অধ্যায় চার
কীভাবে আপনি একটা ঘর সামলাতে পারেন?
১. কেন একটা ঘর সামলানো বর্তমানে এত কঠিন হতে পারে?
“জগতের রূপ বদলে যাচ্ছে।” (১ করিন্থীয় ৭:৩১, বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারসন) এই কথাগুলো ১,৯০০ বছরেরও বেশি সময় আগে লেখা হয়েছিল আর তা আজকেও কতই না সত্য! বিভিন্ন বিষয়, বিশেষ করে পারিবারিক জীবনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিষয়গুলো বদলে যাচ্ছে। ৪০ অথবা ৫০ বছর আগে যেটাকে স্বাভাবিক বা পরম্পরাগত হিসেবে দেখা হতো, তা বর্তমানে প্রায়ই গ্রহণযোগ্য নয়। এই কারণে সফলভাবে একটা ঘর সামলানো অনেক বড় বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে আসতে পারে। তবে, যদি শাস্ত্রীয় পরামর্শে মনোযোগ দেওয়া হয়, তাহলে আপনি সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলো মোকাবিলা করতে পারবেন।
আয় বুঝে ব্যয় করুন
২. কোন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিগুলো পরিবারের মধ্যে চাপ নিয়ে আসে?
২ আজকে অনেক লোক সাধারণ, সাংসারিক জীবন নিয়ে আর সন্তুষ্ট নয়। বাণিজ্যিক জগৎ জনগণকে প্রলুব্ধ করার জন্য যতই বেশি বেশি পণ্য উৎপন্ন করছে এবং বিজ্ঞাপনের দক্ষতা ব্যবহার করছে, ততই লক্ষ লক্ষ বাবা ও মা কর্মক্ষেত্রে দীর্ঘসময় ব্যয় করে থাকে, যাতে তারা এইসমস্ত পণ্যদ্রব্য কিনতে পারে। অন্যান্য লক্ষ লক্ষ বাবা-মা কেবল সামান্য খাবার জোগাড় করতে গিয়েই রোজকার সংগ্রামের মুখোমুখি হয়ে থাকে। তাদেরকে কর্মক্ষেত্রে আগের চেয়ে আরও অনেক বেশি সময় ব্যয় করতে হয়, হয়তো কেবল অপরিহার্য বিষয়গুলোর জন্য অর্থসংস্থান করতে দুটো চাকরি করতে হয়। আবার, অন্যেরা একটা চাকরি পেলেই খুশি হবে, যেহেতু বেকারত্ব এক ব্যাপক সমস্যা। হ্যাঁ, আধুনিক পরিবারের জন্য জীবন সবসময় সহজ নয় কিন্তু বাইবেলের নীতিগুলো পরিবারগুলোকে তাদের পরিস্থিতি অনুযায়ী সর্বোত্তমটা করার জন্য সাহায্য করতে পারে।
৩. প্রেরিত পৌল কোন নীতি সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন আর তা প্রয়োগ করা কীভাবে একজন ব্যক্তিকে একটা ঘর সামলানোর ক্ষেত্রে সফল হতে সাহায্য করতে পারে?
৩ প্রেরিত পৌল অর্থনৈতিক চাপের মুখোমুখি হয়েছিলেন। সেগুলোর মোকাবিলা করতে গিয়ে তিনি এক মূল্যবান শিক্ষা লাভ করেছেন, যা তিনি তার বন্ধু তীমথিয়ের কাছে লেখা তার চিঠিতে ব্যাখ্যা করেছেন। পৌল লেখেন: “আমরা জগতে কিছুই সঙ্গে আনি নাই, কিছুই সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতেও পারি না; কিন্তু গ্রাসাচ্ছাদন পাইলে আমরা তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকিব।” (১ তীমথিয় ৬:৭, ৮) এটা ঠিক যে, একটা পরিবারের জন্য কেবল খাদ্য ও বস্ত্রের চেয়ে আরও বেশি কিছুর প্রয়োজন। এর জন্য বাসস্থানেরও প্রয়োজন। সন্তানদের শিক্ষার প্রয়োজন। এ ছাড়াও রয়েছে চিকিৎসা এবং অন্যান্য বিষয়ের খরচ। তা সত্ত্বেও, পৌলের কথাগুলোর নীতিটা প্রযোজ্য। আমরা যা চাই, সেগুলো পূরণ করার পরিবর্তে যদি আমাদের চাহিদাগুলো মিটিয়ে সন্তুষ্ট থাকি, তাহলে জীবন আরও সহজ হবে।
৪, ৫. কীভাবে আগে থেকেই চিন্তা করা এবং পরিকল্পনা করা ঘর সামলাতে সাহায্য করতে পারে?
