আশায় নোঙ্গর ফেলা, প্রেমে চালিত হওয়া
“বিশ্বাস, প্রত্যাশা, প্রেম এই তিনটী আছে, আর ইহাদের মধ্যে প্রেমই শ্রেষ্ঠ।”—১ করিন্থীয় ১৩:১৩.
১. প্রেরিত পৌল আমাদের কোন্ বিষয়ে সতর্ক করেন?
প্রেরিত পৌল আমাদের সতর্ক করেন যে জাহাজের মতো আমাদের বিশ্বাসও ভেঙে যেতে পারে। তিনি বলেন, “বিশ্বাস ও সৎসংবেদ রক্ষা কর; সৎসংবেদ দূরে ফেলাতে কাহারও কাহারও বিশ্বাসরূপ নৌকা [জাহাজ] ভগ্ন হইয়াছে।” (১ তীমথিয় ১:১৯) প্রথম শতাব্দীতে, সমুদ্রগামী জাহাজগুলো কাঠ দিয়ে তৈরি করা হতো। এগুলো সমুদ্রে চলার উপযোগী কিনা তা কাঠের মান ও কতটা দক্ষভাবে এটা তৈরি করা হয়েছে তার ওপর নির্ভর করত।
২. কেন আমাদের বিশ্বাসরূপ জাহাজকে ভালভাবে গড়ে তুলতে হবে এবং এর জন্য আমাদের কী দরকার?
২ আমাদের বিশ্বাসরূপ জাহাজ সম্বন্ধে বলা যেতে পারে যে এটা মানবজাতির উত্তাল সমুদ্রের মধ্যে রয়েছে। (যিশাইয় ৫৭:২০; প্রকাশিত বাক্য ১৭:১৫) তাই এটাকে ভালভাবে গড়ে তুলতে হবে আর তা আমাদের ওপর নির্ভর করে। যিহূদী ও রোমীয় সমাজের ‘সমুদ্র’ যখন বিশেষ করে প্রাথমিক খ্রীষ্টানদের জন্য অশান্ত হয়ে উঠছিল, তখন যিহূদা বলেছিলেন: “প্রিয়তমেরা তোমরা আপনাদের পরম পবিত্র বিশ্বাসের উপরে আপনাদিগকে গাঁথিয়া তুলিতে তুলিতে, পবিত্র আত্মাতে প্রার্থনা করিতে করিতে, ঈশ্বরের প্রেমে আপনাদিগকে রক্ষা কর, এবং অনন্ত জীবনের জন্য আমাদের প্রভু যীশু খ্রীষ্টের দয়ার অপেক্ষায় থাক।” (যিহূদা ২০, ২১) যেহেতু যিহূদাও “পবিত্রগণের কাছে একবারে সমর্পিত বিশ্বাসের” জন্য প্রাণপণ করার কথা বলেছিলেন, তাই ‘পরম পবিত্র বিশ্বাস’ কথাটা হয়তো খ্রীষ্টীয় শিক্ষার সব দিককেই নির্দেশ করে যার মধ্যে পরিত্রাণের সুসমাচারও রয়েছে। (যিহূদা ৩) খ্রীষ্টই হলেন এই বিশ্বাসের ভিত্তি। আমরা যদি সত্যিকারের খ্রীষ্টীয় বিশ্বাস ধরে রাখতে চাই, তাহলে দৃঢ় বিশ্বাস দরকার।
“সাম্প্রদায়িক আতঙ্কের” ঝড়ের মধ্যে টিকে থাকা
৩. কীভাবে কিছুজন “সাম্প্রদায়িক আতঙ্ক”-কে ব্যবহার করছেন?
