আপনার সন্তানদেরকে সম্মান করতে শিক্ষা দিন
একটা জার্মান প্রবাদ বলে: “হাতে হ্যাট নিয়ে সারা দেশই ভ্রমণ করা যায়।” অনেক সংস্কৃতিতে, একজন পুরুষ কারো বাড়িতে প্রবেশ করার অথবা পরস্পরকে সম্ভাষণ জানানোর সময় যদি তার হ্যাট খুলতেন, তাহলে সেটাকে এমন একটা ভদ্রতা হিসেবে বিবেচনা করা হতো, যা তার জন্য সম্মান নিয়ে আসে। তাই, ওপরে উল্লেখিত প্রবাদের অর্থ হল, যারা উত্তম আচারব্যবহার দেখিয়ে থাকে, তাদের প্রতি লোকেরা সাধারণত আরও বেশি সদয় এবং উত্তম মনোভাব দেখিয়ে থাকে।
অল্পবয়সিরা যখন উত্তম আচারব্যবহার দেখিয়ে থাকে, তখন সেটা কতই না উৎসাহজনক হয়ে থাকে! হন্ডুরাসের একজন সীমা অধ্যক্ষ, যিনি ঘরে ঘরে সুসমাচার প্রচারের সময় বিভিন্ন বয়সি প্রকাশকদের সঙ্গে কাজ করেন, তিনি বলেন, “আমি প্রায়ই লক্ষ করেছি যে, আমার কথার চেয়ে বরং কোনো সুপ্রশিক্ষিত সন্তান এবং তার সম্মানজনক আচরণ একজন গৃহকর্তার ওপর আরও বেশি প্রভাব ফেলে।”
যেহেতু বর্তমানে অসম্মান দেখানোর মনোভাব দিন দিন বেড়েই চলছে, তাই অন্যদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয়, তা জানা কার্যকারী ও উপকারজনক। এর চেয়ে বড়ো বিষয় হল, শাস্ত্র আমাদেরকে এই উপদেশ দেয় যে, “খ্রীষ্টের সুসমাচারের যোগ্যরূপে . . . আচরণ কর।” (ফিলি. ১:২৭; ২ তীম. ৩:১-৫) এই কারণে, অন্যদের প্রতি সম্মান দেখানোর বিষয়ে আমাদের সন্তানদেরকে শিক্ষা দেওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে তাদেরকে শুধু ওপর ওপর মার্জিত আচারব্যবহার করতেই নয় বরং প্রকৃতই সম্মান দেখানোর ব্যাপারে শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে?a
উদাহরণের মাধ্যমে উত্তম আচারব্যবহার সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়া
সাধারণত সন্তানরা যে-উদাহরণগুলো লক্ষ করে, সেগুলো অনুকরণ করার মাধ্যমে শিখে থাকে। তাই, একটা যে-মৌলিক উপায়ে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের মনে উত্তম আচারব্যবহারের বিষয়টা গেঁথে দিতে পারে, সেটা হল তারা নিজেরা উত্তম আচারব্যবহার দেখিয়ে। (দ্বিতীয়. ৬:৬, ৭) যদিও আপনার সন্তানদের সঙ্গে ভদ্রতার বিষয়ে যুক্তি করা গুরুত্বপূর্ণ, তবে শুধু এটাই যথেষ্ট নয়। স্মরণ করিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক উত্তম উদাহরণ স্থাপন করাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পলারb উদাহরণ বিবেচনা করুন, যিনি এক খ্রিস্টান পরিবারে একক মায়ের কাছে মানুষ হয়েছেন। সকলের প্রতি সম্মান দেখানো তার ব্যক্তিত্বের এক অংশ হয়ে উঠেছে। কেন? উত্তরে তিনি বলেন: “যেহেতু মা উদাহরণ স্থাপন করেছেন, তাই সন্তান হিসেবে আমরাও স্বাভাবিকভাবেই সম্মান দেখিয়ে থাকি।” অলটার নামে একজন খ্রিস্টান ভাই তার ছেলেদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, যেন তারা তাদের অবিশ্বাসী মায়ের প্রতি সম্মান দেখায়। তিনি বলেন: “আমার স্ত্রীকে কখনো অবজ্ঞা করে কথা না বলে, নিজের উদাহরণের মাধ্যমে আমার ছেলেদেরকে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছি, যেন তারা তাদের মাকে সম্মান করে।” অলটার সবসময় তার ছেলেদেরকে ঈশ্বরের বাক্য থেকে নির্দেশনা দিতেন এবং যিহোবার সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করতেন। তাদের মধ্যে একজন এখন যিহোবার সাক্ষিদের একটা শাখা অফিসে সেবা করছে এবং আরেকজন অগ্রগামী হিসেবে কাজ করছে। তার ছেলেরা বাবা-মা উভয়কেই ভালোবাসে এবং সম্মান করে।
