এক প্রাচীন শপথ এর আধুনিক তাৎপর্য
সাধারণ কাল পূর্ব প্রায় ৪০০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক হিসেবে পরিচিত একজন গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস হিপোক্রেটিক শপথটা লিখেছিলেন। সেই মহৎ নৈতিক মতবাদ এখনও চিকিৎসা পেশায় নির্দেশনা জোগায়। আপনাকে কি তা-ই শেখানো হয়েছে? যদি তা-ই হয়, তা হলে আপনি একা নন। কিন্তু এগুলোর সবই কি প্রকৃত সত্য?
বিভিন্ন তথ্য দেখায় যে, হিপোক্রেটিস হয়তো তার নাম বহনকারী এই শপথটার লেখক ছিলেন না। এ ছাড়া, আজকের চিকিৎসা জগতের ব্যক্তিরা এই নীতিগুলোকে শুরুতে যেভাবে লেখা হয়েছিল, সেগুলোর সঙ্গে সবসময় একমত হয় না।
এই প্রাচীন শপথটা আসলে কে লিখেছিলেন, তা কি আপনি জানেন? আর এমনকি যদি আমরা জানিও, তবুও আমাদের দিনে এই শপথের কি কোনো তাৎপর্য রয়েছে?
হিপোক্রেটিস কি শপথটা লিখেছেন?
হিপোক্রেটিস আদৌ শপথটা লিখেছিলেন কি না, সেই সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলার বহু কারণ রয়েছে। একটা কারণ হল যে, বেশ কয়েক জন দেবদেবীর নামে এই শপথটা শুরু হয়। কিন্তু, হিপোক্রেটিসকে সেই ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যিনি সবচেয়ে প্রথম ধর্ম থেকে চিকিৎসাকে আলাদা করেছিলেন এবং অসুস্থতার কারণগুলোর জন্য অতিমানবীয় বিষয়গুলোকে নয় বরং শারীরিক বিষয়গুলোকে দায়ী করেছিলেন।
এ ছাড়া, শপথে নিষিদ্ধ বেশ কয়েকটা বিষয় হিপোক্রেটিসের দিনে যেধরনের চিকিৎসা করা হতো, সেগুলোর বিপরীত ছিল না। (২৩ পৃষ্ঠায় দেওয়া বাক্সটা দেখুন।) উদাহরণস্বরূপ, হিপোক্রেটিসের দিনে আইন অথবা অধিকাংশ ধর্মীয় মানগুলোর দ্বারা গর্ভপাত ও আত্মহত্যার বিচার করা হতো না। এ ছাড়া, শপথ গ্রহণকারী ব্যক্তিরা অস্ত্রোপচারের দায়িত্ব শল্যচিকিৎসকদের ওপর ছেড়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করত। অথচ, শল্যচিকিৎসার পদ্ধতিগুলো হিপোক্রেটিক বইগুলোর অংশ ছিল, যেগুলো হচ্ছে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন সাহিত্য, যা লেখার কৃতিত্ব প্রায়ই হিপোক্রেটিস ও অন্যান্য প্রাচীন লেখকদের দেওয়া হয়ে থাকে।
তাই, যদিও এই প্রশ্নটি এখনও পণ্ডিত ব্যক্তিদের মধ্যে এক বিতর্কিত বিষয় হয়ে রয়েছে, এইজন্য খুব সম্ভবত হিপোক্রেটিক শপথ আসলে হিপোক্রেটিস লেখেননি বলেই মনে হয়। শপথে অভিব্যক্ত দার্শনিক চিন্তাধারা সা.কা.র্পূ. চতুর্থ শতাব্দীর পিথাগোরীয়দের দর্শনবাদের সঙ্গে খুব ভালভাবে মিলে যায়, যারা জীবনের পবিত্রতা সম্বন্ধীয় আদর্শগুলো গ্রহণ করেছিল এবং শল্যচিকিৎসা পদ্ধতিগুলোর বিরুদ্ধে ছিল।
পতন ও পুনরুদয়
শপথের লেখক আসলে যে-ই হোন না কেন, যে-বিষয়টা সম্বন্ধে কোনো বিতর্ক নেই সেটা হল, পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে ও বিশেষ করে নৈতিকতার ক্ষেত্রে শপথটা যে-তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। এই শপথকে বলা হয়েছে “চিকিৎসাবিজ্ঞানে নিখুঁত নৈতিক ধারণাগুলোর অগ্রগতির শিখর,” “উন্নত জগতে ডাক্তার ও রোগীর সম্পর্কের ভিত্তি,” এবং “ডাক্তারি পেশায় নৈতিকতার সর্বোচ্চ ধাপ।” ১৯১৩ সালে, কানাডার একজন বিখ্যাত ডাক্তার সার উইলিয়াম ওসলার বলেছিলেন: “এটা হিপোক্রেটিসের দিনের কি না, সেটা বড় বিষয় নয় . . . কারণ পঁচিশ শতাব্দী ধরে এটা ডাক্তারি পেশার ‘মতবাদ’ হয়ে রয়েছে এবং ডাক্তারি ডিগ্রি পাওয়ার জন্য বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও এই কথাগুলো বলে শপথ নেওয়া হয়।”
