আপনি কি “বদ্ধমূল ও সংস্থাপিত”?
আপনি কি কখনো একটা বড়ো গাছকে ঝোড়ো বাতাসে এদিক-ওদিক দুলতে দেখেছেন? প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে সেই গাছটা নুয়ে পড়লেও, এটা টিকে থাকে। কেন? কারণ এটার এক শক্তিশালী মূলতন্ত্র রয়েছে, যা মাটির সঙ্গে গেঁথে থাকে। আমরা সেই গাছের মতো হতে পারি। আমাদের জীবনে যখন ঝড়তুল্য পরীক্ষাগুলোর মুখোমুখি হই, তখন আমরাও টিকে থাকতে পারব, যদি আমরা “বদ্ধমূল ও সংস্থাপিত” থাকি। (ইফি. ৩:১৪-১৭) কীসের ওপর?
ঈশ্বরের বাক্য বলে যে, খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর “প্রধান কোণস্থ প্রস্তর স্বয়ং খ্রীষ্ট যীশু।” (ইফি. ২:২০; ১ করি. ৩:১১) খ্রিস্টান হিসেবে আমাদেরকে উৎসাহিত করা হয়েছে যেন আমরা ‘তাঁহাতেই চলি, তাঁহাতেই বদ্ধমূল ও সংগ্রথিত হইয়া বিশ্বাসে দৃঢ়ীভূত হই।’ যদি আমরা তা করি, তাহলে আমরা আমাদের বিশ্বাসের ওপর আসা সমস্ত আক্রমণের—যেগুলোর অন্তর্ভুক্ত মানুষের ‘অনর্থক প্রতারণার’ ওপর ভিত্তি করে ‘প্ররোচক বাক্যের’ আকারে আসা বিষয়গুলো, সেগুলোর—মধ্যেও টিকে থাকতে সমর্থ হব।—কল. ২:৪-৮.
“প্রশস্ততা, দীর্ঘতা, উচ্চতা ও গভীরতা”
কিন্তু, কীভাবে আমরা “বদ্ধমূল” ও “বিশ্বাসে দৃঢ়ীভূত” হতে পারি? রূপকভাবে বললে, আমাদের মূলকে মাটির গভীরে গেঁথে দেওয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ উপায় হল, অধ্যবসায়ের সঙ্গে ঈশ্বরের অনুপ্রাণিত বাক্য অধ্যয়ন করা। যিহোবা চান যেন আমরা ‘সমস্ত পবিত্রগণের সহিত বুঝিতে সমর্থ হই যে,’ সত্যের “সেই প্রশস্ততা, দীর্ঘতা, উচ্চতা ও গভীরতা কি।” (ইফি. ৩:১৮) তাই, কোনো খ্রিস্টানেরই নিছক ওপর ওপর বোধগম্যতা লাভ করে সন্তুষ্ট হওয়া, ঈশ্বরের বাক্যে পাওয়া শুধুমাত্র মৌলিক বা “আদিম কথার অক্ষরমালা” সম্বন্ধে জ্ঞান নিয়ে পরিতৃপ্ত থাকা উচিত নয়। (ইব্রীয় ৫:১২; ৬:১) এর বিপরীতে, আমাদের প্রত্যেকেরই বাইবেলের সত্যের প্রতি বোধগম্যতাকে বৃদ্ধি করার জন্য উৎসুক হওয়া উচিত।—হিতো. ২:১-৫.
অবশ্য, তার মানে এই নয় যে, সত্যে “বদ্ধমূল ও সংস্থাপিত” হওয়ার জন্য আমাদের প্রচুর জ্ঞান থাকতে হবে। আসলে স্বয়ং শয়তানও জানে যে, বাইবেলে কী রয়েছে। তাই, শুধু জ্ঞান থাকার চেয়েও আরও বেশি কিছু প্রয়োজন। আমাদেরকে “জ্ঞানাতীত যে খ্রীষ্টের প্রেম, তাহা . . . জানিতে সমর্থ” হতে হবে। (ইফি. ৩:১৯) তা সত্ত্বেও, আমরা যখন যিহোবা এবং সত্যকে ভালোবাসি বলে অধ্যয়ন করি, তখন ঈশ্বরের বাক্য সম্বন্ধে জানা বা সঠিক জ্ঞানকে বৃদ্ধি করা আমাদের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে।—কল. ২:২.
