জীবনকাহিনি
বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের যিহোবা প্রচুর আশীর্বাদ করেন
অনেক বছর আগে কারো সঙ্গে আপনার যে-কথা হয়েছিল, তা কি আপনার আজও মনে আছে? আমারও এইরকম একটা কথা আজও মনে আছে, যেটা ৫০ বছর আগে আমার বন্ধু আমাকে বলেছিল। সেই সময় আমরা কেনিয়াতে ছিলাম। আমরা দু-জন বেশ কয়েক মাস ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম এবং রোদে আমাদের গায়ের রং পালটে গিয়েছিল। আমরা দু-জন আগুন জ্বালিয়ে সেটার সামনে বসে ছিলাম আর একটা সিনেমা নিয়ে কথা বলছিলাম। সেখানে ধর্মের বিষয়ে কিছু বলা হয়েছিল। আমার বন্ধু তখন বলে, “এখানে বাইবেলের বিষয়ে যা বলা হয়েছিল, সেটা ঠিক ছিল না।”
ওর কথা শুনে আমি হেসে ফেলি। আমি জানতাম না, ধর্মের বিষয়ে ওর আগ্রহ রয়েছে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “তুই আবার বাইবেল সম্বন্ধে কী জানিস?” প্রথমে ও কিছুই বলল না। কিছুক্ষণ পর ও বলল যে, ওর মা একজন যিহোবার সাক্ষি ছিলেন এবং তিনি ওকে বাইবেলের বিষয়ে কিছু বলেছিলেন। আমি ওকে বলি, ও যেন আমাকেও সেই বিষয়ে কিছু বলে।
আমরা অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলতে থাকি। আমার বন্ধু বলল যে, বাইবেলে লেখা আছে, শয়তান এই জগতের শাসক আর সে-ই এই জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করছে। (যোহন ১৪:৩০) আপনারা হয়তো ছোটোবেলা থেকেই এটা জানেন, তবে আমি এটা প্রথম বার শুনছি। এত দিন আমি জানতাম, ঈশ্বর এই জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, যিনি আমাদের খুব ভালোবাসেন এবং কখনো কারো প্রতি অন্যায় করেন না। কিন্তু, চারপাশে আমি উলটোটাই দেখতে পেয়েছিলাম। আমার বয়স মাত্র ২৬ বছর ছিল, তবে এত কম বয়সেই এত খারাপ বিষয় দেখেছিলাম যে, আমি সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকতাম। তাই, আমার বন্ধু যা বলেছিল, সেই বিষয়ে আমি আরও জানতে চেয়েছিলাম।
আমার বাবা আমেরিকার এয়ার ফোর্সের একজন পাইলট ছিলেন। তাই, আমি ছোটোবেলা থেকেই শুনেছিলাম, যেকোনো সময় পরমাণু যুদ্ধ শুরু হতে পারে, শুধুমাত্র একটা বোতাম টেপার অপেক্ষা। আমি যখন ক্যালিফোর্নিয়ার একটা কলেজে পড়ছিলাম, তখন ভিয়েতনামে যুদ্ধ চলছিল। সেইসময় আমিও অন্য ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আন্দোলন করতে শুরু করি। পুলিশেরা হাতে লাঠি নিয়ে আমাদের তাড়া করত। তারা কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ত, যেটার কারণে আমাদের জন্য নিশ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে যেত আর আমরা কিছু দেখতেও পেতাম না। তা সত্ত্বেও, যা-ই হোক করে আমরা সেখান থেকে পালিয়ে যেতাম। চারিদিকে গণ্ডগোল চলছিল এবং লোকেরা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিল। রাজনীতি করার কারণে অনেক লোককে খুন করা হয়েছিল এবং লোকেরা দাঙ্গাহাঙ্গামা করছিল। কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়, এই ব্যাপারে প্রত্যেকের আলাদা আলাদা মতামত ছিল। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, কী হচ্ছিল।
১৯৭০ সালে আমি আলাস্কার উত্তর উপকূলে একটা চাকরি করতে শুরু করি এবং প্রচুর টাকা কামাই। এরপর, আমি প্লেনে করে লন্ডনে যাই এবং একটা মোটরসাইকেল কিনি। আমি সেটাতে চেপে দক্ষিণের দিকে রওনা দিই। আমি চিন্তা করিনি, কোথায় যাব। আমি শুধু চোখ বন্ধ করে চলেই যাচ্ছিলাম। কয়েক মাস পর আমি আফ্রিকায় পৌঁছাই। রাস্তায় আমার এমন লোকদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, যাদের জীবনে অনেক সমস্যা ছিল আর তারা চিন্তা করত, তারাও যদি আমার মতো সব কিছু ছেড়েছুড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে পারত, তা হলে কতই-না ভালো হত!
