“নম্রতায় কটিবন্ধন কর”
“‘ঈশ্বর অহঙ্কারীদের প্রতিরোধ করেন, কিন্তু নম্রদিগকে অনুগ্রহ প্রদান করেন।’”—১ পিতর ৫:৫.
১, ২. কোন্ দুটো প্রবণতা মানুষের ব্যবহারের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে?
ঈশ্বরের বাক্যে মানুষের মনের দুটো বিপরীতমুখী প্রবণতা সম্বন্ধে বলা আছে। দুটোই মানুষের ব্যবহারের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। এর একটা হল ‘নম্রতা।’ (১ পিতর ৫:৫) একটা অভিধান “নম্রতার” সংজ্ঞা এভাবে দেয়, “ব্যবহারে বা স্বভাবে বিনয়ী হওয়া: আত্ম-অহংকার থেকে মুক্ত হওয়া।” নম্রতা ও বিনয়ীভাবের অর্থ একই আর ঈশ্বরের চোখে এটা খুবই সুন্দর একটা গুণ।
২ বিপরীত প্রবণতাটা হল অহংকার। এর সংজ্ঞা এভাবে দেওয়া হয়েছে, “নিজের সম্বন্ধে অতিরিক্ত উঁচু ধারণা রাখা,” “তাচ্ছিল্যপূর্ণ” হওয়া। এর মানে নিজেকে নিয়ে মত্ত থাকা আর অন্যের কোন ক্ষতি হল কী হল না সেদিকে কোনরকম আমল না দিয়েই ধনসম্পদের পিছনে ছোটা, নিজেকে বড় মনে করা ও অন্যান্য সুযোগ খোঁজা। বাইবেল এর একটা পরিণাম সম্বন্ধে বলে: “মনুষ্য . . . এক জন অন্যের উপরে তাহার অমঙ্গলার্থে কর্ত্তৃত্ব করে।” বাইবেল “একে অন্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা” করাকে “বাতাসের সঙ্গে লড়াই করা” বলে কারণ মরণের সময় “সে যাহা সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতে পারে, এমন কিছুই নাই।” ঈশ্বর এইরকম অহংকার একদমই পছন্দ করেন না।—উপদেশক ৪:৪, NW; ৫:১৫; ৮:৯.
জগতে ছড়িয়ে থাকা আত্মা
৩. জগতে ছড়িয়ে থাকা আত্মা কী?
৩ এই দুটোর মধ্যে কোন্ প্রবণতা আজকের জগতে ছড়িয়ে আছে? সারা জগতে ছড়িয়ে থাকা আত্মা কী? বিশ্ব সামরিক শক্তি এবং সামাজিক ব্যয় ১৯৯৬ (ইংরেজি) নামের বইটা বলে: “বিংশ শতাব্দীর মতো অন্য আর কোন শতাব্দীতে এত পাশবিক . . . হিংস্রতা দেখা যায়নি।” রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার লড়াই আর সেইসঙ্গে জাতিগত, ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক ও উপজাতিগত লড়াইয়ে, এই শতাব্দীতে দশ কোটিরও বেশি লোক প্রাণ হারিয়েছে। স্বার্থপর লোকেদের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। শিকাগো ট্রাইবুন বলেছিল: “সামাজিক ব্যাধির মধ্যে বাছবিচারহীন হিংস্রতা, শিশুদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, বিবাহবিচ্ছেদ, মাতলামি, এইডস, কিশোরকিশোরীদের আত্মহত্যা, মাদক দ্রব্য, গুণ্ডাদল, ধর্ষণ, অবৈধ সন্তান, গর্ভপাত, অশ্লীলতা, . . . মিথ্যা বলা, প্রতারণা করা, রাজনীতিতে দুর্নীতি এই সমস্তকিছু রয়েছে। . . . আজ ভাল মন্দের মধ্যে কোন তফাৎ নেই।” তাই ইউএন ক্রনিক্যাল (ইংরেজি) সতর্ক করেছিল: “সমাজ ভেঙে যাচ্ছে।”
৪, ৫. আমাদের দিনের জন্য করা বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীতে কীভাবে জগতের আত্মাকে সঠিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে?