বাইবেল বলে: “ঈশ্বর গোলযোগের ঈশ্বর নহেন, কিন্তু শান্তির।” (১ করি. ১৪:৩৩) যিহোবা সমস্তকিছু শৃঙ্খলা বজায় রেখে করেন। খ্রিস্টানদের এই ঈশ্বরীয় গুণ অনুকরণ করার এবং বাড়িঘরের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখার প্রচেষ্টা করা উচিত। কিছু বাবা-মা তাদের সন্তানদেরকে স্কুলে যাওয়ার আগে তাদের বিছানা গোছানোর, কাপড়চোপড় সঠিক স্থানে রাখার এবং ঘরের টুকিটাকি কাজে সাহায্য করার ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সন্তানরা যদি দেখে যে, বাড়ির অন্যান্য সমস্ত জায়গা সুশৃঙ্খল এবং পরিচ্ছন্ন অবস্থায় রয়েছে, তাহলে খুব সম্ভবত তারাও তাদের রুম এবং জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে চাইবে।
আপনার সন্তানরা স্কুলে যা শেখে, সেটার প্রতি তাদের মনোভাব কেমন? তাদের শিক্ষকরা তাদের জন্য যা করে, সেটার প্রতি কি তারা উপলব্ধি প্রকাশ করে? বাবা-মা হিসেবে আপনারা কি এই ধরনের উপলব্ধি প্রকাশ করেন? আপনার সন্তানরাও তাদের স্কুলের কাজ এবং শিক্ষকদের প্রতি আপনার মতো একই মনোভাব দেখাতে চাইবে। শিক্ষকদেরকে ধন্যবাদ জানানোর অভ্যাস গড়ে তোলার ব্যাপারে তাদেরকে উৎসাহিত করুন না কেন? একজন শিক্ষক, ডাক্তার, দোকানদার অথবা অন্য যে-কেউই সেবা প্রদান করুন না কেন, সেটার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হল সম্মান দেখানোর এক চমৎকার উপায়। (লূক ১৭:১৫, ১৬) যে-অল্পবয়সি খ্রিস্টানরা তাদের ভদ্রতা এবং উত্তম আচরণের জন্য তাদের সহছাত্রছাত্রীদের থেকে আলাদা, তারা প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।
আদবকায়দার ব্যাপারে খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর সদস্যদের এক উত্তম উদাহরণ স্থাপন করা উচিত। মণ্ডলীর সঙ্গে মেলামেশা করে এমন অল্পবয়সিদেরকে “প্লিজ” এবং “থ্যাঙ্ক ইউ” বলার দ্বারা ভদ্রতা প্রদর্শন করতে দেখা কতই না আনন্দদায়ক! সভাগুলোর সময় যে-নির্দেশনা প্রদান করা হয়, সেগুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়ার মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্করা যখন যিহোবার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, তখন অল্পবয়সিরা তাদেরকে অনুকরণ করার জন্য উৎসাহিত হয়। কিংডম হলে উত্তম আচারব্যবহারে চমৎকার উদাহরণগুলো দেখার মাধ্যমে সন্তানরা তাদের প্রতিবেশীদের সম্মান করা শিখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, চার বছর বয়সেই অ্যান্ড্রু বড়োদের মাঝখান দিয়ে যাওয়ার সময় “এক্সকিউজ মি” বলা শিখে গিয়েছে।
তাদের কাছ থেকে কোন ধরনের আচরণ আশা করা হয়, সেই সম্বন্ধে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে শিখতে সাহায্য করার জন্য আর কী করতে পারে? বাবা-মায়েরা ঈশ্বরের বাক্যে প্রাপ্ত বিভিন্ন উদাহরণ থেকে যে-শিক্ষা লাভ করে, সেগুলো সন্তানদের কাছে বলার জন্য সময় করে নিতে পারে এবং তাদের তা নেওয়া উচিত।—রোমীয় ১৫:৪.