আমি যা-কিছু দেখেছিলাম এবং যা-কিছু শুনেছিলাম, তা থেকে আমার বাইবেলের এই শিক্ষাটা ঠিক বলে মনে হয়েছিল যে, শয়তান এই জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু এরপর আমি চিন্তা করি, “ঈশ্বর যদি এই জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করছেন না, তা হলে তিনি করছেনটা কী?”
কয়েক মাস পর আমি এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাই। সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার এমন লোকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল, যারা আলাদা আলাদা পরিস্থিতিতে বিশ্বস্তভাবে সত্য ঈশ্বরের সেবা করে যাচ্ছিল।
উত্তর আয়ার্ল্যান্ড—“বোমা ও বন্দুকের এলাকা”
কিছুসময় পর আমি লন্ডনে ফিরে আসি। সেখানে আমি আমার বন্ধুর মায়ের সঙ্গে দেখা করি এবং তিনি আমাকে একটা বাইবেল দেন। এরপর, আমি নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে চলে যাই। একদিন আমি রাস্তার ধারে একটা লাইট পোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে বাইবেল পড়ছিলাম, তখন একজন যিহোবার সাক্ষি সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি যখন আমাকে দেখেছিলেন, তখন তিনি আমাকে বাইবেল সম্বন্ধে বেশ কিছু কথা বলেছিলেন। তারপর আমি আয়ার্ল্যান্ডের ডাবলিন শহরে চলে যাই। সেখানে আমি যিহোবার সাক্ষিদের শাখা অফিসে যাই। আমি অফিসের দরজার কড়া নাড়ি আর সেখানেই ভাই আর্থার ম্যাথিউসের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি অনেক বুদ্ধিমান ছিলেন এবং তাঁর অনেক বছরের অভিজ্ঞতা ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, তিনি কি আমাকে বাইবেল অধ্যয়ন করাতে পারবেন? তাতে তিনি রাজি হয়ে যান।
আমি অনেক কিছু জানতে চেয়েছিলাম, তাই আমি মন দিয়ে বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করি। সাক্ষিদের যেকোনো প্রকাশনা আমি হাতে পেলেই, আমি সেই সব পড়ে ফেলতাম। এমনকী আমি পুরো বাইবেলও পড়ে ফেলেছিলাম। আমি যে-নতুন নতুন বিষয়গুলো শিখছিলাম, সেগুলো আমার এত ভালো লাগত যে, কী আর বলি! আমি যখন সভায় যেতাম, তখন আমি দেখতাম যে, ছোটো ছোটো বাচ্চারাও সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানে, যেগুলোর উত্তর বড়ো বড়ো পণ্ডিত ব্যক্তিরাও বছরের পর বছর ধরে দিতে পারেনি। যেমন, ‘জগতে এত মন্দতা কেন ছেয়ে রয়েছে? ঈশ্বর কে? মারা যাওয়ার পর কী হয়?’ এই দেশে আমার যত বন্ধু ছিল, তারা সবাই যিহোবার সাক্ষি ছিল। কারণ আমি সেখানে কাউকে চিনতাম না। সেই বন্ধুরা আমাকে যিহোবাকে জানতে অনেক সাহায্য করেছিল। আমি যিহোবাকে ভালোবাসতে শুরু করি এবং ঠিক করি, আমি তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করব।