৩ সম্প্রতি বছরগুলোতে, গুপ্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে দল বেঁধে আত্মহত্যা, খুন ও সন্ত্রাসীদের আক্রমণের মতো কিছু ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে। দেখা গেছে যে, আন্তরিক রাজনৈতিক নেতা সহ অনেক ব্যক্তিরা নিরীহ লোকেদের, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের এইরকম বিপদজনক সম্প্রদায়গুলোর হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। এতে কোন সন্দেহ নেই যে এই জঘণ্য অপরাধের পিছনে “এই যুগের দেব” রয়েছে যে সাম্প্রদায়িক আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে আর এটাকে যিহোবার লোকেদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। (২ করিন্থীয় ৪:৪; প্রকাশিত বাক্য ১২:১২) কেউ কেউ আমাদের কাজে বাধা দেওয়ার জন্য এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়েছেন। কিছু দেশে, তারা এমন ভাব দেখিয়ে এক অভিযান চালিয়েছেন যেন তারা “বিপদজনক সম্প্রদায়গুলোর” হাত থেকে লোকেদের বাঁচাচ্ছেন কিন্তু তারা ভুলভাবে যিহোবার সাক্ষিদেরকে সেই সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ফেলছেন আর এভাবে সুকৌশলে আমাদের বিরুদ্ধে দুর্নাম রটাচ্ছেন। এইজন্য ইউরোপের কিছু দেশে ঘরে ঘরে প্রচার কাজ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আমাদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতেন এমন কিছু লোকেরা অধ্যয়ন বন্ধ করে দিয়েছেন। এটা আমাদের কিছু ভাইদের ওপরও খারাপ প্রভাব ফেলেছে।
৪. কেন বিরোধিতা আসলে আমাদের উৎসাহ হারিয়ে ফেলা উচিত না?
৪ কিন্তু বিরোধিতার জন্য নিরূৎসাহিত না হয়ে বরং আমাদের বিশ্বাস আরও শক্তিশালী হওয়া উচিত যে আমরা সত্যিকারের খ্রীষ্টান ধর্ম পালন করছি। (মথি ৫:১১, ১২) প্রাথমিক খ্রীষ্টানদের বিদ্রোহী দলের সদস্য বলে অভিযোগ করা হয়েছিল আর সব জায়গায় লোকেরা তাদের “বিরুদ্ধে কথা” বলত। (প্রেরিত ২৪:৫; ২৮:২২) কিন্তু প্রেরিত পৌল তার খ্রীষ্টান ভাইবোনদের এই লিখে আশ্বাস দিয়েছিলেন: “প্রিয়েরা, তোমাদের পরীক্ষার্থে যে আগুন তোমাদের মধ্যে জ্বলিতেছে, ইহা বিজাতীয় ঘটনা বলিয়া আশ্চর্য্য জ্ঞান করিও না; বরং যে পরিমাণে খ্রীষ্টের দুঃখভোগের সহভাগী হইতেছ, সেই পরিমাণে আনন্দ কর, যেন তাঁহার প্রতাপের প্রকাশকালে উল্লাস সহকারে আনন্দ করিতে পার।” (১ পিতর ৪:১২, ১৩) পৌলের মতোই, প্রথম শতাব্দীর পরিচালক গোষ্ঠীর একজন সদস্য লিখেছিলেন: “হে আমার ভ্রাতৃগণ, তোমরা যখন নানাবিধ পরীক্ষায় পড়, তখন তাহা সর্ব্বতোভাবে আনন্দের বিষয় জ্ঞান করিও; জানিও, তোমাদের বিশ্বাসের পরীক্ষাসিদ্ধতা ধৈর্য্য সাধন করে। আর সেই ধৈর্য্য সিদ্ধ কার্য্যবিশিষ্ট হউক, যেন তোমরা সিদ্ধ ও সম্পূর্ণ হও, কোন বিষয়ে তোমাদের অভাব না থাকে।” (যাকোব ১:২-৪) দমকা হাওয়া যেমন একটা জাহাজ সমুদ্রে চলার উপযোগী কিনা তা পরীক্ষা করে, তেমনই বিরোধিতার ঝড় আমাদের বিশ্বাসরূপ জাহাজে কোনরকম দুর্বলতা আছে কিনা তা প্রকাশ করবে।
ক্লেশ ধৈর্য বাড়ায়
৫. কীভাবে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে আমাদের বিশ্বাস ক্লেশের মধ্যেও অটল?
