তীত “তোমাদের পক্ষে . . . সহকারী”
প্রথম শতাব্দীর খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীতে মাঝে মাঝে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিত। সেগুলি সমাধান করতে হতো, ফলে সাহস ও বাধ্যতার প্রয়োজন ছিল। তীত ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি সফলতার সঙ্গে একাধিকবার এইধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মোকাবিলা করেছিলেন। প্রেরিত পৌলের একজন সহকর্মী হিসাবে তিনি যিহোবার পথে কাজ করতে অন্যদের সাহায্য করার জন্য ঐকান্তিক প্রচেষ্টা করেছিলেন। তাই পৌল করিন্থের খ্রীষ্টানদের বলেছিলেন যে তীত ‘তাদের পক্ষে . . . সহকারী’ ছিলেন।—২ করিন্থীয় ৮:২৩.
তীত কে ছিলেন? তিনি বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করার ক্ষেত্রে কী ভূমিকা পালন করেছিলেন? আর আমরা তার আচরণ বিবেচনা করার মাধ্যমে কিভাবে উপকার লাভ করতে পারি?
ত্বকচ্ছেদসংক্রান্ত বিচার্য বিষয়টি
তীত একজন অছিন্নত্বক গ্রিক ছিলেন। (গালাতীয় ২:৩)a পৌল যেহেতু তাকে “বিশ্বাস সম্বন্ধে আমার যথার্থ বৎস” বলে অভিহিত করেন, তাই তীত হয়তো এই প্রেরিতের আধ্যাত্মিক সন্তানদের মধ্যে একজন ছিলেন। (তীত ১:৪. ১ তীমথিয় ১:২ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।) ত্বকচ্ছেদসংক্রান্ত প্রশ্নের মীমাংসা করার জন্য প্রায় সা.কা. ৪৯ সালে পৌল, বার্ণবা এবং সুরিয়ার আন্তিয়খিয়া থেকে অন্যান্যরা যখন যিরূশালেমে গিয়েছিলেন, তখন তীতও তাদের সঙ্গে ছিলেন।—প্রেরিত ১৫:১, ২; গালাতীয় ২:১.
যিরূশালেমে যেহেতু অছিন্নত্বক পরজাতীয়দের ধর্মান্তরের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছিল, তাই ধারণা করা হয় যে তীতকেও সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল এটি দেখানোর জন্য যে যিহূদী ও ন-যিহূদী উভয়েই ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করতে পারেন, তা তারা ছিন্নত্বক হোক বা না হোক। যিরূশালেম মণ্ডলীর কয়েকজন সদস্য যারা খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করার পূর্বে ফরীশী ছিলেন, তারা যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে ধর্মান্তরিত পরজাতীয়রা ত্বকচ্ছেদ করতে এবং ব্যবস্থা মানতে বাধ্য ছিলেন কিন্তু এই যুক্তিকে প্রতিরোধ করা হয়েছিল। তীত এবং অন্যান্য পরজাতীয়দের ত্বকচ্ছেদ করতে বাধ্য করা হলে, পরিত্রাণ যে ব্যবস্থার কাজের উপর নয় বরঞ্চ যিহোবার অযাচিত করুণা এবং যীশু খ্রীষ্টে বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে তা অস্বীকার করা হত। এছাড়াও তাদের ত্বকচ্ছেদ করতে বাধ্য করা হলে, পরজাতীয় কিংবা অন্য জাতির লোকেরা যে ঈশ্বরের পবিত্র আত্মা লাভ করেছিলেন সেই সাক্ষ্যপ্রমাণকে প্রত্যাখ্যান করা হত।—প্রেরিত ১৫:৫-১২.
