তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন
তিনি প্রভুর কাছ থেকে ক্ষমা করা সম্বন্ধে শিক্ষা লাভ করেছিলেন
পিতর সেই চরম মুহূর্তের কথা কখনো ভুলবেন না, যখন তারা একে অপরের দিকে তাকিয়েছিল। তিনি কি যিশুর স্থির দৃষ্টিতে তাকানোর মধ্যে হতাশা বা ভর্ৎসনার কোনো ইঙ্গিত দেখতে পেয়েছিলেন? আমরা নিশ্চিত করে তা বলতে পারি না; অনুপ্রাণিত বিবরণ কেবল বলে যে, “প্রভু মুখ ফিরাইয়া পিতরের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন।” (লূক ২২:৬১) কিন্তু সেই এক ঝলকেই, পিতর তার নিজ ব্যর্থতার গভীরতাকে বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, তিনি সবেমাত্র ঠিক সেই কাজটাই করেছিলেন, যেটার বিষয়ে যিশু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন আর যে-বিষয়ে পিতর দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন যে, তিনি কখনো তা করবেন না—তিনি তার প্রিয় প্রভুকে অস্বীকার করেছিলেন। পিতরের জন্য এটা একটা দুর্বল মুহূর্ত ছিল, সম্ভবত তার জীবনে সবচেয়ে খারাপ দিনের সবচেয়ে খারাপ মুহূর্ত।
তবে সবকিছুই শেষ হয়ে যায়নি। যেহেতু পিতর প্রচুর বিশ্বাসের অধিকারী একজন ব্যক্তি ছিলেন, তাই তখনও তার ভুলগুলো কাটিয়ে ওঠার ও যিশুর সর্বোত্তম শিক্ষাগুলোর মধ্যে একটা শেখার সুযোগ তার ছিল। এটা ছিল ক্ষমা করা সম্বন্ধীয় শিক্ষা। আমাদের প্রত্যেকের একই শিক্ষা লাভ করা প্রয়োজন, তাই আসুন আমরা বিবেচনা করে দেখি যে, কীভাবে পিতর এই কঠিন শিক্ষা লাভ করেছিলেন।
একজন ব্যক্তি যাকে অনেক কিছু শিখতে হয়েছিল
প্রায় ছয় মাস পূর্বে তার নিজ শহর কফরনাহূমে, পিতর যিশুর কাছে এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: “প্রভু, আমার ভ্রাতা আমার নিকটে কত বার অপরাধ করিলে আমি তাহাকে ক্ষমা করিব? কি সাত বার পর্য্যন্ত?” সম্ভবত পিতর ভেবেছিলেন যে, তিনি খুবই উদার। কারণ, সেই সময়ের ধর্মীয় নেতারা শিক্ষা দিত যে, একজনকে কেবল তিন বার ক্ষমা করতে হবে! যিশু উত্তর দিয়েছিলেন: ‘সাত বার নয়, কিন্তু সাতাত্তর বার পর্যন্ত।’—মথি ১৮:২১, ২২, NW.