৫ খ্রীষ্টানেরা ক্লেশের ঝড়ের মধ্যে টিকে থাকার পরই তাদের ধৈর্য ও বিশ্বাস কতটা অটল সেই বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেন। উত্তাল সমুদ্রে আমাদের ধৈর্য “সিদ্ধ কার্য্যবিশিষ্ট” হবে যদি আমরা ‘সিদ্ধ ও সম্পূর্ণ হই, কোন বিষয়ে আমাদের অভাব না থাকে।’ পৌল লিখেছিলেন: “ঈশ্বরের পরিচারক বলিয়া সর্ব্ববিষয়ে আপনাদিগকে যোগ্যপাত্র দেখাইতেছি,—বিপুল ধৈর্য্যে, নানা প্রকার ক্লেশে, অনাটনে, সঙ্কটে।”—২ করিন্থীয় ৬:৪.
৬. কেন আমাদের নানারকম “ক্লেশেও শ্লাঘা” করা উচিত এবং কীভাবে এটা আমাদের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে?
৬ আমরা মাঝে মধ্যে হয়তো ক্লেশের দমকা হাওয়ার মুখে পড়তে পারি আর তখন এটাকে আমাদের বিশ্বাসরূপ জাহাজ যে অটুট ও অটল তা প্রমাণ করার সুযোগ বলে দেখা উচিত। পৌল রোমের খ্রীষ্টানদের লিখেছিলেন: “নানাবিধ ক্লেশেও শ্লাঘা করিতেছি, কারণ আমরা জানি, ক্লেশ ধৈর্য্যকে, ধৈর্য্য পরীক্ষাসিদ্ধতাকে এবং পরীক্ষাসিদ্ধতা প্রত্যাশাকে উৎপন্ন করে; আর প্রত্যাশা লজ্জাজনক হয় না।” (রোমীয় ৫:৩-৫) পরীক্ষার সময় বিশ্বস্ত থাকলে আমরা যিহোবার স্বীকৃতি পাব। আর এটা আমাদের আশাকে শক্তিশালী করে।
কেন কিছুজনের জাহাজ ভঙ্গ হয়
৭. (ক) পৌলের কথা অনুযায়ী, কীভাবে কিছুজনের আধ্যাত্মিক জাহাজ ভঙ্গ হয়েছিল? (খ) আজকে কীভাবে কিছুজন সত্য থেকে সরে গেছেন?
৭ পৌল যখন জাহাজ ভঙ্গ হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন, তখন তার মনে এমন কয়েকজনের নাম ছিল যারা তাদের উত্তম বিবেককে ‘দূরে সরিয়ে ফেলেছিলেন’ ও তাদের বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। (১ তীমথিয় ১:১৯) তাদের মধ্যে হুমিনায় ও আলেক্সান্দর ছিলেন যারা সত্য থেকে সরে গিয়ে এবং খারাপ কথা বলে ধর্মভ্রষ্ট হয়েছিলেন। (১ তীমথিয় ১:২০, পাদটীকা, NW; ২ তীমথিয় ২:১৭, ১৮) আজকে, সত্য থেকে সরে গেছে এমন ধর্মভ্রষ্টরা ‘বিশ্বস্ত ও বুদ্ধিমান্ দাসের’ সম্বন্ধে বাজে কথা বলে আর এভাবে তারা সেই হাতকে কামড়ে দিচ্ছে যা তাদের আধ্যাত্মিক খাবার খাইয়েছিল। ‘দুষ্ট দাসের’ মতো কেউ কেউ মনে মনে বলে, “আমার প্রভুর আসিবার বিলম্ব আছে।” (মথি ২৪:৪৪-৪৯; ২ তীমথিয় ৪:১৪, ১৫) এই দুষ্ট বিধিব্যবস্থার শেষ যে খুব কাছে তা তারা মেনে নেয় না বরং আধ্যাত্মিকভাবে সচেতন দাস শ্রেণীকে টিটকারি দেয় কারণ তারা যিহোবার লোকেদের মধ্যে তৎপর মনোভাব বজায় রাখেন। (যিশাইয় ১:৩) এইরকম ধর্মভ্রষ্টরা আধ্যাত্মিক জাহাজ ভঙ্গ করে ‘কাহারও কাহারও বিশ্বাস উল্টাইয়া ফেলিতে’ সফল হয়।—২ তীমথিয় ২:১৮.
