আপনি কি প্রেম দেখানোর ক্ষেত্রে প্রশস্ত হতে পারেন?
জাহাজের নোঙরকে যে-শেকলটা আটকে রাখে, সেটাকে প্রচণ্ড শক্তির মধ্যে টিকে থাকতে হয়, যাতে জাহাজ ভেসে না যায়। কিন্তু, এটা কেবলমাত্র তখনই সম্ভব হয়, যখন সেই শেকলের আংটাগুলো দৃঢ় ও শক্ত হয়। তা না হলে, সেই শেকল ভেঙে যাবে।
খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর সম্বন্ধেও একই বিষয় বলা যেতে পারে। একটা মণ্ডলীকে দৃঢ় ও গঠনমূলক হতে হলে, মণ্ডলীর প্রত্যেক সদস্যকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কোন বিষয়টা তাদেরকে বন্ধনে আবদ্ধ রাখে? প্রেম হচ্ছে একতার সবচেয়ে জোরালো শক্তি। তাই, এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে যিশু খ্রিস্ট তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন: “এক নূতন আজ্ঞা আমি তোমাদিগকে দিতেছি, তোমরা পরস্পর প্রেম কর; আমি যেমন তোমাদিগকে প্রেম করিয়াছি, তোমরাও তেমনি পরস্পর প্রেম কর। তোমরা যদি আপনাদের মধ্যে পরস্পর প্রেম রাখ, তবে তাহাতেই সকলে জানিবে যে, তোমরা আমার শিষ্য।” বস্তুতপক্ষে, সত্য খ্রিস্টানদের একে অন্যের জন্য সেই ধরনের প্রেম রয়েছে, যা নিছক বন্ধুত্ব ও পরস্পরের প্রতি সম্মান দেখানোর চেয়েও আরও বেশি কিছু। তারা আত্মত্যাগমূলক প্রেম গড়ে তোলে।—যোহন ১৩:৩৪, ৩৫.
আমাদের সহবিশ্বাসীদের প্রতি উপলব্ধি দেখানো
অনেক মণ্ডলী বিভিন্ন বয়সের, বর্ণের, জাতির, সংস্কৃতির, ভাষার ও সামাজিক পটভূমির লোকেদের নিয়ে গঠিত। প্রত্যেক সদস্যেরই নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ, আশা-আশঙ্কা রয়েছে এবং সাধারণত প্রত্যেককেই কোনো না কোনো ভার বহন করতে হয়—হতে পারে শারীরিক অসুস্থতা অথবা আর্থিক অনিশ্চয়তা। এই বিভিন্নতা খ্রিস্টীয় একতার জন্য এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে। তা হলে, কোন বিষয়টা আমাদেরকে প্রেম দেখানোর ক্ষেত্রে প্রশস্ত হতে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও ঐক্যবদ্ধ থাকতে সাহায্য করতে পারে? মণ্ডলীর সকলের প্রতি অকৃত্রিম উপলব্ধিবোধ থাকা আমাদেরকে একে অন্যের প্রতি আমাদের প্রেমকে গভীর করতে সাহায্য করবে।
কীভাবে আমরা অন্যদের প্রতি উপলব্ধি দেখাতে পারি? আমরা যদি আমাদের সহবিশ্বাসীদের প্রতি উপলব্ধি দেখাই, তা হলে আমরা তাদের প্রয়োজনগুলো অনুভব করি, তাদেরকে খুব মূল্যবান বলে গণ্য করি, আমরা তাদের ভাল গুণগুলো স্বীকার করি এবং তারা আমাদের সঙ্গে একত্রে উপাসনা করে বলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকি। ফলস্বরূপ, তাদের প্রতি আমাদের ভালবাসা অনেক বৃদ্ধি পায়। প্রেরিত পৌল করিন্থের প্রথম শতাব্দীর খ্রিস্টানদের উদ্দেশে যা লিখেছিলেন, তা সংক্ষেপে বিবেচনা করা আমাদেরকে বুঝতে সাহায্য করবে যে, কীভাবে আমরা যতটা সম্ভব পূর্ণমাত্রায় খ্রিস্টীয় প্রেম দেখাতে পারি।
করিন্থীয়রা ‘সঙ্কুচিত রহিয়াছে’
পৌল সা.কা. ৫৫ সালে করিন্থীয়দের উদ্দেশে তার প্রথম পত্র লিখেছিলেন এবং সেটার এক বছরের মধ্যেই দ্বিতীয় পত্র লিখেছিলেন। তার মন্তব্যগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, করিন্থীয় মণ্ডলীর মধ্যে কারো কারো তাদের সহবিশ্বাসীদের প্রতি উপলব্ধিবোধের অভাব ছিল। সেই পরিস্থিতিকে পৌল এই কথাগুলোর মাধ্যমে বর্ণনা করেছিলেন: “হে করিন্থীয়েরা, তোমাদের প্রতি আমাদের মুখ খোলা রহিয়াছে, আমাদের হৃদয় প্রশস্ত রহিয়াছে। তোমরা আমাদিগেতে সঙ্কুচিত নহ; কিন্তু আপন আপন অন্তরে সঙ্কুচিত রহিয়াছ।” (২ করিন্থীয় ৬:১১, ১২) পৌল যখন বলেছিলেন যে, তারা ‘সঙ্কুচিত রহিয়াছে,’ তখন তিনি কী বুঝিয়েছিলেন?