৪ আরেকটা উপকারী নীতি যিশুর একটা দৃষ্টান্ত থেকে পাওয়া যায়। তিনি বলেছিলেন: “দুর্গ নির্ম্মাণ করিতে ইচ্ছা হইলে তোমাদের মধ্যে কে অগ্রে বসিয়া ব্যয় হিসাব করিয়া না দেখিবে, সমাপ্ত করিবার সঙ্গতি তাহার আছে কি না?” (লূক ১৪:২৮) এখানে যিশু আগে থেকেই চিন্তা করার অর্থাৎ পূর্বপরিকল্পনা করার বিষয়ে বলছেন। আগের একটা অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে, যখন অল্পবয়সি কোনো যুগল বিয়ে করার চিন্তাভাবনা করে থাকে, তখন কীভাবে এটা সাহায্য করে থাকে। আর বিয়ে করার পর একটা ঘর সামলানোর ক্ষেত্রেও তা উপকারী। এই ক্ষেত্রটাতে আগে থেকেই চিন্তা করার অন্তর্ভুক্ত বাজেট করা, যে-সম্পদগুলো ইতিমধ্যেই রয়েছে, সেগুলো বিজ্ঞতার সঙ্গে ব্যবহার করার জন্য পূর্বপরিকল্পনা করা। এভাবে একটা পরিবার খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহে অপরিহার্য জিনিসপত্র কেনার জন্য টাকাপয়সা আলাদা করে রাখতে পারে এবং আয়ের অতিরিক্ত ব্যয় করে না।
৫ কিছু দেশে, এই ধরনের বাজেট করার অর্থ হতে পারে অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটার জন্য চড়া সুদে ঋণ নেওয়ার চাপ প্রতিরোধ করা। অন্যান্য দেশে এর অর্থ হতে পারে, ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারকে কড়াকড়িভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। (হিতোপদেশ ২২:৭) এ ছাড়া এর অর্থ হতে পারে যে, ঝোঁকের বশে কেনাকাটা করে ফেলার—চাহিদা ও ফলাফলের কথা চিন্তা না করেই হুট করে কিছু কিনে ফেলার—বিষয়টা রোধ করা। অধিকন্তু, বাজেট করা এই বিষয়টা স্পষ্ট করবে যে, জুয়াখেলা, তামাক সেবন করা এবং অতিরিক্ত মদ্যপান করার জন্য স্বার্থপরভাবে টাকাপয়সা অপচয় করা পরিবারের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ও সেইসঙ্গে সেগুলো বাইবেলের নীতির বিপরীত।—হিতোপদেশ ২৩:২০, ২১, ২৯-৩৫; রোমীয় ৬:১৯; ইফিষীয় ৫:৩-৫.
৬. কোন শাস্ত্রীয় সত্যগুলো সেই ব্যক্তিদের সাহায্য করে, যাদের দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করতে হচ্ছে?