৮. কী কারণে কিছুজন তাদের বিশ্বাসরূপ জাহাজ ভঙ্গ করেছেন বা ডুবিয়ে দিয়েছেন?
৮ অন্য উৎসর্গীকৃত খ্রীষ্টানেরা তাদের বিবেককে উপেক্ষা করে এবং এই জগতের উচ্ছৃঙ্খল আমোদপ্রমোদ ও যৌন অনৈতিকতায় ডুবে গিয়ে তাদের বিশ্বাসরূপ জাহাজ ভঙ্গ করেছেন। (২ পিতর ২:২০-২২) এছাড়াও অনেকে তাদের বিশ্বাসরূপ জাহাজ ডুবিয়ে দেন কারণ তারা নতুন বিধিব্যবস্থার পোতাশ্রয় এখনও দেখতে পাচ্ছেন না। কিছু ভবিষ্যদ্বাণীর পরিপূর্ণতার সময় গণনা করতে না পেরে এবং “প্রভুর [যিহোবার] দিন” থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে তারা সত্য উপাসনা ছেড়ে দেন। (২ পিতর ৩:১০-১৩; ১ পিতর ১:৯) শীঘ্রই তারা তাদের চারিদিকে ঘোর অন্ধকার দেখতে পান ও বর্তমান বিধিব্যবস্থার ঘোলা জলে গিয়ে পড়েন। (যিশাইয় ১৭:১২, ১৩; ৫৭:২০) খ্রীষ্টান মণ্ডলীর সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দিয়েছেন এমন কিছু ব্যক্তি এখনও বিশ্বাস করেন যে এটা সত্য ধর্ম। এর থেকে এটাই বোঝা যায় যে যিহোবা ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞাত নতুন জগতের জন্য যে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা দরকার তা তাদের নেই। তাদের কাছে পরমদেশে জীবন পেতে এখনও অনেক দেরি আছে বলে মনে হয়েছে।
৯. কিছু উৎসর্গীকৃত খ্রীষ্টানেরা কী করছেন এবং এই ঘটনাগুলো আমাদের কী ভাবতে পরিচালিত করবে?
৯ বিশ্বের কয়েকটা দেশের কিছু উৎসর্গীকৃত খ্রীষ্টানদেরকে তাদের বিশ্বাসরূপ জাহাজের পাল গুটিয়ে নিতে দেখা যায়। জাহাজ যদিও এখনও ভেসে চলেছে কিন্তু পুরো বিশ্বাস নিয়ে সামনে এগিয়ে না গিয়ে তারা ধীরে ধীরে এগুচ্ছেন। “খুব তাড়াতাড়ি পরমদেশ” পাওয়ার আশায় আকৃষ্ট হয়ে, কিছুজন সেখানে বাস করার জন্য যে কোন কিছু করতে তৈরি ছিলেন—তারা উদ্যোগের সঙ্গে প্রচার করতেন এবং সব সভা, সম্মেলন ও অধিবেশনগুলোতে নিয়মিত যোগ দিতেন। কিন্তু এখন তাদের আশা পূরণ হতে তারা যতটা ভেবেছিলেন তার চেয়ে অনেক দেরি আছে এই মনে করে তারা আগে যতটা উদ্যোগী ছিলেন এখন আর ততটা নন। এইজন্যই তাদেরকে প্রচারে কম যেতে, নিয়মিত সভাতে না আসতে এবং সম্মেলন বা অধিবেশগুলোতে যোগ না দিতে দেখা যায়। অন্যেরা বিনোদনের পিছনে এবং আরও আরামআয়েসে জীবন কাটানোর জন্য বেশি সময় দিচ্ছেন। এই বিষয়গুলো আমাদের ভাবতে পরিচালিত করে যে যিহোবার কাছে আমাদের উৎসর্গীকরণের অর্থ অনুযায়ী কী আমাদের জীবনের চালিকা শক্তি হওয়া উচিত। তাঁর পরিচর্যায় আমাদের উদ্যোগ কি “খুব তাড়াতাড়ি পরমদেশ” পাওয়ার আশার ওপর নির্ভর করে?
