ঈশ্বর কি বিবর্তনের মাধ্যমে জীবন সৃষ্টি করেছিলেন?
“হে আমাদের প্রভু [ “যিহোবা,” NW] ও আমাদের ঈশ্বর, তুমিই প্রতাপ ও সমাদর ও পরাক্রম গ্রহণের যোগ্য; কেননা তুমিই সকলের সৃষ্টি করিয়াছ, এবং তোমার ইচ্ছাহেতু সকলই অস্তিত্বপ্রাপ্ত ও সৃষ্ট হইয়াছে।”—প্রকাশিত বাক্য ৪:১১.
চার্লস ডারউইন বিবর্তনবাদকে জনপ্রিয় করে তোলার পরই, অনেক তথাকথিত খ্রিস্টান ঈশ্বরের প্রতি তাদের বিশ্বাসকে বিবর্তনবাদের সঙ্গে যুক্ত করার উপায়গুলো খুঁজতে শুরু করেছিল।
আজকে, অধিকাংশ নামকরা “খ্রিস্টান” ধর্মীয় দল এই বিষয়টা মেনে নিতে ইচ্ছুক বলে মনে হয় যে, ঈশ্বর নিশ্চয়ই কোনো না কোনোভাবে বিবর্তনের মাধ্যমে জীবন সৃষ্টি করেছিলেন। কেউ কেউ শিক্ষা দেয় যে, ঈশ্বর পূর্ব থেকেই নিখিলবিশ্বকে এমনভাবে গড়ে ওঠার জন্য প্রোগ্রাম করে রেখেছিলেন যে, ক্রমাগতভাবে জীবিত বস্তুগুলো নির্জীব রাসায়নিক বস্তু থেকে বিবর্তিত হতে হতে শেষ পর্যন্ত মানুষকে জন্ম দেবে। যারা আস্তিকতামূলক বিবর্তন নামে পরিচিত এই শিক্ষাকে বিশ্বাস করে, তারা মনে করে যে, এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাওয়ার পর ঈশ্বর তাতে আর কোনোরকম হস্তক্ষেপ করেননি। অন্যেরা মনে করে যে, ঈশ্বর পুরোপুরিভাবে বিবর্তনের মাধ্যমে অধিকাংশ উদ্ভিদ ও প্রাণীর গোত্রকে উৎপন্ন করেছেন কিন্তু মাঝেমধ্যে প্রক্রিয়াটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য হস্তক্ষেপ করেছেন।
শিক্ষার মিশ্রণ—এটা কি একে অন্যের সম্পূরক?
বিবর্তনবাদ কি আসলেই বাইবেলের শিক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ? বিবর্তনবাদ যদি সত্য হয়, তা হলে প্রথম মানুষ আদমের সৃষ্টির বিষয়ে বাইবেলের বিবরণ বড় জোর নীতি শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এক গল্প মাত্র, আক্ষরিক নয়। (আদিপুস্তক ১:২৬, ২৭; ২:১৮-২৪) বাইবেলের এই বিবরণকে কি যিশু এভাবেই দেখেছিলেন? “তোমরা কি পাঠ কর নাই যে,” যিশু বলেছিলেন, “সৃষ্টিকর্ত্তা আদিতে পুরুষ ও স্ত্রী করিয়া তাহাদিগকে নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন, আর বলিয়াছিলেন, ‘এই কারণ মনুষ্য পিতা ও মাতাকে ত্যাগ করিয়া আপন স্ত্রীতে আসক্ত হইবে, এবং সে দুই জন একাঙ্গ হইবে’? সুতরাং তাহারা আর দুই নয়, কিন্তু একাঙ্গ। অতএব ঈশ্বর যাহার যোগ করিয়া দিয়াছেন, মনুষ্য তাহার বিয়োগ না করুক।”—মথি ১৯:৪-৬.