যিশু কি এই ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন যে, পিতরের একজন অপরাধীর কাজকর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ রেকর্ড রাখা উচিত? না; বরং, পিতরের ৭ বারকে ৭৭ বারে পরিণত করার দ্বারা তিনি বলছিলেন যে, ক্ষমা করার ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। যিশু দেখিয়েছিলেন যে, পিতর সেই সময়ে ব্যাপকভাবে ছেয়ে থাকা এক নির্মম ও ক্ষমাহীন মনোভাবের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, যে-মনোভাব খুব অল্প পরিমাণে ক্ষমা করার সীমা নির্ধারণ করত। কিন্তু, ঐশিক ক্ষমা ব্যাপক ও উদার।
পিতর যিশুর সঙ্গে তর্ক করেননি। কিন্তু যিশুর শিক্ষা কি সত্যিই তার হৃদয়ে পৌঁছেছিল? কখনো কখনো ক্ষমা করা সম্বন্ধে আমরা তখনই সবচেয়ে বেশি করে শিখি, যখন আমরা উপলব্ধি করি যে, আমাদের নিজেদের ক্ষমা লাভ করা কতখানি প্রয়োজন। তাই আসুন আমরা যিশুর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটা ঘটনাগুলোতে ফিরে যাই। সেই কঠিন সময়গুলোতে পিতর এমন অনেক কিছুই করেছিলেন, যেগুলোর জন্য তার প্রভুর কাছ থেকে তার ক্ষমা লাভ করার প্রয়োজন ছিল।
আরও বেশি ক্ষমা লাভের প্রয়োজন
এটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক সন্ধ্যা—যিশুর পার্থিব জীবনের শেষ রাত। তখনও যিশুর তাঁর প্রেরিতদেরকে শিক্ষা দেওয়ার মতো অনেক কিছু ছিল—উদাহরণস্বরূপ, নম্রতা সম্বন্ধে। নম্রভাবে তাদের পা ধুইয়ে দেওয়ার মাধ্যমে যিশু এক উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন, যে-কাজ সাধারণত সবচেয়ে নিম্নপদস্থ দাসকে করতে হতো। প্রথমে, পিতর যিশুর সেই কাজের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তারপর তিনি সেই সেবা পাওয়া প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরে তিনি জোরের সঙ্গে বলেছিলেন যে, যিশু যেন তার শুধু পা-ই নয় কিন্তু হাত ও মাথাও ধুয়ে দেন! যিশু তাঁর ধৈর্য হারাননি বরং তিনি যা করছিলেন শান্তভাবে সেটার গুরুত্ব ও অর্থ ব্যাখ্যা করেছিলেন।—যোহন ১৩:১-১৭.
কিন্তু এর অল্প সময় পরেই, প্রেরিতরা তাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ, সেই নিয়ে তর্কবিতর্ক শুরু করেছিল। পিতরও নিশ্চিতভাবেই সেই লজ্জাজনক মানব অহংকার প্রদর্শন করেছিলেন। তা সত্ত্বেও, যিশু সদয়ভাবে তাদেরকে সংশোধন করেছিলেন আর এমনকী তারা যা-কিছু ভালো করেছে সেটার জন্য অর্থাৎ তাদের প্রভুর প্রতি অনুগত থাকার জন্য তাদের প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু, তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, তারা সকলে তাঁকে পরিত্যাগ করবে। পিতর উত্তর দিয়েছিলেন যে, তিনি এমনকী মুত্যুর মুখোমুখি হলেও যিশুকে পরিত্যাগ করবেন না। এর বিপরীতে, যিশু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, সেই রাতেই কুকুড়া বা মোরগ দুবার ডাকার আগে পিতর তার প্রভুকে তিন বার অস্বীকার করবেন। তখন পিতর কেবল যিশুর বিরোধিতাই করেননি কিন্তু সেইসঙ্গে দম্ভও করেছিলেন যে, তিনি অন্য সমস্ত প্রেরিতের চেয়ে আরও বেশি বিশ্বস্ত বলে প্রমাণিত হবেন!—মথি ২৬:৩১-৩৫; মার্ক ১৪:২৭-৩১; লূক ২২:২৪-২৮.
যিশু কি পিতরের ব্যাপারে ধৈর্য হারাতে বসেছিলেন? বস্তুতপক্ষে, এই কষ্টকর সময়কালে, যিশু তাঁর অসিদ্ধ প্রেরিতদের মধ্যে ভালো কিছু দেখার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি জানতেন যে, পিতর তাঁকে হতাশ করবেন তবুও তিনি বলেছিলেন: “আমি তোমার নিমিত্ত বিনতি করিয়াছি, যেন তোমার বিশ্বাসের লোপ না হয়; আর তুমিও একবার ফিরিলে পর তোমার ভ্রাতৃগণকে সুস্থির করিও।” (লূক ২২:৩২) এভাবে যিশু এই আস্থা প্রকাশ করেছিলেন যে, পিতর এই ভুলকে কাটিয়ে উঠবেন এবং বিশ্বস্তভাবে আবারও পরিচর্যা করবেন। কী এক সদয়, ক্ষমাশীল মনোভাব!