৬ কিন্তু, তাদের সম্বন্ধে কী বলা যায়, যারা দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করতে বাধ্য হয়? একটা বিষয় হল এটা জেনে তারা সান্ত্বনা লাভ করতে পারে যে, বিশ্বব্যাপী এই সমস্যা কেবল ক্ষণস্থায়ী। দ্রুত আসন্ন নতুন জগতে, যিহোবা দারিদ্র্য ও সেইসঙ্গে অন্যান্য সমস্ত মন্দতা দূর করে দেবেন, যেগুলো মানবজাতির জন্য দুর্দশা নিয়ে আসে। (গীতসংহিতা ৭২:১, ১২-১৬) সেই সময় না আসা পর্যন্ত, সত্য খ্রিস্টানরা এমনকি তারা যদি অত্যন্ত দরিদ্রও হয়ে থাকে, একেবারে হতাশ হয় না কারণ যিহোবার এই প্রতিজ্ঞায় তাদের বিশ্বাস রয়েছে: “আমি কোন ক্রমে তোমাকে ছাড়িব না, ও কোন ক্রমে তোমাকে ত্যাগ করিব না।” অতএব, একজন বিশ্বাসী আস্থার সঙ্গে বলতে পারেন: “প্রভু [“যিহোবা,” NW] আমার সহায়, আমি ভয় করিব না।” (ইব্রীয় ১৩:৫, ৬) এই কঠিন সময়ে, যিহোবা তাঁর উপাসকদের অনেক উপায়ে সমর্থন করেছেন, যখন তারা তাঁর নীতি অনুযায়ী জীবনযাপন করে এবং তাঁর রাজ্যকে তাদের জীবনে প্রথমে রাখে। (মথি ৬:৩৩) তাদের মধ্যে অনেকে প্রমাণ দিতে এবং প্রেরিত পৌলের মতো এই কথা বলতে পারে: “প্রত্যেক বিষয়ে ও সর্ব্ববিষয়ে আমি তৃপ্ত কি ক্ষুধিত হইতে, এবং উপচয় কি অনাটন ভোগ করিতে দীক্ষিত হইয়াছি। যিনি আমাকে শক্তি দেন, তাঁহাতে আমি সকলই করিতে পারি।”—ফিলিপীয় ৪:১২, ১৩.
দায়িত্বের ভার ভাগ করে নেওয়া
৭. যিশুর কোন কথাগুলো প্রয়োগ করা হলে, তা ঘর সামলানোর ক্ষেত্রে সফল হতে সাহায্য করবে?
৭ যিশু তাঁর পার্থিব পরিচর্যার শেষ দিকে বলেছিলেন: “তোমার প্রতিবাসীকে আপনার মত প্রেম করিবে।” (মথি ২২:৩৯) পরিবারে এই পরামর্শ প্রয়োগ করা ঘর সামলানোর ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করে। বস্তুতপক্ষে, পরিবারের সদস্যরাই—স্বামী ও স্ত্রী, বাবা-মা ও সন্তানই—কি আমাদের সবচেয়ে কাছের এবং প্রিয় প্রতিবেশী নয়? কীভাবে পরিবারের সদস্যরা একে অপরের প্রতি প্রেম দেখাতে পারে?
৮. কীভাবে পরিবারের মধ্যে প্রেম দেখানো যেতে পারে?
৮ একটা উপায় হল, ঘরের টুকিটাকি কাজে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের তাদের যথাসাধ্য করা। এভাবে, সন্তানদের শেখাতে হবে যে, জিনিসপত্র ব্যবহার করার পর সেগুলো ঠিক জায়গায় রাখতে হবে, হোক তা কাপড়চোপড় বা খেলনাপাতি। প্রতিদিন সকালে বিছানা গোছাতে হয়তো সময় ও প্রচেষ্টার প্রয়োজন কিন্তু ঘর সামলানোর ক্ষেত্রে এটা এক বড় সাহায্য। অবশ্য, কিছু ছোটোখাটো ক্ষণস্থায়ী বিশৃঙ্খলা এড়ানো যায় না কিন্তু ঘরকে যথাসম্ভব পরিপাটী ও সেইসঙ্গে খাবারের পর পরিষ্কার রাখার জন্য সকলে একসঙ্গে কাজ করতে পারে। প্রত্যেকের ওপরই অলসতা, আত্মসুখপরায়ণতা এবং অনিচ্ছুক ও অনীহা মনোভাবের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। (হিতোপদেশ ২৬:১৪-১৬) অন্যদিকে, হাসিখুশি, ইচ্ছুক মনোভাব এক সুখী পারিবারিক জীবনকে টিকিয়ে রাখে। “ঈশ্বর হৃষ্টচিত্ত দাতাকে ভাল বাসেন।”—২ করিন্থীয় ৯:৭.