১৯৭২ সালে আমি বাপ্তিস্ম নিই। এর এক বছর পর আমি অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে শুরু করি আমি উত্তর আয়ার্ল্যান্ডের নিউরি শহরের একটা ছোট্ট মণ্ডলীতে যোগ দিতে শুরু করি। সেখানে পাহাড়ি অঞ্চলে আমি পাথরের একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করি। সেখানে দূর দূর পর্যন্ত কাউকে দেখা যেত না। কিন্তু, সেই ঘরের পাশেই একটা খেত ছিল, যেখানে অনেক গরু থাকত আর আমি ওদের সামনে আমার বক্তৃতা প্র্যাকটিস করতাম। ওদের দেখে মনে হত, ওরা জাবর কাটতে কাটতে মন দিয়ে আমার বক্তৃতা শুনছে। এটা ঠিক, ওরা আমাকে বলতে পারত না যে, আমাকে কোথায় কোথায় উন্নতি করতে হবে, তবে এভাবে আমি এটা শিখতে পেরেছি, কীভাবে আমি শ্রোতাদের চোখে চোখ মিলিয়ে কথা বলতে পারি। ১৯৭৪ সালে আমাকে একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার জন্য বলা হয় এবং ভাই নাইজেল পিটকে আমার সঙ্গে সেবা করার জন্য পাঠানো হয়। আমরা দু-জন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠি।
সেইসময় উত্তর আয়ার্ল্যান্ডে রাজনীতি নিয়ে অনেক ঝামেলা চলছিল আর চারিদিকে অনেক দাঙ্গাহাঙ্গামা হচ্ছিল। তাই, সেখানকার লোকেরা সেই জায়গার একটা উপযুক্ত নাম দিয়েছিল: “বোমা ও বন্দুকের এলাকা।” রাস্তাঘাটে লড়াই ঝগড়া করা, বন্দুক চালানো এবং বোমা মেরে গাড়ি উড়িয়ে দেওয়া একটা সাধারণ বিষয় হয়ে গিয়েছিল। এই সব কিছুর পিছনে আসলে ধর্মেরই হাত ছিল। তবে, প্রোটেস্টান্ট এবং ক্যাথলিক চার্চের লোকেরা জানত, যিহোবার সাক্ষিরা রাজনৈতিক ব্যাপারে কারো পক্ষ নেয় না। তাই, আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি আর আমরা কোনো ভয় ছাড়াই প্রচার করতে পেরেছিলাম। অনেক বার তো এমনও হয়েছিল যে, আমরা ঘরে ঘরে প্রচার করছি আর সেইসময় লোকেরা আমাদের বলে দিয়েছে যে, কোথায় ও কখন দাঙ্গা হবে, যাতে আমরা সেখানে না যাই।
কিন্তু, বিভিন্ন সমস্যাও এসেছিল। একদিন আমি এবং ভাই ডেনিস ক্যারিগান, আমরা দু-জন পাশের একটা শহরে প্রচার করতে গিয়েছিলাম। তিনিও একজন অগ্রগামী ছিলেন। সেই এলাকায় কোনো যিহোবার সাক্ষি ছিল না এবং আমরা সেখানে এর আগে মাত্র এক বারই গিয়েছিলাম। সেখানে একটা চায়ের দোকানে একজন মহিলা আমাদের এই অভিযোগ দিয়েছিলেন যে, আমরা নাকি ব্রিটিশ গোয়েন্দা সৈন্য। তিনি হয়তো এমনটা মনে করেছিলেন কারণ আমাদের কথা বলার ধরন সেখানকার লোকদের মতো ছিল না। সেই সময় কেউ যদি সৈন্যদের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলত, তা হলে লোকেরা তাকে খুন করত অথবা তার হাঁটুতে গুলি মারত। তাই, সেই মহিলার কথা শুনে আমরা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তারপর আমরা বাইরে বের হয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। আমাদের খুব ঠাণ্ডা লাগছিল আর আশেপাশে কেউ ছিল না। তখন আমরা দেখি, একটা গাড়ি সেই দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। সেই মহিলা বাইরে বের হয়ে গাড়িতে থাকা