বাইবেলের দৃষ্টিভঙ্গি
আসলেই কি তিনজন রাজা বৈৎলেহমে শিশু যীশুকে দেখতে এসেছিলেন?
যীশুর জন্মের পর, পূর্ব দেশ থেকে বিশিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তি যিহুদিদের রাজা যীশুকে প্রণাম করার জন্য বৈৎলেহমে এসেছিলেন। সেই দিন থেকে এই ঘটনা লোকেদের এত বেশি প্রিয় হয়ে উঠেছে যে সারা পৃথিবীর লোকেরা যখন বড়দিন পালন করেন, তারা এই ঘটনার কথা মনে করেন।
কিছু এলাকার লোকেরা যীশুর জন্মের যে দৃশ্যগুলো তৈরি করেন তাতে তারা দেখান যে পূর্ব দেশের তিনজন রাজা শিশু যীশুর জন্য উপহার নিয়ে এসেছিলেন। কিছু দেশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা “পবিত্র রাজাদের” মতো পোশাক পরে তাদের বাড়ির আশেপাশে শোভাযাত্রা করে। এমনকি বিংশ শতাব্দীতেও সব জায়গার লোকেরা সেই অতিথিদের কথা মনে রেখেছেন। কিন্তু এই ব্যক্তিরা আসলে কারা?
তারা কি আসলেই রাজা ছিলেন?
এই ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ বাইবেলে মথির বইয়ে পাওয়া যায়। সেখানে আমরা পড়ি: “যীশুর জন্মের পর . . . পূর্ব দেশ থেকে কয়েকজন জ্যোতিষী যিরূশালেমে এসে জিজ্ঞেস করেন, ‘যিহূদীদের যে রাজা জন্মেছেন তিনি কোথায়? আমরা তাঁর তারা উঠতে দেখেছি, ও তাঁকে প্রণাম করতে এসেছি।’” (মথি ২:১, ২, নিউ আ্যমেরিকান বাইবেল) কেন এই বাইবেল অনুবাদ অতিথিদের রাজা না বলে পূর্ব দেশ থেকে আসা কয়েকজন জ্যোতিষী বলে?
শাস্ত্র এখানে গ্রিক শব্দ মাগোস এর জন্য বহুবচন শব্দ ব্যবহার করেছে। বিভিন্ন বাইবেল অনুবাদকেরা এই ইব্রীয় শব্দকে “পণ্ডিত,” “জ্যোতিষী” বা “গণক” হিসেবে অনুবাদ করেছেন অথবা তারা কিছু কিছু অনুবাদে ইংরেজি শব্দ “ম্যাজাই” লিখে দিয়েছেন। এই শব্দগুলো তাদেরকে বোঝায়, যারা তারার ও গ্রহের অবস্থা দেখে পরামর্শ দেন এবং ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বলতে পারেন। বাইবেল বলে যে যারা বৈৎলেহমে যীশুকে দেখতে এসেছিলেন তারা ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বলতে পারতেন ও জাদুবিদ্যা চর্চা করতেন, যা ঈশ্বর কখনও অনুমোদন করেন না।—দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:১০-১২.
এছাড়াও তারা কি আসলেই রাজা ছিলেন? তারা যদি সত্যিই রাজা হতেন তাহলে বাইবেল তাদের রাজা বলেই উল্লেখ করত। মথি ২:১-১২ পদে “রাজা” শব্দটা চার বার ব্যবহার করা হয়েছে, একবার যীশুর জন্য আর তিনবার রাজা হেরোদের জন্য। কিন্তু এখানে একবারও ম্যাজাইদের রাজা বলা হয়নি। এই বিষয়ে দ্যা ক্যাথলিক এনসাইক্লোপিডিয়া বলে: “কোন খ্রীষ্টান লেখকই ম্যাজাইদেরকে রাজা বলে বিশ্বাস করতেন না।”
তারা কি তিনজন এসেছিলেন?
বাইবেলে বলে না যে কতজন ম্যাজাই যীশুকে দেখতে এসেছিলেন। তবুও যীশুর জন্মের দৃশ্য এবং বড়দিনের গানগুলো থেকে দেখা যায় যে লোকেরা মনে করেন সেখানে তিনজন ম্যাজাই এসেছিলেন। তারা কেন এমন মনে করেন তার কারণ এটা হতে পারে যে যীশুকে তিন ধরনের উপহার দেওয়া হয়েছিল। উপহার সম্বন্ধে বাইবেল বলে: “আপনাদের ধনকোষ খুলিয়া তাঁহাকে স্বর্ণ, কুন্দুরু ও গন্ধরস উপহার দিলেন।”—মথি ২:১১.
