যেভাবে গায় তার ভাইদের সাহায্য করেছিলেন
প্রথম শতাব্দীর শেষের দিকে, গায় এবং অন্যান্য খ্রিস্টান বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। যে-ব্যক্তিরা মিথ্যা শিক্ষা ছড়াচ্ছিল, তারা মণ্ডলীগুলোকে দুর্বল ও সেইসঙ্গে বিভক্ত করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। (১ যোহন ২:১৮, ১৯; ২ যোহন ৭) দিয়ত্রিফি নামে একজন ব্যক্তি, প্রেরিত যোহন ও অন্যান্য ব্যক্তিদের সম্বন্ধে “দুর্ব্বাক্য” বা খারাপ কথা ছড়াচ্ছিলেন, ভ্রমণকারী খ্রিস্টানদের প্রতি আতিথেয়তা দেখাতে প্রত্যাখ্যান করছিলেন এবং অন্যদেরও তার উদাহরণ অনুসরণ করার জন্য প্ররোচিত করছিলেন। (৩ যোহন ৯, ১০) যোহন যখন গায়কে চিঠি লিখেছিলেন, তখন পরিস্থিতি ঠিক এইরকমই ছিল। প্রায় ৯৮ খ্রিস্টাব্দে লেখা প্রেরিতের এই চিঠি, খ্রিস্টান গ্রিক শাস্ত্রে “যোহনের তৃতীয় পত্র” হিসেবে পরিচিত।
বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও, গায় বিশ্বস্তভাবে যিহোবার সেবা করে গিয়েছিলেন। কীভাবে তিনি তার বিশ্বস্ততা প্রকাশ করেছিলেন? কেন বর্তমানে আমরা গায়ের উদাহরণ অনুকরণ করতে চাই? এক্ষেত্রে, কীভাবে যোহনের চিঠি আমাদের সাহায্য করতে পারে?
এক প্রিয় বন্ধুর প্রতি একটা চিঠি
তৃতীয় যোহন চিঠির লেখক নিজেকে “প্রাচীন” ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন। এই অভিব্যক্তিই তার প্রিয় গায়কে বুঝতে সাহায্য করেছিল যে, প্রেরিত যোহনই এই চিঠি লিখেছেন, যার কাছ থেকে গায় সত্য সম্বন্ধে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। যোহন গায়কে “প্রিয়তম” বলে উষ্ণভাবে সম্বোধন করেছিলেন এবং তার বিষয়ে বলেছিলেন, “যাঁহাকে আমি সত্যে প্রেম করি।” এরপর যোহন এই আশা প্রকাশ করেছিলেন যে, ঈশ্বরকে সঠিকভাবে উপাসনা করার পাশাপাশি গায় নিশ্চয়ই শারীরিকভাবেও সুস্থ আছেন। কতই-না চমৎকার এক প্রশংসা!—৩ যোহন ১, ২, ৪.
খুব সম্ভবত গায় একটা মণ্ডলীতে একজন অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করছিলেন, তবে চিঠিতে এই বিষয়ে স্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই। বিভিন্ন ভাইয়ের প্রতি আতিথেয়তা দেখিয়েছিলেন বলে যোহন গায়ের প্রশংসা করেছিলেন, এমনকী যদিও সেই ভাইয়েরা গায়ের কাছে অপরিচিত ছিলেন। যোহন এই বিষয়টাকে গায়ের বিশ্বস্ততার প্রমাণ হিসেবে দেখেছিলেন, কারণ আতিথেয়তা দেখানো সবসময়ই ঈশ্বরের দাসদের এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।—আদি. ১৮:১-৮; ১ তীম. ৩:২; ৩ যোহন ৫.