যিশু এখানে আদিপুস্তক ২ অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ সৃষ্টির বিবরণ থেকে উদ্ধৃতি করছিলেন। যিশু যদি মনে করতেন যে, প্রথম বিবাহ শুধু কাল্পনিক কাহিনী, তা হলে তিনি কি বিবাহের পবিত্রতা সম্বন্ধে তাঁর দেওয়া শিক্ষাকে সমর্থন করতে এই বিষয়ে উল্লেখ করতেন? না। যিশু আদিপুস্তকের বিবরণের বিষয় উল্লেখ করেছিলেন কারণ তিনি জানতেন যে, এটা এক সত্য ঘটনা।—যোহন ১৭:১৭.
একইভাবে, যিশুর শিষ্যরাও আদিপুস্তকের সৃষ্টির বিবরণে বিশ্বাস করত। উদাহরণস্বরূপ, লূকের সুসমাচারের বিবরণ যিশুর বংশবৃত্তান্ত, একেবারে আদম পর্যন্ত বর্ণনা করে। (লূক ৩:২৩-৩৮) আদম যদি এক কাল্পনিক চরিত্রই হতো, তা হলে কোন পর্যায়ে এসে এই বংশবৃত্তান্ত বাস্তব থেকে কাল্পনিকে রূপান্তরিত হয়েছে? এই বংশতালিকার উৎস যদি কাল্পনিকই হতো, তা হলে যিশুর এই দাবি যে, তিনিই হচ্ছেন সেই মশীহ, যিনি দায়ূদের বংশে জন্মগ্রহণ করেছেন, সেটাকে কতটা নির্ভরযোগ্য করে তুলত? (মথি ১:১) সুসমাচার লেখক লূক বলেছিলেন যে তিনি, ‘প্রথম হইতে সকল বিষয় সবিশেষ অনুসন্ধান করিয়াছিলেন।’ স্পষ্টতই, তিনি নিজেও আদিপুস্তকের সৃষ্টির বিবরণে বিশ্বাস করতেন।—লূক ১:৩.
যিশুর ওপর প্রেরিত পৌলের বিশ্বাস, আদিপুস্তকের বিবরণের ওপর পৌলের নির্ভরতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। তিনি লিখেছিলেন: “মনুষ্য দ্বারা যখন মৃত্যু আসিয়াছে, তখন আবার মনুষ্য দ্বারা মৃতগণের পুনরুত্থান আসিয়াছে। কারণ আদমে যেমন সকলে মরে, তেমনি আবার খ্রীষ্টেই সকলে জীবনপ্রাপ্ত হইবে।” (১ করিন্থীয় ১৫:২১, ২২) আক্ষরিকভাবে আদম যদি সমস্ত মানবজাতির পূর্বপুরুষ না হতো, যার মাধ্যমে “পাপ দ্বারা মৃত্যু জগতে প্রবেশ করিল,” তা হলে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া পাপের প্রভাবগুলোকে দূর করার জন্য যিশুকে কেন মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে?—রোমীয় ৫:১২; ৬:২৩.
আদিপুস্তকে উল্লেখিত সৃষ্টির বিবরণের ওপর বিশ্বাসকে দুর্বল করে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে, খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের আসল ভিত্তিকে দুর্বল করে দেওয়া। বিবর্তনবাদ ও খ্রিস্টের শিক্ষাগুলো সংগতিপূর্ণ নয়। এই দুটো বিশ্বাসকে মেশানোর যেকোনো প্রচেষ্টা কেবল এক দুর্বল বিশ্বাসেরই জন্ম দিতে পারে, যা ‘তরঙ্গাহত এবং যে সে শিক্ষাবায়ুতে ইতস্ততঃ পরিচালিত’ হওয়ার প্রবণতা রাখে।—ইফিষীয় ৪:১৪.
এক দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপিত বিশ্বাস
শত শত বছর ধরে বাইবেল নানা সমালোচনা ও আক্রমণের মধ্যেও টিকে রয়েছে। বরাবরই বাইবেলের পাঠ্যাংশ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। বাইবেল যখন ইতিহাস, স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞানের বিষয় উল্লেখ করে, তখন এটির বিবরণগুলো সবসময় নির্ভরযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। মানব সম্পর্ক সম্বন্ধে এটির উপদেশ হচ্ছে নির্ভরযোগ্য ও সময়োপযোগী। মানুষের দর্শনবিদ্যা ও মতবাদগুলো, অনেকটা সবুজ ঘাসের মতো অঙ্কুরিত হয় ও কিছু সময়ের মধ্যে ম্লান হয়ে পড়ে কিন্তু ঈশ্বরের বাক্য “চিরকাল থাকিবে।”—যিশাইয় ৪০:৮.