৯, ১০. (ক) কোন দায়িত্বের ভার প্রায়ই ঘরের মহিলার ওপর অর্পিত হয় আর কীভাবে তা হালকা করা যেতে পারে? (খ) ঘরের কাজ সম্বন্ধে কোন ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে?
৯ বিবেচনাবোধ ও প্রেম সেই পরিস্থিতিকে রোধ করতে সহায়তা করবে, যা কোনো কোনো বাড়িতে এক গুরুতর সমস্যা। সাধারণত মায়েরাই পারিবারিক জীবনের প্রধান অবলম্বন। তারা সন্তানদের যত্ন নিয়ে থাকে, ঘরদোর পরিষ্কার করে, পরিবারের সদস্যদের কাপড়চোপড় ধুয়ে থাকে এবং কেনাকাটা করে ও রান্না করে। এ ছাড়া, কিছু দেশে মহিলাদেরকে সাধারণত জমিতে কাজ করতে হয়, বাজারে জিনিসপত্র বিক্রি করতে হয় এবং অন্যান্য উপায়ে পরিবারের আয়-ব্যয়ে অবদান রাখতে হয়। এমনকি যেখানে আগে রীতি ছিল না, সেখানেও লক্ষ লক্ষ মহিলা প্রয়োজনের তাগিদে ঘরের বাইরে চাকরি খুঁজতে বাধ্য হয়েছে। যে-স্ত্রী ও মা এই ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে কঠোর পরিশ্রম করে থাকেন, তিনি প্রশংসার যোগ্য। বাইবেলে বর্ণিত ‘গুণবতী স্ত্রীর’ মতো তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমী। “তিনি আলস্যের খাদ্য খান না।” (হিতোপদেশ ৩১:১০, ২৭) তবে, এর অর্থ এই নয় যে, ঘরের কাজকর্ম কেবল মহিলাই করবেন। স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই সারাদিন ঘরের বাইরে কাজ করার পর, কেবল স্ত্রীকেই কি ঘরের কাজের ভার বহন করতে হবে আর অন্যদিকে স্বামী ও পরিবারের বাকি সকলে আরাম করবে? অবশ্যই না। (তুলনা করুন, ২ করিন্থীয় ৮:১৩, ১৪.) তাই, উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মা যদি খাবার তৈরি করতে যান, তাহলে তিনি হয়তো কৃতজ্ঞ হবেন যদি পরিবারের অন্য সদস্যরা টেবিল গোছানোর, কিছু কেনাকাটা করার অথবা বাড়ির চারপাশটা একটু পরিষ্কার করার দ্বারা প্রস্তুতিতে সাহায্য করে। হ্যাঁ, সকলে দায়িত্ব ভাগ করে নিতে পারে।—তুলনা করুন, গালাতীয় ৬:২.
১০ কেউ কেউ হয়তো বলতে পারে: “আমি যেখানে বাস করি, সেখানে এই ধরনের বিষয় করা পুরুষের কাজ নয়।” এটা হয়তো সত্য কিন্তু এই বিষয়টায় কিছুটা মনোযোগ দেওয়া কি উত্তম হবে না? যিহোবা ঈশ্বর যখন পরিবারের সূচনা করেছিলেন, তখন তিনি এইরকম নির্দেশ দেননি যে, নির্দিষ্ট কিছু কাজ কেবল নারীরাই করবে। একবার বিশ্বস্ত ব্যক্তি অব্রাহামের কাছে যখন যিহোবার কাছ থেকে বিশেষ বার্তাবাহকরা সাক্ষাৎ করতে এসেছিল, তখন তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রস্তুতির কাজে অংশ নিয়েছিলেন এবং সেই অতিথিদের জন্য খাবার পরিবেশন করেছিলেন। (আদিপুস্তক ১৮:১-৮) বাইবেল পরামর্শ দেয়: “স্বামীরাও আপন আপন স্ত্রীকে আপন আপন দেহ বলিয়া প্রেম করিতে বাধ্য।” (ইফিষীয় ৫:২৮) দিনের শেষে স্বামী যদি ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং বিশ্রাম নিতে চান, তাহলে সম্ভবত স্ত্রীও কি একইরকম, হয়তো আরও বেশি অনুভব করবেন না? (১ পিতর ৩:৭) তাই, ঘরে স্ত্রীকে সাহায্য করা কি স্বামীর জন্য উপযুক্ত ও প্রেমময় কাজ হবে না?—ফিলিপীয় ২:৩, ৪.