আপনার বোধগম্যতাকে পরীক্ষা করুন
এখনই, বাইবেলে পাওয়া কয়েকটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ সত্যের বিষয়ে আপনার বোধগম্যতাকে পরীক্ষা করে দেখুন না কেন? তা করা আপনাকে আপনার ব্যক্তিগত বাইবেল অধ্যয়নে আরও বেশি অধ্যবসায়ী হতে উৎসাহিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ইফিষীয়দের প্রতি পৌলের চিঠির শুরুর কয়েকটি পদ পড়ুন। (“ইফিষীয়দের প্রতি” শিরোনামের বাক্সটা দেখুন।) এই পদগুলো পড়ার পর নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, ‘এই বাক্সে দেওয়া বাইবেলের পদগুলোর বাঁকা অক্ষরে মুদ্রিত বাক্যাংশগুলোর অর্থ কি আমি বুঝতে পেরেছি?’ আসুন আমরা এক এক করে সেগুলো বিবেচনা করি।
“জগৎপত্তনের পূর্ব্বে” নিরূপিত
পৌল সহবিশ্বাসীদের লিখেছিলেন: “[ঈশ্বর] আমাদিগকে যীশু খ্রীষ্ট দ্বারা আপনার জন্য দত্তকপুত্ত্রতার নিমিত্ত পূর্ব্ব হইতে নিরূপণও করিয়াছিলেন।” বস্তুতপক্ষে, যিহোবা স্থির করেছিলেন যে, তিনি কিছু মানুষকে তাঁর নিজের সিদ্ধ স্বর্গীয় পরিবারে দত্তক নেবেন। ঈশ্বরের এই দত্তক পুত্ররা, রাজা এবং যাজক হিসেবে খ্রিস্টের সঙ্গে শাসন করবে। (রোমীয় ৮:১৯-২৩; প্রকা. ৫:৯, ১০) যিহোবার সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শয়তান ইঙ্গিত করেছিল যে, ঈশ্বরের মানব সৃষ্টিতে কোনো খুঁত ছিল। তাই, এটা কতই না উপযুক্ত যে, যিহোবা সেই একই মানব পরিবারের সদস্যদেরকে বাছাই করেছেন, যারা শেষপর্যন্ত এই নিখিলবিশ্বকে মন্দতার উৎস শয়তান দিয়াবলসহ সমস্ত মন্দতা থেকে মুক্ত করায় এক ভূমিকা পালন করবে! কিন্তু, যিহোবা আগে থেকে নির্ধারণ করে রাখেননি যে, কোন ব্যক্তি বিশেষদের তাঁর পুত্র হিসেবে দত্তক নেওয়া হবে। এর পরিবর্তে ঈশ্বর স্থির করেছিলেন যে, মানুষদের এক দল বা শ্রেণী খ্রিস্টের সঙ্গে স্বর্গে রাজত্ব করবে।—প্রকা. ১৪:৩, ৪.
পৌল কোন ‘জগতের’ কথা বুঝিয়েছিলেন, যখন তিনি সহখ্রিস্টানদের লিখেছিলেন যে, একটা দল হিসেবে তাদেরকে “জগৎপত্তনের পূর্ব্বে” মনোনীত করা হয়েছিল? ঈশ্বর পৃথিবী বা মানবজাতি সৃষ্টি করার পূর্বের কোনো সময়কে তিনি নির্দেশ করছিলেন না। তা করলে ন্যায়বিচারের প্রধান নীতিকে লঙ্ঘন করা হতো। ঈশ্বর যদি আদম ও হবাকে সৃষ্টি করার আগেই নির্ধারণ করে রাখতেন যে তারা ব্যর্থ হবে, তাহলে তাদের করা কাজের জন্য কীভাবে তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা যেতে পারে? তাই, আদম ও হবা যখন ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে শয়তানের বিদ্রোহে তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল, তখন যে-পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল, সেই পরিস্থিতিকে ঈশ্বর কীভাবে মীমাংসা করবেন, তা তিনি কখন স্থির করেছিলেন? আমাদের প্রথম পিতামাতা বিদ্রোহ করার পর, তবে এক অসিদ্ধ কিন্তু উদ্ধারযোগ্য মানবজাতির জগৎ অস্তিত্বে আসার পূর্বেই যিহোবা তা স্থির করেছিলেন।
“তাঁহার সেই অনুগ্রহ-ধন অনুসারে”