কিন্তু তাই বলে কি একথা ধরে নেওয়া ঠিক হবে যে যেহেতু ম্যাজাইরা তিন ধরনের উপহার দিয়েছিলেন তাই সেখানে তিনজন ম্যাজাই এসেছিলেন? আসুন আমরা ইস্রায়েলের আরেকজন বিশিষ্ট অতিথির কথা দেখি। একবার শিবার রানি রাজা শলোমনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন এবং তাকে ‘বিপুল ঐশ্বর্য্যসহ, সুগন্ধি দ্রব্য, অতি বিস্তর স্বর্ণ ও মনি’ উপহার দিয়েছিলেন। (১ রাজাবলি ১০:২) যদিও এখানে তিনধরনের উপহারের কথা বলা হয়েছে কিন্তু শুধু একজন ব্যক্তিই অর্থাৎ শিবার রানিই সেগুলো রাজাকে দিয়েছিলেন। এই উপহারের মানে ছিল না যে তিনজন ব্যক্তি শলোমনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। একইভাবে যীশু যে তিন ধরনের উপহার পেয়েছিলেন তা থেকে ধরে নেওয়া যায় না যে কেবল তিনজন ব্যক্তিই তাঁকে দেখতে এসেছিলেন।
দ্যা ক্যাথলিক এনসাইক্লোপিডিয়া বলে: “সুসমাচারের বই বলে না যে কতজন ম্যাজাই এসেছিলেন। আর এ সম্বন্ধে লোকেদের আলাদা আলাদা ধারণা রয়েছে। কিছু কিছু খ্রীষ্টান লেখক মনে করেন যে যীশুকে যেহেতু তিনটে উপহার দেওয়া হয়েছিল তাই বলা যেতে পারে যে তিনজন ম্যাজাই এসেছিলেন।” এই একই এনসাইক্লোপিডিয়া বলে, কিছু কিছু ছবিতে দেখা যায় যে যীশুকে দুইজন, তিনজন, চারজন এবং এমনকি আটজনও দেখতে এসেছিলেন। কেউ কেউ মনে করেন যে যীশুকে ১২ জন দেখতে এসেছিলেন। আসলে আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন আমাদের জানার কোন উপায়ই নেই যে ঠিক কতজন ম্যাজাই এসেছিলেন।
জনপ্রিয় কিন্তু মনগড়া গল্প
সারা পৃথিবীর লোকেরা জানেন যে যীশু যখন জন্মেছিলেন তখন ম্যাজাইরা যীশুকে দেখতে বৈৎলেহমে এসেছিলেন। কিন্তু তা ঠিক নয়, কারণ তারা প্রথমে যিরূশালেমে গিয়েছিলেন আর যীশুর জন্মের সময় তারা বৈৎলেহমে ছিলেন না। বাইবেল বলে যে পরে যখন তারা বৈৎলেহমে যান তখন “তাঁহারা গৃহমধ্যে গিয়া শিশুটীকে . . . দেখিতে পাইলেন।” (মথি ২:১, ১১) তাই এটা পরিষ্কার যে ম্যাজাইরা যখন যীশুকে দেখতে এসেছিলেন তখন তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে একটা ঘরে বাস করতেন। তারা তাকে যাবপাত্রে শোয়ানো অবস্থায় দেখেননি।
বাইবেল অনুসারে, তিনজন রাজা যীশুকে সম্মান জানানোর জন্য যে তাঁর জন্মের সময় এসেছিলেন সেই জনপ্রিয় গল্প ঠিক নয়। যেমন শুরুতে আমরা পড়েছি যে যীশুকে দেখতে যে ম্যাজাইরা এসেছিলেন তারা রাজা ছিলেন না কিন্তু জ্যোতিষী ছিলেন, যারা জাদুবিদ্যা চর্চা করতেন। আর বাইবেল বলে না যে তারা কতজন ছিলেন। এছাড়াও তারা যীশুর জন্মের সময়ই তাঁকে দেখতে যাননি যখন তিনি যাবপাত্রে শোয়ানো ছিলেন বরং কিছুদিন পর যখন তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে একটা ঘরে বাস করতেন তখন তাঁকে দেখতে এসেছিলেন।
এই তিন রাজার জনপ্রিয় গল্প ও বড়দিনের আরও অন্যান্য গল্প বাইবেল অনুসারে ঠিক নয় কিন্তু তবুও লোকেরা এই গল্পকে এইজন্য পছন্দ করে যে এগুলো ছেলে বুড়ো সকলের মন ভোলায়। কিন্তু সত্য খ্রীষ্টানদের দৃষ্টিভঙ্গি এই লোকেদের থেকে একেবারে আলাদা কারণ তারা এমন উপাসনা করেন যেখানে মিথ্যার কোন স্থান নেই। যীশু নিজেও এইরকম মনে করতেন। পিতার কাছে প্রার্থনা করার সময় একবার তিনি বলেছিলেন: “তোমার বাক্যই সত্যস্বরূপ।” (যোহন ১৭:১৭) আর তিনি এও বলেছিলেন যে “প্রকৃত ভজনাকারীরা আত্মায় ও সত্যে পিতার ভজনা করিবে; কারণ বাস্তবিক পিতা এইরূপ ভজনাকারীদেরই অন্বেষণ করেন।”—যোহন ৪:২৩.
[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
“ম্যাজাইদের ভক্তি প্রদর্শন”