যুবক-যুবতীদের জিজ্ঞাস্য . . .
আমার ওজন নিয়ে কেন আমি এত বেশি চিন্তিত?
“দিন রাত আমার মনে ভীষণ টানাপোড়েন চলতে থাকে। আমার এক মন বলে খেয়ে নিই কিন্তু অন্য মন বাধা দেয়, ভয় করে পাছে আমি খুব মোটা হয়ে যাই।”—জেমি
কোন্ বিষয়টাকে তুমি সবচেয়ে বেশি ভয় কর? অনেক মেয়েরা সঙ্গেই সঙ্গেই উত্তর দেবে: মোটা হওয়াকে। একটা সমীক্ষা দেখিয়েছিল যে আজকে যুবতী মেয়েরা মোটা হয়ে যাওয়াকে যতটা ভয় পায় ততটা ভয় তারা পরমাণু যুদ্ধ, ক্যানসার বা বাবামার মৃত্যুকেও পায় না!
কখনও কখনও অনেকে একেবারে ছোটবেলা থেকেই ওজন নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে শুরু করে দেয়। ড. ক্যাথরিন স্টিনার-এডেয়ার বলেন, এমনকি কিশোরী হওয়ার আগেই অনেক মেয়েরা একসঙ্গে জড়ো হয়ে “মোটা হয়ে যাওয়া নিয়ে কথাবার্তা বলে” আর তারা প্রত্যেকে তাদের শরীরের খুঁতগুলো নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু দেখা গেছে যে এটা শুধু হালকা কথাবার্তাই নয়। ২,৩৭৯ জন মেয়ের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ মেয়েই তাদের ওজন কমানোর জন্য সত্যিই চেষ্টা করছিল। আর এই মেয়েদের বয়স শুধু নয় দশ বছরই ছিল!
পরে এই মেয়েদের অনেকেই হয়ত ডায়েটিং করার ফাঁদে পড়ে যেতে পারে। এর চেয়েও খারাপ বিষয় হল যে কারও কারও দশা হয়ত ২০ বছর বয়সী জিনার মতো হতে পারে। তার উচ্চতা পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি আর ওজন মাত্র ৪০ কিলোগ্রাম। জিনা বলে, “আমি একদম খেতে চাই না। আমার সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা হল যে আমি তিন বছর ধরে অনেক চেষ্টা করে রোগা হয়েছি আর এখন খেতে শুরু করে এক মাসের মধ্যেই আমার তিন বছরের পরিশ্রমকে মাটি করে দেব।”
তুমি হয়ত জিনার অবস্থা বুঝতে পার। আর তুমিও হয়ত সবচেয়ে সুন্দরী হওয়ার জন্য রোগা হতে চাও। নিজের চেহারা সম্বন্ধে সচেতন থাকা দোষের কিছু নয়। কিন্তু রোগা হওয়ার পাগলামিতে জিনা প্রায় মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছে। কীভাবে?
