-
সুবর্ণ নিয়ম এক সর্বজনীন শিক্ষা২০০১ প্রহরীদুর্গ | ডিসেম্বর ১
-
-
সুবর্ণ নিয়ম এক সর্বজনীন শিক্ষা
“অতএব সর্ব্ববিষয়ে তোমরা যাহা যাহা ইচ্ছা কর যে, লোকে তোমাদের প্রতি করে, তোমরাও তাহাদের প্রতি সেইরূপ করিও।”—মথি ৭:১২.
এই কথাগুলো, যীশু খ্রীষ্ট প্রায় দুহাজার বছর আগে তাঁর সুপরিচিত পার্বত্য উপদেশে বলেছিলেন। শত শত বছর ধরে এই সহজসরল কথাগুলোর বিষয়ে অনেক কিছু বলা হয়েছে এবং লেখা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে এই কথাগুলোকে “শাস্ত্রের সারমর্ম,” “প্রতিবেশীদের প্রতি খ্রীষ্টীয় দায়িত্বের সারসংক্ষেপ” এবং “নৈতিকতার একটা মূল নীতি” বলে প্রশংসা করা হয়েছে। এই কথাগুলো এতই সুপরিচিত হয়েছে যে, প্রায়ই এটাকে সুবর্ণ নিয়ম হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু, সুবর্ণ নিয়মের ধারণা শুধু নামধারী খ্রীষ্টীয়জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। যিহুদি ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম এবং গ্রিক দর্শনবিদ্যা, নৈতিকতার এই মূল নীতিটাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছে। প্রাচ্যে সর্বজ্ঞানী এবং শিক্ষক হিসেবে শ্রদ্ধেয় কনফুসিয়াসের কথাগুলো বিশেষ করে সুদূর প্রাচ্যের লোকেদের কাছে খুবই পরিচিত। কনফুসিয়াসের চারটে বইয়ের মধ্যে তৃতীয় বইয়ে অর্থাৎ দি আ্যনালেক্টস-এ আমরা এই কথাগুলো তিনবার পাই। দুবার ছাত্রদের প্রশ্নের উত্তরে কনফুসিয়াস বলেছিলেন: “তোমার প্রতি যা করা হোক বলে তুমি চাও না, অন্যদের প্রতি তুমি তা করো না।” আরেকবারতার শিষ্য জিগং যখন অহংকার করে বলেছিল, “অন্যেরা আমার প্রতি যা করুক বলে আমি চাই না, আমিও তাদের প্রতি তা করতে চাই না,” তখন শিক্ষক মৃদুভাবে এই উত্তর দিয়েছিলেন, “হ্যাঁ, কিন্তু তারপরও তুমি তা করতে পারবে না।”
এই কথাগুলো পড়ে একজন বুঝতে পারেন যে, কনফুসিয়াসের কথাগুলো যীশু পরে যা বলেছিলেন তার বিপরীত বা নেতিবাচক। এর মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্যটা হল, যীশু যে সুবর্ণ নিয়মের কথা বলেছিলেন তার জন্য অন্যদের প্রতি ভাল কিছু করার ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ দরকার। যেমন, লোকেদেরকে যীশুর এই ইতিবাচক কথাগুলোর সঙ্গে মিল রেখে কাজ করতে, অন্যদের যত্ন নিতে, অন্যদেরকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসতে এবং রোজ এই নীতির সঙ্গে মিল রেখে জীবনযাপন করতে হতো। তাহলে আপনি কি মনে করেন যে, তা আজকের এই জগৎকে এক ভাল জায়গায় পরিণত করত? এতে কোন সন্দেহ নেই।
এই নিয়মকে ইতিবাচক, নেতিবাচক বা অন্য যে কোনভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, গুরত্বপূর্ণ বিষয়টা হল যে বিভিন্ন সময়ের ও জায়গার এবং বিভিন্ন পটভূমির লোকেরা সুবর্ণ নিয়মের ধারণার ওপর যথেষ্ট বিশ্বাস স্থাপন করেছে। এটা পরিষ্কার দেখায় যে পার্বত্য উপদেশে যীশু যা বলেছিলেন সেটা হল এক সর্বজনীন শিক্ষা, যা সমস্ত যুগে সব জায়গার লোকেদের ওপর ছাপ ফেলে।