দু-জন লোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন এবং কথা বলার সময়ে আমাদের দিকে আঙুল দেখাচ্ছিলেন। তারপর, সেই দু-জন লোক গাড়ি নিয়ে ধীরে ধীরে আমাদের কাছে এসেছিল এবং বাসের বিষয়ে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল। পরে যখন বাস এসেছিল, তখন তারা বাসের ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছিল। তবে, আমরা তাদের কথাবার্তা শুনতে পাইনি। বাস একেবারে খালি ছিল, তাই আমাদের মনে হয়েছিল, ‘এবার আর কিছু করার নেই! তারা নিশ্চয়ই তাকে বলছে যে, সে যেন আমাদের শহরের বাইরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়, যাতে তারা আমাদের ক্ষতি করতে পারে।’ কিন্তু, এমন কিছুই হয়নি। আমরা যখন বাস থেকে নামি, তখন ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করি, “তারা কি আমাদের সম্বন্ধে কিছু বলছিল?” তিনি বলেন, “আমি জানি, তোমরা কারা আর আমি ওদের বলেও দিয়েছি। চিন্তা কোরো না, তোমাদের কিছু হবে না।”
১৯৭৬ সালে ডাবলিন শহরে একটা জেলা সম্মেলন হয়।a সেখানে পলিন লোম্যাক্স নামে একজন বোনের সঙ্গে আমার দেখা হয়। সে ইংল্যান্ড থেকে এই সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিল আর সে একজন বিশেষ অগ্রগামী ছিল। সে যিহোবাকে ভালোবাসত এবং একজন নম্র বোন ছিল আর দেখতেও খুব সুন্দর ছিল। সে আর তার ভাই, রে লোম্যাক্স ছোটোবেলা থেকেই সত্যে ছিল। সেই জেলা সম্মেলনে আমাদের দেখা হওয়ার এক বছর পর আমরা দু-জন বিয়ে করে নিই। এরপর, উত্তর আয়ার্ল্যান্ডের বেলিমিনা শহরে আমরা বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে শুরু করি।
কিছুসময়ের জন্য আমি সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করি। আমাকে এবং পলিনকে বেলফাস্ট, লন্ডনডেরি এবং এরকমই অন্যান্য জায়গাগুলোতে যেতে হত, যেখানে অনেক বিপদ ছিল। এখানে এমন অনেক ভাই-বোনের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল, যারা আগে লোকদের সঙ্গে ভেদাভেদ করত, নিজেদের ধর্মের বিষয়ে খুবই গোঁড়া ছিল এবং যাদের মধ্যে একসময় ঘৃণা ভরে ছিল। কিন্তু, তারা যিহোবার উপর বিশ্বাস করেছিল এবং এই সমস্ত কিছু ছেড়েছিল। যিহোবা তাদের প্রচুর আশীর্বাদ করেছিলেন এবং তাদের সুরক্ষা জুগিয়েছিলেন। তাদের বিশ্বাস দেখে আমাদের উদ্যোগ আরও বেড়ে গিয়েছিল।
আমি প্রায় ১০ বছর আয়ার্ল্যান্ডে ছিলাম। তারপর, ১৯৮১ সালে গিলিয়েডের ৭২তম ক্লাসের জন্য আমাদের দু-জনকে ডাকা হয়েছিল। স্কুল শেষ হওয়ার পর আমাদের পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিওন দেশে সেবা করার জন্য পাঠানো হয়।
সিয়েরা লিওন—অভাবের মধ্যেও দৃঢ়বিশ্বাস