সত্বর করিন্থে প্রেরণ করা হয়েছিল
ত্বকচ্ছেদসংক্রান্ত বিচার্য বিষয়টি যখন নিষ্পত্তি হয়েছিল, পৌল ও বার্ণবাকে বিভিন্ন জাতির কাছে প্রচার করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। একই সময়ে তারা দরিদ্রদের বিষয়ে চিন্তা করতেও সচেষ্ট ছিলেন। (গালাতীয় ২:৯, ১০) বস্তুতপক্ষে, প্রায় ছয় বছর পর অনুপ্রাণিত বিবরণে যখন আবার তীতের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়, তখন তিনি করিন্থে পবিত্রগণের জন্য দান সংগ্রহের কাজকে সুসংগঠিত করতে পৌলের দূত হিসাবে কাজ করছিলেন। কিন্তু, যখন তীত এই কাজ সম্পাদন করতে গিয়েছিলেন, তখন তিনি চাপপূর্ণ আরেকটি পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
করিন্থীয়দের প্রতি পৌলের পত্র প্রকাশ করে যে তিনি প্রথমে লিখেছিলেন “ব্যভিচারীদের সংসর্গে থাকিতে নাই।” তাদের মধ্যে থেকে অনুতাপহীন ব্যভিচারীকে বহিষ্কার করার জন্য তাকে বলতে হয়েছিল। হ্যাঁ, পৌল “অনেক অশ্রুপাত করিতে করিতে” তাদেরকে একটি জোরালো পত্র লিখেছিলেন। (১ করিন্থীয় ৫:৯-১৩; ২ করিন্থীয় ২:৪) ইতিমধ্যে, সেখানকার অভাবগ্রস্ত যিহূদিয়ার খ্রীষ্টানদের জন্য ব্যবস্থাকৃত দান সংগ্রহের কাজে সহযোগিতা করতে, তীতকে সত্বর করিন্থের উদ্দেশে প্রেরণ করা হয়েছিল। সম্ভবত, করিন্থীয়দের প্রতি পৌলের পত্রের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করার জন্যও তাকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল।—২ করিন্থীয় ৮:১-৬.
পৌলের পরামর্শের প্রতি করিন্থীয়রা কিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল? এটি জানার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে, পৌল হয়তো তীতকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংবাদ দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে ইফিষ থেকে এজিয়ান সাগরের অপর পারে করিন্থে পাঠিয়েছিলেন। যদি এই যাত্রা শীতকালের (প্রায় নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে) কারণে নৌযাত্রা বন্ধ করে দেওয়ার আগে হতো, তবে তীত জাহাজ যোগে কিংবা হেল্লেসপন্ট হয়ে স্থলপথে দীর্ঘ যাত্রা করে ত্রোয়াতে যেতে পারতেন। সম্ভবত পৌল আগেই ত্রোয়ার পূর্বনির্ধারিত সম্মিলন স্থানে এসে পৌঁছেছিলেন কিন্তু রৌপ্যকারদের দ্বারা দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ায় তাকে যথা সময়ের আগেই ইফিষ ছাড়তে হয়েছিল। ত্রোয়াতে অস্থির হয়ে প্রতীক্ষা করার পর, পৌল বুঝতে পেরেছিলেন যে তীত সমুদ্রপথে আসবেন না। তাই, পৌল তার সঙ্গে পথে মিলিত হওয়ার আশায় স্থলপথে রওনা দিয়েছিলেন। ইউরোপে আসতে পারলেই পৌল ভিয়া ইগনেশিয়ার পথ ধরে যাত্রা করবেন আর এভাবেই অবশেষে তিনি তীতের সঙ্গে মাকিদনিয়াতে মিলিত হতে পেরেছিলেন। পৌলের জন্য করিন্থের সুসংবাদ মহা স্বস্তি ও আনন্দ বয়ে এনেছিল। প্রেরিতের পরামর্শের প্রতি ওই মণ্ডলী অনুকূল প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল।—২ করিন্থীয় ২:১২, ১৩; ৭:৫-৭.