পরে গেৎশিমানী বাগানে, পিতরকে একাধিক বার সংশোধন করার প্রয়োজন হয়েছিল। যিশু তাকে আর সেইসঙ্গে যাকোব ও যোহনকে তাঁর প্রার্থনা করার সময় জেগে থাকতে বলেছিলেন। যিশু নিদারুণ আবেগগত যন্ত্রণা ভোগ করছিলেন ও তাঁর সমর্থনের প্রয়োজন ছিল কিন্তু পিতর এবং অন্যেরা বার বার ঘুমিয়ে পড়েছিল। যিশু এই সহমর্মিতাপূর্ণ ও ক্ষমাশীল মন্তব্য করেছিলেন: “আত্মা ইচ্ছুক বটে, কিন্তু মাংস দুর্ব্বল।”—মার্ক ১৪:৩২-৩৮.
শীঘ্র, মশাল হাতে খড়্গ ও লাঠি নিয়ে জনতা এসে হাজির হয়েছিল। তখনই সতর্কতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করার সময় এসেছিল। কিন্তু, পিতর তাড়াহুড়ো করে অবিবেচনাপূর্ণ কাজ করেছিলেন, মহাযাজকের একজন দাস, মল্কের মাথার দিকে খড়্গ চালিয়ে তার একটা কান কেটে ফেলেছিলেন। যিশু শান্তভাবে পিতরকে সংশোধন করেছিলেন, ক্ষত সারিয়ে দিয়েছিলেন এবং অহিংসার এক নীতি সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করেছিলেন, যা আজও তাঁর অনুসারীদেরকে নির্দেশনা দেয়। (মথি ২৬:৪৭-৫৫; লূক ২২:৪৭-৫১; যোহন ১৮:১০, ১১) পিতর ইতিমধ্যেই অনেক ভুল করেছিলেন, যেগুলোর জন্য তার প্রভুর কাছ থেকে ক্ষমা লাভের প্রয়োজন ছিল। তার ঘটনা হয়তো আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে, “আমরা সকলে অনেক প্রকারে উছোট খাই।” (যাকোব ৩:২) আমাদের মধ্যে কার প্রতিদিন ঈশ্বরের কাছ থেকে ক্ষমা লাভের প্রয়োজন হয় না? কিন্তু, সেই রাতে পিতরের প্রতি আরও অনেক কিছু ঘটতে যাচ্ছিল। চরম ব্যর্থতা অপেক্ষা করছিল।
পিতরের চরম ব্যর্থতা
যিশু সেই জনতাকে এই যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, তারা যদি তাঁরই অন্বেষণ করে থাকে, তাহলে তাদের তাঁর প্রেরিতদের চলে যেতে দেওয়া উচিত। জনতা যখন যিশুকে ঘিরে রেখেছিল, তখন পিতর শুধু অসহায়ভাবে দেখেছিলেন। এরপর পিতর তার সহপ্রেরিতদের মতো পালিয়ে গিয়েছিলেন।
পিতর ও যোহন পালিয়ে যাওয়ার পথে থেমেছিল, সম্ভবত প্রাক্তন মহাযাজক হাননের বাড়ির কাছাকাছি, যেখানে যিশুকে জেরা করার জন্য প্রথমে নিয়ে আসা হয়েছিল। যিশুকে যখন সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখন পিতর ও যোহনও তাঁকে অনুসরণ করেছিল তবে, “দূরে থাকিয়া।” (মথি ২৬:৫৮; যোহন ১৮:১২, ১৩) পিতর কাপুরুষ ছিলেন না। নিশ্চিতভাবেই তাঁকে অনুসরণ করার জন্য অনেকটা সাহসের প্রয়োজন হয়েছিল। জনতা সশস্ত্র ছিল আর পিতর ইতিমধ্যেই তাদের একজনকে আঘাত করেছিলেন। তবুও, এখানে পিতরের উদাহরণে আমরা সেই অনুগত প্রেম দেখতে পাই না, যেটার বিষয়ে তিনি নিজেই ঘোষণা করেছিলেন—প্রয়োজনে তিনি তার প্রভুর সঙ্গে মরতেও ইচ্ছুক।—মার্ক ১৪:৩১.