কেন পৌল বলেছিলেন যে, ইফিষীয় বইয়ের শুরুর পদগুলোতে বিবেচিত ব্যবস্থাদি “[ঈশ্বরের] সেই অনুগ্রহ-ধন” বা অযাচিত দয়া “অনুসারে” হয়েছিল? অসিদ্ধ মানবজাতিকে মুক্ত করতে যিহোবা যে বাধ্য ছিলেন না, এই বিষয়টার ওপর জোর দেওয়ার জন্য তিনি তা বলেছিলেন।
স্বভাবতই, আমাদের কারোরই এমন কোনো যোগ্যতা নেই, যেটার মাধ্যমে আমরা মুক্তি অর্জন করতে পারি। কিন্তু, মানব পরিবারের প্রতি তাঁর গভীর প্রেমের দ্বারা পরিচালিত হয়ে যিহোবা আমাদের উদ্ধার করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাদি করেছেন। আমাদের অসিদ্ধতা এবং পাপপূর্ণ অবস্থা বিবেচনা করলে, পৌলের মতো বলা যায় যে, আমাদের মুক্তি সত্যিই এক অযাচিত দয়া।
ঈশ্বরের উদ্দেশ্যের নিগূঢ়তত্ত্ব
ঈশ্বর প্রথমেই প্রকাশ করেননি যে, শয়তানের দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতিকে তিনি কীভাবে দূর করবেন। এটা এক “নিগূঢ়তত্ত্ব” ছিল। (ইফি. ৩:৪, ৫) পরে খ্রিস্টীয় মণ্ডলী স্থাপিত হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে যিহোবা বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করেছিলেন যে, কীভাবে তিনি মানবজাতি এবং পৃথিবী সম্বন্ধে তাঁর আদি উদ্দেশ্যকে পরিপূর্ণ করবেন। পৌল ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, ‘কালের পূর্ণতায়’ ঈশ্বর এক “বিধান” অর্থাৎ বিভিন্ন বিষয়কে পরিচালনা করার এক পদ্ধতি কার্যকর করেন, যে-পদ্ধতি তাঁর সমস্ত বুদ্ধিবিশিষ্ট প্রাণীকে একত্রিত করবে।
এই একত্রীকরণের প্রথম পর্যায় শুরু হয়েছিল সা.কা. ৩৩ সালের পঞ্চাশত্তমীর দিনে, যখন যিহোবা সেই ব্যক্তিদের সংগ্রহ করতে শুরু করেছিলেন, যারা স্বর্গে খ্রিস্টের সঙ্গে রাজত্ব করবে। (প্রেরিত ১:১৩-১৫; ২:১-৪) এর দ্বিতীয় পর্যায় হবে, সেই ব্যক্তিদের সংগ্রহ করা, যারা খ্রিস্টের মশীহ রাজ্যের অধীনে এক পরমদেশ পৃথিবীতে বসবাস করবে। (প্রকা. ৭:১৪-১৭; ২১:১-৫) “বিধান” শব্দটি মশীহ রাজ্যকে নির্দেশ করে না, কারণ এই রাজ্য ১৯১৪ সালের আগে পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এর পরিবর্তে, এই শব্দটি সর্বজনীন একতাকে পুনর্স্থাপন করার উদ্দেশ্যে বিষয়গুলোকে ঈশ্বরের দ্বারা পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করাকে বোঝায়।
“বুদ্ধিতে পরিপক্ব” হোন
কোনো সন্দেহ নেই যে, ব্যক্তিগত অধ্যয়নের উত্তম অভ্যাস সত্যের “প্রশস্ততা, দীর্ঘতা, উচ্চতা ও গভীরতা” পুরোপুরিভাবে বুঝতে আপনাকে সাহায্য করবে। কিন্তু, এই ব্যাপারেও কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না যে, মানুষের বর্তমান ব্যস্ত জীবনধারার কারণে, এই ধরনের অধ্যয়নের উত্তম অভ্যাসকে দুর্বল করে দেওয়া—এমনকী পুরোপুরি নষ্ট করে দেওয়া—শয়তানের পক্ষে অনেক সহজ হয়েছে। আপনার ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটতে দেবেন না। বোধগম্যতায় বা “বুদ্ধিতে পরিপক্ব” হওয়ার জন্য ঈশ্বর আপনাকে যে-“বুদ্ধি” বা মেধা দিয়েছেন, তা ব্যবহার করুন। (১ যোহন ৫:২০; ১ করি. ১৪:২০) এই ব্যাপারে নিশ্চিত হোন যে, কোনো একটা বিষয় আপনি কেন বিশ্বাস করেন, তা আপনি বোঝেন এবং আপনি সবসময় ‘আপনার অন্তরস্থ প্রত্যাশার হেতু’ বা কারণ প্রদান করতে পারেন।—১ পিতর ৩:১৫.
