবে; তাহাতে . . . তাহার ক্ষমা পাইবে।”—লেবীয় পুস্তক ৬:১-৭.
২০ এটা ঈশ্বরের কাছ থেকে এক করুণাপূর্ণ আইন ছিল। এর থেকে যিনি অপরাধের শিকার হতেন তিনি উপকার পেতেন, তার সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া হতো আর নিঃসন্দেহে অপরাধী শেষ পর্যন্ত তার পাপ স্বীকার করার ফলে অনেক স্বস্তি পেতেন। একই সময়ে, এই আইনটা সেই ব্যক্তিকে উপকৃত করত, যার বিবেক শেষ পর্যন্ত তাকে তার অপরাধ স্বীকার করতে ও তার ভুল শুধরাতে পরিচালিত করত। সে যদি তা না করত, তা হলে ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করতেন না।
২১ যদিও আমরা মোশির ব্যবস্থার অধীনে নই, তবুও সেই ব্যবস্থা ক্ষমার ব্যাপারে তাঁর চিন্তাধারা সহ যিহোবার মন সম্বন্ধে আমাদের অন্তর্দৃষ্টি দেয়। (কলসীয় ২:১৩, ১৪) অন্যেরা যদি আমাদের পাপের কারণে দুঃখ পেয়ে থাকে, তা হলে আমরা যখন ভুল শুধরানোর জন্য আমাদের যথাসাধ্য করি, তখন ঈশ্বর খুশি হন। (মথি ৫:২৩, ২৪) এটা আমাদের পাপ প্রকাশ করা, অপরাধ স্বীকার করা আর এমনকি যার প্রতি তা করা হয়েছে, তার কাছে ক্ষমা চাওয়াকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। এরপর আমরা যিশুর বলিদানের ভিত্তিতে যিহোবার কাছে আবেদন করতে পারি আর ঈশ্বর আমাদের ক্ষমা করবেন বলে যে-আশ্বাস দিয়েছেন, সেটা লাভ করতে পারি।—ইব্রীয় ১০:২১, ২২.
২২. যিহোবার ক্ষমার সঙ্গে কী আসতে পারে?
২২ যেকোনো একজন প্রেমময় পিতার মতো যিহোবা কিছুটা শাসনের সঙ্গে ক্ষমা করতে পারেন। (হিতোপদেশ ৩:১১, ১২) একজন অনুতপ্ত খ্রিস্টানকে হয়তো একজন প্রাচীন, পরিচারক দাস বা একজন পূর্ণ-সময়ের সুসমাচার প্রচারক হিসেবে সেবা করার বিশেষ সুযোগ ছেড়ে দিতে হতে পারে। কিছু সময়ের জন্য সেই বিশেষ সুযোগগুলো, যেগুলো তার কাছে মূল্যবান ছিল, সেগুলো হারানোর ফলে তার হয়তো কষ্ট লাগতে পারে। কিন্তু এইরকম শাসনের মানে এই নয় যে, যিহোবা তাকে ক্ষমা করতে চান না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, যিহোবার শাসন আমাদের প্রতি তাঁর প্রেমের প্রমাণ। এটা মেনে নেওয়া ও কাজে লাগানো আমাদের মঙ্গল নিয়ে আসে।—ইব্রীয় ১২:৫-১১.
২৩. কেন আমাদের কখনোই এই সিদ্ধান্তে আসা উচিত নয় যে আমরা যিহোবার করুণা পাব না আর কেন আমাদের তাঁর ক্ষমা অনুকরণ করা উচিত?
২৩ এটা জানা কতই না সতেজতাদায়ক যে, আমাদের ঈশ্বর “ক্ষমা করার জন্য তৈরি”! যে-ভুলগুলো আমরা করেছি তা সত্ত্বেও, আমাদের কখনোই এই সিদ্ধান্তে আসা উচিত নয় যে আমরা যিহোবার করুণা পাব না। আমরা যদি প্রকৃতই অনুতপ্ত হই, ভুল শুধরানোর পদক্ষেপ নিই এবং যিশুর পাতিত রক্তের ভিত্তিতে ক্ষমার জন্য আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করি, তা হলে আমরা পূর্ণ আস্থা রাখতে পারি যে যিহোবা আমাদের ক্ষমা করবেন। (১ যোহন ১:৯) একে অপরের সঙ্গে আচরণের সময় আসুন আমরা তাঁর ক্ষমা অনুকরণ করি। যিহোবা যিনি পাপ করেন না, তিনি যদি এতটা প্রেমের সঙ্গে আমাদের ক্ষমা করেন, তা হলে আমাদের পাপী মানুষদের কি একে অপরকে ক্ষমা করার জন্য আমাদের যথাসাধ্য করা উচিত নয়?
a যে-ইব্রীয় শব্দটা “আমাদের গঠন” হিসেবে অনুবাদিত হয়েছে, সেটা একজন কুম্ভকারের তৈরি মাটির পাত্রগুলোর ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়।—যিশাইয় ২৯:১৬.
b একজন পণ্ডিত ব্যক্তি বলেন যে, সেই সিন্দুরবর্ণ “ছিল স্থায়ীভাবে রঞ্জিত বা স্থায়ী রং। শিশির, বৃষ্টি, ধৌতকরণ, দীর্ঘ ব্যবহার কোনো কিছুই এটা উঠাতে পারে না।”