১১. কোন উপায়ে যিশু পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য এক উত্তম উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন?
১১ যিশু হলেন সর্বোত্তম উদাহরণ, যিনি ঈশ্বরকে খুশি করেছিলেন এবং তাঁর সঙ্গীদের জন্য আনন্দ নিয়ে এসেছিলেন। যদিও তিনি কখনো বিয়ে করেননি কিন্তু যিশু হলেন স্বামীদের ও সেইসঙ্গে স্ত্রী এবং সন্তানদের জন্য এক উত্তম উদাহরণ। তিনি নিজে বলেছিলেন: “মনুষ্যপুত্ত্র পরিচর্য্যা পাইতে আইসেন নাই, কিন্তু পরিচর্য্যা করিতে, এবং অনেকের পরিবর্ত্তে আপন প্রাণ মুক্তির মূল্যরূপে দিতে আসিয়াছেন।” (মথি ২০:২৮) সেই পরিবারগুলো কতই না আনন্দিত, যেখানে সমস্ত সদস্য এইরকম এক মনোভাব গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করে!
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা—কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
১২. যারা যিহোবাকে সেবা করে, তাদের কাছ থেকে তিনি কী চান?
১২ বাইবেলের আরেকটা যে-নীতি ঘর সামলানোর ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে, তা ২ করিন্থীয় ৭:১ পদে পাওয়া যায়। সেখানে আমরা পড়ি: “আইস, আমরা মাংসের ও আত্মার সমস্ত মালিন্য হইতে আপনাদিগকে শুচি করি।” যারা এই অনুপ্রাণিত বাক্যগুলো মেনে চলে, তারা যিহোবার কাছে গ্রহণযোগ্য, যিনি “শুচি ও বিমল ধর্ম্ম” চান। (যাকোব ১:২৭) আর তাদের পরিজনেরা এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত উপকারগুলো লাভ করে থাকে।
১৩. ঘর সামলানোর ক্ষেত্রে কেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা গুরুত্বপূর্ণ?
১৩ উদাহরণস্বরূপ, বাইবেল আমাদের আশ্বাস দেয় যে, এমন দিন আসবে যখন রোগব্যাধি ও অসুস্থতা আর থাকবে না। সেই সময় “নগরবাসী কেহ বলিবে না, আমি পীড়িত।” (যিশাইয় ৩৩:২৪; প্রকাশিত বাক্য ২১:৪, ৫) কিন্তু, সেই সময় না আসা পর্যন্ত প্রত্যেক পরিবারকে সময়ে সময়ে অসুস্থতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। এমনকি পৌল এবং তীমথিয়ও অসুস্থ হয়েছিল। (গালাতীয় ৪:১৩; ১ তীমথিয় ৫:২৩) তা সত্ত্বেও, চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলে যে, বেশিরভাগ অসুস্থতা প্রতিরোধ করা যায়। বিজ্ঞ পরিবারগুলো প্রতিরোধযোগ্য কিছু অসুস্থতা থেকে রেহাই পায়, যদি তারা মাংসিক ও আধ্যাত্মিক অশুচিতা এড়িয়ে চলে। আসুন আমরা বিবেচনা করি যে, কীভাবে তা করে।—তুলনা করুন, হিতোপদেশ ২২:৩.
১৪. কোন উপায়ে নৈতিক শুচিতা একটা পরিবারকে অসুস্থতা থেকে রক্ষা করতে পারে?