পিতরের মতো, আজকেও অনেকে “দূরে থাকিয়া” খ্রিস্টকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে—এমনভাবে যেন আর কেউ-ই তা লক্ষ করবে না। কিন্তু পিতর নিজেই যেমন পরে লিখেছিলেন, খ্রিস্টকে যথাযথভাবে অনুসরণ করার একমাত্র উপায় হল যতটা সম্ভব তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থাকা, পরিণতি যা-ই হোক না কেন, সমস্ত বিষয়ে তাঁর উদাহরণ অনুকরণ করা।—১ পিতর ২:২১.
পিতর সতর্কভাবে যেতে যেতে শেষ পর্যন্ত যিরূশালেমের সবচেয়ে সুদৃশ্য এক বাসভবনের দরজার কাছে এসে পৌঁছেছিলেন। এটা ছিল ধনী ও ক্ষমতাশালী মহাযাজক কায়াফার গৃহ। সাধারণত এই ধরনের গৃহগুলোর কেন্দ্রে একটা প্রাঙ্গণ থাকত, যেটার সামনের দিকে একটা দরজা থাকত। পিতর সেই দরজার কাছে পৌঁছেছিলেন কিন্তু তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। যোহন, যিনি ইতিমধ্যেই ভিতরে ছিলেন তিনি বাইরে এসে দ্বাররক্ষিকার কাছ থেকে পিতরকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়ার অনুমতি নিয়েছিলেন। মনে হয় যে, পিতর যোহনের কাছাকাছি ছিলেন না; কিংবা তার প্রভুর পক্ষ নেওয়ার জন্য তিনি গৃহের ভিতরে যাওয়ার চেষ্টা করেননি। তিনি প্রাঙ্গণেই ছিলেন, যেখানে কিছু দাস-দাসী কনকনে ঠাণ্ডায় আগুন পোহাচ্ছিল, সেখান থেকে তিনি দেখছিলেন যে, কীভাবে ভিতরে চলা বিচারে যিশুর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষিদের দল আসা-যাওয়া করছিল।—মার্ক ১৪:৫৪-৫৭; যোহন ১৮:১৫, ১৬, ১৮.
যে-দাসীটি পিতরকে ভিতরে ঢুকতে দিয়েছিল, সে আগুনের আলোয় তাকে আরও ভালোভাবে দেখতে সমর্থ হয়েছিল। সে পিতরকে জানত। সে অভিযোগ করে বলেছিল: “তুমিও সেই গালীলীয় যীশুর সঙ্গে ছিলে।” অপ্রস্তুতে পড়ে, পিতর বলেছিলেন যে, তিনি যিশুকে চেনেন না আর সেই দাসীর কথা বুঝতে পারছেন না। তিনি দ্বারের কাছে গিয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু আরেকটা দাসী তাকে লক্ষ করে একই বিষয় উল্লেখ করেছিল: “এ ব্যক্তি সেই নাসরতীয় যীশুর সঙ্গে ছিল।” পিতর শপথ করে বলেছিলেন: “আমি সে ব্যক্তিকে চিনি না।” (মথি ২৬:৬৯-৭২) সম্ভবত এই দ্বিতীয় বার অস্বীকার করার পরই পিতর মোরগ ডাকতে শুনেছিলেন কিন্তু তিনি এতটাই বিক্ষিপ্ত ছিলেন যে, মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে যিশুর করা ভবিষ্যদ্বাণীটি তার মনে ছিল না।