তিনি বুঝিয়েছিলেন যে, তারা হৃদয়ে সংকীর্ণ ও অনুদার ছিল। একজন বাইবেল পণ্ডিত মনে করেন যে, পৌলের প্রতি করিন্থীয়দের ভালবাসা “ভিত্তিহীন সন্দেহের কারণে পর্বতপ্রমাণ বিভিন্ন সমস্যা . . . এবং ক্ষতিকর গর্বের দ্বারা বাধাগ্রস্ত” হয়েছিল।
পৌল যে-পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা লক্ষ করুন: “আমি তোমাদিগকে বৎসের ন্যায় জানিয়া বলিতেছি, অনুরূপ প্রতিদানের জন্য তোমরাও প্রশস্ত হও।” (২ করিন্থীয় ৬:১৩) পৌল সহবিশ্বাসীদের প্রতি প্রেম দেখানোর ক্ষেত্রে প্রশস্ত হওয়ার জন্য করিন্থীয়দের উৎসাহিত করেছিলেন। এর অর্থ, অবিশ্বাসের সঙ্গে ও সংকীর্ণমনা হয়ে নয় বরং এক ইতিবাচক মনোভাব এবং উদার হৃদয়ের দ্বারা প্রণোদিত হওয়া।
আজকে প্রেম দেখানোর ক্ষেত্রে প্রশস্ত হওয়া
আজকে ঈশ্বরের সত্য উপাসকরা একে অন্যের প্রতি প্রেম দেখানোর ক্ষেত্রে প্রশস্ত হওয়ার জন্য যে-কঠোর প্রচেষ্টা করছে, তা দেখা হৃদয়কে স্পর্শ করে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, প্রশস্ত হওয়ার জন্য প্রচেষ্টার প্রয়োজন। এটা নিছক পুঁথিগত বিদ্যা নয়। প্রশস্ত হওয়ার জন্য আমাদের সেই লোকেদের থেকে ভিন্ন আচরণ করতে হবে, যারা বাইবেলের মানগুলো অনুযায়ী জীবনযাপন করে না। প্রায়ই এই ধরনের লোকেদের অন্যদের প্রতি খুব সামান্য উপলব্ধিবোধ থাকে। তারা অবিবেচক, ধৃষ্টতাপূর্ণ এবং বিদ্রূপকারী হতে পারে। তাই, আমরা যেন কখনোই এই ধরনের মনোভাবের দ্বারা নিজেদের প্রভাবিত হতে না দিই। যদি করিন্থীয়দের মতো আমাদের ভালবাসাও অবিশ্বাসের অনুভূতি দ্বারা ব্যাহত হয়, তবে তা কত দুঃখজনকই না হবে! আজকে তা ঘটতে পারে যদি আমরা কোনো খ্রিস্টান ভাইয়ের ভুলগুলো খুঁজতে সত্বর হই কিন্তু তার ভাল গুণাবলি স্বীকার করতে ধীর হই। এটা তখনও ঘটতে পারে, যখন ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে এসেছে বলে কারো প্রতি স্নেহ প্রদর্শনের ব্যাপারে আমরা সংকুচিত থাকি।