পৌল যদিও তার প্রেরিত দূত সেখানে গিয়ে কিরূপ সাদর সম্ভাষণ লাভ করবেন সেই সম্বন্ধে চিন্তিত ছিলেন কিন্তু ঈশ্বর তীতকে তার কার্যভার সম্পাদন করার জন্য সাহায্য করেছিলেন। তীতকে “সভয় ও সকম্পে” গ্রহণ করা হয়েছিল। (২ করিন্থীয় ৭:৮-১৫) বর্ণনাকারী ডব্লু. ডি. থমাসের কথানুসারে: “আমরা ধরে নিতে পারি যে পৌলের ভর্ৎসনাকে হালকা না করে, [তীত] করিন্থীয়দের সঙ্গে দক্ষ ও কৌশলীভাবে বাদানুবাদ করেছিলেন; তাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে কেবল তাদের আধ্যাত্মিক মঙ্গলের কথা স্মরণে রেখেই পৌল এভাবে কথা বলেছিলেন।” এভাবেই, তীত করিন্থীয় খ্রীষ্টানদের বাধ্য মনোভাব ও ইতিবাচক পরিবর্তনের কারণে তাদের প্রতি প্রেম প্রদর্শন করেছিলেন। তাদের প্রশংসনীয় মনোভাব তার উৎসাহের মূল কারণ হিসাবে প্রমাণিত হয়েছিল।
তীতের করিন্থে যাওয়ার আরেকটি কারণ অর্থাৎ যিহূদীয়ার পবিত্রগণের জন্য দান সংগ্রহ সুসংগঠিত করার সম্বন্ধেই বা কী বলা যায়? তীত সেখানেও কাজ করেছিলেন, যা ২ করিন্থীয়তে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়। তীত ও পৌল মিলিত হওয়ার অল্প সময় পরেই, ওই পত্রটি সম্ভবত মাকিদনিয়ায় সা.কা. ৫৫ সালের শরৎকালে লেখা হয়েছিল। পৌল লিখেছিলেন যে তীত, যিনি দান সংগ্রহের কাজ শুরু করেছিলেন তা সমাপ্ত করার জন্য তখন তাকে দুজন অজ্ঞাতনামা সহকারীর সঙ্গে পুনরায় পাঠানো হচ্ছিল। করিন্থীয়দের প্রতি আন্তরিক আগ্রহ থাকায়, তীত ফিরে যেতে অত্যন্ত ইচ্ছুক ছিলেন। করিন্থে ফিরে যাওয়ার সময়ে, তীত সম্ভবত করিন্থীয়দের প্রতি লেখা পৌলের দ্বিতীয় অনুপ্রাণিত পত্রটি সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন।—২ করিন্থীয় ৮:৬, ১৭, ১৮, ২২.
তীত কেবল সুসংগঠকই ছিলেন না সেইসঙ্গে তিনি এমন এক ব্যক্তি ছিলেন, যার উপর কঠিন পরিস্থিতিতেও সূক্ষ্ম দায়িত্বভার দেওয়া যেত। তিনি নির্ভীক, পরিপক্ব এবং অটল ছিলেন। স্পষ্টত, পৌল তীতকে করিন্থের “প্রেরিত-চূড়ামণিদের” দ্বারা সৃষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলি মোকাবিলা করার যোগ্যপাত্র হিসাবে গণ্য করেছিলেন। (২ করিন্থীয় ১১:৫) বাইবেলে যখন আবার একবার তীত সম্বন্ধে উল্লেখ করা হয় তখন তার এই উত্তম গুণের প্রমাণ পাওয়া যায় কারণ এই সময় তাকে খুবই কষ্টসাধ্য এক কার্যভার দেওয়া হয়েছিল।
ক্রীতী দ্বীপে
সম্ভবত সা.কা. ৬১ থেকে ৬৪ সালের মধ্যে কোনও এক সময়ে, পৌল তীতের প্রতি পত্র লিখেছিলেন, যিনি তখন ক্রীতীর ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপে পরিচর্যা করছিলেন। পৌল তাকে সেখানে ‘যাহা যাহা অসম্পূর্ণ . . . তাহা ঠিক করিয়া দেওয়ার’ এবং ‘প্রত্যেক নগরে প্রাচীনদিগকে নিযুক্ত করার’ জন্য রেখে এসেছিলেন। সার্বিকভাবে, ক্রীতীর অধিবাসীরা “মিথ্যাবাদী, হিংস্র জন্তু, অলস পেটুক” হিসাবে কুখ্যাত ছিল। সুতরাং, ক্রীতীতে তীতকে সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করতে