অল্প কিছুক্ষণ পর, পিতর তখনও নিজেকে আড়াল করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু প্রাঙ্গণের চারদিকে দাঁড়িয়ে থাকা একদল লোক তার দিকে এগিয়ে এসেছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সেই দাস মল্কের আত্মীয় যাকে পিতর আঘাত করেছিলেন। তিনি পিতরকে বলেছিলেন: “আমি কি উদ্যানে উহার সঙ্গে তোমাকে দেখি নাই?” পিতর তাদের মধ্যে এই প্রত্যয় উৎপন্ন করতে পরিচালিত হয়েছিলেন যে, তারা ভুল বলছে। তাই এই ব্যাপারে তিনি, স্পষ্টভাবে এই কথা বলার দ্বারা শপথ করেছিলেন যে, তিনি যদি মিথ্যা বলে থাকেন, তাহলে তার ওপর যেন অভিশাপ নেমে আসে। তার মুখ থেকে কথাগুলো বের হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে মোরগ ডেকে উঠেছিল—পিতর সেই রাতে দ্বিতীয় বার তা শুনেছিলেন।—যোহন ১৮:২৬, ২৭; মার্ক ১৪:৭১, ৭২.
যিশু সবেমাত্র প্রাঙ্গণের ওপরের দিকে যে-বারান্দা আছে, সেখানে বেরিয়ে এসেছেন। শুরুতে যেমন বর্ণনা করা হয়েছে, সেই মুহূর্তেই তিনি পিতরের দিকে তাকিয়েছিলেন। আর সেই মুহূর্তেই পিতর উপলব্ধি করেছিলেন যে, তিনি কত চরমভাবে তার প্রভুকে হতাশ করেছেন। পিতর প্রাঙ্গণ থেকে চলে গিয়েছিলেন ও অপরাধবোধের দ্বারা জর্জরিত হয়ে পড়েছিলেন। এরপর তিনি পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত নগরের রাস্তার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পূর্বের দৃশ্যগুলো তার চোখের সামনে ভাসছিল। তার চোখে জল এসে গিয়েছিল। তিনি হতাশ হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন।—মার্ক ১৪:৭২; লূক ২২:৬১, ৬২.
এইরকম এক ভুলের গুরুত্ব সম্বন্ধে উপলব্ধি করার পর, একজন ব্যক্তির পক্ষে এটা ধরে নেওয়া খুবই সহজ যে, তার পাপ এতই গুরুতর যে, ক্ষমা লাভ করা সম্ভব নয়। পিতর হয়তো নিজের সম্বন্ধে সেটাই ভেবেছিলেন। কিন্তু সেটাই কি সত্য?
পিতর কি ক্ষমা লাভের অযোগ্য ছিলেন?