ভাইদের প্রতি আতিথেয়তা দেখানোর কারণে গায়ের প্রতি যোহন যে-কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন, সেটা ইঙ্গিত দেয় যে, খ্রিস্টানরা নিয়মিতভাবে প্রেরিত যোহন যেখানে থাকতেন, সেখান থেকে বিভিন্ন মণ্ডলীতে যেতেন এবং ফিরে এসে স্পষ্টতই তাদের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে জানাতেন। সম্ভবত এভাবেই যোহন সেই মণ্ডলীগুলোর খবরাখবর পেতেন।
নিশ্চিতভাবেই, ভ্রমণকারী খ্রিস্টানরা সহবিশ্বাসীদের সঙ্গে থাকতে চাইতেন। কারণ তখনকার পান্থশালাগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ ছিল, সেখানে উত্তম পরিসেবা লাভ করা যেত না এবং সেগুলো অনৈতিকতায় পরিপূর্ণ ছিল। তাই, সম্ভব হলে বিজ্ঞ ভ্রমণকারীরা তাদের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আর ভ্রমণকারী খ্রিস্টানরা তাদের খ্রিস্টান ভাই-বোনের সঙ্গে থাকতেন।
“সেই নামের অনুরোধে তাঁহারা বাহির হইয়াছেন”
যোহন গায়কে আবারও আতিথেয়তা দেখানোর জন্য উৎসাহিত করেছিলেন, কারণ তিনি গায়কে বলেছিলেন, “ঈশ্বরের উপযোগীরূপে [ভ্রমণকারীদের] সযত্নে পাঠাইয়া দেও।” এক্ষেত্রে, অতিথিদের পাঠিয়ে দেওয়ার অর্থ ছিল পরবর্তী ভ্রমণের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু জোগানো। এটা স্পষ্ট যে, ইতিমধ্যেই গায় তার আগের অতিথিদের জন্য এই সমস্ত কিছু করেছিলেন, যেহেতু তারা যোহনকে গায়ের প্রেম ও বিশ্বাস সম্বন্ধে জানিয়েছিলেন।—৩ যোহন ৩, ৬.
হতে পারে, সেই অতিথিরা ছিলেন মিশনারি, যোহনের বার্তাবাহক কিংবা ভ্রমণ অধ্যক্ষ। তারা যে-ই হোন না কেন, তারা সুসমাচারের কাজের জন্য ভ্রমণ করতেন। যোহন বলেছিলেন: “সেই নামের অনুরোধে তাঁহারা বাহির হইয়াছেন।” (৩ যোহন ৭) ঠিক আগের পদেই যোহন ঈশ্বরের বিষয়ে উল্লেখ করেছেন (৬ পদ দেখুন), তাই “সেই নামের অনুরোধে” অভিব্যক্তিটা যিহোবার নামকেই নির্দেশ করে। সুতরাং, সেই ভাইয়েরা খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর অংশ ছিলেন এবং উষ্ণ অভ্যর্থনা পাওয়ার যোগ্য ছিলেন। যোহন বিষয়টা এভাবে তুলে ধরেছিলেন: “আমরা এই প্রকার লোকদিগকে সাদরে গ্রহণ করিতে বাধ্য, যেন সত্যের সহকারী হইতে পারি।”—৩ যোহন ৮.
এক কঠিন পরিস্থিতিতে সাহায্য
যোহন কেবল গায়কে ধন্যবাদ জানানোর জন্যই চিঠি লেখেননি। যোহন তাকে একটা গুরুতর সমস্যার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্যও সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। কোনো কারণে, দিয়ত্রিফি নামে খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর একজন সদস্য, ভ্রমণকারী খ্রিস্টানদের প্রতি আতিথেয়তা দেখাতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি এমনকী অন্যদেরও আতিথেয়তা দেখানোর বিষয়ে বারণ করেছিলেন।—৩ যোহন ৯, ১০.