আশাকে নোঙ্গরের সঙ্গে তুলনা করা যায়
১০, ১১. পৌল আমাদের আশাকে কীসের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন এবং কেন এই তুলনা ঠিক ছিল?
১০ পৌল মনোযোগ আকর্ষণ করিয়েছিলেন যে যিহোবা অব্রাহামের মাধ্যমে আশীর্বাদ করার প্রতিজ্ঞা করেছেন। এরপর প্রেরিত বলেছিলেন: ‘ঈশ্বর . . . শপথ করিলেন; অভিপ্রায় এই, যে ব্যাপারে মিথ্যাকথা বলা ঈশ্বরের অসাধ্য, এমন অপরিবর্ত্তনীয় দুই ব্যাপার [তাঁর বাক্য ও তাঁর শপথ] দ্বারা আমরা—যাহারা সম্মুখস্থ প্রত্যাশা ধরিবার জন্য শরণার্থে পলায়ন করিয়াছি—যেন দৃঢ় আশ্বাস প্রাপ্ত হই। আমাদের সেই প্রত্যাশা আছে, তাহা প্রাণের লঙ্গরস্বরূপ, অটল ও দৃঢ়, এবং তিরস্করিণীর ভিতরে যায়।’ (ইব্রীয় ৬:১৭-১৯; আদিপুস্তক ২২:১৬-১৮) অভিষিক্ত খ্রীষ্টানদের সামনে যে আশা রয়েছে তা হল স্বর্গে অমর জীবন। আজকে, যিহোবার বেশিরভাগ দাসেরই পরমদেশ পৃথিবীতে অনন্ত কাল বেঁচে থাকার চমৎকার আশা রয়েছে। (লূক ২৩:৪৩) এইরকম আশা ছাড়া একজনের বিশ্বাস থাকতে পারে না।
১১ নোঙ্গর হল একটা শক্তিশালী নিরাপদ হাতিয়ার যা একটা জাহাজকে ঘাটে ভিড়িয়ে রাখার ও ভেসে যাওয়া থেকে আটকানোর জন্য একান্তভাবে দরকার। কোন নাবিকই নোঙ্গর ছাড়া যাত্রা করবেন না। যেহেতু পৌল কয়েকবারই জাহাজ ভঙ্গের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তাই তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে জানতেন যে নাবিকদের জীবন তাদের জাহাজের নোঙ্গরের ওপর নির্ভর করত। (প্রেরিত ২৭:২৯, ৩৯, ৪০; ২ করিন্থীয় ১১:২৫) প্রথম শতাব্দীতে জাহাজে কোন ইঞ্জিন ছিল না যে নাবিক তার ইচ্ছাখুশি মতো তা চালাবেন। দাঁড় টানা যুদ্ধজাহাজ বাদে আর সব জাহাজগুলোকে ভেসে চলার জন্য মূলত বাতাসের ওপর নির্ভর করতে হতো। যদি তার জাহাজের পাথুরে কোন জায়গায় চলে যাওয়ার ভয় থাকতো, তবে বাঁচার জন্য একজন নাবিকের নোঙ্গর ফেলা ও ঝড়ের মোকাবিলা করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না আর নোঙ্গর তারা এই আস্থা নিয়ে ফেলতো যে এটা সমুদ্রতল থেকে ছুটে যাবে না। তাই পৌল একজন খ্রীষ্টানের আশাকে ‘প্রাণের লঙ্গরের’ সঙ্গে তুলনা করেছিলেন যা “অটল ও দৃঢ়।” (ইব্রীয় ৬:১৯) আমরা যখন বিরোধিতার ঝড়ের মুখোমুখি হই বা অন্য পরীক্ষার সামনে পড়ি, তখন আমাদের চমৎকার আশা নোঙ্গরের মতো কাজ করে যা আমাদেরকে স্থির রাখে যাতে আমাদের বিশ্বাসরূপ জাহাজ সন্দেহ বা ধর্মভ্রষ্টতার সর্বনাশা পাথরের বিপদজনক চড়ার দিকে ভেসে না যায়।—ইব্রীয় ২:১; যিহূদা ৮-১৩.
১২. কীভাবে আমরা যিহোবার কাছ থেকে সরে যাওয়াকে এড়াতে পারি?