এর বিপরীতে, ঈশ্বরের যে-দাস প্রেম দেখানোর ক্ষেত্রে প্রশস্ত, তার সহবিশ্বাসীদের প্রতি অকৃত্রিম উপলব্ধিবোধ রয়েছে। তিনি তাদেরকে খুব মূল্যবান বলে গণ্য করেন, তাদের মর্যাদাকে সম্মান করেন এবং তাদের প্রয়োজনগুলো অনুভব করে থাকেন। এমনকি যখন অভিযোগ করার উপযুক্ত কারণও থাকে, তখনও তিনি ক্ষমা করতে ইচ্ছুক থাকেন এবং অসন্তোষ পুষে রাখেন না। এ ছাড়া, তিনি তার সহবিশ্বাসীদের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ করেন না। এক উদার হৃদয় তাকে সেই ধরনের প্রেম দেখাতে সাহায্য করে, যা এই ভবিষ্যদ্বাণী করার সময় যিশুর মনে ছিল: “তোমরা যদি আপনাদের মধ্যে পরস্পর প্রেম রাখ, তবে তাহাতেই সকলে জানিবে যে, তোমরা আমার শিষ্য।”—যোহন ১৩:৩৫.
গণ্ডির বাইরে যান এবং নতুন বন্ধু করুন
আন্তরিক প্রেম আমাদেরকে বন্ধুমহলের গণ্ডির বাইরে যেতে এবং মণ্ডলীর সেই ব্যক্তিদের সাহচর্য খুঁজতে সমর্থ করবে, যাদের সঙ্গে সাধারণত আমাদের তেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নেই। এই লোকেদের মধ্যে কারা থাকতে পারে? আমাদের খ্রিস্টান ভাইবোনদের মধ্যে কেউ কেউ লাজুক হতে পারে অথবা কোনো না কোনো কারণে তাদের বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা অল্প। প্রথমে আমরা হয়তো মনে করতে পারি যে, শুধুমাত্র একসঙ্গে উপাসনা করা ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে আমাদের মধ্যে তেমন আর কোনো মিল নেই। কিন্তু, এটা কি সত্য নয় যে, বাইবেলে লিপিবদ্ধ কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বও এমন ব্যক্তিদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল, যাদের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে খুব কম বিষয়েই মিল ছিল?
উদাহরণস্বরূপ, রূৎ ও নয়মী ভিন্ন প্রজন্মের ছিল, তাদের জাতি ও সংস্কৃতি, এমনকি তাদের মাতৃভাষাও আলাদা ছিল। তারপরও তাদের বন্ধুত্ব এই ধরনের বৈসাদৃশ্যের ঊর্ধ্বে ছিল। যোনাথন একজন রাজপুত্র হিসেবে এবং দায়ূদ একজন মেষপালক হিসেবে বড় হয়েছিল। তাদের মধ্যে বয়সের যথেষ্ট পার্থক্য ছিল কিন্তু তাদের বন্ধুত্ব পবিত্র শাস্ত্রে উল্লেখিত সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বগুলোর মধ্যে একটা। উভয় বন্ধুত্বের ক্ষেত্রেই, সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য তা আনন্দ ও আধ্যাত্মিক সমর্থনের এক উৎস হয়ে উঠেছিল।—রূতের বিবরণ ১:১৬; ৪:১৫; ১ শমূয়েল ১৮:৩; ২ শমূয়েল ১:২৬.
