আমার বাল্যকাল থেকে ধৈর্য সহকারে যিহোবার অপেক্ষা করা
রাডল্ফ গ্রাইকেন দ্বারা কথিত
যখন আমি মাত্র ১২ বছরের ছিলাম, দুঃখজনক ঘটনা আমাদের পরিবারকে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত আঘাত করে। প্রথমে আমার বাবাকে কারাগারে বন্দী করা হয়। তারপর, আমার বোন ও আমাকে জোর করে ঘর থেকে নিয়ে যাওয়া হয় ও অপরিচিত লোকেদের সাথে থাকার জন্য পাঠান হয়। পরবর্তীকালে, গোয়েন্দারা আমার মা এবং আমাকে গ্রেপ্তার করে। আমি জেলে যাই আর তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।
এই ধারাবাহিক ঘটনাগুলি ছিল এক যন্ত্রণাদায়ক তাড়নাপূর্ণ সময়কালের সূচনামাত্র যা আমি এক যিহোবার সাক্ষী হিসাবে আমার বাল্যকালে ভোগ করেছিলাম। কুখ্যাত নাৎসী গোয়েন্দা ও তারপর পূর্ব জার্মানীর স্ট্যাসি ঈশ্বরের প্রতি আমার বিশ্বস্ততা ভাঙতে চেষ্টা করেছিল। তাঁর প্রতি ৫০ বছরের উৎসর্গীকৃত সেবার পর এখন আমিও ঠিক তেমনই বলতে পারি যেমন গীতরচক বলেছিলেন: “আমার বাল্যকাল হইতে লোকে আমাকে অনেক পীড়ন করিয়াছে, তথাপি আমার উপরে জয়ী হয় নাই।” (গীতসংহিতা ১২৯:২) যিহোবার কাছে আমি কতই না কৃতজ্ঞ!
আমি ১৯২৫ সালের ২রা জুন জার্মানীর লিপজিগের কাছে লূকা নামক একটি ছোট শহরে জন্মগ্রহণ করি। এমনকি আমার জন্মের পূর্বেই আমার বাবামা আলফ্রেড ও টেরেসা বাইবেলের ছাত্র, যে নামে যিহোবার সাক্ষীরা তখন পরিচিত ছিল, তাদের প্রকাশনাদি থেকে বাইবেল সত্যের ধ্বনিকে শনাক্ত করেছিলেন। আমাদের ঘরের দেওয়ালে ঝোলান বাইবেলের দৃশ্যের ছবিগুলি প্রত্যেক দিন দেখার কথা আমার মনে আছে। একটা ছবি ছিল যেখানে ভল্লুক ও ভেড়ার বাচ্চা, ছাগল ছানা ও চিতা বাঘ, গরুর বাচ্চা ও সিংহ—সকলে শান্তিতে একটি ছোট বালকের দ্বারা চালিত হচ্ছে। (যিশাইয় ১১:৬-৯) এইধরনের ছবিগুলি আমার উপর এক দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল।
যখনই সম্ভব হত আমার বাবামা আমাকে মণ্ডলীর কার্যাবলিতে যুক্ত করতেন। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হিটলার ক্ষমতায় আসার অল্প কিছু দিন পরেই “ফটো ড্রামা অফ ক্রিয়েশন”—এর স্লাইড, চলচিত্র ও রেকর্ড করা বিষয়টি—আমাদের ছোট শহরে প্রদর্শিত হয়েছিল। “ফটো ড্রামা”-র প্রচার অভিযানের অংশ হিসাবে একটি মালবাহী গাড়ির পিছনে চড়ে সমস্ত শহর ঘোরায়, মাত্র সাত বছর বয়সী একটি ছেলে হিসাবে আমি কতই না রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম! এটি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিতে ভাইয়েরা আমাকে আমার অল্প বয়স সত্ত্বেও মণ্ডলীর এক কার্যকারী সদস্য হিসাবে অনুভব করিয়েছিল। তাই খুব অল্প বয়স থেকেই আমি যিহোবার কাছে শিক্ষিত ও তাঁর বাক্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলাম।
যিহোবার উপর আস্থা রাখতে প্রশিক্ষিত হওয়া
দৃঢ় খ্রীষ্টীয় নিরপেক্ষতার কারণে যিহোবার সাক্ষীরা নাৎসী রাজনীতিতে জড়িত হয়নি। ফলস্বরূপ, ১৯৩৩ সালে নাৎসীরা আমাদের প্রচার, সভা ও এমনকি আমাদের নিজেদের বাইবেল সাহিত্য পড়া নিষিদ্ধ করে এক আইন প্রবর্তন করে। ১৯৩৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমার বাবাসহ আমাদের মণ্ডলীর সমস্ত ভাইয়েরা গোয়েন্দাদের দ্বারা গ্রেপ্তার হয়েছিল। এটি আমাকে খুবই দুঃখিত করেছিল। আমার বাবা পাঁচ বছর জেলে বন্দী থাকার জন্য দণ্ডিত হয়েছিলেন।