নিজেকে জিজ্ঞেস করুন: ‘আমি কি চাই যে আমার প্রতি সম্মানজনক, পক্ষপাতহীন এবং সৎ আচরণ করা হোক? আমি কি এমন এক জগতে বাস করতে চাই যেখানে জাতিগত বৈষম্য, অপরাধ এবং যুদ্ধ থাকবে না? আমি কি এমন এক পরিবারে থাকতে চাই, যেখানে প্রত্যেকে অন্যের অনুভূতির প্রতি চিন্তা দেখায় ও মঙ্গলের জন্য চিন্তা করে?’ সত্যি বলতে কী, এইরকম পরিস্থিতিতে বাস করতে চায় না, এমন কেউ কি আছে? কিন্তু কঠিন বাস্তব হল, খুব কম লোকই এইরকম পরিস্থিতিতে বাস করছে। আর বেশির ভাগ লোকই, এই বিষয়গুলোর জন্য এমনকি আশাও করে না।
সুর্বণ নিয়ম নিস্তেজ হয়ে পড়েছে
ইতিহাস দেখায়, মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধগুলো করা হয়েছে, সেখানে লোকেদের অধিকারকে পুরোপুরি অবহেলা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আফ্রিকায় ক্রীতদাস বাণিজ্য, নাৎসিদের মৃত্যু শিবিরগুলো, জোরপূর্বক শিশু দাস্যকর্ম এবং অসংখ্য জায়গায় নিষ্ঠুর গণহত্যা। এই ভয়ংকর ঘটনাগুলোর তালিকা বলে শেষ করা যাবে না।
আজকের এই উচ্চ-প্রযুক্তিগত জগৎ হল আত্মকেন্দ্রিক। যেখানে লোকেদের নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বা তথাকথিত অধিকার বিপদের মধ্যে রয়েছে, সেখানে খুব কম লোকই অন্যদের বিষয়ে চিন্তা করে। (২ তীমথিয় ৩:১-৫) কেন অনেকে স্বার্থপর, নিষ্ঠুর, নির্দয় এবং আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে? এর কারণ কি এই নয় যে, এখনও সুপরিচিত সুবর্ণ নিয়মকে অবাস্তব এবং এক পুরনো নৈতিক বিষয় বলে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে? দুঃখের বিষয় যে, যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে বলে দাবি করে, এমনকি তাদের মধ্যেও এই মনোভাব দেখা যায়। আর লোকেরা যদি তাদের চারপাশের পরিস্থিতি দেখে বিচার করে, তাহলে তারা শুধু আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়বে।
তাই, যে জরুরি প্রশ্নগুলো বিবেচনা করা দরকার সেগুলো হল: সুবর্ণ নিয়মের সঙ্গে মিল রেখে জীবনযাপন করার সঙ্গে কী জড়িত? কেউ কি আজও এর সঙ্গে মিল রেখে জীবনযাপন করে? আর এমন সময় কি কখনও আসবে যখন সমস্ত মানবজাতি সুবর্ণ নিয়মের সঙ্গে মিল রেখে জীবনযাপন করবে? এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তরের জন্য দয়া করে পরের প্রবন্ধটা পড়ুন।
[৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
কনফুসিয়াস এবং অন্যেরা বিভিন্নভাবে সুবর্ণ নিয়ম সম্বন্ধে শিক্ষা দিয়েছিলেন
-
-
সুবর্ণ নিয়ম কাজে লাগানো যায়২০০১ প্রহরীদুর্গ | ডিসেম্বর ১
-
-
সুবর্ণ নিয়ম কাজে লাগানো যায়
যদিও বেশির ভাগ লোক সুবর্ণ নিয়মকে যীশুর দেওয়া একটা নৈতিক শিক্ষা বলে মনে করে কিন্তু তিনি নিজে বলেছিলেন: “আমার উপদেশ আমার নহে, কিন্তু যিনি আমাকে পাঠাইয়াছেন, তাঁহার।”—যোহন ৭:১৬.