এমনকি আজকেও সত্য খ্রিস্টানদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, যারা ভিন্ন প্রজন্মের অথবা যাদের জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে আলাদা। উদাহরণস্বরূপ, রেজিনা হলেন একজন একক মা, যার কিশোরবয়সি দুটো সন্তান রয়েছে।a তার একটা ব্যস্ত তালিকা রয়েছে এবং সামাজিক মেলামেশা করার জন্য খুব কম সময়ই হাতে থাকে। হারাল্ট ও ইউটে হল অবসরপ্রাপ্ত বিবাহিত দম্পতি, যাদের কোনো সন্তান নেই। আপাতদৃষ্টিতে, এই দুটো পরিবারের মধ্যে খুব কম বিষয়েই মিল রয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু, হারাল্ট ও ইউটে প্রশস্ত হওয়ার বিষয়ে বাইবেলের পরামর্শ কাজে লাগিয়েছিল। তারা বিভিন্ন কাজে রেজিনা ও তার সন্তানদের জড়িত করার জন্য, তাদের সঙ্গে জনসাধারণ্যে পরিচর্যায় সময় ব্যয় ও কিছু বিনোদন উপভোগ করার জন্য নিজেদের গণ্ডির বাইরে গিয়েছিল।
আমরা কি পরিচিত বন্ধুমহলের বাইরে প্রশস্ত হতে পারি? অন্য জাতির, সংস্কৃতির অথবা ভিন্ন বয়সের সহবিশ্বাসীদের আরেকটু সাহচর্যে যেতে চেষ্টা করুন না কেন?
অন্যদের প্রয়োজনের প্রতি সাড়া দেওয়া
এক উদার হৃদয় আমাদেরকে অন্যদের প্রয়োজনগুলোর প্রতি মনোযোগ দিতে পরিচালিত করবে। কোন ধরনের প্রয়োজনের প্রতি? খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর সদস্যদের একটু লক্ষ করুন। অল্পবয়সিদের নির্দেশনা প্রয়োজন, বয়স্কদের উৎসাহ প্রয়োজন, পূর্ণসময়ের পরিচারকদের প্রশংসা ও সমর্থন প্রয়োজন এবং নিরুৎসাহিত সহবিশ্বাসীদের এমন কাউকে প্রয়োজন, যিনি তার কথা শুনবেন। প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো প্রয়োজন রয়েছে। আমরা যতটা সম্ভব যুক্তিসংগতভাবে এই প্রয়োজনগুলোর প্রতি সাড়া দিতে চাই।
এ ছাড়া, প্রশস্ত হওয়ার অর্থ যাদের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে, তাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখানো। আপনি কি এমন কাউকে চেনেন, যিনি দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছেন অথবা জীবনের অন্য কোনো পরীক্ষার সঙ্গে মোকাবিলা করছেন? প্রেম দেখানোর ক্ষেত্রে প্রশস্ত হওয়া এবং এক উদার হৃদয় গড়ে তোলা আমাদেরকে, প্রয়োজন রয়েছে এমন ব্যক্তিদের প্রতি সহমর্মী ও সমর্থনকারী হতে সাহায্য করবে।
নিকট ভবিষ্যতের জন্য বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো যখন পরিপূর্ণ হবে, তখন মণ্ডলীর মধ্যে একতার দৃঢ় বন্ধন ধনসম্পদ, ক্ষমতা অথবা সাফল্যের চেয়েও আরও মূল্যবান বলে গণ্য হবে। (১ পিতর ৪:৭, ৮) আমাদের সহবিশ্বাসীদের প্রতি প্রেম দেখানোর ক্ষেত্রে প্রশস্ত হওয়ার মাধ্যমে আমরা প্রত্যেকে আমাদের নিজ নিজ মণ্ডলীর একতার বন্ধনকে শক্তিশালী করার জন্য ব্যক্তিগতভাবে অবদান রাখতে পারি। আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি যে, যিহোবা আমাদের প্রচুররূপে আশীর্বাদ করবেন যদি আমরা তাঁর পুত্র যিশু খ্রিস্টের বলা এই কথাগুলোর সঙ্গে মিল রেখে কাজ করি, যিনি বলেছিলেন: “আমার আজ্ঞা এই, তোমরা পরস্পর প্রেম কর, যেমন আমি তোমাদিগকে প্রেম করিয়াছি।”—যোহন ১৫:১২.
[পাদটীকা]
a কিছু নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।
[১০ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]
আমাদের ভাইবোনদের প্রতি উপলব্ধি দেখানোর অর্থ আমরা তাদের সকলকে খুব মূল্যবান বলে গণ্য করি, তাদের মর্যাদাকে সম্মান করি এবং তাদের প্রয়োজনগুলো অনুভব করি