সেখানে আমরা একটা বাড়িতে আরও ১১ জন ভাই-বোনের সঙ্গে ছিলাম, যারা সেখানে মিশনারি হিসেবে সেবা করতে এসেছিল। তারা খুবই ভালো ছিল। সেই বাড়িতে শুধুমাত্র একটা রান্নাঘর, তিনটে টয়লেট, দুটো বাথরুম, একটা টেলিফোন, একটা ওয়াশিং-মেশিন এবং একটা ড্রায়ার বা কাপড় শোকানোর মেশিন ছিল। সেখানে হঠাৎ হঠাৎ কারেন্ট চলে যেত আর এমনটা প্রায়ই হত। বাড়ির ছাদে ইঁদুররা আস্তানা গেড়ে ছিল এবং বেসমেন্টে বিষধর সাপেরা চলাফেরা করত।
এইরকম একটা ঘরে থাকা মোটেও সহজ ছিল না, কিন্তু আমাদের প্রচার করতে খুব ভালো লাগত। লোকেরা বাইবেলকে অনেক সম্মান করত এবং আমরা যখন প্রচার করতাম, তখন তারা মন দিয়ে আমাদের কথা শুনত। অনেক লোক বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করেছিল এবং তারা যিহোবার সাক্ষি হয়েছিল। সেখানকার লোকেরা আমাকে “মিস্টার রবার্ট” আর পলিনকে “মিসেস রবার্ট” বলে ডাকত। কিছুসময় পর আমি শাখা অফিসের কাছ থেকে অনেক কাজ পেতে শুরু করি। তাই, প্রচারে খুব একটা বের হতে পারতাম না। সেইজন্য লোকেরা পলিনকে “মিসেস পলিন” এবং আমাকে “মিস্টার পলিন” বলে ডাকতে শুরু করেছিল। এটা শুনে পলিন খুব মজা পেত।
আমাদের অনেক ভাই-বোন খুবই গরিব ছিল, কিন্তু যিহোবা তাদের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর যত্ন নিয়েছিলেন। অনেকসময় তিনি এমনভাবে তাদের সাহায্য করেছিলেন, যেটা তারা চিন্তাও করতে পারেনি। (মথি ৬:৩৩) আমার মনে আছে, এমন একজন বোন ছিলেন, যার কাছে শুধু ততটুকুই টাকা ছিল, যেটা দিয়ে তিনি তার এবং তার বাচ্চাদের জন্য সেই দিনের খাবার কিনতে পারতেন। কিন্তু, তিনি সেই সব টাকা একজন ভাইকে দিয়ে দিয়েছিলেন, যার ম্যালেরিয়া হয়ে গিয়েছিল কারণ তার কাছে ওষুধপত্র কেনার মতো টাকা ছিল না। তবে, সেই দিনই একজন মহিলা তার চুল স্টাইল করার জন্য সেই বোনের কাছে এসেছিল এবং তাকে টাকা দিয়েছিল। সেই বোনের মতো অনেক ভাই-বোন নিজের চোখে দেখতে পেয়েছিল যে, কীভাবে যিহোবা তাদের যত্ন নিচ্ছিলেন।
নাইজেরিয়া—নতুন সংস্কৃতি শিখি
আমরা নয় বছর ধরে সিয়েরা লিওনে ছিলাম। তারপর আমাদের নাইজেরিয়ার শাখা অফিসে পাঠানো হয়। সেই শাখা অফিস অনেক বড়ো ছিল। আগে আমি সিয়েরা লিওনে যেমন কাজ করতাম, সেখানে আমাকে তেমনই কাজ দেওয়া হয়। কিন্তু, পলিনের জন্য সব কিছু নতুন ছিল। আগে ও ১৩০ ঘণ্টা প্রচার করত এবং এমন লোকদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করত, যারা সত্যিই উন্নতি করছিল। তবে, এখন ওকে সেলাইয়ের কাজ করতে হত। ছেঁড়া জামাকাপড় সেলাই করতে করতেই ওর দিন কেটে যেত। শুরুতে এই পরিবর্তন ওর জন্য সহজ ছিল না। কিন্তু ও যখন দেখেছিল, ভাই-বোনেরা ওর এই কাজের জন্য ওকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে, তখন ধীরে ধীরে বেথেলের এই কাজ ওর ভালো লাগতে শুরু করেছিল। আর ও সবসময় সুযোগ খুঁজত, যাতে ও বেথেলের ভাই-বোনদের উৎসাহ বাড়াতে পারে।