হ্যাঁ,যীশু যা শিখিয়েছিলেন ও যেটা সুবর্ণ নিয়ম হিসেবে পরিচিত হয়েছে, সেটার উৎস মূলত সৃষ্টিকর্তা যিহোবা ঈশ্বর, যিনি যীশুকে পাঠিয়েছিলেন।
ঈশ্বরের আদি উদ্দেশ্য ছিল, সমস্ত মানবজাতি তাদের প্রতি যেমন ব্যবহার করা হোক বলে চায়, একে অন্যের সঙ্গে তারাও সেরকম ব্যবহার করবে। ঈশ্বর মানুষকে যেভাবে সৃষ্টি করেছেন, তার মাধ্যমে অন্যদের মঙ্গলের জন্য চিন্তা দেখিয়ে তিনি সবচেয়ে উত্তম উদাহরণ স্থাপন করেছেন: “ঈশ্বর আপনার প্রতিমূর্ত্তিতে মনুষ্যকে সৃষ্টি করিলেন; ঈশ্বরের প্রতিমূর্ত্তিতেই তাহাকে সৃষ্টি করিলেন, পুরুষ ও স্ত্রী করিয়া তাহাদিগকে সৃষ্টি করিলেন।” (আদিপুস্তক ১:২৭) এর অর্থ হল, ঈশ্বর প্রেমের সঙ্গে মানুষদেরকে তাঁর উত্তম গুণগুলোর কয়েকটা দিয়ে এমনভাবে তৈরি করেছেন, যাতে তারা—সম্ভবত চিরকাল—সুখে-শান্তিতে এবং মিলেমিশে জীবন উপভোগ করতে পারে। ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া তাদের বিবেক যখন সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত হয়, তখন তা তাদেরকে অন্যদের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পরিচালিত করে, যেমনটা তারা অন্যদের কাছ থেকে চেয়ে থাকে।
সব জায়গায় স্বার্থপরতা
মানবজাতির শুরুটা যদিও খুব সুন্দর ছিল কিন্তু কী ঘটেছিল? সহজ করে বলতে গেলে, স্বার্থপর মনোভাব চলে এসেছিল। প্রথম মানব দম্পতি কী করেছিল, সেই সম্বন্ধে আদিপুস্তক ৩ অধ্যায়ে দেওয়া বাইবেলের সেই ঘটনার কথা বেশির ভাগ লোকই জানে। শয়তান, যে ঈশ্বরের সমস্ত ধার্মিক মানের বিরোধিতা করে, তার উসকানিতে আদম ও হবা স্বাধীন হতে ও নিজেদের ভালমন্দ নিজেরাই ঠিক করতে চেয়ে স্বার্থপরভাবে ঈশ্বরের শাসনব্যবস্থাকে অস্বীকার করেছিল। তাদের স্বার্থপর এবং বিদ্রোহাত্মক কাজের ফলে শুধু তাদেরই বিরাট ক্ষতি হয়নি কিন্তু সেইসঙ্গে তা তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্যও দুঃখজনক পরিস্থিতি নিয়ে এসেছিল। এটা সুবর্ণ নিয়ম হিসেবে পরিচিত শিক্ষাকে তুচ্ছ করার ধ্বংসাত্মক ফলের এক স্পষ্ট নিদর্শন। এর ফলে, “এক মনুষ্য দ্বারা পাপ, ও পাপ দ্বারা মৃত্যু জগতে প্রবেশ করিল; আর এই প্রকারে মৃত্যু সমুদয় মনুষ্যের কাছে উপস্থিত হইল, কেননা সকলেই পাপ করিল।”—রোমীয় ৫:১২.
যদিও মানবজাতি যিহোবা ঈশ্বরের প্রেমময় পথগুলোকে মেনে চলেনি কিন্তু যিহোবা তাদেরকে ছেড়ে দেননি। উদাহরণ হিসেবে, ইস্রায়েল জাতিকে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য যিহোবা তাঁর ব্যবস্থা দিয়েছিলেন। এটা তাদেরকে শিখিয়েছিল যে অন্যদের কাছ থেকে তারা যেরকম আচরণ আশা করে, তারাও যেন তাদের সঙ্গে সেরকম আচরণ করে। এছাড়া, দাসদাসী, অনাথ ছেলেমেয়ে এবং বিধবাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে সেই সম্বন্ধেও ব্যবস্থা নির্দেশনা দিয়েছিল। আক্রমণ, অপহরণ এবং চুরি করা হলে কী করতে হবে সেই সম্বন্ধে এটা জানিয়েছিল। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত আইনগুলো দিয়ে অন্যদের স্বাস্থ্যের উপকারের জন্য চিন্তা দেখানো হয়েছিল। এমনকি যৌনতার বিষয়েও আইন দেওয়া হয়েছিল। যিহোবা, লোকেদেরকে এই কথা বলে তাঁর ব্যবস্থার সারাংশ করেছিলেন: “আপন প্রতিবাসীকে আপনার মত প্রেম করিবে,” যে কথা পরে যীশুও উদ্ধৃতি করেছিলেন। (লেবীয় পুস্তক ১৯:১৮; মথি ২২:৩৯, ৪০) ব্যবস্থা এও দেখিয়েছিল যে, ইস্রায়েলীয়দের মধ্যে যে প্রবাসীরা ছিল তাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে। ব্যবস্থায় বলা হয়েছিল: “তুমি বিদেশীর প্রতি উপদ্রব করিও না; তোমরা ত বিদেশীর হৃদয় জান, কেননা তোমরা মিসর দেশে বিদেশী ছিলে।” অন্যভাবে বললে, যারা খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে ছিল তাদের প্রতি ইস্রায়েলীয়দেরকে সহানুভূতি দেখাতে হতো।—যাত্রাপুস্তক ২৩:৯; লেবীয় পুস্তক ১৯:৩৪; দ্বিতীয় বিবরণ ১০:১৯.