৪ সারা বিশ্বে এই একই অবস্থা রয়েছে। বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী আমাদের দিন সম্বন্ধে হুবহু এইরকম কিছুই বলেছিল: “শেষ কালে বিষম সময় উপস্থিত হইবে। কেননা মনুষ্যেরা আত্মপ্রিয়, অর্থপ্রিয়, আত্মশ্লাঘী, অভিমানী, ধর্ম্মনিন্দক, পিতামাতার অবাধ্য, অকৃতজ্ঞ, অসাধু, স্নেহরহিত, ক্ষমাহীন, অপবাদক, অজিতেন্দ্রিয়, প্রচণ্ড, সদ্বিদ্বেষী, বিশ্বাসঘাতক, দুঃসাহসী, গর্ব্বান্ধ।”—২ তীমথিয় ৩:১-৪.
৫ এটা জগতে ছড়িয়ে থাকা আত্মার এক সঠিক বর্ণনা। এটা হল স্বার্থপর আমিত্ব মনোভাব। এরজন্যই ব্যক্তিদের মধ্যে ও জাতিগুলোর মধ্যে শত্রুতা রয়েছে। যেমন, প্রতিযোগিতামূলক খেলাধূলার কথাই ধরা যাক। বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই যে কোন ভাবে প্রথম হতে চান, এতে কেউ মানসিক বা শারীরিকভাবে আঘাত পেল কী না তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। নিজেকে নিয়ে মত্ত থাকার এই মনোভাব ছেলেবেলাতেই গড়ে ওঠে আর তা বড় হওয়ার পরও অনেকের মধ্যে রয়ে যায়। এর ফল হয় “শত্রুতা, বিবাদ, ঈর্ষা, রাগ, প্রতিযোগিতা, বিচ্ছিন্নতা।”—গালাতীয় ৫:১৯-২১.
৬. কে স্বার্থপর মনোভাব বৃদ্ধি করে আর যিহোবা এই মনোভাবকে কোন্ চোখে দেখেন?
৬ বাইবেল দেখায় যে এই জগতে নিজেকে নিয়ে মত্ত থাকার আত্মা সেই ব্যক্তির মনোভাবকে প্রকাশ করে “যাহাকে দিয়াবল [অপবাদক] এবং শয়তান [বিপক্ষ] বলা যায়, সে সমস্ত নরলোকের ভ্রান্তি জন্মায়।” এই সংকটপূর্ণ শেষ কালে বসবাসকারী লোকেদের ওপর শয়তানের প্রভাব সম্বন্ধে বাইবেল ভবিষ্যদ্বাণী করে: ‘পৃথিবীর . . . সন্তাপ হইবে; কেননা দিয়াবল তোমাদের নিকটে নামিয়া গিয়াছে; সে অতিশয় রাগাপন্ন, সে জানে, তাহার কাল সংক্ষিপ্ত।’ (প্রকাশিত বাক্য ১২:৯-১২) তাই শয়তান ও তার সঙ্গী মন্দ দূতেরা মানুষের মধ্যে স্বার্থপর মনোভাব গড়ে তোলার জন্য আরও বেশি সচেষ্ট হয়েছে। কিন্তু যিহোবা এইরকম মনোভাবকে কোন্ চোখে দেখেন? তাঁর বাক্য বলে: “যে কেহ হৃদয়ে গর্ব্বিত, সে সদাপ্রভুর ঘৃণাস্পদ।”—হিতোপদেশ ১৬:৫.
যিহোবা নম্র ব্যক্তিদের পাশে থাকেন
৭. যিহোবা নম্রদের কোন্ চোখে দেখেন আর তিনি তাদের কী শেখান?