হয়েছিল। (তীত ১:৫, ১০-১২) সেটি অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ কাজ ছিল, কারণ সেটিই সম্ভবত ওই দ্বীপে খ্রীষ্টধর্মের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেছিল। অনুপ্রাণিত হয়েই পৌল তীতকে অধ্যক্ষপদের যোগ্যপাত্র হওয়ার ক্ষেত্রে কী কী লক্ষ্য করা প্রয়োজন তা বলার দ্বারা সাহায্য করেছিলেন। খ্রীষ্টীয় প্রাচীনদের নিয়োগ করার সময়, আজও ওই যোগ্যতাগুলি বিবেচনা করা হয়।
শাস্ত্রাবলি ইঙ্গিত করে না যে তীত কখন ক্রীতী ত্যাগ করেন। তিনি সেখানে বেশ কিছু সময় ছিলেন, কারণ পৌল তাকে সীনা এবং আপল্লো যারা তাদের যাত্রাকালে কিছু সময়ের জন্য সেখানে এসেছিলেন তাদের প্রয়োজনীয় বস্তু প্রদান করার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু তীত সেই দ্বীপে দীর্ঘসময় থাকেননি। পৌল সেখানে হয়তো আর্ত্তিমাকে কিংবা তুখিককে পাঠানোর পরিকল্পনা করছিলেন আর তীত তখন নীকপলিতে পৌলের সঙ্গে দেখা করার জন্য গিয়েছিলেন, যেটি সেইসময় উত্তরপশ্চিম গ্রিসের একটি প্রসিদ্ধ নগর ছিল।—তীত ৩:১২, ১৩.
বাইবেল যখন শেষবার তীত সম্বন্ধে উল্লেখ করে, সেই সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি যে সম্ভবত প্রায় সা.কা. ৬৫ সালে পৌল তাকে আরেকটি কার্যভারে পাঠান। তাকে দাল্মাতিয়াতে পাঠানো হয়েছিল, যে অঞ্চলটি বর্তমানে ক্রোয়েশিয়ার অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের পূর্ব দিকে অবস্থিত। (২ তীমথিয় ৪:১০) তীত সেখানে কী করেছিলেন সেই সম্বন্ধে আমাদের বলা হয়নি কিন্তু এটি জানা যায় যে সেখানে তাকে মণ্ডলীসংক্রান্ত বিষয়গুলি পরিচালনা এবং মিশনারি কাজে রত থাকার জন্য পাঠানো হয়েছিল। যদি তাই হয়, তবে তীত নিশ্চয়ই ক্রীতিতে যেভাবে পরিচর্যা করেছিলেন, সেই একই যোগ্যতা অনুযায়ী সেখানেও কাজ করেছিলেন।
তীতের মতো পরিপক্ব খ্রীষ্টীয় অধ্যক্ষগণ থাকায় আমরা কতই না কৃতজ্ঞ! শাস্ত্রীয় নীতির প্রতি তাদের স্পষ্ট বোধগম্যতা এবং সেগুলির নির্ভীক প্রয়োগ, মণ্ডলীর আধ্যাত্মিক অবস্থা রক্ষার্থে সাহায্য করে। আসুন আমরা তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করি আর তীতের মতোই আমরা আধ্যাত্মিক বিষয়ে বেড়ে চলার জন্য আমাদের সহবিশ্বাসীদের সাহায্য করি।—ইব্রীয় ১৩:৭.
[পাদটীকাগুলো]
a গালাতীয় ২:৩ পদে তীতকে একজন গ্রিক (হেলেন) হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এটি হয়তো বোঝায় যে তিনি গ্রিক বংশীয় ছিলেন। কিন্তু কিছু গ্রিক লেখক, ন-গ্রিকদের অর্থাৎ যারা গ্রিক ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিলেন তাদের সম্বন্ধে উল্লেখ করার ক্ষেত্রে বহুবচন (হেলেনস্) ব্যবহার করেছিলেন বলে জানা যায়। সম্ভবত সেই অর্থেই তীত একজন গ্রিক ছিলেন।
[৩১ পৃষ্ঠার চিত্র]
তীত করিন্থে এবং অন্যান্য জায়গায় খ্রীষ্টানদের পক্ষে একজন নির্ভীক সহকারী ছিলেন