১২ পৌল ইব্রীয় খ্রীষ্টানদের সতর্ক করেছিলেন: “ভ্রাতৃগণ, দেখিও, পাছে অবিশ্বাসের এমন মন্দ হৃদয় তোমাদের কাহারও মধ্যে থাকে যে, তোমরা জীবন্ত ঈশ্বর হইতে সরিয়া পড়।” (ইব্রীয় ৩:১২) গ্রিক শাস্ত্রে ‘সরিয়া পড়া’ মানে “ভিন্ন দিকে যাওয়া,” অর্থাৎ ধর্মভ্রষ্ট হওয়া। কিন্তু আমরা এইরকম চরম জাহাজ ভঙ্গ এড়াতে পারি। পরীক্ষার প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যেও বিশ্বাস ও আশা আমাদের যিহোবার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে সাহায্য করবে। (দ্বিতীয় বিবরণ ৪:৪; ৩০:১৯, ২০) আমাদের বিশ্বাস এমন এক জাহাজের মতো হবে না যা ভ্রান্ত শিক্ষাবায়ুতে এদিক সেদিক ভেসে বেড়ায়। (ইফিষীয় ৪:১৩, ১৪) আর আমাদের নোঙ্গররূপ আশা থাকলে আমরা যিহোবার দাস হিসেবে জীবন ঝড়ের মধ্যে টিকে থাকতে পারব।
প্রেম ও পবিত্র আত্মা দ্বারা চালিত হওয়া
১৩, ১৪. (ক) কেন শুধু আমাদের আশার নোঙ্গরই যথেষ্ঠ নয়? (খ) যিহোবার পবিত্র সেবা করায় কী আমাদের চালিকা শক্তি হওয়া উচিত এবং কেন?
১৩ একজন খ্রীষ্টান নতুন ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে পারবেন না যদি যিহোবাকে সেবা করার পিছনে তার একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে পরমদেশ পৃথিবীতে অনন্তকাল বেঁচে থাকা। তার নোঙ্গররূপ আশাকে তার জীবন স্থির রাখার হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগানো ছাড়াও প্রেমের চালিকা শক্তিকে এর সঙ্গে যুক্ত করা দরকার। আর আমাদের বিশ্বাসের সঙ্গেও সেই প্রেম থাকা দরকার। পৌল এই বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছিলেন যখন তিনি লিখেছিলেন: “বিশ্বাস, প্রত্যাশা, প্রেম এই তিনটী আছে, আর ইহাদের মধ্যে প্রেমই শ্রেষ্ঠ।”—১ করিন্থীয় ১৩:১৩.
১৪ আমাদের প্রতি যিহোবা যে অপরিমেয় ভালবাসা দেখিয়েছেন, তার জবাবে তাঁর প্রতি আন্তরিক ভালবাসাই পবিত্র সেবা করার জন্য আমাদের চালিকা শক্তি হওয়া উচিত। প্রেরিত যোহন লিখেছিলেন: “যে প্রেম করে না, সে ঈশ্বরকে জানে না, কারণ ঈশ্বর প্রেম। আমাদিগেতে ঈশ্বরের প্রেম ইহাতেই প্রকাশিত হইয়াছে যে, ঈশ্বর আপনার একজাত পুত্ত্রকে জগতে প্রেরণ করিয়াছেন, যেন আমরা তাঁহা দ্বারা জীবন লাভ করিতে পারি। আমরা প্রেম করি, কারণ তিনিই প্রথমে আমাদিগকে প্রেম করিয়াছেন।” (১ যোহন ৪:৮, ৯, ১৯) যিহোবার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ, আমাদের মূল লক্ষ্য শুধু ব্যক্তিগত পরিত্রাণ পাওয়া নয় বরং তাঁর পবিত্র নামের প্রশংসা ও তাঁর ধার্মিক সার্বভৌমত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা হওয়া উচিত।
১৫. কীভাবে যিহোবার জন্য ভালবাসা তাঁর সার্বভৌমত্বের প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত?