নাইজেরিয়ার লোকদের জীবনধারা এবং সংস্কৃতি অনেক আলাদা ছিল আর তখনও আমরা সেগুলো শিখছিলাম। একবার আমার অফিসে একজন ভাই এক বোনকে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য নিয়ে এসেছিলেন। যখনই আমি তার সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য আমার হাত বাড়াই, তখনই তিনি নীচু হয়ে আমার পায়ে পড়ে যান। এটা দেখে আমি চমকে যাই। সঙ্গেসঙ্গে দুটো শাস্ত্রপদ আমার মাথায় আসে: প্রেরিত ১০:২৫, ২৬ আর প্রকাশিত বাক্য ১৯:১০ পদ। আমি চিন্তা করি, ‘এই বোন করছেনটা কী? তাকে কি বারণ করব?’ কিন্তু, তখন আমি চিন্তা করি, এই বোনকে তো বেথেলে ডাকা হয়েছে, তাই তিনি নিশ্চয়ই এটা জানেন, বাইবেলে এই বিষয়ে কী লেখা রয়েছে।
যতক্ষণ আমাদের কথাবার্তা চলছিল, আমার একটু অস্বস্তি লাগছিল। কিন্তু, সেই বোন চলে যাওয়ার পর আমি এই বিষয়ে গবেষণা করি। গবেষণা করে আমি জানতে পারি, এটা হল সেখানকার লোকদের সংস্কৃতির একটা অংশ, যেটা সেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় লোকেরা এখনও মেনে চলে। এটা শুধু মহিলারাই নয়, কিন্তু পুরুষেরাও মেনে চলে। এমনটা তারা উপাসনা করার জন্য নয় বরং লোকদের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য করে থাকে। বাইবেলে লেখা রয়েছে, কিছু বিশ্বস্ত লোকও এইরকমটা করেছিল। (১ শমূ. ২৪:৮) আমি চিন্তা করেছিলাম, ভালোই হল আমি না বুঝে সেই বোনকে এমন কিছু বলে দিইনি, যেটার কারণে তিনি দুঃখ পেতে পারতেন।
নাইজেরিয়াতে এমন অনেক ভাই-বোনের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, যারা বছরের পর বছর ধরে বিশ্বস্তভাবে যিহোবার সেবা করে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ভাই আইজা আডাগ্বোনা।b যুবক বয়সেই তিনি সত্য শিখেছিলেন, কিন্তু পরে তার কুষ্ঠ রোগ হয়ে যায়। এইজন্য তাকে এমন একটা জায়গায় পাঠানো হয়, যেখানে সমস্ত কুষ্ঠ রোগী থাকত। সেখানে তিনি একাই যিহোবার সাক্ষি ছিলেন। তাকে অনেক বিরোধিতা করা হয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি প্রচার করে চলেছিলেন। তিনি ৩০ জনেরও বেশি কুষ্ঠ রোগীকে সাক্ষি হতে সাহায্য করেছিলেন এবং পরে সেখানে একটা মণ্ডলীও হয়।
কেনিয়া—ভাইয়েরা আমার প্রতি ধৈর্য ধরেছিল
১৯৯৬ সালে আমাদের কেনিয়ার শাখা অফিসে পাঠানো হয়। শুরুতে আপনাদের যে-ঘটনাটা বলেছিলাম, সেটার পর এই প্রথম বার আমি কেনিয়াতে ফিরে আসি। আমরা বেথেলে থাকতাম। সেখানে লোকদের ছাড়াও বাঁদররাও ঘুরতে আসত। ওরা যখনই কোনো বোনের হাতে ফল দেখত, সঙ্গেসঙ্গে সেটা “লুট” করে নিত। একবার কী হয়েছিল, একজন বোন তার ঘর থেকে বের হয়েছিলেন, কিন্তু জানলা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি যখন তার রুমে ফিরে আসেন, তখন দেখেন, বাঁদরের একটা দল মিলে তার রুমে আরাম করে বসে খাবার খাচ্ছে। ভয়ে বোন চিৎকার করে ওঠেন এবং রুম থেকে দৌড়ে পালিয়ে যান। এটা দেখে বাঁদররাও চিৎকার করে জানলা থেকে পালিয়ে যায়।