১৪ আধ্যাত্মিক শুচিতার অন্তর্ভুক্ত নৈতিক শুচিতা। সবাই যেমন জানে যে, বাইবেল উচ্চ নৈতিক মান সম্বন্ধে তুলে ধরে এবং বিয়ের বাইরে যেকোনো ধরনের যৌনসম্পর্ককে নিন্দা করে। “যাহারা ব্যভিচারী . . . কি পারদারিক কি স্ত্রীবৎ আচারী কি পুঙ্গামী . . . তাহারা ঈশ্বরের রাজ্যে অধিকার পাইবে না।” (১ করিন্থীয় ৬:৯, ১০) এই কঠোর মানগুলো মেনে চলা সেই খ্রিস্টানদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যারা আজকের অধঃপতিত জগতে বাস করছে। তা করা ঈশ্বরকে খুশি করে এবং পরিবারকে যৌনবাহিত রোগব্যাধি থেকেও রক্ষা পেতে সাহায্য করে যেমন, এইডস, সিফিলিস, গনোরিয়া এবং ক্লামিডিয়া।—হিতোপদেশ ৭:১০-২৩.
১৫. দৈহিক শুচিতার অভাবের একটা উদাহরণ দিন, যা অযথা অসুস্থতার কারণ হতে পারে।
১৫ ‘মাংসের সমস্ত মালিন্য হইতে নিজেদেরকে শুচি করা’ পরিবারকে অন্যান্য অসুস্থতা থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। অনেক রোগ দৈহিক শুচিতার অভাবের কারণে হয়ে থাকে। একটা প্রধান উদাহরণ হল, ধূমপানের অভ্যাস। ধূমপান কেবল ফুসফুস, কাপড়চোপড় এবং বাতাসকেই নোংরা করে না কিন্তু সেইসঙ্গে এটা লোকেদেরও অসুস্থ করে দেয়। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ লোক তামাক সেবনের কারণে মারা যায়। এই বিষয়ে চিন্তা করুন; প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ লোক অসুস্থ হতো না ও অকালে মারা যেত না, যদি কিনা তারা ‘মাংসের মালিন্য’ এড়িয়ে চলত!
১৬, ১৭. (ক) যিহোবাদত্ত কোন আইন ইস্রায়েলীয়দের কিছু অসুস্থতা থেকে সুরক্ষা করেছিল? (খ) দ্বিতীয় বিবরণ ২৩:১২, ১৩ পদের পিছনে যে-নীতিটা রয়েছে, সেটা কীভাবে সমস্ত ঘরের প্রতি প্রযোজ্য হতে পারে?
১৬ আরেকটা উদাহরণ বিবেচনা করুন। প্রায় ৩,৫০০ বছর আগে, ঈশ্বর ইস্রায়েল জাতিকে তাদের উপাসনা এবং কিছুটা হলেও তাদের রোজকার জীবনকে সংগঠিত করার জন্য তাঁর ব্যবস্থা দিয়েছিলেন। স্বাস্থ্যসম্মত কিছু মৌলিক নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা ইস্রায়েল জাতিকে রোগব্যাধি থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করেছিল। এর মধ্যে একটা আইন মানুষের মলত্যাগ করার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল, যা শিবিরের বাইরে সঠিকভাবে ঢেকে দিতে হতো যাতে লোকেরা যেখানে বাস করে, সেই এলাকা দূষিত না হয়। (দ্বিতীয় বিবরণ ২৩:১২, ১৩) সেই প্রাচীন আইন আজকের জন্যও উত্তম পরামর্শ। এমনকি আজকেও লোকেরা অসুস্থ হয় ও মারা যায় কারণ তারা এটা অনুসরণ করে না।a
১৭ এই ইস্রায়েলীয় আইনের পিছনে যে-নীতিটা রয়েছে, সেটার সঙ্গে মিল রেখে পরিবারের স্নানাগার ও শৌচাগার—হোক তা বাড়ির ভিতরে অথবা বাইরে—পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং দূষণমুক্ত রাখা উচিত। শৌচাগারের আশেপাশে যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না থাকে ও তা ঢেকে রাখা না হয়, তাহলে সেখানে মাছি আসবে আর বাড়ির অন্যান্য স্থানে—এবং আমরা যে-খাবার খাই, সেখানে—জীবাণু ছড়াবে! অধিকন্তু, সেই জায়গাগুলো ব্যবহার করার পর ছেলে-মেয়ে ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের হাত ধোয়া উচিত। নতুবা তারা তাদের ত্বকের সঙ্গে করে জীবাণু নিয়ে আসবে। ফ্রান্সের একজন ডাক্তারের কথা অনুযায়ী, হাত ধোয়া হল “এখনও কিছু পরিপাক, শ্বাসপ্রশ্বাস অথবা ত্বক সংক্রান্ত সংক্রমণ প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম সুরক্ষা।”
১৮, ১৯. এমনকি দরিদ্র এলাকার মধ্যেও একটা ঘরকে পরিষ্কার রাখার জন্য কোন পরামর্শগুলো দেওয়া হয়েছে?