সূর্য ওঠার ও সেই দিনের ঘটনাগুলো ঘটতে থাকার সঙ্গেসঙ্গে পিতর যে-গভীর যন্ত্রণা বোধ করেছিলেন, সেটা কল্পনা করা কঠিন। তিনি নিজেকে নিশ্চয় কতই-না ভর্ৎসনা করেছিলেন, যখন সেই দুপুরে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে কষ্টভোগ করার পর যিশু মারা গিয়েছিলেন! পিতর প্রতিবার যখনই চিন্তা করেছেন যে, মানুষ হিসেবে তার প্রভুর জীবনের শেষ দিনে যে-পরিণতি হয়েছিল, তাতে তিনি কীভাবে তাঁর যন্ত্রণাকে বৃদ্ধি করেছেন, তখন তিনি নিশ্চয় খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। নিশ্চিতভাবে তার গভীর দুঃখ থাকা সত্ত্বেও, পিতর হতাশ হয়ে পড়েননি। আমরা তা জানি কারণ বিবরণ বলে যে, শীঘ্র তিনি তার ভাইদের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হয়েছিলেন। (লূক ২৪:৩৩) কোনো সন্দেহ নেই যে, সেই ভয়াবহ রাতে প্রেরিতরা যেভাবে আচরণ করেছিল, তার জন্য তারা সকলেই অনুশোচনা করেছিল আর তারা একে অপরকে কিছুটা সান্ত্বনা প্রদান করেছিল।
এক অর্থে, আমরা এখানে দেখতে পাচ্ছি যে, পিতর সবচেয়ে বিজ্ঞতাপূর্ণ এক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ঈশ্বরের একজন দাস যখন পতিত হন, তখন যে-বিষয়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হল তার পতিত হওয়ার গুরুতর অবস্থা নয় কিন্তু আবারও উঠে দাঁড়ানোর, বিষয়গুলোকে শুধরানোর ব্যাপারে তার দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ মনোবল। (হিতোপদেশ ২৪:১৬) হতাশ হয়ে পড়লেও পিতর তার ভাইদের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার দ্বারা অকৃত্রিম বিশ্বাস দেখিয়েছিলেন। একজন যখন দুঃখ অথবা অনুশোচনার দ্বারা ভারগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তখন নিজেকে পৃথক করার প্রবণতা আসতে পারে কিন্তু তা বিপদজনক। (হিতোপদেশ ১৮:১) সহবিশ্বাসীদের সান্নিধ্যে থাকা ও পুনরায় আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করা বিজ্ঞতার কাজ।—ইব্রীয় ১০:২৪, ২৫.
যেহেতু তিনি তার আধ্যাত্মিক ভাইদের সঙ্গে ছিলেন, তাই পিতর এই দুঃখজনক সংবাদটি পেয়েছিলেন যে, যিশুর দেহ কবরে নেই। পিতর ও যোহন দৌড়ে সেই কবরের কাছে গিয়েছিল, যেখানে যিশুকে কবর দিয়ে সেটার দরজা বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। সম্ভবত অপেক্ষাকৃত কমবয়সি হওয়ায় যোহন প্রথমে সেখানে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু কবরের দরজা খোলা দেখে তিনি ইতস্তত করেছিলেন। পিতর করেননি। এমনকী যদিও তিনি রুদ্ধশ্বাসে দৌড়েছিলেন তবুও তিনি সোজা ভিতরে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা খালি ছিল!—যোহন ২০:৩-৯.
পিতর কি বিশ্বাস করেছিলেন যে, যিশু পুনরুত্থিত হয়েছেন? প্রথমে করেননি, এমনকী যদিও সেই বিশ্বস্ত স্ত্রীলোকেরা সংবাদ দিয়েছিল যে, স্বর্গদূতেরা তাদের কাছে দেখা দিয়ে ঘোষণা করেছে যে, যিশু মৃতদের মধ্য থেকে উত্থাপিত হয়েছেন। (লূক ২৩:৫৫–২৪:১১) কিন্তু সেই দিনের শেষে, পিতরের হৃদয়ে দুঃখের সমস্ত চিহ্ন ও সন্দেহ দূর হয়ে গিয়েছিল। যিশু জীবিত হয়েছেন ও এখন তিনি একজন শক্তিমান আত্মিক ব্যক্তি! তিনি তাঁর সমস্ত প্রেরিতকে দেখা দিয়েছিলেন। কিন্তু, প্রথমে তিনি আরও কিছু করেছিলেন যদিও তা একান্তে। সেই দিনে প্রেরিতরা বলেছিল: “প্রভু নিশ্চয়ই উঠিয়াছেন, এবং শিমোনকে দেখা দিয়াছেন।” (লূক ২৪:৩৪) একইভাবে, সেই উল্লেখযোগ্য দিন সম্বন্ধে প্রেরিত পৌল পরে লিখেছিলেন যে, যিশু “কৈফাকে, পরে সেই বারো জনকে দেখা দিলেন।” (১ করিন্থীয় ১৫:৫) কৈফা ও শিমোন হল পিতরের অন্য নাম। যিশু সেই দিনে তাকে দেখা দিয়েছিলেন—স্পষ্টতই পিতর যখন একা ছিলেন।