যতদিন পর্যন্ত ইস্রায়েল বিশ্বস্ততার সঙ্গে ব্যবস্থা মেনে চলেছিল, যিহোবা ততদিন সেই জাতিকে আশীর্বাদ করেছিলেন। দায়ূদ এবং শলোমনের রাজত্বের সময় সেই জাতি সমৃদ্ধ হয়েছিল এবং লোকেরা সুখী ও পরিতৃপ্ত ছিল। ঐতিহাসিক এক বিবরণ আমাদেরকে জানায়: “যিহূদা ও ইস্রায়েল সমুদ্রতীরস্থ বালুকার ন্যায় বহুসংখ্যক ছিল, তাহারা ভোজন পান ও আমোদ করিত। . . . যিহূদা ও ইস্রায়েল প্রত্যেক জন আপন আপন দ্রাক্ষালতার ও আপন আপন ডুমুর বৃক্ষের তলে নির্ভয়ে বাস করিত।”—১ রাজাবলি ৪:২০, ২৫.
দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, সেই জাতির শান্তি ও নিরাপত্তা বেশি দিন স্থায়ী ছিল না। ঈশ্বরের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও, ইস্রায়েলীয়রা তা মেনে চলেনি; স্বার্থপরতার কারণে তারা অন্যদের প্রতি চিন্তা দেখায়নি। এর জন্য ও সেইসঙ্গে ধর্মভ্রষ্টতার কারণে তাদের প্রত্যেকের এবং পুরো জাতির ওপর কষ্ট নেমে এসেছিল। শেষে, সা.কা.পূ. ৬০৭ সালে যিহোবা বাবিলনীয়দেরকে যিহূদা রাজ্য, যিরূশালেম শহর ও এমনকি সেখানকার চমৎকার মন্দির ধ্বংস করার অনুমতি দিয়েছিলেন। কী কারণে? “তোমরা আমার বাক্য শুন নাই, এই জন্য দেখ, আমি আদেশ পাঠাইয়া উত্তরদিক্স্থ সমস্ত গোষ্ঠীকে লইয়া আসিব, সদাপ্রভু কহেন, আমি আমার দাস বাবিল-রাজ নবূখদ্নিৎসরকে আনিব, ও তাহাদিগকে এই দেশের বিরুদ্ধে, এতন্নিবাসীদিগের বিরুদ্ধে ও চতুর্দ্দিকস্থিত এই সমস্ত জাতির বিরুদ্ধে আনিব; এবং ইহাদিগকে নিঃশেষে বিনষ্ট করিব, এবং বিস্ময়ের ও শিশ শব্দের বিষয় ও চিরস্থায়ী উৎসন্ন স্থান করিব।” (যিরমিয় ২৫:৮, ৯) যিহোবার বিশুদ্ধ উপাসনা পরিত্যাগ করায় কত বড় মূল্যই না দিতে হয়েছিল!