৭ অন্যদিকে যিহোবা নম্র ব্যক্তিদের আশীর্বাদ করেন। যিহোবার উদ্দেশে গান গাওয়ার সময়, রাজা দায়ূদ বলেছিলেন: “তুমি দুঃখীদিগকে [বিনয়ী লোকেদের] নিস্তার করিবে, কিন্তু গর্ব্বীদের উপরে তোমার দৃষ্টি আছে, তুমি তাহাদিগকে অবনত করিবে।” (২ শমূয়েল ২২:১, ২৮) তাই ঈশ্বরের বাক্য পরামর্শ দেয়: “হে দেশস্থ সমস্ত নম্র লোক, . . . তোমরা যিহোবার অন্বেষণ কর, ধর্ম্মের অনুশীলন কর, নম্রতার অনুশীলন কর; হয় ত সদাপ্রভুর ক্রোধের দিনে তোমরা গুপ্তস্থানে রক্ষা পাইবে।” (সফনিয় ২:৩) যারা নম্রভাবে যিহোবাকে খোঁজেন তারা এই জগৎ থেকে একেবারে ভিন্ন এক আত্মা গড়ে তোলার জন্য তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা পান। “তিনি . . . নম্রদিগকে আপন পথ দেখাইয়া দেন।” (গীতসংহিতা ২৫:৯; যিশাইয় ৫৪:১৩) এই পথই হচ্ছে প্রেমের পথ। এটা ঈশ্বরের মানদণ্ড অনুযায়ী সঠিক কাজ করার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। বাইবেল অনুযায়ী, নীতির ওপর ভিত্তি করা এই প্রেম “আত্মশ্লাঘা করে না, গর্ব্ব করে না, . . . স্বার্থ চেষ্টা করে না।” (১ করিন্থীয় ১৩:১-৮) এই প্রেম নম্রতার মধ্যে দিয়েও প্রকাশ পায়।
৮, ৯. (ক) নীতির উপর ভিত্তি করা প্রেমের উৎস কে? (খ) যীশু যে প্রেম ও নম্রতা দেখিয়েছিলেন তা অনুকরণ করা কতটা জরুরি?
৮ পৌল ও প্রথম শতাব্দীর অন্য খ্রীষ্টানেরা যীশুর শিক্ষা থেকে এইরকম প্রেম দেখাতে শিখেছিলেন। আর যীশু এটা তাঁর পিতা, যিহোবার কাছ থেকে শিখেছিলেন, যাঁর বিষয়ে বাইবেল বলে: “ঈশ্বর প্রেম।” (১ যোহন ৪:৮) যীশু জানতেন যে ঈশ্বর চান যেন তিনি অন্যদের প্রেম দেখান আর তিনি তা দেখিয়েছিলেনও। (যোহন ৬:৩৮) এইজন্য দুঃখী, গরিব ও পাপীদের জন্য তাঁর করুণা ছিল। (মথি ৯:৩৬) তিনি তাদের বলেছিলেন: “হে পরিশ্রান্ত ও ভারাক্রান্ত লোক সকল, আমার নিকটে আইস, আমি তোমাদিগকে বিশ্রাম দিব। আমার যোঁয়ালি আপনাদের উপরে তুলিয়া লও, এবং আমার কাছে শিক্ষা কর, কেননা আমি মৃদুশীল ও নম্রচিত্ত।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।)—মথি ১১:২৮, ২৯.
৯ যীশু তাঁর শিষ্যদেরকে দেখিয়েছিলেন যে তাঁর মতো করে প্রেম ও নম্রতা দেখানো তাদের জন্য কতটা জরুরি, যখন তিনি তাদের বলেছিলেন: “তোমরা যদি আপনাদের মধ্যে পরস্পর প্রেম রাখ, তবে তাহাতেই সকলে জানিবে যে, তোমরা আমার শিষ্য।” (যোহন ১৩:৩৫) স্বার্থপর জগৎ থেকে আলাদা হিসেবে তারা সকলের নজরে পড়বেন। আর এইজন্যই যীশু তাঁর শিষ্যদের বিষয়ে বলতে পেরেছিলেন: “তাহারা জগতের নয়।” (যোহন ১৭:১৪) না, তারা শয়তানের জগতের গর্বিত, স্বার্থপর আত্মা দেখান না। বরং তারা সেই প্রেম ও নম্রতার আত্মা দেখান যা যীশু দেখিয়েছিলেন।
১০. আমাদের দিনে যিহোবা নম্র লোকেদের কী করছেন?
১০ ঈশ্বরের বাক্য আগেই বলেছিল যে এই শেষ কালে সারা পৃথিবীর নম্র লোকেরা একটা বিশ্বব্যাপী সমাজ গড়ে তুলবে, যার ভিত্তি হবে প্রেম ও নম্রতা। তাই দিনের পর দিন আরও উদ্ধত হয়ে ওঠা এই জগতে থেকেও যিহোবার লোকেরা ভিন্ন মনোভাব অর্থাৎ নম্রতা দেখান। তারা বলেন: “চল, সদাপ্রভুর পর্ব্বতে [তাঁহার উচ্চীকৃত সত্য উপাসনাস্থলে] . . . গিয়া উঠি; তিনি আমাদিগকে আপন পথের বিষয়ে শিক্ষা দিবেন, আর আমরা তাঁহার মার্গে গমন করিব।” (যিশাইয় ২:২, ৩) যিহোবার সাক্ষিরাই এই বিশ্বব্যাপী সমাজ গড়ে তোলেন, যা ঈশ্বরের পথে চলছে। তাদের মধ্যে ‘প্রত্যেক জাতির ও বংশের ও প্রজাবৃন্দের ও ভাষার বিস্তর লোকেরা আছেন যাদের গণনা করিতে সমর্থ কেহ ছিল না।’ (প্রকাশিত বাক্য ৭:৯) এই বিরাট জনতা এখন লাখ লাখ লোকেদের নিয়ে গড়ে উঠছে। কীভাবে যিহোবা তাদের নম্র হতে শেখান?