ঘরেতে আমাদের জন্য বিষয়গুলি খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আমরা খুব দ্রুত যিহোবার উপর আস্থা রাখতে শিখেছিলাম। একদিন যখন আমি বিদ্যালয় থেকে ঘরে আসি আমার মা তখন প্রহরীদুর্গ পড়ছিলেন। তিনি আমার জন্য তাড়াতাড়ি খাবার তৈরি করে দিতে চেয়েছিলেন আর তাই তিনি পত্রিকাটিকে একটি ছোট আলমারির উপর রেখে দেন। খাবারের পরে যখন আমরা বাসনপত্র রাখছিলাম, তখন দরজায় সজোরে কড়াঘাত করা হয়। এটি একটি পুলিশকর্মী ছিল যে বাইবেল সাহিত্যাদির জন্য আমাদের গৃহে সন্ধান করতে চেয়েছিল। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম।
সেই দিনটি অস্বাভাবিক গরম ছিল। তাই পুলিশকর্মীটি প্রথমেই যে কাজটি করেছিল তা ছিল, সে তার হেলমেটটি খুলে টেবিলের উপর রেখেছিল। তারপর সে তার খোঁজার কাজ শুরু করেছিল। যখন সে টেবিলের তলায় দেখছিল তার হেলমেটটি পাশে সরতে থাকে। তাই আমার মা দ্রুত হেলমেটটি আঁকড়ে ধরেন ও সেটি আলমারির উপর প্রহরীদুর্গ-টির উপরে রেখে দেন! পুলিশকর্মীটি আমাদের গৃহটি তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান করেছিল কিন্তু কোন সাহিত্য খুঁজে পায়নি। অবশ্যই সে তার হেলমেটের তলায় খুঁজবার কথা কখনই ভাবেনি। যখন সে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল, তখন পিছনে রাখা হেলমেটটি নেওয়ার সময় সে আমার মায়ের কাছে অস্পষ্টভাবে অপরাধ স্বীকার করেছিল। কী ভীষণ স্বস্তি আমি অনুভব করেছিলাম!
এইপ্রকার অভিজ্ঞতাগুলি আমাকে আরও কঠিন পরীক্ষাগুলির জন্য প্রস্তুত করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, বিদ্যালয়ে হিটলার যুব সংগঠনে যুক্ত হওয়ার জন্য আমার উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল যেখানে ছোটদের সামরিক কর্তব্যনিষ্ঠা ও নাৎসী দর্শন শেখানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। কিছু শিক্ষকদের, ১০০ শতাংশ ছাত্রদেরই অংশগ্রহণ করানোর জন্য নিজস্ব লক্ষ্য ছিল। আমার শিক্ষক মি: স্নিডার অবশ্যই নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ বলে মনে করেছিলেন কারণ আমার বিদ্যালয়ের অন্যান্য সমস্ত শিক্ষকদের বৈসাদৃশ্যে তারই কেবলমাত্র ১০০ শতাংশ অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে একজন ছাত্রের অভাব ছিল। সেই ছাত্রটি ছিলাম আমি।
একদিন মি: স্নিডার সমস্ত শ্রেণীতে ঘোষণা করেছিলেন: “ছেলেরা, আগামীকাল আমরা বাইরে বেড়াতে যাব।” প্রত্যেকেরই পরিকল্পনাটিকে খুব ভাল লেগেছিল। তারপর তিনি আরও বলেছিলেন: “তোমাদের সকলের হিটলার যুব ইউনিফর্ম পড়া উচিত যাতে করে যখন আমরা রাস্তা দিয়ে হাঁটব সকলে যেন দেখতে পায় যে তোমরা ভদ্র আচরণকারী হিটলার বালক।” পরের দিন সকালে আমি ছাড়া সকলকে তাদের ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় দেখা গিয়েছিল। শিক্ষক আমাকে শ্রেণীকক্ষের সামনে ডেকেছিলেন এবং বলেছিলেন: “অন্যান্য সমস্ত ছেলেদের দিকে তাকাও আর তারপর নিজের দিকে তাকাও।” এরপর তিনি আরও বলেছিলেন: “আমি জানি যে তোমার বাবামা গরিব আর তোমাকে একটি ইউনিফর্ম কিনে দিতে পারেনি কিন্তু আমি তোমাকে কিছু দেখাতে চাই।” তিনি তার ডেস্কের কাছে আমাকে নিয়ে যান, একটি তাক খোলেন এবং বলেন: “আমি তোমাকে একেবারে নতুন এই ইউনিফর্মটি দিতে চাই। এটি খুব সুন্দর, তাই নয় কি?”