না খেয়ে থাকা
জিনা খাওয়া সংক্রান্ত একটা মারাত্মক রোগের সঙ্গে লড়াই করছে যাকে খাদ্যভীতি বলে। এই একই রোগ জেমিরও আছে যার কথা শুরুতে বলা হয়েছে। কিছু সময় পর্যন্ত এই মেয়েরা সত্যিই না খেয়ে থেকেছিল আর এদের মতো আরও অনেকেই আছে। হিসাব করে দেখা গেছে যে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ১ জন খাদ্যভীতিতে ভোগে। এর মানে কোটি কোটি কম বয়সী মেয়েরা এই রোগে ভুগছে—আপনি হয়ত তাদের কাউকে কাউকে চেনেনও!a
খাদ্যভীতি রোগটা কখন শুরু হয়ে যায় তা জানাও যায় না। একটা মেয়ে হয়ত শুধু দু-এক কিলো ওজন কমানোর জন্য ডায়েটিং করতে শুরু করতে পারে, যেটাকে এমন কিছু ক্ষতিকর বলে মনে হয় না। কিন্তু সে তার লক্ষ্যে পৌঁছে খুশি হয় না। আয়নায় নিজেকে দেখে কপাল কুঁচকে সে বলে, “আমি এখনও অনেক মোটা!” তাই সে আরও একটু ওজন কমাবে বলে ঠিক করে। কিছুদিন পর আরেকটু। তারপর আরও একটু। আর এভাবেই তার মধ্যে খাদ্যভীতি রোগ শুরু হয়ে যায়।
এটা ঠিক যে ডায়েটিং করে এমন সবাই খাদ্যভীতিতে ভোগে না। মোটা হয়ে যাওয়া নিয়ে কেউ কেউ চিন্তা করে ঠিকই করে কারণ কয়েক কিলো ওজন কমানো তাদের জন্য হয়ত উপকারী। কিন্তু অনেক মেয়েদেরই নিজের শরীর সম্বন্ধে ভুল ধারণা রয়েছে। এফডিএ কনজিউমার পত্রিকা বলে নিজের শরীর সম্বন্ধে ভুল ধারণা রাখা বাঁকাচোরা আয়নায় নিজেকে দেখার সমান। এই পত্রিকা বলে, “তুমি নিজেকে ততটা মোটা দেখবে যতটা মোটা তুমি নও।”
তাই খাদ্যভীতিতে ভুগছে এমন মেয়েদের মোটা হয়ে যাওয়ার ভয় পেয়ে বসে, যদিও সে একেবারেই রোগা। সে হয়ত ওজন কমানোর জন্য নানারকম কসরত করতেই থাকে আর দিনের মধ্যে হাজারবার তার ওজন নিয়ে দেখে যে সে “আবার মোটা” হয়ে যাচ্ছে না তো। খাওয়ার সময় সে খুবই কম খায় বা একেবারেই কিছু খায় না। হেদার বলে, “স্কুলে খাওয়ার জন্য আমার মা রোজ খাবার বানিয়ে আমাকে দিতেন কিন্তু রোজই আমি তা ফেলে দিতাম। কয়েক দিনের মধ্যেই না খেয়ে থাকা আমার এতটাই অভ্যাস হয়ে যায় যে আমি খেতে চাইলেও আর খেতে পারতাম না। আমার খিদে পর্যন্ত লাগত না।”
প্রথম প্রথম হেদারের মতো খাদ্যভীতিতে ভুগছে এমন মেয়েরা ওজন কমতে দেখে খুবই খুশি হয়। কিন্তু পরে পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাবের কারণে তাদের মাশুল দিতে হয়। তারা সবসময় ঝিমাতে থাকে আর সবকিছুতেই অনীহা এসে যায়। এর ফলে পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটে। তাদের মাসিক হয়ত বন্ধ হয়ে যায়।b একসময় তাদের হৃদস্পন্দন ও রক্ত চাপ একেবারেই কমে যেতে পারে যা খুবই মারাত্মক। এছাড়াও তখন তাদের কোন বিপদ সম্বন্ধেই জ্ঞান থাকে না। তারা শুধু একটা বিপদের কথাই বুঝতে পারে যা হল তাদের হারানো ওজন ফিরে পাওয়া—এমনকি এক কিলো ওজন বাড়লেও।
কিন্তু খাদ্যভীতিই একমাত্র খাওয়া সংক্রান্ত রোগ নয় বা এটাই যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় তাও না। ক্ষুধাধিক্য হল এমন এক মহামারী যাতে খাদ্যভীতির তুলনায় তিন গুণ বেশি মেয়েরা ভোগে। এছাড়াও বেশি খাওয়ার বাতিক আছে যা অনেকটা ক্ষুধাধিক্যের মতোই। আসুন এই রোগগুলোর দিকে আমরা একটু ভাল করে নজর দিই।