নম্র হতে শেখা
১১, ১২. ঈশ্বরের দাসেরা কীভাবে নম্রতা দেখান?
১১ ঈশ্বরের আত্মা তাঁর লোকেদের ওপর কাজ করছে আর এর ফলে তারা জগতের মন্দ আত্মাকে পরাজিত করে ঈশ্বরের আত্মার ফল দেখাতে শেখেন। এই ফলগুলো হল, “প্রেম, আনন্দ, শান্তি, দীর্ঘসহিষ্ণুতা, মাধুর্য্য, মঙ্গলভাব, বিশ্বস্ততা, মৃদুতা, ইন্দ্রিয়দমন।” (গালাতীয় ৫:২২, ২৩) ঈশ্বরের দাসদের এই গুণগুলো উৎপন্ন করতে সাহায্য করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যেন তারা ‘অনর্থক দর্প না করে, পরস্পরকে জ্বালাতন না করে, পরস্পর হিংসাহিংসি না করে।’ (গালাতীয় ৫:২৬) একইভাবে প্রেরিত পৌল বলেছিলেন: “আমি তোমাদের মধ্যবর্ত্তী প্রত্যেক জনকে বলিতেছি, আপনার বিষয়ে যেমন বোধ করা উপযুক্ত, কেহ তদপেক্ষা বড় বোধ না করুক; কিন্তু . . . সে সুবোধ হইবারই চেষ্টায় আপনার বিষয়ে বোধ করুক।”—রোমীয় ১২:৩.
১২ ঈশ্বরের বাক্য সত্য খ্রীষ্টানদের বলে, “প্রতিযোগিতার কিম্বা অনর্থক দর্পের বশে কিছুই করিও না, বরং নম্রভাবে প্রত্যেক জন আপনা হইতে অন্যকে [ঈশ্বরের দাসদের] শ্রেষ্ঠ জ্ঞান কর; এবং প্রত্যেক জন আপনার বিষয়ে নয়, কিন্তু পরের বিষয়েও লক্ষ্য রাখ।” (ফিলিপীয় ২:৩, ৪) “কেহই স্বার্থ চেষ্টা না করুক, বরং প্রত্যেক জন পরের মঙ্গল চেষ্টা করুক।” (১ করিন্থীয় ১০:২৪) সত্যিই, নিঃস্বার্থ কথা ও কাজের মাধ্যমে ‘প্রেম’ অন্যদের “গাঁথিয়া তুলে।” (১ করিন্থীয় ৮:১) এটা সহযোগিতা করার ইচ্ছাকে বাড়িয়ে তোলে, প্রতিযোগিতা নয়। যিহোবার দাসদের মধ্যে আমিত্ব মনোভাবের কোন জায়গা নেই।
১৩. কেন নম্র হতে শিখতে হবে আর একজন ব্যক্তি কীভাবে তা শেখেন?
১৩ কিন্তু, জন্মগতভাবে অসিদ্ধ হওয়ায় আমরা নম্রতা নিয়ে জন্মাই না। (গীতসংহিতা ৫১:৫) এই গুণ উৎপন্ন করতে হবে। আর তা উৎপন্ন করা হয়তো তাদের জন্য কঠিন হতে পারে যারা ছোটবেলা থেকে যিহোবার পথের বিষয়ে শিখতে পারেননি কিন্তু বড় হয়ে শিখেছেন। এই পুরনো জগতের প্রভাবে ইতিমধ্যেই তাদের ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছে। তাই তাদের “পূর্ব্বকালীন আচরণ সম্বন্ধে সেই পুরাতন মনুষ্যকে ত্যাগ” করতে এবং “নূতন মনুষ্যকে পরিধান” করতে শিখতে হবে “যাহা সত্যের ধার্ম্মিকতায় ও সাধুতায় ঈশ্বরের সাদৃশ্যে সৃষ্ট হইয়াছে।” (ইফিষীয় ৪:২২, ২৪) ঈশ্বরের সাহায্য নিয়ে আন্তরিক লোকেরা তিনি তাদের কাছ থেকে যা চান তা করতে পারেন: “তোমরা . . . করুণার চিত্ত, মধুর ভাব, নম্রতা, মৃদুতা, সহিষ্ণুতা পরিধান কর।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।)—কলসীয় ৩:১২.