নিঃসন্দেহে, বিশ্বস্ত খ্রিস্টানরা এমনকী সম্ভব হলেও দিয়ত্রিফির সঙ্গে থাকতে চাইতেন না। তিনি মণ্ডলীতে প্রাধান্য লাভ করতে চাইতেন, যোহনকে গ্রাহ্য করতেন না আর এমনকী সেই প্রেরিত ও অন্যদের সম্বন্ধে খারাপ কথা ছড়াতেন। যদিও যোহন কখনোই তাকে একজন মিথ্যা শিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করেননি কিন্তু দিয়ত্রিফি সেই প্রেরিতের কর্তৃত্বের বিরোধিতা করেছিলেন। দিয়ত্রিফি প্রাধান্যপ্রিয় মনোভাব দেখিয়েছিলেন বলে ও সেইসঙ্গে খ্রিস্টের মতো আচরণ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বলে তার আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। দিয়ত্রিফির এই ঘটনা দেখায় যে, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও উদ্ধত ব্যক্তিরা হয়তো মণ্ডলীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী প্রভাব ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। তাই, যোহন গায়কে ও সেইসঙ্গে ব্যাপক অর্থে আমাদের প্রত্যেককে বলেছিলেন: “যাহা মন্দ, তাহার অনুকারী হইও না।”—৩ যোহন ১১.
উত্তম কাজ করার এক চমৎকার কারণ
দিয়ত্রিফির বিপরীতে, দীমীত্রিয় নামে একজন খ্রিস্টানকে যোহন একজন উদাহরণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। যোহন লিখেছিলেন, “দীমীত্রিয়ের পক্ষে সকলে . . . সাক্ষ্য দিয়াছে; এবং আমরাও সাক্ষ্য দিতেছি; আর তুমি জান, আমাদের সাক্ষ্য সত্য।” (৩ যোহন ১২) হতে পারে, দীমীত্রিয়ের গায়ের সাহায্যের প্রয়োজন ছিল আর তৃতীয় যোহন চিঠিটা হয়তো দীমীত্রিয়ের পরিচিতি ও সেইসঙ্গে তার সম্বন্ধে প্রেরিত যোহনের সুপারিশ হিসেবে কাজ করেছিল। সম্ভবত, দীমীত্রিয় নিজে এই চিঠিটা গায়ের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। যোহনের একজন বার্তাবাহক হিসেবে কিংবা সম্ভবত একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে দীমীত্রিয় হয়তো যোহনের লিখিত কথাগুলোর সত্যতা প্রমাণ করেছিলেন।
যেহেতু গায় ইতিমধ্যেই আতিথেয়তা দেখাচ্ছিলেন, তার পরও কেন যোহন তাকে তা দেখিয়ে চলার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন? যোহন কি গায়ের সাহসকে আরও বৃদ্ধি করার প্রয়োজন বোধ করেছিলেন? যোহন কি এই বিষয়টা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, যেহেতু দিয়ত্রিফি অতিথিপরায়ণ খ্রিস্টানদের মণ্ডলী থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তাই গায় হয়তো আতিথেয়তা দেখাতে ইতস্তত বোধ করবেন? যা-ই হোক না কেন, যোহন গায়কে এই কথাগুলো বলার মাধ্যমে আশ্বস্ত করেছিলেন: “যে উত্তম কার্য্য করে, সে ঈশ্বর হইতে।” (৩ যোহন ১১) এটা হল উত্তম কাজ করার এবং তা করে চলার এক চমৎকার কারণ।
যোহনের চিঠি কি গায়কে আতিথেয়তা দেখিয়ে চলার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল? যেহেতু তৃতীয় যোহন চিঠিটা বাইবেলের প্রামাণিক অংশে সংরক্ষিত করা হয়েছে, যাতে এটা ‘যাহা উত্তম, তাহার অনুকারী হইবার’ জন্য অন্যদের উৎসাহিত করতে পারে, তাই বলা যায় যে, গায় আতিথেয়তা দেখিয়ে চলার জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
তৃতীয় যোহন থেকে আমাদের জন্য শিক্ষা
প্রাচীন কালের এই প্রিয় ভাই গায় সম্বন্ধে আর কিছু জানা যায় না। তা সত্ত্বেও, তার জীবন সম্বন্ধে এই সংক্ষিপ্ত চিত্র আমাদের বেশ কয়েকটা শিক্ষা প্রদান করতে পারে।
প্রথমত, আমাদের মধ্যে অধিকাংশই, কিছুটা হলেও সেই বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের কারণে সত্যের বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে পেরেছি, যারা সেই জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ভ্রমণ করতে ইচ্ছুক ছিল। অবশ্য, বর্তমানে খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর সমস্ত সদস্যই যে সুসমাচারের কাজের জন্য দূরদূরান্তে ভ্রমণ করে, এমন নয়। কিন্তু, গায়ের মতো আমরাও কোনো-না-কোনো উপায়ে ভ্রমণকারী ভাই-বোনদের, যেমন সীমা অধ্যক্ষ ও তাদের স্ত্রীদের, সাহায্য করতে ও উৎসাহ দিতে পারি। অথবা আমরা হয়তো সেই ভাই-বোনদেরও ব্যাবহারিক উপায়ে সাহায্য করতে পারি, যারা যেখানে রাজ্যের প্রকাশকদের বেশি প্রয়োজন, সেখানে গিয়ে সেবা করার জন্য নিজেদের দেশের কোনো এলাকায় কিংবা বিদেশে যায়। তাই আসুন, আমরা ‘অতিথি-সেবায় রত হই।’—রোমীয় ১২:১৩; ১ তীম. ৫:৯, ১০.