বাইবেলের উদাহরণগুলোর মাধ্যমে শিক্ষা দিন
শমূয়েলের মা খুব সম্ভবত তার ছেলেকে প্রস্তুত করেছিলেন, যেন সে মহাযাজক এলিকে প্রণিপাত করে। তিনি যখন শমূয়েলকে আবাসে নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন তার বয়স হয়তো মাত্র তিন কী চার বছর ছিল। (১ শমূ. ১:২৮) আপনি কি আপনার ছোটো সন্তানকে বার বার এই ধরনের সম্ভাষণগুলো যেমন, “গুড মর্নিং,” “গুড আফটারনুন,” “গুড ইভনিং” অথবা আপনি যেখানে বাস করেন, সেখানকার প্রথা অনুযায়ী যা বলা হয়, সেটা বলতে শেখান? অল্পবয়সি শমূয়েলের মতো আপনার সন্তানরাও “সদাপ্রভুর কাছে ও মনুষ্যদের কাছে অনুগ্রহ প্রাপ্ত” হতে পারে।—১ শমূ. ২:২৬.
সম্মান এবং অসম্মানের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরার জন্য বাইবেলের বিবরণগুলো ব্যবহার করুন না কেন? উদাহরণস্বরূপ, ইস্রায়েলের অবিশ্বস্ত রাজা অহসিয় যখন ভাববাদী এলিয়কে দেখতে চেয়েছিলেন, তখন তিনি ‘পঞ্চাশৎপতি ও তাহার পঞ্চাশ জন লোককে’ পাঠিয়েছিলেন। সেই কর্মকর্তা ভাববাদীকে তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য হুকুম দিয়েছিলেন। ঈশ্বরের প্রতিনিধি ছিলেন এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে এভাবে কথা বলা উপযুক্ত ছিল না। এলিয় কীভাবে উত্তর দিয়েছিলেন? “যদি আমি ঈশ্বরের লোক হই,” তিনি বলেছিলেন, “তবে আকাশ হইতে অগ্নি নামিয়া তোমাকে ও তোমার পঞ্চাশ জন লোককে গ্রাস করুক।” আর ঠিক তা-ই ঘটেছিল। “আকাশ হইতে অগ্নি নামিয়া তাহাকে ও তাহার পঞ্চাশ জন লোককে গ্রাস করিল।”—২ রাজা. ১:৯, ১০.
এলিয়কে নিয়ে আসার জন্য দ্বিতীয় পঞ্চাশৎপতিকে পাঠানো হয়েছিল। তিনিও এলিয়কে তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য হুকুম দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আবারও আকাশ থেকে অগ্নি নেমে এসেছিল। কিন্তু, এরপর এলিয়ের কাছে তৃতীয় পঞ্চাশৎপতি এসেছিলেন। এই ব্যক্তি সম্মান দেখিয়েছিলেন। এলিয়কে হুকুম দেওয়ার পরিবর্তে তিনি হাঁটু গেড়ে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে বলেছিলেন: “হে ঈশ্বরের লোক, আমি বিনয় করি, আমার প্রাণ এবং আপনার এই পঞ্চাশ জন দাসের প্রাণ আপনার দৃষ্টিতে বহুমূল্য হউক। দেখুন, আকাশ হইতে অগ্নি নামিয়া পূর্ব্বাগত দুই সেনাপতিকে ও তাহাদের পঞ্চাশ পঞ্চাশ জনকে গ্রাস করিয়াছে; কিন্তু এখন আমার প্রাণ আপনার দৃষ্টিতে বহুমূল্য হউক।” ঈশ্বরের ভাববাদী কি এমন কারো ওপর অগ্নি নেমে আসার কথা বলবেন, যিনি হয়তো ভয় পেয়েছিলেন কিন্তু এইরকম সম্মানের সঙ্গে কথা বলেছিলেন? এইরকমটা চিন্তাই করা যায় না! এর পরিবর্তে, যিহোবার দূত এলিয়কে বলেছিলেন, যেন তিনি সেই কর্মকর্তার সঙ্গে যান। (২ রাজা. ১:১১-১৫) এই বিবরণ কি সম্মান দেখানোর মূল্যের ওপর জোর দেয় না?
