যীশুর অলৌকিক কাজগুলি থেকে শিক্ষালাভ করা
“আর তৃতীয় দিবসে গালীলের কান্না নগরে এক বিবাহ হইল, . . . আর সেই বিবাহে যীশু ও তাঁহার শিষ্যগণেরও নিমন্ত্রণ হইয়াছিল। পরে দ্রাক্ষারসের আকুলান হইলে যীশুর মাতা তাঁহাকে কহিলেন, উহাদের দ্রাক্ষারস নাই।” এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই যীশু তাঁর প্রথম অলৌকিক কাজটি করেছিলেন।—যোহন ২:১-৩.
যীশুর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে এরূপ এক সমস্যা কি সত্যই খুবই নগণ্য, তুচ্ছ ঘটনা ছিল না? একজন বাইবেল পণ্ডিত জানান: “প্রাচ্যে আতিথেয়তা প্রদর্শন করাকে পবিত্র দায়িত্ব বলে গণ্য করা হত . . . প্রকৃত আতিথেয়তা, বিশেষ করে তা বিবাহভোজে প্রদর্শন করার অন্তর্ভুক্ত ছিল অপর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার-দাবার ও পানীয় মজুদ রাখা। বিবাহভোজে যদি এই জিনিসগুলির যোগান [শেষ হয়ে] যেত, তাহলে সেই পরিবার এবং দম্পতিটির সুনাম সর্বসময়ের জন্য নষ্ট হয়ে যেত।”
এইজন্য যীশু কিছু করেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে “সেখানে যিহূদীদের শুচীকরণ রীতি অনুসারে পাথরের ছয়টা জালা বসানো ছিল।” খাওয়ার আগে শাস্ত্রীয় রীতি অনুযায়ী জলে শুচিকরণ যিহূদীদের মধ্যে প্রথানুরূপ ছিল এবং উপস্থিত সকলের প্রয়োজন মিটানোর জন্য বেশ অনেক পরিমাণ জলের প্রয়োজন হত। যেসব ব্যক্তিরা অতিথিসেবা করছিল, যীশু তাদের আদেশ দেন, “ঐ সকল জালায় জল পূর।” যীশু “ভোজাধ্যক্ষ” ছিলেন না, কিন্তু তবুও তিনি সরাসরি ও জোর দিয়ে বলেছিলেন। বিবরণটি জানায়: “ভোজাধ্যক্ষ যখন সেই জল আস্বাদন করলেন, তখন [তা] দ্রাক্ষারসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।”—যোহন ২:৬-৯, NW; মার্ক ৭:৩.
এটা হয়ত অদ্ভুত মনে হতে পারে যে বিবাহের মত একটা সাধারণ অনুষ্ঠানের পটভূমিকায় যীশুর প্রথম অলৌকিক কাজ সম্পন্ন হয়েছিল, কিন্তু ঘটনাটি যীশুর সম্পর্কে অনেক কিছু প্রকাশ করে। যীশু একজন অবিবাহিত ব্যক্তি ছিলেন এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে তিনি তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে অবিবাহিত থাকার উপকারগুলি আলোচনা করেছিলেন। (মথি ১৯:১২) যাইহোক, বিবাহভোজে তাঁর উপস্থিতি এটাই প্রমাণ করে যে তিনি বিবাহের বিরোধী ছিলেন না। তিনি ভারসাম্য বজায় রেখে চলেন এবং বিবাহের আয়োজনকে সমর্থন করেন; তিনি এটিকে ঈশ্বরের দৃষ্টিতে আদরণীয় রূপে দেখেছিলেন।—তুলনা করুন ইব্রীয় ১৩:৪.