১৪. নিজেকে বড় করতে চাওয়ার বিপরীতে যীশু কী বলেছিলেন?
১৪ যীশুর শিষ্যদেরও এই গুণ উৎপন্ন করতে শিখতে হয়েছিল। তারা যখন তাঁর শিষ্য হয়েছিলেন তখন তারা সবাই প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন আর তাই তাদের মধ্যে জগতের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব ছিল। দুজন শিষ্যের মা যখন তার ছেলেদেরকে উঁচু পদ দেওয়ার জন্য যীশুকে অনুরোধ করেছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন: “পরজাতীয়দের অধিপতিরা [লোকেদের] উপরে প্রভুত্ব করে, এবং যাহারা মহান্, তাহারা তাহাদের উপরে কর্ত্তৃত্ব করে। তোমাদের মধ্যে সেরূপ হইবে না; কিন্তু তোমাদের মধ্যে যে কেহ মহান্ হইতে চায়, সে তোমাদের পরিচারক হইবে; এবং তোমাদের মধ্যে যে কেহ প্রধান হইতে চায়, সে তোমাদের দাস হইবে; যেমন মনুষ্যপুত্ত্র [যীশু] পরিচর্য্যা পাইতে আইসেন নাই, কিন্তু পরিচর্য্যা করিতে, এবং অনেকের পরিবর্ত্তে আপন প্রাণ মুক্তির মূল্যরূপে দিতে আসিয়াছেন।” (মথি ২০:২০-২৮) যীশু যখন তাঁর শিষ্যদেরকে নিজেদের বড় করার চেষ্টায় কোন উপাধি ব্যবহার না করার কথা বলেছিলেন, তখন তিনি আরও বলেন: “তোমরা সকলে ভ্রাতা।”—মথি ২৩:৮.
১৫. যারা অধ্যক্ষপদে সেবা করতে চান তাদের মনোভাব কেমন হওয়া উচিত?
১৫ যীশুর একজন সত্যিকারের শিষ্য হলেন একজন পরিচারক, হ্যাঁ, তার খ্রীষ্টান ভাইবোনদের দাস। (গালাতীয় ৫:১৩) এটা বিশেষ করে তাদের বেলায় বেশি খাটে যারা মণ্ডলীকে দেখাশোনা করার জন্য যোগ্য হতে চান। উঁচু পদ বা ক্ষমতার জন্য তাদের কখনই প্রতিযোগিতায় নামা উচিত নয়; তারা ‘নিরূপিত অধিকারের উপরে কর্ত্তৃত্ব করবেন না, কিন্তু পালের আদর্শ হবেন।’ (১ পিতর ৫:৩) আসলেই, স্বার্থপর মনোভাব অধ্যক্ষপদের জন্য একজন ব্যক্তিকে যোগ্য করে না। এইরকম ব্যক্তি মণ্ডলীর ক্ষতি করেন। এটা ঠিক যে “অধ্যক্ষপদের আকাঙ্ক্ষী” হওয়ার মধ্যে দোষের কিছু নেই, তবে এটা অন্য খ্রীষ্টানদের সেবা করার ইচ্ছা থেকে আসা উচিত। এটা মর্যাদা বা ক্ষমতার কোন পদ নয় কারণ যারা দেখাশোনার দায়িত্বে থাকেন তাদেরকে মণ্ডলীর মধ্যে সবচেয়ে নম্র হতে হয়।—১ তীমথিয় ৩:১, ৬.
১৬. কেন ঈশ্বরের বাক্যে দিয়ত্রিফিকে দোষ দেওয়া হয়েছিল?