বিবর্তনবাদের শিক্ষা শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটা মানুষের তৈরি এক দর্শনবিদ্যা, যেটা প্রস্ফুটিত হয়েছে এবং দশকের পর দশক ধরে ছড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিবর্তন সম্বন্ধে ডারউইনের পরম্পরাগত শিক্ষা ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হয়েছে—বস্তুতপক্ষে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে—যখন প্রকৃতিতে বিদ্যমান নকশা সম্বন্ধে ক্রমান্বয়ে পাওয়া প্রমাণগুলো সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রচেষ্টা করা হয়েছে। আমরা আপনাকে এই বিষয়টা আরও পরীক্ষা করে দেখতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনি এই সংখ্যার অন্যান্য প্রবন্ধ পরীক্ষা করার দ্বারা তা করতে পারেন। অধিকন্তু, আপনি হয়তো এই পৃষ্ঠা ও ৩২ পৃষ্ঠায় দেখানো প্রকাশনাগুলো পড়তে চাইবেন।
এই বিষয়ের ওপর গবেষণা করার পর আপনি সম্ভবত দেখতে পাবেন যে, অতীত সম্বন্ধে বাইবেল যা বলে, সেই বিষয়ে আপনার বিশ্বাস আরও শক্তিশালী হবে। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, ভবিষ্যতের বিষয়ে বাইবেলের প্রতিজ্ঞাগুলোর ওপর আপনার বিশ্বাস আরও শক্তিশালী হবে। (ইব্রীয় ১১:১) এ ছাড়া, আপনি যিহোবাকে প্রশংসা করতে পরিচালিত হবেন, যিনি ‘আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী নির্ম্মাণ করিয়াছেন।’—গীতসংহিতা ১৪৬:৬. (g ৯/০৬)
এটিও পড়ুন
বাইবেলের শিক্ষাগুলো নিয়ে বিতর্কের কিছু নির্দিষ্ট উদাহরণ এই ব্রোশারে আলোচনা করা হয়েছে
আরও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পরীক্ষা করে দেখুন এবং জানুন যে, কেন একজন চিন্তাশীল ঈশ্বর এত দুঃখকষ্ট থাকতে দিয়েছেন
পৃথিবীর জন্য ঈশ্বরের উদ্দেশ্য কী? প্রশ্নটির উত্তর এই বইয়ের ৩ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে
[১০ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]
যিশু আদিপুস্তকের সৃষ্টির বিবরণে বিশ্বাস করতেন। তিনি কি ভুল করেছিলেন?
[৯ পৃষ্ঠার বাক্স]
বিবর্তন কী?
‘বিবর্তনের’ একটা সংজ্ঞা হচ্ছে: “একটা নির্দিষ্ট ধারায় পরিবর্তনের প্রক্রিয়া।” কিন্তু, এই শব্দটি বেশ কয়েকভাবে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, এটা জড় বস্তুর বড় বড় পরিবর্তন সম্বন্ধে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়—নিখিলবিশ্বের ক্রমবিকাশ। এ ছাড়া, এই শব্দটি সজীব বস্তুর মধ্যে ছোট ছোট পরিবর্তনের বিষয় বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়—যে-উপায়ে উদ্ভিদ ও প্রাণীরা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। কিন্তু, এই শব্দটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই মতবাদকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয় যে, অজৈব রাসায়নিক বস্তু থেকে জীবনের উৎপত্তি হয়েছে, স্বপ্রজনন কোষগুলোতে গঠিত হয়েছে এবং ক্রমাগতভাবে আরও বেশি জটিল প্রাণীতে পরিণত হয়েছে আর এর মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিবিশিষ্ট হচ্ছে মানুষ। এই প্রবন্ধে “বিবর্তন” শব্দটির দ্বারা এই তৃতীয় মতবাদকেই বোঝানো হয়েছে।
[১০ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]
মহাশূন্যের ছবি: J. Hester and P. Scowen (AZ State Univ.), NASA