দ্বিতীয়ত, বর্তমানে কদাচিৎ যদি মণ্ডলীতে কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তা হলে আমাদের অবাক হওয়া উচিত নয়। যোহনের কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল; প্রেরিত পৌলের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছিল। (২ করি. ১০:৭-১২; ১২:১১-১৩) তা হলে, মণ্ডলীতে আমরা যদি কারো কাছ থেকে একইরকম সমস্যার মুখোমুখি হই, তা হলে আমাদের কেমন প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত? পৌল তীমথিয়কে পরামর্শ দিয়েছিলেন: “যুদ্ধ করা প্রভুর দাসের উপযুক্ত নহে; কিন্তু সকলের প্রতি কোমল, শিক্ষাদানে নিপুণ, সহনশীল হওয়া, এবং মৃদু ভাবে বিরোধিগণকে শাসন করা তাহার উচিত।” এমনকী অন্যেরা যখন আমাদের প্ররোচিত করার চেষ্টা করে, তখনও আমরা যদি মৃদুতা বজায় রাখি, তা হলে অভিযোগকারী ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো তাদের মনোভাব পরিবর্তন করার জন্য অনুপ্রাণিত হবে। ফল স্বরূপ, যিহোবা “হয় ত . . . তাহাদিগকে মনপরিবর্ত্তন দান করিবেন, যেন তাহারা সত্যের তত্ত্বজ্ঞান প্রাপ্ত হয়।”—২ তীম. ২:২৪-২৬.
তৃতীয়ত, বিরোধিতা সত্ত্বেও অনুগতভাবে যিহোবার সেবা করে চলে এমন সহখ্রিস্টানদের বিশ্বস্ত কাজের জন্য তাদের প্রতি উপলব্ধি প্রকাশ করতে ও সেইসঙ্গে তাদের আন্তরিকভাবে প্রশংসা করতে হবে। নিশ্চিতভাবেই, প্রেরিত যোহন গায়কে উৎসাহিত করেছিলেন এবং তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, তিনি যা সঠিক, তা-ই করছেন। একইভাবে, বর্তমানে প্রাচীনদেরও তাদের ভাই-বোনদের উৎসাহিত করার মাধ্যমে যোহনের উদাহরণ অনুসরণ করা উচিত, যাতে ভাই-বোনেরা ‘শ্রান্ত না’ হয়ে পড়ে।—যিশা. ৪০:৩১; ১ থিষল. ৫:১১.
গায়ের প্রতি লেখা প্রেরিত যোহনের এই চিঠিটায় মূল গ্রিক পাঠ্যাংশে যেহেতু মাত্র ২১৯টা শব্দ রয়েছে, তাই এটা হল বাইবেলের সবচেয়ে ছোটো বই। তা সত্ত্বেও, বর্তমানে খ্রিস্টানদের জন্য এই চিঠি অত্যন্ত মূল্যবান।