অনুকরণ করার মতো এক উদাহরণ
অন্যদিকে, যীশু খ্রীষ্ট সুবর্ণ নিয়ম সম্বন্ধে শুধু শিক্ষাই দেননি, সেইসঙ্গে তা পালন করে সুন্দর উদাহরণও স্থাপন করেছেন। তিনি অন্তর থেকে অন্যদের মঙ্গলের জন্য চিন্তা করতেন। (মথি ৯:৩৬; ১৪:১৪; লূক ৫:১২, ১৩) একবার যীশু নায়িন্ নগরের কাছে একজন মুষড়ে পড়া বিধবাকে তার একমাত্র ছেলের শবযাত্রার মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন। বাইবেলের বিবরণ বলে: “তাহাকে দেখিয়া প্রভু তাহার প্রতি করুণাবিষ্ট হইলেন।” (লূক ৭:১১-১৫) ভাইনস এক্সপোজিটরি ডিকশনারি অফ ওল্ড আ্যন্ড নিউ টেস্টামেন্ট ওয়ার্ডস অনুসারে “করুণাবিষ্ট” বলতে “একজন ব্যক্তির অন্তরের অনুভূতি দ্বারা পরিচালিত হওয়া”-কে বোঝায়। যীশু ওই বিধবার মনের কষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন আর তা তাঁকে তার কষ্ট দূর করার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পরিচালিত করেছিল। যীশু যখন সেই ছেলেকে পুনরুত্থিত করেছিলেন এবং “তাহার মাতার হস্তে সমর্পণ করিলেন” তখন তা সেই বিধবার জন্য কত আনন্দই না নিয়ে এসেছিল!
শেষে, ঈশ্বরের উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিল রেখে যীশু স্বেচ্ছায় কষ্টভোগ করেছিলেন এবং মুক্তির মূল্য হিসেবে তাঁর জীবন দিয়েছিলেন, যাতে মানবজাতি পাপ এবং মৃত্যুর দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে পারে। সুবর্ণ নিয়ম অনুসারে জীবনযাপন করার ব্যাপারে এটা ছিল সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ।—মথি ২০:২৮; যোহন ১৫:১৩; ইব্রীয় ৪:১৫.
যে লোকেরা সুবর্ণ নিয়মকে কাজে লাগান
আমাদের দিনে এমন লোকেরা কি আছেন, যারা সত্যিই সুবর্ণ নিয়ম অনুসারে জীবনযাপন করেন? হ্যাঁ আছেন আর তারা শুধু তাদের সুবিধামতো সময়েই তা কাজে লাগান না। উদাহরণ হিসেবে, নাৎসি জার্মানিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যিহোবার সাক্ষিরা ঈশ্বরের প্রতি তাদের বিশ্বাস ও প্রতিবেশীদের প্রতি প্রেম বজায় রেখেছিলেন এবং সুবর্ণ নিয়মের ব্যাপারে আপোশ করেননি। যখন দেশে সমস্ত যিহুদিদের প্রতি ঘৃণা এবং বৈষম্যের মনোভাব দেখানোর এক জোরদার অভিযান চালানো হয়েছিল, তখনও সাক্ষিরা সুবর্ণ নিয়ম মেনে চলেছিলেন। এমনকি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পর্যাপ্ত খাবার না থাকা সত্ত্বেও, ক্ষুধায় মৃতপ্রায় যিহুদি ও ন-যিহুদিদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে নিয়ে তারা তাদের সহ মানবদের যত্ন নিয়েছিলেন। এছাড়া, যদিও সরকার অন্যদেরকে হত্যা করার জন্য তাদের হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বলেছিল কিন্তু তারা তা করতে রাজি হননি, ঠিক যেমন তারা চেয়েছিলেন যে অন্যেরা তাদেরকে হত্যা না করুক। যাদেরকে নিজের মতো করে ভালবাসার কথা তাদেরকে তারা কীভাবে হত্যা করতে পারেন? তারা তা করতে রাজি হননি বলে তাদের মধ্যে অনেককে শুধু কনসেনট্রেশন ক্যাম্পেই পাঠানো হয়নি কিন্তু মেরে ফেলাও হয়েছিল।—মথি ৫:৪৩-৪৮.