যীশু জেদি কঠোর তপস্বী ছিলেন না, যেমন পরবর্তীকালে গির্জার চিত্রকরেরা তাঁকে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছিল। তিনি লোকের সাথে পরিষ্কারভাবে মেলামেশা করে আনন্দ পেতেন এবং সমাজতান্ত্রিক নীতির বিরোধী ছিলেন না। (তুলনা করুন লূক ৫:২৯.) এইভাবে তাঁর কাজ তাঁর অনুগামীদের জন্য এক নজির স্থাপন করেছিল। যীশু ব্যক্তিগতভাবে প্রদর্শন করেছিলেন যে তারা যেন অহেতুক বিষণ্ণ বা নিরানন্দময় হয়ে না পড়ে—যেন ধার্মিকতার অর্থ হল নিরানন্দ। বিপরীতে, পরবর্তীকালে খ্রীষ্টানদের আদেশ দেওয়া হয়েছিল: “তোমরা প্রভুতে সর্ব্বদা আনন্দ কর।” (ফিলিপীয় ৪:৪) আজকের দিনে খ্রীষ্টানেরা আমোদ-প্রমোদকে এক উপযুক্ত গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রয়াস করে থাকে। তারা ঈশ্বরের সেবায় আনন্দ পায়, কিন্তু যীশুর উদাহরণ অনুসরণ করে তারা মাঝে মাঝে সামাজিক পরিবেশে একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করতে সময় করে নেয়।
যীশুর মানসিক আবেগে যে কোমলতার ভাব ছিল, সে বিষয়েও চিন্তা করুন। এই অলৌকিক কাজ করতে যীশু বাধ্য ছিলেন না। এবিষয়ে কোন ভবিষ্যদ্বাণীও ছিল না, যেটা পূর্ণ হওয়ার ছিল। স্পষ্টত:, যীশু তাঁর মার কথা চিন্তা করে ও সদ্যবিবাহিত দম্পতির দুর্দশাপূর্ণ অবস্থা দেখে তা করতে প্ররোচিত হয়েছিলেন। তিনি তাদের মনের কথা বুঝতে পেরেছিলেন এবং তাদের দায় থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এটা কি আপনার মধ্যে দৃঢ আস্থা গড়ে তোলে না, যে যীশু প্রকৃতই আপনার জন্য আগ্রহী—এমনকি আপনার দৈনন্দিন সমস্যগুলির জন্যও?—তুলনা করুন ইব্রীয় ৪:১৪-১৬.
যেহেতু প্রতিটি জালায় “এক একটাতে দুই তিন মণ করিয়া জল ধরিত,” তাই যীশুর অলৌকিক কাজের ফলে অনেক পরিমাণ দ্রাক্ষারস তৈরি হয়েছিল—সম্ভবত ৩৯০ লিটার (১০৫ গ্যালন)! (যোহন ২:৬) কেন এত বেশি পরিমাণ দ্রাক্ষারসের প্রয়োজন ছিল? যীশু কাউকে মাতাল হতে প্রশ্রয় দিচ্ছিলেন না, কারণ ঈশ্বর তা নিন্দা করেন। (ইফিষীয় ৫:১৮) পরিবর্তে তিনি ঈশ্বরের মত উদারতা প্রদর্শন করছিলেন। যেহেতু দ্রাক্ষারস ছিল অতি সাধারণ পানীয়, তাই যদি কিছু অতিরিক্ত থেকেও যেত, তা অন্য কোন অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা যেতে পারত।—তুলনা করুন মথি ১৪:১৪-২০; ১৫:৩২-৩৭.
প্রাথমিক খ্রীষ্টানেরা যীশুর উদারতার উদাহরণকে অনুকরণ করেছিল। (তুলনা করুন প্রেরিত ৪:৩৪, ৩৫.) আর যিহোবার লোকেদের আজ একইভাবে উৎসাহ দেওয়া হয় “দান করা”-র জন্য। (লূক ৬:৩৮, NW) যাইহোক, যীশুর প্রথম অলৌকিক কাজ ভাববাণীমূলক ভাবী ঘটনাদির আভাস দেয়। এটা ভবিষ্যতের এক সময়ের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করায় যখন ঈশ্বর উদার হস্তে “উত্তম উত্তম খাদ্যদ্রব্যের এক ভোজ, পুরাতন দ্রাক্ষারসের, মেদো যুক্ত উত্তম খাদ্য দ্রব্যের . . . এক ভোজ প্রস্তুত করিবেন” এবং সম্পূর্ণরূপে ক্ষুধা নিবারণ করবেন।—যিশাইয় ২৫:৬.