তবে, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কিছু সময় ধরে, সম্ভবত সেই সময়ে হওয়া বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিগুলোর কারণে এই শপথকে অনুমোদন করা হয়নি। যুক্তিবাদিতার ক্রমবর্ধমান পরিবেশে, শপথটা হয়তো সেকেলে ও অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু এমনকি বিজ্ঞানের উন্নতি সত্ত্বেও, নৈতিক নীতিগুলোর প্রয়োজন হয়েই এসেছে। হতে পারে এই কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শপথকে পুনরায় অনুমোদন করা হচ্ছে।
ডাক্তারদের মেডিক্যাল স্কুলে ভরতি অথবা সেখান থেকে স্নাতক হওয়ার সময় শপথ নেওয়া আবারও এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। ১৯৯৩ সালে, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মেডিক্যাল স্কুলগুলোতে করা সমীক্ষা ইঙ্গিত করেছিল যে, যেসমস্ত স্কুলে সমীক্ষা করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ৯৮ শতাংশ স্কুলে কোনো না কোনো ধরনের শপথ নেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। ১৯২৮ সালে, মাত্র ২৪ শতাংশ স্কুলে তা করা হতো। যুক্তরাজ্যে, একইধরনের একটা সমীক্ষা দেখায় যে, বর্তমানে শতকরা প্রায় ৫০ শতাংশ স্কুল কোনো একটা শপথ বা ঘোষণাপত্র ব্যবহার করে। অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডেও এই সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন
কিন্তু হিপোক্রেটিসের শপথটা পরিবর্তনশীল; শতাব্দী ধরে খ্রিস্টীয়জগতের প্রচলিত বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করার জন্য এটাতে নানা রদবদল করা হয়েছে। মাঝেমধ্যে অন্যান্য বিতর্কিত বিষয়গুলো যেমন মহামারীতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের যত্ন নেওয়ার মতো বিষয়ের জন্য নানা পরিবর্তন করা হয়েছে। অতি সম্প্রতি, আধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য এটাকে রদবদল করা হয়েছে।
শপথের বিভিন্ন সংস্করণে, যে-ধারণাগুলো আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানকে প্রতিফলিত করে না, সেগুলোকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে আর সমসাময়িক সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলোকে যোগ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, রোগীর অধিকার সম্বন্ধীয় নীতিটি বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের মুখ্য বিষয় কিন্তু প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসায় এর কোনো ভূমিকাই ছিল না আর তা হিপোক্রেটিক শপথেরও কোনো অংশ ছিল না। রোগীর বিভিন্ন অধিকার সম্বন্ধীয় নীতিটি বর্তমানে ব্যবহৃত অনেক ঘোষণাপত্রের এক বিশেষ অংশ হয়ে রয়েছে।