১৬ প্রেরিত যোহন এমন একজন ব্যক্তির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করান যার ভুল চিন্তাধারা ছিল। তিনি বলেন: “আমি মণ্ডলীকে কিছু লিখিয়াছিলাম, কিন্তু তাহাদের প্রাধান্যপ্রিয় দিয়ত্রিফি আমাদিগকে গ্রাহ্য করে না।” এই ব্যক্তি তাঁর নিজের প্রাধান্য বাড়ানোর জন্য অন্যদের সঙ্গে অসম্মানজনক ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু ঈশ্বরের আত্মা যোহনকে, দিয়ত্রিফির আমিত্ব মনোভাবের জন্য তার দোষকে বাইবেলে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল।—৩ যোহন ৯, ১০.
ভাল মনোভাব
১৭. পিতর, পৌল ও বার্ণবা কীভাবে নম্রতা দেখিয়েছিলেন?
১৭ বাইবেলে ভাল মনোভাব অর্থাৎ নম্রতার অনেক উদাহরণ আছে। পিতর যখন কর্ণীলিয়ের বাড়িতে ঢোকেন তখন তিনি “[পিতরের] চরণে পড়িয়া প্রণাম করিলেন।” কিন্তু প্রণাম গ্রহণ করার বদলে “পিতর তাঁহাকে উঠাইলেন, বলিলেন, উঠুন; আমি আপনিও মনুষ্য।” (প্রেরিত ১০:২৫, ২৬) পৌল ও বার্ণবা যখন লুস্ত্রায় ছিলেন, তখন পৌল জন্ম থেকে খোঁড়া এক লোককে সুস্থ করেছিলেন। এর ফলে সেখানকার লোকেরা এই প্রেরিতদেরকে দেবতা বলেছিল। কিন্তু পৌল ও বার্ণবা “আপন আপন বস্ত্র ছিঁড়িয়া, দৌড়িয়া বাহির হইয়া লোকদের মধ্যে গিয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, মহাশয়েরা, এ সকল কেন করিতেছেন? আমরাও আপনাদের ন্যায় সুখদুঃখীভোগী মনুষ্য।” (প্রেরিত ১৪:৮-১৫) এই নম্র খ্রীষ্টানেরা মানুষের কাছ থেকে গৌরব পেতে চাননি।
১৮. একজন শক্তিমান দূত নম্রভাবে যোহনকে কী বলেছিলেন?
১৮ প্রেরিত যোহনকে যখন “যীশু খ্রীষ্টের প্রকাশিত বাক্য” দেওয়া হয়েছিল, তখন একজন দূত তাকে এটা দিয়েছিলেন। (প্রকাশিত বাক্য ১:১) একজন দূতের যে ক্ষমতা আছে তা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে কেন যোহন ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, কারণ একজন দূত এক রাতের মধ্যে ১,৮৫,০০০ অশূরীয় সৈন্যকে হত্যা করেছিলেন। (২ রাজাবলি ১৯:৩৫) যোহন বলেন: “এই সকল দেখিলে ও শুনিলে পর, যে দূত আমাকে এই সমস্ত দেখাইতেছিলেন, আমি ভজনা করিবার জন্য তাঁহার চরণের সম্মুখে পড়িলাম। আর তিনি আমাকে কহিলেন, দেখিও, এমন কর্ম্ম করিও না; আমি তোমার সহদাস, এবং তোমার ভ্রাতা . . . ঈশ্বরেরই ভজনা কর।” (প্রকাশিত বাক্য ২২:৮, ৯) এই শক্তিমান দূত কতই না নম্র ছিলেন!