তাহলে, যীশু অলৌকিক পদ্ধতিতে অনেক ব্যক্তিকে দৈহিকভাবেও সুস্থ করেছিলেন, সেই সম্বন্ধে কী? সেগুলি থেকে আমরা কী শিখতে পারি?
বিশ্রামবারে উত্তম কিছু সম্পাদন করা
“উঠ, তোমার খাট তুলিয়া লইয়া চলিয়া বেড়াও।” এই কথাগুলি যীশু ৩৮ বৎসর যাবৎ অসুস্থ এক ব্যক্তিকে বলেছিলেন। সুসমাচারের বিবরণ আরও বলে: “তাহাতে তৎক্ষণাৎ সেই ব্যক্তি সুস্থ হইল, এবং আপনার খাট তুলিয়া লইয়া চলিয়া বেড়াইতে লাগিল।” আশ্চর্যের বিষয় যে, এই ঘটনার পরিবর্তনে সকলে খুশি হয়নি। বিবরণ জানায়: “যিহূদীরা যীশুকে তাড়না করিতে লাগিল, কেননা তিনি বিশ্রামবারে এই সকল করিতেছিলেন।”—যোহন ৫:১-৯, ১৬.
বিশ্রামবারের উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ বিশ্রাম নেওয়া এবং সকলে যেন আনন্দ করে। (যাত্রাপুস্তক ২০:৮-১১) যদিও যীশুর দিনে এটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক দুর্দশাদায়ক, মানুষের তৈরি জটিল নিয়মে। আলফ্রেড ইডারসেম তালমুডের দীর্ঘ বিশ্রাম বিষয়ক নীতিবিভাগ সম্পর্কে লিখেছিলেন, “বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় বিষয় মনে করে ঐকান্তিকভাবে আলোচনা করা হত, কিন্তু সুক্ষ্ম বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন কোন ব্যক্তি বিষয়টিকে গভীরভাবে পরীক্ষা করে দেখবেন।” (মশীহ যীশুর জীবন ও সময়কাল) রব্বিরা এই বিধিবহির্ভূত তুচ্ছ নিয়মগুলিকে জীবন-মরনের মত গুরুত্ব আরোপ করত, যা একজন যিহূদীর জীবনকে ক্ষেত্রবিশেষে নিয়ন্ত্রণ করত—প্রায়ই মানব অনুভুতিগুলির প্রতি পরিকল্পনাপূর্বক অসম্মান প্রদর্শনের দ্বারা। বিশ্রামবিষয়ক একটি নীতি এই রায় দেয়: “যদি কোন বাড়ি ধসে কোন লোকের উপরে পড়ে এবং যদি সন্দেহ থাকে যে সেখানে সে আছে কিনা, অথবা সে জীবিত কী মৃত, অথবা সেই ব্যক্তি পরজাতীয় কী ইস্রায়েলীয়, তাহলে তারা যদি মনে করে, তাহলে সেই ব্যক্তির উপর থেকে ধ্বংসাবশেষ সরাতে পারে। তারা যদি তাকে জীবিত অবস্থায় খুঁজে পায়, তাহলে তারা সেই ব্যক্তির উপর হতে আরও বেশি ধ্বংসাবশেষ সরাতে পারে; কিন্তু যদি [তাকে] মৃত অবস্থায় খুঁজে পায়, তাহলে যেন আর কিছু না করে।”—ট্র্যাক্টেট ইয়োমা ৮:৭, দি মিশ্না, হারবার্ট ড্যান্বির দ্বারা অনুবাদিত।
এইধরনের আইনমাফিক সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম প্রভেদকে যীশু কিভাবে দেখতেন? বিশ্রামবারে সুস্থ করার জন্য যখন সমালোচনা করা হয়, তখন তিনি বলেছিলেন: “আমার পিতা এখন পর্য্যন্ত কার্য্য করিতেছেন, আমিও করিতেছি।” (যোহন ৫:১৭) নিজেকে সমৃদ্ধশালী করবার জন্য যীশু মাইনে করা চাকুরি করছিলেন না। বরং, তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করছিলেন। ঠিক যেমন লেবীয়দের অধিকার ছিল বিশ্রামবারেও পবিত্র সেবা করার, তেমনি যীশুও মশীহ হিসাবে ঈশ্বরের কোন আইন অমান্য না করেই সঠিকভাবে ঈশ্বর-নিযুক্ত দায়িত্ব পালন করছিলেন।—মথি ১২:৫.