লুকোনো মহামারী
“আমার এক বান্ধবী কিছুদিন হল স্বীকার করেছে যে সে খাবার চুরি করে লুকিয়ে লুকিয়ে খায়। তারপর সে গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করে। সে বলেছে যে গত দুবছর ধরে সে এরকমই করছে।” এই কথাগুলো একটা কম বয়সী মেয়ে এক পত্রিকার পরামর্শ কলামে লিখেছে আর এটাই ক্ষুধাধিক্য রোগের একটা বড় উপসর্গ।
এই রোগে ভুগছে এমন মেয়েরা কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অনেক খাবার খেয়ে ফেলে। তারপর যা তারা খেয়েছে সেটাকে বাইরে বের করে দেওয়ার জন্য গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করে।c এটা মানতেই হবে যে এভাবে পেট খালি করা খুবই জঘন্য কাজ। কিন্তু, সমাজকর্মী ন্যান্সী জে. কলোডনি লেখেন: “আপনি যতবার খাবার খাবেন আর যতবার তা বের করে দেবেন ততই তা আপনার জন্য সহজ হয়ে দাঁড়াবে। প্রথমদিকে আপনার ঘেন্না লাগতে পারে বা হয়ত আপনি ভয়ও পেতে পারেন কিন্তু পরে তা আপনার বার বার করতে ইচ্ছা হবে।”
খাদ্যভীতি এবং ক্ষুধাধিক্যকে “একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ” বলা হয়। যদিও এদের উপসর্গগুলো আলাদা আলাদা কিন্তু এই দুটো রোগই খাবার সম্বন্ধে কিছু ভুল ধারণার কারণে হয়ে থাকে।d কিন্তু, ক্ষুধাধিক্যকে খুব সহজেই লুকিয়ে রাখা গেলেও খাদ্যভীতিকে রাখা যায় না। কারণ খুব বেশি খাওয়ার ফলে ব্যক্তির ওজন কমার ভয় থাকে না আবার পেট খালি করে ফেলায় ওজন বাড়ারও ভয় থাকে না। তাই, ক্ষুধাধিক্যে ভুগছে এমন মেয়েরা বেশি মোটা বা রোগা হয় না আর সবার কাছে তার খাওয়ার অভ্যাসকে স্বাভাবিক বলেই মনে হতে পারে। লিনজি নামে এক মহিলা বলেন, “আমি অনেক বেশি বেশি খেতাম আর দিনে চার পাঁচবার বমি করতাম। . . . কেউ জানত না যে আমার ক্ষুধাধিক্য রোগ আছে কারণ আমি তা আমার মন ভোলানো চেহারা, হাসিখুশি ভাব এবং শরীরের ওজনের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলাম।”
কিন্তু বেশি খাওয়ার বাতিকে ভোগেন এমন ব্যক্তির ব্যাপারগুলো কিছুটা আলাদা। ক্ষুধাধিক্যে আক্রান্ত ব্যক্তির মতোই এই ব্যক্তিও একসঙ্গে অনেক বেশি খান। দ্যা নিউ টিনএজ বডি বুক বলে: “এরা বেশি বেশি খান কিন্তু পেট খালি করেন না, তাই বেশি খাওয়ার বাতিক আছে এমন ব্যক্তির ওজন অনেক বেড়ে যায় বা তিনি খুব বেশি বা অস্বাভাবিকরকম মোটা হয়ে যান।”
স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর
এই তিন ধরনের রোগই একজন ব্যক্তির স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক বিপদ নিয়ে আসতে পারে। খাদ্যভীতির কারণে অপুষ্টি আর অনেক সময় মৃত্যুও হতে পারে। হিসাব করে দেখা গেছে যে ১৫ শতাংশ লোক এই কারণে মারাও যায়। পেট খালি করা হোক বা নাই হোক, অনেক বেশি খাওয়া তোমার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বেশি মোটা হয়ে যাওয়ার জন্য পরে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস আর এমনকি কয়েক ধরনের ক্যানসারও হতে পারে। গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করলে খাদ্যনালী ছিঁড়ে যেতে পারে আর জোলাপ ও প্রশ্রাবের বেগ বাড়ানোর ওষুধ খুব বেশি খেলে তা হৃদস্পন্দনকে কিছুক্ষণের জন্য বা চিরতরেই থামিয়ে দিতে পারে।