১৫ যিহোবা চান যেন আমরা তাঁকে ভালবাসি বলেই তাঁর সেবা করি, শুধু পরমদেশের জন্য নয়। বাইবেল এনসাইক্লোপিডিয়া শাস্ত্রের প্রতি অন্তর্দৃষ্টিa বলে: “যিহোবার সৃষ্ট প্রাণীরা মূলত ভালবাসার কারণে তাঁর সার্বভৌমত্বকে মেনে নেন বলে তিনি আনন্দিত হন। তিনি শুধু তাদেরকেই চান যারা তাঁর ভাল গুণাবলির জন্য আর এগুলো ধার্মিক বলে তাঁর সার্বভৌমত্বকে পছন্দ করেন ও যে কোন কিছুর থেকে তাঁর সার্বভৌমত্বকে বেশি গুরুত্ব দেন। (১ করি ২:৯) তারা স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা না করে বরং তাঁর সার্বভৌমত্বের অধীনে সেবা করা বেছে নেন আর এটা তারা করেন এই কারণে যে তারা তাঁর সম্বন্ধে এবং তাঁর ভালবাসা, ন্যায়বিচার ও প্রজ্ঞা সম্বন্ধে জানেন ও বোঝেন যে তাদের চেয়ে এই গুণাবলি যিহোবার অনেক অনেক গুণ বেশি। (গীতসংহিতা ৮৪:১০, ১১)”—খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৭৫.
১৬. কীভাবে যীশুর জন্য ভালবাসা আমাদের জীবনের এক চালিকা শক্তি?
১৬ খ্রীষ্টান হিসেবে আমরা যীশুর প্রতিও আমাদের ভালবাসা দেখাই কারণ তিনিও আমাদের ভালবাসা দেখিয়েছেন। পৌল যুক্তি দেখিয়েছিলেন: “খ্রীষ্টের প্রেম আমাদিগকে বশে রাখিয়া চালাইতেছে; কেননা আমরা এরূপ বিচার করিয়াছি যে, এক জন সকলের জন্য মরিলেন, সুতরাং সকলেই মরিল; আর তিনি সকলের জন্য মরিলেন, যেন, যাহারা জীবিত আছে, তাহারা আর আপনাদের উদ্দেশে নয়, কিন্তু তাঁহারই উদ্দেশে জীবন ধারণ করে, যিনি তাহাদের জন্য মরিয়াছিলেন, ও উত্থাপিত হইলেন।” (২ করিন্থীয় ৫:১৪, ১৫) খ্রীষ্টই হলেন সেই ভিত্তি যাঁর ওপর আমাদের আধ্যাত্মিক জীবন, বিশ্বাস ও আশা গড়ে ওঠে। যীশু খ্রীষ্টের জন্য ভালবাসা আমাদের আশাকে শক্তিশালী করে এবং বিশ্বাসকে অটল করে, বিশেষ করে প্রচণ্ড পরীক্ষার সময়।—১ করিন্থীয় ৩:১১; কলসীয় ১:২৩; ২:৬, ৭.
১৭. যিহোবা আমাদের কোন্ সক্রিয় শক্তি দেন এবং এর গুরুত্ব কীভাবে প্রেরিত ১:৮ ও ইফিষীয় ৩:১৬ পদে দেখানো হয়েছে?
১৭ যদিও ঈশ্বর ও তাঁর পুত্রের জন্য ভালবাসা খ্রীষ্টান হিসেবে আমাদের জীবনের মূল চালিকা শক্তি, তবুও যিহোবা আরও কিছু যোগান যা আমাদের তার সেবা করে যেতে প্রেরণা দেয়, বল দেয় ও শক্তিশালী করে। এটা হল তাঁর কার্যকারী শক্তি বা পবিত্র আত্মা। “আত্মা” হিসেবে অনূদিত ইব্রীয় ও গ্রিক শব্দগুলো মূলত বাতাসের শক্তিশালী গতিকে বোঝায়। পৌল যেরকম পাল তোলা জাহাজে চড়েছিলেন, সেগুলোকে তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য বাতাসের অদৃশ্য শক্তির ওপর নির্ভর করতে হতো। একইভাবে, আমাদের বিশ্বাসরূপ জাহাজ যদি আমাদেরকে যিহোবার পরিচর্যায় এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়, তাহলে আমাদের ভালবাসা এবং ঈশ্বরের অদৃশ্য কার্যকারী শক্তির পরিচালনা দরকার।—প্রেরিত ১:৮; ইফিষীয় ৩:১৬.