এ ছাড়া, সবদিক জেনেশুনে নেওয়া আমাদের সিদ্ধান্তের মতো কিছু নীতিকে অন্তর্ভুক্ত করার দ্বারা ডাক্তার-রোগীর সম্পর্কে পরিবর্তন এসেছে আর এই নীতিটি দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাই এটা স্বাভাবিক যে, খুব কম সংখ্যক মেডিক্যাল স্কুলে এখনও সেই পুরনো ধাঁচের হিপোক্রেটিক শপথটা নেওয়া হয়।
শপথের মধ্যে করা অন্যান্য পরিবর্তন দেখে সম্ভবত আরও আশ্চর্য লাগতে পারে। ১৯৯৩ সালে, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় নেওয়া শপথগুলোর মধ্যে শতকরা মাত্র ৪৩টা শপথে এই অঙ্গীকারটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যে, ডাক্তারদের তাদের কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে, যেখানে শপথের আধুনিক সংস্করণগুলোর অধিকাংশেই বলা আছে যে, শপথের শর্তগুলো লঙ্ঘন করার জন্য কোনো শাস্তি নেই। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের জন্য যন্ত্রণাহীন মৃত্যুকে (ইউথানেজিয়া), গর্ভপাতকে ও দেবদেবীর কাছে সাহায্য চাওয়াকে প্রত্যাখ্যান করা এমনকি নেই বললেই চলে এবং রোগীদের সঙ্গে কোনোরকম যৌনসম্পর্ক না করার অঙ্গীকারের বিষয়টা সমীক্ষাকৃত স্কুলগুলোর মধ্যে শতকরা মাত্র ৩টা স্কুলের ঘোষণাপত্রে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
একটা শপথের মূল্য
হিপোক্রেটিক শপথে যদিও অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে কিন্তু শপথগুলো নেওয়া প্রায়ই সেই পেশার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়ে থাকে, যেটা মূলত মহৎ ও নৈতিক নীতিগুলোর প্রতি নিজেদের নিয়োজিত করে। ওপরে উল্লেখিত ১৯৯৩ সালের সমীক্ষা থেকে জানা গেছে যে, ব্যবহৃত শপথগুলোর অধিকাংশই রোগীদের প্রতি করা ডাক্তারদের প্রতিশ্রুতিকে তুলে ধরে, যার ফলে ভাবী ডাক্তারদের প্রতিজ্ঞা করার দরকার হয় যে, তারা তাদের রোগীদের যত্ন নিতে যথাসাধ্য করবে। এই ধরনের ঘোষণা করা, ডাক্তারি পেশায় অন্তর্নিহিত যোগ্য নৈতিক নীতিগুলোর দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করে।
দ্যা মেডিক্যাল জার্নাল অফ অস্ট্রেলিয়া-য় প্রকাশিত এক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে, অধ্যাপক এডমেন্ট পেলেগ্রিনো লিখেছিলেন: “সম্ভবত আজকে, অনেকের জন্য চিকিৎসা সম্বন্ধীয় এই শপথটা হল প্রাচীন সময়কার এক ভাঙাচোরা ছবির টুকরোর মতো। কিন্তু সেই ছবির যথেষ্ট অংশ ডাক্তারি পেশার চিন্তাধারায় অন্তর্ভুক্ত, এই কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য যে, এটাকে সম্পূর্ণভাবে ভুলে যাওয়ার অর্থ হবে চিকিৎসা পেশাকে এক বাণিজ্যিক, শিল্পসংক্রান্ত অথবা শুধুমাত্র লাভের জন্য করা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা।”
বর্তমানে, হিপোক্রেটিক শপথ নাকি সেটার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আধুনিক ঘোষণাপত্রগুলো প্রাসঙ্গিক, তা নিয়ে সম্ভবত পণ্ডিত ব্যক্তিদের মধ্যে বিতর্ক চলতেই থাকবে। কিন্তু ফলাফল যা-ই হোক না কেন, রোগীদের যত্ন নেওয়ার বিষয়ে ডাক্তারদের প্রতিশ্রুতি সবসময় কৃতজ্ঞতা পাওয়ার যোগ্য। (g০৪ ৪/২২)