যিশু ও পিতরের সেই বিশেষ পুনর্মিলনের সময়ে কী ঘটেছিল, সেই সম্বন্ধে বাইবেল আমাদের কিছু জানায় না। আমরা কেবল কল্পনা করতে পারি যে, তার প্রিয় প্রভুকে আবারও জীবিত দেখা আর তাঁর কাছে তার দুঃখ ও অনুতাপ প্রকাশ করার সুযোগ পাওয়া পিতরকে কতখানি প্রভাবিত করেছিল। পৃথিবীর অন্য যেকোনো কিছুর চাইতে তিনি ক্ষমা পেতে চেয়েছিলেন। যিশু যে ক্ষমা করেছিলেন আর তা যে প্রচুররূপে করেছিলেন, সেই বিষয়ে কে সন্দেহ করতে পারে? আজকে যে-খ্রিস্টানরা পাপে পতিত হয়, তাদের পিতরের ঘটনার কথা মনে রাখা প্রয়োজন। আমাদের কখনো ধরে নেওয়া উচিত নয় যে, আমরা ঈশ্বরের কাছ থেকে ক্ষমা লাভ করার অযোগ্য। যিশু নিখুঁতভাবে তাঁর পিতাকে প্রতিফলিত করেছিলেন, যিনি “প্রচুররূপে ক্ষমা করিবেন।”—যিশাইয় ৫৫:৭.
ক্ষমা করার আরও প্রমাণ
যিশু তাঁর প্রেরিতদের গালীলে যেতে বলেছিলেন, যেখানে তারা আবারও তাঁর সঙ্গে মিলিত হবে। তারা যখন সেখানে পৌঁছেছিল, তখন পিতর গালীল সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া স্থির করেছিলেন। অন্য কয়েক জন তার সঙ্গে গিয়েছিল। আবারও, পিতর সেই হ্রদে গিয়েছিলেন যেখানে তিনি আগে অনেক সময় কাটিয়েছিলেন। নৌকার ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ, ছোটো ছোটো ঢেউয়ের মৃদু শব্দ এবং তার হাতে যে-সাধারণ জাল ছিল, সেটার স্পর্শ এই সমস্ত কিছু নিশ্চয়ই বেশ পরিচিত বলে মনে হয়েছিল। সেই রাতে তিনি কি ভেবেছিলেন যে, যেহেতু যিশুর পার্থিব পরিচর্যা শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাই এখন তার জীবনকে কীভাবে পরিচালিত করা উচিত? একজন জেলের সাদাসিধে জীবন কি তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল? যা-ই হোক না কেন, সারারাত ধরে তারা কোনো মাছ ধরতে পারেনি।—মথি ২৬:৩২; যোহন ২১:১-৩.
কিন্তু, যখন প্রায় ভোর হয়ে আসছিল, তখন এক ব্যক্তি তীরের কাছ থেকে ডেকে তাদেরকে নৌকার উলটো দিকে তাদের জাল ফেলার জন্য জোরালো পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারা কথামতো কাজ করেছিল ও জালে ধরা পড়া ১৫৩টা মাছ টেনে তুলেছিল! পিতর জানতেন ব্যক্তিটি কে ছিলেন। তিনি নৌকা থেকে জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটে তীরে এসেছিলেন। সেই তীরে, যিশু তাদেরকে কয়লার আগুনে রান্না করা মাছ খেতে দিয়েছিলেন। তিনি পিতরের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিলেন।
যিশু পিতরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, তিনি “ইহাদের অপেক্ষা”—স্পষ্টতই জালে ধরা পড়া প্রচুর মাছের দিকে নির্দেশ করে—তার প্রভুকে বেশি ভালোবাসেন কি না। পিতরের হৃদয়ে, মাছ ধরার ব্যাবসার প্রতি ভালোবাসা কি যিশুর প্রতি ভালোবাসার সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করবে? ঠিক যেমন পিতর তার প্রভুকে তিন বার অস্বীকার করেছিলেন, তেমনই যিশু এখন তাকে তার সঙ্গীদের সামনে যিশুর প্রতি তার ভালোবাসাকে তিনবার প্রমাণ করার সুযোগ দিয়েছিলেন। পিতর যখন তা করেছিলেন, তখন যিশু তাকে বলেছিলেন যে, কীভাবে সেই ভালোবাসা দেখাতে হবে: পবিত্র সেবাকে সমস্ত কিছুর আগে রাখার আর খ্রিস্টের পাল অর্থাৎ তাঁর বিশ্বস্ত অনুসারীদের চরানোর ও পালন করার দ্বারা।—যোহন ২১:৪-১৭.