আমাদের লক্ষ্যে এগিয়ে চলা!
১৮. কী ভবিষ্যতে আমাদের বিশ্বাসের পরীক্ষায় ধৈর্য ধরতে সমর্থ করবে?
১৮ নতুন বিধিব্যবস্থায় পৌঁছানোর আগে আমাদের বিশ্বাস ও ভালবাসা হয়তো কঠিনভাবে পরীক্ষিত হতে পারে। কিন্তু যিহোবা আমাদের জন্য এমন এক নোঙ্গর যুগিয়েছেন যা “অটল ও দৃঢ়” অর্থাৎ আমাদের চমৎকার আশা। (ইব্রীয় ৬:১৯; রোমীয় ১৫:৪, ১৩) আমরা যখন বিরোধিতা বা অন্যান্য পরীক্ষার মুখোমুখি হই, তখন আমরা ধৈর্য ধরতে পারি যদি আমরা আমাদের আশার দ্বারা নিরাপদভাবে নোঙ্গর ফেলি। একটা ঝড় শান্ত হয়ে যাওয়ার পর আর আরেকটা ঝড় শুরু হওয়ার আগে আসুন আমরা সবাই আমাদের আশাকে শক্তিশালী করার ও বিশ্বাসকে দৃঢ় করার জন্য স্থিরসংকল্প হই।
১৯. কীভাবে আমরা আমাদের বিশ্বাসরূপ জাহাজকে চালিয়ে যেতে পারি এবং ঈশ্বরের নতুন জগতের পোতাশ্রয়ে ভিড়াতে পারি?
১৯ ‘প্রাণের লঙ্গরের’ কথা বলার আগে পৌল বলেছিলেন: “আমাদের বাসনা এই, যেন তোমাদের প্রত্যেক জন একই প্রকার যত্ন দেখায় [“বেগ বৃদ্ধি” করে, পাদটীকা, NW], যাহাতে শেষ পর্য্যন্ত প্রত্যাশার পূর্ণতা থাকিবে; যেন তোমরা শিথিল না হও, কিন্তু যাহারা বিশ্বাস ও দীর্ঘসহিষ্ণুতা দ্বারা প্রতিজ্ঞা-সমূহের দায়াধিকারী, তাহাদের অনুকারী হও।” (ইব্রীয় ৬:১১, ১২) যিহোবা ও তাঁর পুত্রের জন্য ভালবাসার দ্বারা চালিত হয়ে এবং পবিত্র আত্মার দ্বারা শক্তিশালী হয়ে, আসুন আমরা আমাদের বিশ্বাসরূপ জাহাজকে চালিয়ে নিয়ে যাই যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা ঈশ্বরের নতুন জগতের পোতাশ্রয়ে ভিড়ি।
[পাদটীকাগুলো]
a ওয়াচটাওয়ার বাইবেল অ্যাণ্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটি দ্বারা প্রকাশিত।
পুনরালোচনা
◻ আমাদের বিশ্বাস সম্বন্ধে পৌল কোন্ সতর্কবাণী দিয়েছিলেন?
◻ কীভাবে কিছুজনের আধ্যাত্মিক জাহাজ ভঙ্গ হয়েছে এবং কীভাবে কিছুজন ধীর গতি হয়ে পড়ছেন?
◻ আমাদের বিশ্বাসের সঙ্গে আর কোন্ ঈশ্বরীয় গুণাবলি দরকার?
◻ কী আমাদের ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞাত নতুন জগতের পোতাশ্রয়ে পৌঁছাতে সমর্থ করবে?
[১৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
জীবনের ঝড়গুলোর মধ্যে টিকে থাকার জন্য আমাদের বিশ্বাসরূপ জাহাজকে ভালভাবে গড়ে তুলতে হবে
[১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
আমাদের বিশ্বাস ভঙ্গ হতে পারে
[১৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
খ্রীষ্টান হিসেবে আশা হল আমাদের জীবনের নোঙ্গর