১৯, ২০. বিজয়ী রোমীয় সেনাপতিদের অহংকারী মনোভাবের সঙ্গে যীশুর নম্র মনোভাবের কোন্ পার্থক্য রয়েছে তা বলুন।
১৯ যীশু ছিলেন নম্রতার সবচেয়ে ভাল উদাহরণ। তিনি ঈশ্বরের একজাত পুত্র ও ঈশ্বরের স্বর্গীয় রাজ্যের ভাবী রাজা ছিলেন। তিনি যখন লোকেদের সামনে তাঁর এই পরিচয় তুলে ধরেছিলেন, তখন তিনি রোমীয় বিজয়ী সেনাপতিদের মতো তা করেননি। বিজয়ী সেনাপতিদের জাঁকজমকপূর্ণ বিরাট শোভাযাত্রা করে এবং সোনা ও হাতির দাঁতের কারুকাজ করা রথে চড়িয়ে সম্বর্ধনা দেওয়া হতো। এই রথগুলো সাদা ঘোড়া, এমনকি হাতি, সিংহ বা বাঘেরাও টেনে নিয়ে যেত। শোভাযাত্রায় গায়কগায়িকারা বিজয়ের গান গাইত আর রথের ওপর যুদ্ধ থেকে লুট করে আনা জিনিসপত্র ও যুদ্ধের দৃশ্যও থাকত। এই শোভাযাত্রায় বন্দি রাজা, রাজকুমার, সেনাপতি ও তাদের পরিবার থাকত আর প্রায়ই তাদের কাপড় খুলে দিয়ে তাদেরকে অপমান করা হতো। এই ঘটনাগুলো অহংকার ও উদ্ধত মনোভাবের আভাস দেয়।
২০ কিন্তু যীশু নিজেকে একেবারে অন্যরকমভাবে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি তাঁর বিষয়ে করা ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ করতে আগ্রহী ছিলেন, যেখানে বলা ছিল: “দেখ, তোমার রাজা তোমার কাছে আসিতেছেন; তিনি ধর্ম্মময় ও পরিত্রাণযুক্ত, তিনি নম্র ও গর্দ্দভে উপবিষ্ট, গর্দ্দভীর শাবকে উপবিষ্ট।” (সখরিয় ৯:৯; মথি ২১:৪, ৫) নম্র লোকেরা এটা জেনে কতই না খুশি যে নতুন জগতে সারা পৃথিবীর ওপর যীশুই হবেন যিহোবার মনোনীত রাজা, যিনি সত্যিই নম্র, বিনয়ী, প্রেমময়, করুণাময়, দয়ালু!—যিশাইয় ৯:৬, ৭; ফিলিপীয় ২:৫-৮.
২১. নম্রতা মানে কী বোঝায় না?
২১ যীশু, পিতর, পৌল এবং বাইবেলের সময়ের অন্য বিশ্বাসী পুরুষ ও স্ত্রীরা নম্র ছিলেন আর তাদের উদাহরণ এই ধারণাকে পাল্টে দেয় যে নম্রতা হল দুর্বলতা। বরং এটা চারিত্রিক দৃঢ়তাকে প্রকাশ করে কারণ এর জন্য তারা সাহসী ও উদ্যোগী হতে পেরেছিলেন। প্রচণ্ড মানসিক ও নৈতিক শক্তি নিয়ে তারা কঠিন পরীক্ষাগুলো সহ্য করেছিলেন। (ইব্রীয় ১১ অধ্যায়) তেমনই আজকে যিহোবার সাক্ষিরা নম্র হলে তাদেরও একই শক্তি থাকবে কারণ ঈশ্বর নম্র লোকেদের তাঁর শক্তিশালী পবিত্র আত্মা দিয়ে সাহায্য করেন। তাই আমাদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে: “তোমরা সকলেই এক জন অন্যের সেবার্থে নম্রতায় কটিবন্ধন কর, ‘কেননা ঈশ্বর অহঙ্কারীদের প্রতিরোধ করেন, কিন্তু নম্রদিগকে অনুগ্রহ প্রদান করেন।’ অতএব তোমরা ঈশ্বরের পরাক্রান্ত হস্তের নীচে নত হও, যেন তিনি উপযুক্ত সময়ে তোমাদিগকে উন্নত করেন।”—১ পিতর ৫:৫, ৬; ২ করিন্থীয় ৪:৭.
২২. পরের প্রবন্ধে কী নিয়ে আলোচনা করা হবে?
২২ নম্রতার আরেকটা ইতিবাচক দিক রয়েছে যা ঈশ্বরের দাসদের অভ্যাস করা উচিত। মণ্ডলীতে প্রেম ও সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলায় এটা অনেক সাহায্য করে। তাই এটা নম্রতার একটা অপরিহার্য উপাদান। এই বিষয়ে পরের প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে।
পুনরালোচনা
◻ এই জগতে ছড়িয়ে থাকা আত্মার বর্ণনা দিন।
◻ যারা নম্র তাদের যিহোবা কীভাবে অনুগ্রহ দেখান?
◻ কেন নম্র হতে শিখতে হবে?
◻ নম্রতা দেখিয়েছিলেন এমন কোন্ ব্যক্তিদের উদাহরণ বাইবেলে রয়েছে?
[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
দূত যোহনকে বলেছিলেন: “এমন কর্ম্ম করিও না; আমি তোমার সহদাস”