পলিন এবং আমি সোয়াহিলি ভাষার মণ্ডলীতে যোগ দিতে শুরু করি। কিছুসময় পর, আমাকে সেখানে মণ্ডলীর বই অধ্যয়ন (যেটাকে এখন মণ্ডলীর বাইবেল অধ্যয়ন বলা হয়) পরিচালনা করতে বলা হয়। এই নতুন ভাষা বলার ক্ষেত্রে আমি এখনও একটা কচি বাচ্চা ছিলাম। আমি অনেক আগে থেকেই অধ্যয়নের প্রস্তুতি নিতাম। তাই আমি প্রশ্ন তো ঠিকভাবেই পড়ে নিতাম, কিন্তু যদি ভাই-বোনদের উত্তর অনুচ্ছেদের একটু বাইরে চলে যেত, তা হলে আমি কিছুই বুঝতে পারতাম না। আমার অস্বস্তি লাগত এবং ভাই-বোনদের কথা চিন্তা করেও অনেক খারাপ লাগত। কিন্তু, ভাই-বোনেরা খুবই ধৈর্য ধরত এবং আমার বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করার বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি, তারা খুবই নম্র ছিল। তাদের এই বিষয়টা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল।
আমেরিকা—টাকাপয়সার উপর নয়, যিহোবার উপর দৃঢ়বিশ্বাস
আমরা কেনিয়াতে এক বছরও ছিলাম না। ১৯৯৭ সালে আমাদের নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন বেথেলে ডাকা হয়। এখানকার বেশিরভাগ লোক ধনী ছিল এবং এই কারণেও কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারত। (হিতো. ৩০:৮, ৯) কিন্তু, এখানকার ভাই-বোনেরা বিশ্বস্তভাবে যিহোবার সেবা করে যাচ্ছে। তারা নিজেদের সময় ও সম্পত্তি আরাম-আয়েশের পিছনে নয় বরং যিহোবাকে সেবা করার পিছনে কাজে লাগাচ্ছে।
এতগুলো বছর ধরে আমরা দেখেছিলাম, কীভাবে আমাদের ভাই-বোনেরা বিভিন্ন পরিস্থিতিতেও বিশ্বস্তভাবে যিহোবার সেবা করে যাচ্ছে। আয়ার্ল্যান্ডে লড়াই এবং দাঙ্গাহাঙ্গামা থাকা সত্ত্বেও ভাই-বোনদের বিশ্বাস মজবুত ছিল। আফ্রিকায় অভাব এবং নিজেদের প্রিয়জনদের কাছ থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও ভাই-বোনদের বিশ্বাস দুর্বল হয়ে পড়েনি। আর আমেরিকায়, যেখানে লোকেরা টাকাপয়সার উপর নির্ভর করে, সেখানকার ভাই-বোনেরাও যিহোবার উপর দৃঢ়বিশ্বাস রেখেছে। একটু চিন্তা করুন, যিহোবা যখন স্বর্গ থেকে নীচে দেখেন যে, তাঁর লোকেরা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে থাকা সত্ত্বেও তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত থাকে, তখন তিনি কতই-না খুশি হন!
সময় অনেক দ্রুত কেটে গিয়েছিল, ‘তন্তুবায়ের মাকু অপেক্ষা দ্রুত।’ (ইয়োব ৭:৬) বর্তমানে, আমরা নিউ ইয়র্কের ওয়ারউইকে বিশ্বপ্রধান কার্যালয়ে সেবা করছি। আজও আমরা এমন ভাই-বোনদের সঙ্গে সেবা করে খুশি হই, যারা মন থেকে একে অন্যকে ভালোবাসে। আজ আমরা যা করতে পারছি, তাতেই খুশি। আমরা জানি, আমাদের রাজা যিশু খ্রিস্ট আমাদের সঙ্গে রয়েছেন, তিনি খুব তাড়াতাড়ি সমস্ত বিশ্বস্ত সেবককে পুরস্কার দেবেন।—মথি ২৫:৩৪.
a আগে আঞ্চলিক সম্মেলনকে জেলা সম্মেলন বলা হত।
b ভাই আইজা আডাগ্বোনার জীবনকাহিনি পড়ার জন্য ১৯৯৮ সালের ১ এপ্রিল প্রহরীদুর্গ পত্রিকার ২২-২৭ পৃষ্ঠা দেখুন। তিনি ২০১০ সালে মারা যান।