এভাবে যিশু নিশ্চিত করেছিলেন যে, পিতর তখনও তাঁর ও তাঁর পিতার কাছে কার্যকারী ছিলেন। খ্রিস্টের নির্দেশনায় পিতর মণ্ডলীতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। যিশুর পুরোপুরিভাবে ক্ষমা করে দেওয়ার কী জোরালো প্রমাণ! নিশ্চিতভাবেই সেই করুণা পিতরের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল আর তিনি এটার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
পিতর বিশ্বস্তভাবে অনেক বছর ধরে তার কার্যভার সম্পাদন করেছিলেন। তিনি তার ভাইদের শক্তিশালী করেছিলেন, যেমন যিশু তাঁর মৃত্যুর প্রাক্কালে আদেশ দিয়েছিলেন। খ্রিস্টের অনুসারীদের পালন ও চরানোর ব্যাপারে তিনি সদয়ভাবে এবং ধৈর্য সহকারে কাজ করেছিলেন। যে-ব্যক্তিকে শিমোন বলে ডাকা হতো তিনি অবিচল ও দৃঢ় হওয়ার এবং মণ্ডলীতে নির্ভরযোগ্য উত্তম প্রভাব ফেলার দ্বারা যিশুর দেওয়া সেই পিতর অর্থাৎ পাথর নাম অনুসারে চলেছিলেন। সেই প্রভাবের বড়ো প্রমাণ পিতরের লেখা দুটো আন্তরিক, ব্যক্তিগত চিঠিতে দেখতে পাওয়া যায়, যেগুলো বাইবেলের মূল্যবান বই হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া, সেই চিঠিগুলো দেখায় যে, ক্ষমা করা সম্বন্ধে পিতর যিশুর কাছ থেকে যে-শিক্ষা লাভ করেছিলেন, তা তিনি কখনো ভুলে যাননি।—১ পিতর ৩:৮, ৯; ৪:৮.
আমরাও যেন সেই শিক্ষা লাভ করি। আমরা যে অনেক ভুল করি, তার জন্য কি আমরা রোজ ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি? এরপর আমরা কি সেই ক্ষমা করাকে মেনে নিই ও বিশ্বাস করি যে, আমাদেরকে শুদ্ধ করার ক্ষমতা এটার রয়েছে? আর আমরা কি আমাদের চারপাশে যারা রয়েছে তাদেরকেও ক্ষমা করি? আমরা যদি তা করি, তাহলে আমরা পিতরের বিশ্বাস ও তার প্রভুর করুণাকে অনুকরণ করব। (w১০-E ০৪/০১)
[২২ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]
পিতর অনেক ভুল করেছিলেন যেগুলোর জন্য তাঁর প্রভুর কাছ থেকে ক্ষমা লাভের প্রয়োজন ছিল কিন্তু আমাদের মধ্যে কার প্রতিদিন ক্ষমা লাভের প্রয়োজন হয় না?
[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
“প্রভু মুখ ফিরাইয়া পিতরের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন”
[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]
“প্রভু . . . শিমোনকে দেখা দিয়াছেন”