বিশ্রামবারে যীশুর লোকেদের সুস্থ করা এও প্রকাশ করে দিয়েছিল যে যিহূদী অধ্যক্ষ ও ফরীশীরা ছিল “অতি ধার্ম্মিক”—তাদের চিন্তাধারায় কঠোর এবং ভারসাম্যহীন। (উপদেশক ৭:১৬) অবশ্যই, ঈশ্বরের ইচ্ছা ছিল না যে সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনগুলিতে উত্তম কাজগুলিকে সীমিত করে রাখা; না ঈশ্বর চেয়েছিলেন বিশ্রামদিনে লোকে অপ্রয়োজনীয় আইন-কানুন পালনে ব্যস্ত থাকুক। মার্ক ২:২৭ পদে যীশু বলেছিলেন: “বিশ্রামবার মনুষ্যের নিমিত্তই হইয়াছে, মনুষ্য বিশ্রামবারের নিমিত্ত হয় নাই।” যীশু লোকেদের ভালবাসতেন, স্বেচ্ছাচারী নিয়ম-কানুনকে নয়।
একইভাবে আজকের দিনে খ্রীষ্টানেরা ভালই করবে যদি তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে অতিরিক্ত কঠোর অথবা নীতি-নিয়মের উপর জোর না দেয়। মণ্ডলীতে যারা কর্তৃত্বপদে আছেন, তারা যেন অন্যদের উপর মানুষের তৈরি আইন ও নিয়মগুলি চাপিয়ে না দেন। যীশুর উদাহরণ আমাদের এও উৎসাহ দেয় যে উত্তম কাজ করার জন্য যেন আমরা সুযোগগুলি খুঁজে নিই। উদহরণস্বরূপ, একজন খ্রীষ্টান যেন কখনও এমন চিন্তা না করে যে শুধুমাত্র যখন রীতিগতভাবে গৃহ থেকে গৃহে পরিচর্যা করবে বা মঞ্চ থেকে বক্তৃতা দেবে, শুধুমাত্র তখনই বাইবেলের সত্য অপরকে বলবে। প্রেরিত পিতর বলেন, “যে কেহ তোমাদের অন্তরস্থ প্রত্যাশার হেতু জিজ্ঞাসা করে,” একজন খ্রীষ্টান যেন “তাহাকে উত্তর দিতে সর্ব্বদা প্রস্তুত” থাকে। (১ পিতর ৩:১৫) উত্তম কাজ করার জন্য কোন সময়-ক্ষণ লাগে না।
করুণার বিষয়ে শিক্ষালাভ করা
আর একটি উল্লেখযোগ্য অলৌকিক কাজের ঘটনা লূক ৭:১১-১৭ পদে লিপিবদ্ধ করা আছে। বিবরণ অনুসারে, যীশু “নায়িন্ নামক নগরে যাত্রা করিলেন, এবং তাঁহার শিষ্যেরা ও বিস্তর লোক তাঁহার সঙ্গে যাইতেছিল।” আজ পর্যন্ত সেই সমাধি স্থলের জায়গাগুলি, আধুনিক আরবের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে নায়িনের গ্রামে দেখতে পাওয়া যায়। “যখন তিনি নগর-দ্বারের নিকটবর্ত্তী হইলেন,” তিনি এক কোলাহলপূর্ণ দৃশ্য দেখতে পান। “দেখ, লোকেরা একটী মরা মানুষকে বহন করিয়া বাহিরে লইয়া যাইতেছিল; সে আপন মাতার একমাত্র পুত্র, এবং সেই মাতা বিধবা; আর নগরের অনেক লোক তাহার সঙ্গে ছিল।” এইচ. বি. ট্রিস্রাম. বলেন যে “সেই প্রাচীন কালের মৃতদেহ সমাহিত করার পদ্ধতি এখনও বদলায়নি এবং আরও বলেন: “আমি দেখেছিলাম যে নারীরা সেই শবযানের আগে আগে যাচ্ছে, একদল পেশাধারী শোকার্ত নারীর পরিচালনায়। তারা তাদের বাহুদ্বয় উপরের দিকে নিক্ষেপ করছিল, শোকের চরম অঙ্গভঙ্গিমায় মাথার চুল ছিঁড়ছিল, তীব্র চীৎকার করে সেই মৃত ছেলেটির নাম ধরে ডাকছিল।”—ইস্ট্রান্ কাস্টমস্ ইন বাইবেল ল্যান্ড।