কল্পনা করুন যে, পৌলের চিঠিটি যখন প্রথম পড়া হয়েছিল, তখন আপনি ইফিষে ছিলেন। এই কথাগুলো কি আপনাকে ‘ঈশ্বরের পুত্ত্র বিষয়ক তত্ত্বজ্ঞানে’ বা সঠিক জ্ঞানে বৃদ্ধি পেতে পরিচালিত করত না? (ইফি. ৪:১৩, ১৪) নিশ্চয়ই করত! তাই, পৌলের অনুপ্রাণিত কথাগুলো যেন আজকেও আপনাকে একই বিষয় করতে পরিচালিত করে। যিহোবার প্রতি গভীর প্রেম এবং তাঁর বাক্য সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান থাকা আপনাকে খ্রিস্টে দৃঢ়ভাবে “বদ্ধমূল ও সংস্থাপিত” থাকতে সাহায্য করবে। এভাবে, আপনি এমন যেকোনো ঝড়ের মধ্যে টিকে থাকতে সমর্থ হবেন, যা শয়তান এই দুষ্ট জগতের সম্পূর্ণ শেষ আসার আগে, আপনার বিরুদ্ধে নিয়ে আসতে পারে।—গীত. ১:১-৩; যির. ১৭:৭, ৮.
[২৭ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]
“ইফিষীয়দের প্রতি”
“ধন্য আমাদের প্রভু যীশু খ্রীষ্টের ঈশ্বর ও পিতা, যিনি আমাদিগকে সমস্ত আত্মিক আশীর্ব্বাদে স্বর্গীয় স্থানে খ্রীষ্টে আশীর্ব্বাদ করিয়াছেন; কারণ তিনি জগৎপত্তনের পূর্ব্বে খ্রীষ্টে আমাদিগকে মনোনীত করিয়াছিলেন, যেন আমরা তাঁহার সাক্ষাতে প্রেমে পবিত্র ও নিষ্কলঙ্ক হই; তিনি আমাদিগকে যীশু খ্রীষ্ট দ্বারা আপনার জন্য দত্তকপুত্ত্রতার নিমিত্ত পূর্ব্ব হইতে নিরূপণও করিয়াছিলেন; ইহা তিনি নিজ ইচ্ছার হিতসঙ্কল্প অনুসারে, নিজ অনুগ্রহের প্রতাপের প্রশংসার্থে করিয়াছিলেন। সেই অনুগ্রহে তিনি আমাদিগকে সেই প্রিয়তমে অনুগৃহীত করিয়াছেন, যাঁহাতে আমরা তাঁহার রক্ত দ্বারা মুক্তি, অর্থাৎ অপরাধ সকলের মোচন পাইয়াছি; ইহা তাঁহার সেই অনুগ্রহ-ধন অনুসারে হইয়াছে, যাহা তিনি সমস্ত জ্ঞানে ও বুদ্ধিতে আমাদের প্রতি উপচিয়া পড়িতে দিয়াছেন। ফলতঃ তিনি আমাদিগকে আপন ইচ্ছার নিগূঢ়তত্ত্ব জ্ঞাত করিয়াছেন, তাঁহার সেই হিতসঙ্কল্প অনুসারে যাহা তিনি কালের পূর্ণতার বিধান লক্ষ্য করিয়া তাঁহাতে পূর্ব্বে সঙ্কল্প করিয়াছিলেন। তাহা এই, স্বর্গস্থ ও পৃথিবীস্থ সমস্তই খ্রীষ্টেই সংগ্রহ করা যাইবে।”—ইফি. ১:৩-১০.