১৮ এটা ঠিক যে, দরিদ্র এলাকাগুলোতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এক কঠিন বিষয়। এই ধরনের এলাকার সঙ্গে পরিচিত একজন ব্যক্তি বলেন: “অত্যন্ত গরম আবহাওয়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজকে দ্বিগুণ কষ্টকর করে তোলে। ধুলোর ঝড়ের কারণে বাড়ির প্রতিটা কোণায় বাদামি ধুলোর স্তর পড়ে। . . . শহরগুলোতে ও সেইসঙ্গে কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে দ্রুতহারে জনসংখ্যার বৃদ্ধিও স্বাস্থ্যের পক্ষে ঝুঁকির সৃষ্টি করে। উন্মুক্ত পয়োনালি, পড়ে থাকা ময়লার স্তূপ, নোংরা গণশৌচাগার, রোগবহনকারী ইঁদুর, তেলাপোকা এবং মাছি এক সাধারণ দৃশ্য হয়ে উঠেছে।”
১৯ এই ধরনের অবস্থায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা কঠিন। তা সত্ত্বেও, প্রচেষ্টা সার্থক হয়ে থাকে। সাবান এবং জল ও সামান্য বাড়তি কাজ, ওষুধপত্র এবং হাসপাতালের খরচের চেয়ে খুবই সস্তা। আপনি যদি এইরকম এক পরিবেশে বাস করেন, তাহলে যতদূর সম্ভব আপনার নিজের ঘর ও উঠোন পরিষ্কার রাখুন এবং পশুপাখির মল থেকে মুক্ত রাখুন। আপনার বাড়ির পথটা যদি সাধারণত বৃষ্টির সময় কর্দমাক্ত হয়ে থাকে, তাহলে ঘরের মধ্যে যেন কাদা না আসে, সেইজন্য আপনি কি সেখানে কাঁকর অথবা পাথর বিছিয়ে দিতে পারেন? যদি জুতো অথবা স্যান্ডেল ব্যবহার করা হয়, তাহলে পরিহিত ব্যক্তি বাড়িতে প্রবেশ করার আগেই কি সেই কাদা দূর করা যেতে পারে? এ ছাড়া, আপনার জল সরবরাহকেও দূষণমুক্ত রাখতে হবে। হিসেব করে দেখা গিয়েছে যে, প্রতি বছর কমপক্ষে কুড়ি লক্ষ লোক দূষিত জল ও খারাপ স্বাস্থ্যবিধির কারণে ঘটিত ডায়ারিয়ার জন্য মারা যায়।
২০. ঘরকে যদি পরিষ্কার রাখতে হয়, তাহলে কাদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হবে?
২০ একটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাড়ি প্রত্যেকের ওপর নির্ভর করে—মা, বাবা, ছেলে-মেয়ে ও অতিথি। কেনিয়ায় আট সন্তানের একজন মা বলেছিলেন: “সকলে তাদের নিজ নিজ অংশটুকু করতে শিখেছে।” এক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটী বাড়ি পুরো পরিবারের ওপর ভাল প্রভাব ফেলে। একটা স্প্যানিশ প্রবাদ বলে: “দারিদ্র্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মধ্যে কোনো সংঘর্ষ নেই।” একজন ব্যক্তি বৃহৎ অট্টালিকা, অ্যাপার্টমেন্ট, সাধারণ বাড়ি অথবা চালাঘর, যেখানেই বাস করুন না কেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা হল স্বাস্থ্যকর পরিবারের এক চাবিকাঠি।
উৎসাহ আমাদের সমৃদ্ধ করে
২১. হিতোপদেশ ৩১:২৮ পদের সঙ্গে মিল রেখে কী একটা ঘরে সুখ আনতে সাহায্য করবে?