এমন এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মাঝখান দিয়ে একজন শোকার্ত বিধবা হেঁটে চলেছিল, যার শুধু মুখ থেকেই ভয়াবহ দুঃখ প্রতিফলিত হচ্ছিল। ইতিমধ্যেই স্বামীকে হারিয়ে ফেলার জন্য বিধবাটির কাছে তার ছেলেটি, লেখক হারবার্ট লকারের ভাষায়, “তার বৃদ্ধাবস্থার সম্বলস্বরূপ এবং নিঃস্বঙ্গতার সান্ত্বনাস্বরূপ—গৃহের সম্বল এবং স্তম্ভবৎ ভাররক্ষক ব্যক্তি ছিল। একমাত্র ছেলেকে হারানোর ফলে তার শেষ সম্বলটুকুও চলে যায়।” (বাইবেলের সমস্ত অলৌকিক কার্যসকল) এতে যীশুর কী প্রতিক্রিয়া হয়? লূকের অলঙ্কারপূর্ণ ভাষায়, “তাহাকে দেখিয়া প্রভু তাহার প্রতি করুণাবিষ্ট হইলেন, এবং তাহাকে কহিলেন, কাঁদিও না।” এখানে “করুণাবিষ্ট হইলেন” উক্তিটি গ্রীক শব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে, যার অর্থ হল “অভ্যন্তরীণ”। এর অর্থ হল “একজন ব্যক্তি যখন হৃদয়ের গভীরে মানসিক আবেগে আলোড়িত হয়ে ওঠে।” (ভাইনস্ একস্পোজিটরি ডিকসনারী অফ দি ওল্ড অ্যান্ড নিউ টেস্টামেন্ট ওয়ার্ডস) হ্যাঁ, যীশুর হৃদয়ের গভীরে অনুভুতিগুলি আলোড়িত হয়ে ওঠে।
যীশুর নিজের মা সম্ভবত সেই সময়ে বিধবা ছিলেন, সেজন্য যীশু হয়ত নিজেও তাঁর পালকপিতা, যোসেফকে হারানোর দুঃখ কী তা জানতেন। (তুলনা করুন যোহন ১৯:২৫-২৭.) বিধবাটির যীশুকে মিনতি করার প্রয়োজন হয়নি। স্বতঃস্ফুর্তঃভাবে তিনি “নিকটে গিয়া খাট স্পর্শ করিলেন,” যদিও মোশির নিয়ম অনুসারে মৃতদেহকে স্পর্শ করলে একজনকে অশুচি বলে গণ্য করা হত। (গণনাপুস্তক ১৯:১১) অলৌকিক শক্তির মাধ্যমে যীশু অশুচিতার কারণও দূর করতে পারতেন! “তিনি কহিলেন, হে যুবক, তোমাকে বলিতেছি, উঠ। তাহাতে সেই মরা মানুষটী উঠিয়া বসিল, এবং কথা কহিতে লাগিল; পরে তিনি তাহাকে তাহার মাতার হস্তে সমর্পণ করিলেন।”
করুণার বিষয়ে কেমন সরলই শিক্ষা! খ্রীষ্টানেরা যেন এই “শেষ কাল” এর অনুরূপ প্রেমহীন, সৌজন্যহীন মনোভাব প্রদর্শন না করে। (২ তীমথিয় ৩:১-৫) বিপরীতে, ১ পিতর ৩:৮ পদ প্রেরণা দেয়: “অবশেষে বলি, তোমরা সকলে সমমনা, পরদুঃখে দুঃখিত, ভ্রাতৃপ্রেমিক, স্নেহবান্ . . . হও।” যখন আমাদের পরিচিত কোন পরিবারের ব্যক্তিবিশেষের মৃত্যু হয় বা কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়, তখন আমরা তার পুনরুত্থান অথবা তাকে সুস্থ করে তুলতে পারি না। কিন্তু শুধুমাত্র হয়ত সেখানে আমরা উপস্থিত থেকে এবং তাদের সাথে আমাদের চোখের জল ফেলে আমরা তাদের বাস্তবধর্মী সাহায্য এবং সান্ত্বনা দিতে পারি।—রোমীয় ১২:১৫.