যাইহোক, এই রোগগুলোর আরও একটা ক্ষতিকর দিক রয়েছে যা আলোচনা করা দরকার। খাদ্যভীতি, ক্ষুধাধিক্য ও বেশি খাওয়ার বাতিক আছে এমন মেয়েরা সাধারণত অসুখী হয়। তাদের মধ্যে আত্মসম্মানের অভাব থাকে আর সারাক্ষণই দুশ্চিন্তা ও অবসাদে ভোগে। তাদের সাহায্যের দরকার। কিন্তু যারা এই রোগে ভুগছেন তাদেরকে ওজন নিয়ে এত বেশি চিন্তিত হওয়া থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য কীভাবে সাহায্য করা যেতে পারে? এই ধারাবাহিক প্রবন্ধের পরেরটাতে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে।
[পাদটীকাগুলো]
a ছেলেরাও খাদ্যভীতিতে ভোগে। কিন্তু মেয়েরাই যেহেতু বেশি খাদ্যভীতিতে ভোগে তাই আমরা খাদ্যভীতির রোগীদের স্ত্রী লিঙ্গে উল্লেখ করব।
b ডাক্তারি শাস্ত্র অনুযায়ী, একজন মেয়েকে তখনই খাদ্যভীতিতে ভুগছে বলে বলা যায় যখন তার ওজন স্বাভাবিক ওজনের চেয়ে ১৫ শতাংশ কমে যায় ও তিন মাস কিংবা আরও বেশি সময় ধরে মাসিক বন্ধ থাকে।
c পেট খালি করার অন্য পদ্ধতিগুলো হল জোলাপ কিংবা প্রশ্রাবের বেগ বাড়ানোর ওষুধ খাওয়া।
d বেশ কিছু রোগীরা কিছুদিন খাদ্যভীতি আর কিছুদিন ক্ষুধাধিক্য রোগে ভোগেন।
[২১ পৃষ্ঠার বাক্স]
শরীর সম্বন্ধে ভুল ধারণা
বেশিরভাগ মেয়েরা বিনা কারণে তাদের ওজন নিয়ে দুশ্চিন্তা করে। ৫ থেকে ১৭ বছরের মেয়েদের ওপর করা এক সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে যে ৫৮ শতাংশ মেয়েরাই মনে করেছিল যে তারা মোটা কিন্তু তাদের মধ্যে আসলে শুধু ১৭ শতাংশ মেয়েরা মোটা ছিল। আরেকটা সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ৪৫ শতাংশ মহিলা যাদের ওজন আসলে স্বাভাবিক ওজনের চেয়ে কম তারাও মনে করেন যে তারা খুবই মোটা! কানাডায় করা এক সমীক্ষা থেকে দেখা যায় যে, সেখানে ৭০ শতাংশ মহিলারা তাদের ওজন নিয়ে চিন্তিত এবং ৪০ শতাংশ মহিলারা ইয়ো-ইয়ো ডায়েটিং করেন যার মানে হল তারা ওজন কমান আর পরে আবার তা বেড়ে যায় আর এভাবেই চলতে থাকে।
এ কথাটা স্পষ্ট যে, শরীর সম্বন্ধে ভুল ধারণা থাকায় কিছু মেয়েরা এমন কিছু নিয়ে এত বেশি ভাবে যা আসলে কোন সমস্যাই নয়। ১৬ বছর বয়সী ক্রিস্টিন বলে, “আমার এক বান্ধবী ওজন কমানোর জন্য একগাদা ওষুধ খায় আর আমি এমন কিছু মেয়েদের চিনি যাদের খাদ্যভীতি রয়েছে।” সে একথাও বলে যে: “আসলে তারা কেউই মোটা নয়।”
এফডিএ কনজুমার পত্রিকা ঠিক পরামর্শই দেয়: “সবাই ডায়েটিং করছে বলে তুমিও করবে বা তুমি যতটা রোগা হতে চাও ততটা রোগা নও বলে ডায়েটিং করবে, এরকম না করে বরং একজন ডাক্তার বা পুষ্টি বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে দেখ যে তোমার বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী তোমার ওজন বেশি না কম বা তুমি বেশি মোটা কিনা।”
[২২ পৃষ্ঠার চিত্র]
অনেকেই বিনা কারণে তাদের ওজন নিয়ে দুশ্চিন্তা করে