[২৩ পৃষ্ঠার বাক্স]
হিপোক্রেটিসের শপথ
লুটভিখ এডেলস্টাইনের দ্বারা অনুবাদিত
আমি শপথ নিচ্ছি চিকিৎসক আপল্লো ও এস্কলিপাইয়েস এবং ইয়িয়ে ও পানাকিয়া ও সমস্ত দেবদেবীর নামে, তাদের সাক্ষি রেখে আমি বলছি যে, আমার সাধ্য ও বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী আমি এই শপথ ও এই প্রতিজ্ঞাকে পূর্ণ করব:
ধরে রাখব, সেই ব্যক্তিকে আমার পিতামাতার মতো করে, যিনি আমাকে এই বিদ্যা শিখিয়েছেন ও তাকে আমার সঙ্গী করে বেঁচে থাকব এবং তার যদি টাকাপয়সার প্রয়োজন হয়, তা হলে তাকে আমার ভাগ থেকে দেব আর তার সন্তানদের আমার পূর্বপুরুষের বংশ থেকে আসা আমার ভাইয়ের মতো করে দেখব ও তাদের এই বিদ্যা শিক্ষা দেব—তারা যদি এটা শিখতে চায়—বিনামূল্যে ও চুক্তিতে; আমি আমার সন্তানদের ও যিনি আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন তার সন্তানদের এবং সেই সমস্ত ছাত্র যারা চুক্তিতে সাক্ষর করেছে ও যারা চিকিৎসা ব্যবস্থা অনুযায়ী একটা শপথ গ্রহণ করেছে তাদের সঙ্গে এই কর্মবিধি ও মৌখিক নির্দেশনা ভাগ করে নেব কিন্তু অন্য আর কারও সঙ্গে তা করব না।
আমি অবশ্যই, আমার সাধ্যমতো ও বিচারবুদ্ধির সঙ্গে রোগীর উপকারজনক খাওয়াদাওয়ার সুপারিশ করব; আমি তাদের ক্ষতি হওয়ার ও অবিচার থেকে বাঁচাব।
আমি অবশ্যই কখনও কোনো মারাত্মক ওষুধ কাউকে দেব না, এমনকি কেউ যদি তা দিতেও বলে, এমনকি এই উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো পরামর্শও দেব না। একইভাবে আমি কোনো স্ত্রীকে গর্ভপাত করার বিষয়ে কোনো চিকিৎসা সম্বন্ধে জানাব না। আমি আমার জীবন ও বিদ্যাকে শুদ্ধ ও পবিত্রভাবে রক্ষা করব।
আমি অবশ্যই করব না অস্ত্রোপচার, এমনকি সেই সমস্ত রোগীরও নয়, যারা মূত্রশিলায় ভুগছে কিন্তু সেই ব্যক্তিদের হাতে ছেড়ে দেব, যারা এই কাজে রত রয়েছে।
যাদেরই বাড়িতে আমি যাই না কেন, আমি রোগীর উপকারে আসব, ইচ্ছাকৃতভাবে করা সমস্ত অবিচার থেকে দূরে থাকব, সমস্ত অমঙ্গল থেকে এবং বিশেষ করে স্বাধীন বা দাস, স্ত্রী ও পুরুষ যে-ই হোন না কেন, উভয়েরই সঙ্গে যৌনসম্পর্ক করা থেকে দূরে থাকব।
আমি যা কিছু দেখি বা শুনি না কেন, মানুষের জীবন সম্বন্ধে তাদের চিকিৎসা করার সময় অথবা চিকিৎসার বাইরে, যা একজনের কোনোভাবেই অন্যদের জানানো উচিত নয়, আমি সেই সমস্ত বিষয় নিজের কাছে গোপন রাখব, যেগুলো ছড়ানো হবে লজ্জার বিষয়।
আমি যদি এই শপথ পূরণ করি আর এটা লঙ্ঘন না করি, তা হলেই হয়তো জীবন ও এই বিদ্যাকে উপভোগ করার অধিকার আমাকে দেওয়া হবে, ভবিষ্যতে সমস্ত লোকের মাঝে আমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে; যদি আমি এটা ভঙ্গ করি ও মিথ্যাভাবে শপথ নিই, তা হলে এই সমস্তকিছুর উলটোটাই যেন আমার প্রতি ঘটে।
[২২ পৃষ্ঠার চিত্র]
হিপোক্রেটিক বইগুলো থেকে নেওয়া এক পৃষ্ঠা
[২২ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]
হিপোক্রেটিস ও পৃষ্ঠা: Courtesy of the National Library of Medicine