২১ একজন গুণবতী স্ত্রী সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে হিতোপদেশ বই বলে: “তাঁহার সন্তানগণ উঠিয়া তাঁহাকে ধন্য বলে; তাঁহার স্বামীও বলেন, আর তাঁহার . . . প্রশংসা করেন।” (হিতোপদেশ ৩১:২৮) আপনি শেষবার কখন আপনার পরিবারের একজন সদস্যের প্রশংসা করেছিলেন? আসলে, আমরা হলাম বসন্তকালের চারাগাছের মতো, যা কিছুটা উষ্ণতা ও আর্দ্রতা লাভ করলে ফুল ফোটার জন্য তৈরি হয়। আমাদের ক্ষেত্রে উষ্ণ প্রশংসা প্রয়োজন। এটা জানা স্ত্রীকে সাহায্য করে যে, তার স্বামী তার কঠোর পরিশ্রম ও প্রেমময় যত্নকে উপলব্ধি করেন এবং তিনি তাকে হালকাভাবে নেন না। (হিতোপদেশ ১৫:২৩; ২৫:১১) আর এটাও মনোরম, যখন একজন স্ত্রী তার স্বামীকে বাড়ির বাইরে ও ভিতরে কাজ করার জন্য প্রশংসা করেন। ছেলে-মেয়েরাও বিকশিত হয়, যখন তাদের বাবা-মা বাড়িতে, স্কুলে এবং খ্রিস্টীয় মণ্ডলীতে তাদের প্রচেষ্টার জন্য প্রশংসা করে। আর সামান্য এক কৃতজ্ঞতা কত বড় কিছুই না সম্পাদন করে! “ধন্যবাদ,” এই শব্দটি বলতে কতটুকুই বা মূল্যের প্রয়োজন হয়? খুবই কম, অথচ পরিবারের মনোবলের ক্ষেত্রে এর প্রাপ্তি প্রচুর হতে পারে।
২২. একটা ঘর “স্থিরীকৃত” হওয়ার জন্য কীসের প্রয়োজন আর কীভাবে তা লাভ করা যেতে পারে?
২২ অনেক কারণে একটা ঘর সামলানো সহজ নয়। তা সত্ত্বেও, এটা সফলতার সঙ্গে করা যায়। বাইবেলের একটা প্রবাদ বলে: “প্রজ্ঞা দ্বারা গৃহ নির্ম্মিত হয়, আর বুদ্ধি দ্বারা তাহা স্থিরীকৃত হয়।” (হিতোপদেশ ২৪:৩) প্রজ্ঞা ও বুদ্ধি লাভ করা যেতে পারে, যদি পরিবারের সকলে ঈশ্বরের ইচ্ছা সম্বন্ধে শেখার এবং সেগুলো তাদের জীবনে প্রয়োগ করার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা করে। এক সুখী পরিবার নিশ্চিতভাবেই প্রচেষ্টাকে সার্থক করে তোলে!
a কীভাবে ডায়ারিয়া—যে-সাধারণ রোগের কারণে অনেক শিশুর মৃত্যু ঘটে—এড়ানো যায়, সেই বিষয়ে উপদেশ দিতে গিয়ে একটি পুস্তিকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উল্লেখ করে: “যখন কোনো শৌচাগার থাকে না: বাড়ি এবং যেখানে ছেলে-মেয়েরা খেলা করে, সেই জায়গাগুলো ও সেইসঙ্গে জল সরবরাহের স্থান থেকে অন্ততপক্ষে ১০ মিটার দূরে মলত্যাগ করুন; মল মাটি দিয়ে চাপা দিন।”