এই প্রবন্ধটা পড়ার সময়, সুবর্ণ নিয়ম যে কার্যরত তার আরেকটা উদাহরণ থেকে আপনি উপকার পাচ্ছেন। যিহোবার সাক্ষিরা উপলব্ধি করেন যে আজকে অনেক লোক নিরাশায় ভুগছেন এবং অসহায় অবস্থার মধ্যে আছেন। এই কারণে সাক্ষিরা অন্যদেরকে আশা এবং বাইবেলে পাওয়া বাস্তব নির্দেশনা সম্বন্ধে জানতে সাহায্য করার জন্য স্বেচ্ছায় ইতিবাচক পদক্ষেপ নেন। এটা হল বিশ্বব্যাপী শিক্ষাদান কাজের অংশ, যা এখন আরও বড় আকারে করা হচ্ছে। এর ফল? যিশাইয় ২:২-৪ পদে যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, “অনেক দেশের লোক” সত্যি বলতে কী সারা পৃথিবীতে ষাট লক্ষেরও বেশি লোক ‘যিহোবার পথের বিষয়ে শিক্ষা পাইতেছে আর তাঁহার মার্গে গমন করিতেছে।’ রূপকভাবে বলতে গেলে তারা ‘আপন আপন খড়্গ ভাঙ্গিয়া লাঙ্গলের ফাল ও আপন আপন বড়শা ভাঙ্গিয়া কাস্তা গড়িতে’ শিখেছেন। এই দুঃসময়েও তারা শান্তি এবং নিরাপত্তা খুঁজে পেয়েছেন।
আপনার সম্বন্ধে কী বলা যায়?
এদন বাগানে শয়তান দিয়াবল যে বিদ্রোহ শুরু করেছিল তখন থেকে সুবর্ণ নিয়মকে অবহেলা করার কারণে মানবজাতির ওপর যে যন্ত্রণা ও দুঃখকষ্ট এসেছে, সেই সম্বন্ধে একটু চিন্তা করুন। যিহোবার উদ্দেশ্য হল, খুব শীঘ্রিই তিনি পরিস্থিতিকে বদলে দেবেন। কীভাবে? “ঈশ্বরের পুত্ত্র এই জন্যই প্রকাশিত হইলেন, যেন দিয়াবলের কার্য্য সকল লোপ করেন।” (১ যোহন ৩:৮) ঈশ্বরের রাজ্যের অধীনে যীশু খ্রীষ্ট বিজ্ঞ এবং দক্ষ হাতে তা করবেন, যিনি সুবর্ণ নিয়ম সম্বন্ধে শিখিয়েছিলেন এবং সেই অনুসারে জীবনযাপন করেছিলেন।—গীতসংহিতা ৩৭:৯-১১; দানিয়েল ২:৪৪.
প্রাচীন ইস্রায়েলের রাজা দায়ূদ লক্ষ্য করেছিলেন: “আমি যুবক ছিলাম, এখন বৃদ্ধ হইয়াছি, কিন্তু ধার্ম্মিককে পরিত্যক্ত দেখি নাই, তাহার বংশকে খাদ্য ভিক্ষা করিতে দেখি নাই। সে সমস্ত দিন দয়া করে, ও ধার দেয়, তাহার বংশ আশীর্ব্বাদ পায়।” (গীতসংহিতা ৩৭:২৫, ২৬) আপনি কি একমত হবেন না যে ‘দয়া করার ও ধার দেওয়ার’ বদলে আজকে বেশির ভাগ লোকই শুধু পেতে চায় এবং দখল করতে চায়? এটা স্পষ্ট যে, সুবর্ণ নিয়ম মেনে চললে তা প্রকৃত শান্তি এবং নিরাপত্তার দিকে পরিচালিত করতে পারে কারণ তা একজনকে এখন এবং ভবিষ্যতে ঈশ্বরের রাজ্যে আশীর্বাদ পেতে সাহায্য করবে। ঈশ্বরের রাজ্য পৃথিবী থেকে সমস্ত স্বার্থপরতা এবং দুষ্টতা দূর করবে এবং বর্তমানে মানুষের তৈরি কলুষিত শাসন ব্যবস্থাকে সরিয়ে দিয়ে ঈশ্বরের নতুন বিধিব্যবস্থা স্থাপন করবে। এরপর সমস্ত লোক সুবর্ণ নিয়ম মেনে চলে আনন্দ পাবে।—গীতসংহিতা ২৯:১১; ২ পিতর ৩:১৩.
[৪, ৫ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
যীশু সুবর্ণ নিয়ম সম্বন্ধে শুধু শিক্ষাই দেননি, সেইসঙ্গে তা পালন করে সুন্দর উদাহরণও স্থাপন করেছেন
[৭ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
সুবর্ণ নিয়ম মেনে চললে তা প্রকৃত শান্তি এবং নিরাপত্তার দিকে পরিচালিত করতে পারে
-