প্রেরিত পৌলকে যখন রোমীয় সৈন্যরা মন্দিরের কারাকক্ষে নিয়ে গিয়েছিল, তখন তিনি এইরকমটা মনে করেননি যে, তার কথা বলার অধিকার রয়েছে। তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সম্মানের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলেন: “আপনার কাছে কি কিছু বলিতে পারি?” ফল স্বরূপ, পৌলকে পক্ষসমর্থন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।—প্রেরিত ২১:৩৭-৪০.
বিচার চলাকালীন যিশুর মুখে চড় মারা হয়েছিল। কিন্তু, তিনি জানতেন যে, কীভাবে সঠিক উপায়ে প্রতিবাদ করা যায়: “যদি মন্দ বলিয়া থাকি, সেই মন্দের সাক্ষ্য দেও; কিন্তু যদি ভাল বলিয়া থাকি, কি জন্য আমাকে মার?” যিশু যেভাবে কথা বলেছিলেন, সেটার মধ্যে কেউই কোনো দোষ খুঁজে পায়নি।—যোহন ১৮:২২, ২৩.
এ ছাড়া, ঈশ্বরের বাক্যে এমন উদাহরণও রয়েছে, যেগুলো দেখায় যে, কড়া সংশোধনের প্রতি আমরা কীভাবে সাড়া দিতে পারি এবং অতীতের ভুল ও ব্যর্থতা কীভাবে সম্মানের সঙ্গে স্বীকার করতে পারি। (আদি. ৪১:৯-১৩; প্রেরিত ৮:২০-২৪) উদাহরণস্বরূপ, অবীগলের স্বামী নাবল, দায়ূদের সঙ্গে যে-উদ্ধত আচরণ করেছিলেন, সেটার জন্য অবীগল ক্ষমা চেয়েছিলেন। ক্ষমা চাওয়া ছাড়াও তিনি প্রচুর খাদ্যসামগ্রী নিয়ে এসেছিলেন। অবীগলের কাজ দেখে দায়ূদ এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, নাবলের মৃত্যুর পর তিনি অবীগলকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।—১ শমূ. ২৫:২৩-৪১.
আপনার সন্তানদেরকে সম্মান দেখানোর বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তা সেটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে সম্মান দেখানোর বিষয় কিংবা সাধারণভাবে উত্তম আচারব্যবহার দেখানোর বিষয়, যেটাই হোক না কেন। ‘আমাদের দীপ্তি মনুষ্যদের সাক্ষাতে উজ্জ্বল হউক’ আর এভাবে ‘আমাদের স্বর্গস্থ পিতার গৌরব’ হোক।—মথি ৫:১৬.
[পাদটীকাগুলো]
a অবশ্য, সন্তানদেরকে বাবা-মাদের এটা বোঝার জন্য সাহায্য করা প্রয়োজন যে, বড়োদের সম্মান দেখানো এবং খারাপ মনোভাব রয়েছে এমন ব্যক্তিদের প্রতি বশ্যতা দেখানোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসের সচেতন থাক! (ইংরেজি) পত্রিকার ৩-১১ পৃষ্ঠা দেখুন।
b কিছু নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।