যীশুর দ্বারা সম্পাদিত এই নাটকীয় পুনরুত্থান ভবিষ্যতের প্রতিও ইঙ্গিত দেয়—এমন এক সময় “যখন কবরস্থ সকলে তাঁহার রব শুনিবে এবং . . . বাহির হইয়া আসিবে।” (যোহন ৫:২৮, ২৯) পৃথিবীব্যাপী, শোকসন্তপ্ত ব্যক্তিরা ব্যক্তিগতভাবে যীশুর করুণা উপলব্ধি করবে যখন মৃত্যুর দ্বারা বিচ্ছিন্ন মায়েরা, বাবারা, শিশুরা এবং বন্ধুরা কবর থেকে ফিরে আসবে!
অলৌকিক কাজগুলি থেকে শিক্ষা
তাহলে, এটা পরিষ্কার যে যীশুর দ্বারা সম্পাদিত অলৌকিক কাজগুলি শুধুমাত্র রোমাঞ্চকর শক্তিপ্রদর্শনের থেকেও আরও বেশি কিছু। এগুলি ঈশ্বরকে মহিমান্বিত করেছিল এবং যারা ‘ঈশ্বরকে মহিমান্বিত’ করতে উৎসুক, তাদের জন্য এগুলি এক আদর্শ স্থাপন করেছিল। (রোমীয় ১৫:৬) এগুলি ভাল কাজ করা, উদারতা প্রদর্শন করা ও করুণা দেখানকে উৎসাহ দেয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটাই ছিল যে, ঘটনাগুলি ভবিষ্যতে, খ্রীষ্টের সহস্র বৎসরের রাজত্বের সময়ে যে শক্তিশালী কাজ সম্পন্ন হবে, তার পূর্বাভাস দেয়।
পৃথিবীতে থাকাকালীন, যীশু তাঁর অলৌকিক কাজগুলি করেছিলেন তুলনামূলকভাবে এক ছোট গণ্ডির মধ্যে। (মথি ১৫:২৪) মহিমান্বিত রাজারূপে তাঁর রাজ্যের পরিধি হবে পৃথিবীব্যাপী! (গীতসংহিতা ৭২:৮) যীশুর পৃথিবীতে থাকাকালীন যে সব ব্যক্তিরা অলৌকিকভাবে সুস্থতা লাভ করেছিল ও পুনরুত্থিত হয়েছিল, তাদের মৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল। তাঁর স্বর্গীয় রাজত্বকালে পাপ ও মৃত্যু সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হবে, যা অনন্ত জীবনের পথ খুলে দেবে। (রোমীয় ৬:২৩; প্রকাশিত বাক্য ২১:৩, ৪) হ্যাঁ, যীশুর অলৌকিক কাজগুলি এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করায়। যিহোবার সাক্ষীরা লক্ষ লক্ষ ব্যক্তিকে সেখানে অংশীদার হওয়ার জন্য প্রকৃত আশা গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে। সেই সময় না আসা পর্যন্ত, যীশুর দ্বারা সম্পাদিত অলৌকিক কাজগুলি, অদূর ভবিষ্যতে কী ঘটবে, সে বিষয়ে কী অপূর্ব পূর্বানুমানই না যোগায়!
[৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
যীশু জলকে দ্রাক্ষারসে পরিণত করেন