আমি নাৎসী ইউনিফর্ম পরার চেয়ে মৃত্যুকে বেছে নিতাম। যখন আমার শিক্ষক দেখেন যে ইউনিফর্মটি পরার কোনরকম অভিপ্রায় আমার নেই, তিনি রেগে যান আর সম্পূর্ণ ক্লাস আমার বিরুদ্ধে চিৎকার করতে শুরু করে। তারপর তিনি আমাদের বাইরে নিয়ে যান কিন্তু অন্যান্য সমস্ত ইউনিফর্ম পরিহিত ছেলেদের মাঝখানে হাঁটানোর দ্বারা আমাকে লুকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু, শহরের অনেক লোকেরাই আমাকে দেখতে পেয়েছিল যখন আমি আমার সহপাঠীদের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সকলেই জানত যে আমি আর আমার বাবামা যিহোবার সাক্ষী ছিলাম। যখন আমি ছোট ছিলাম সেই সময়ে আমাকে প্রয়োজনীয় আধ্যাত্মিক শক্তি প্রদান করার জন্য আমি যিহোবার কাছে কৃতজ্ঞ।
তাড়নার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়
১৯৩৮ সালের প্রথম দিকে একদিন আমার বোন ও আমাকে বিদ্যালয় থেকে বের করে নিয়ে পুলিশের গাড়িতে করে ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত স্ট্যাডট্রোডারে একটি সংশোধনমূলক বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কেন? কারণ আদালত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে আমাদের বাবামার প্রভাব থেকে আমাদের মুক্ত করা ও নাৎসী সন্তানে পরিণত করা প্রয়োজন। শীঘ্রই সংশোধনমূলক বিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক লক্ষ্য করেছিলেন যে আমার বোন ও আমি যদিও আমাদের খ্রীষ্টীয় নিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে দৃঢ়, তবুও শ্রদ্ধাশীল ও বাধ্য। পরিচালিকা এতই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে তিনি আমার মায়ের সাথে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলেন। ব্যতিক্রম অনুমোদন করা হয়েছিল আর মাকে আমাদের দেখতে আসার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। একটি সম্পূর্ণ দিন একত্রে এই পারস্পরিক উৎসাহদানের সুযোগ দেওয়ার জন্য আমার বোন, আমার মা ও আমি ভীষণ খুশি ও যিহোবার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়েছিলাম। আমাদের সত্যিই এটির প্রয়োজন ছিল।
আমরা প্রায় চার মাস সংশোধনমূলক বিদ্যালয়ে ছিলাম। তারপর পানায় একটি পরিবারের সাথে বাস করার জন্য আমাদের পাঠান হয়েছিল। আমাদের আত্মীয়দের থেকে আমাদের দূরে রাখার জন্য তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আমার মা এমনকি সাক্ষাৎ করার জন্যও অনুমতি পাননি। তবুও কখনও কখনও আমাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য তিনি উপায় খুঁজে নিয়েছিলেন। সেই বিরল সুযোগগুলিতেই সাগ্রহে আমার মা আমাদের মধ্যে যিহোবার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার জন্য এক স্থিরসংকল্পকে অনুপ্রবেশ করানোর ক্ষেত্রে তার যথাসাধ্য করতেন, তা যে কোন পরীক্ষা এবং পরিস্থিতিই তিনি অনুমোদন করুন না কেন।—১ করিন্থীয় ১০:১৩.
আর পরীক্ষা এসেছিল। ১৯৪২ সালের ১৫ই ডিসেম্বরে যখন আমি মাত্র ১৭ বছর বয়সী ছিলাম আমাকে নাৎসী জার্মানির গোয়েন্দারা তুলে নিয়ে যায় ও গেরার একটি কারাগারে রাখে। প্রায় এক সপ্তাহ পরে আমার মাকেও গ্রেপ্তার করা হয় এবং তিনি সেই একই জেলে আমার সাথে যোগ দেন। যেহেতু আমি তখনও অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলাম তাই আদালত আমার বিচার করেনি। তাই আমার মা ও আমি ছয় মাস কারাগারে কাটিয়েছিলাম যখন আদালত আমার ১৮তম জন্মদিনের জন্য অপেক্ষা করেছিল। আমি ১৮ বছর বয়সে পদার্পণ করার সেই দিনেই আমার মা ও আমাকে বিচারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
আমি কিছু উপলব্ধি করার পূর্বেই সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমি বুঝতে পারিনি যে আমি আর আমার মাকে দেখতে পাব না। তার সম্বন্ধে আমার শেষ স্মৃতি হল তাকে আদালতে আমার ডান পাশে একটা কালো কাঠের বেঞ্চে বসে থাকতে দেখা। আমরা দুজনেই অপরাধী বলে ঘোষিত হয়েছিলাম। আমি চার বছর এবং আমার মা দেড় বছরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন।
সেই সমস্ত দিনগুলিতে হাজার হাজার যিহোবার সাক্ষীদের কারাগার এবং শিবিরগুলিতে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। যাইহোক আমাকে স্টলবার্গের একটি কারাগারে বন্দী করা হয়েছিল যেখানে কেবলমাত্র আমি একাই সাক্ষী ছিলাম। এক বছরেরও বেশি সময় আমি নির্জন কারাগারে কাটিয়েছিলাম কিন্তু যিহোবা আমার সাথে ছিলেন। আমার যুব বয়সে তাঁর জন্য যে প্রেম আমার মধ্যে গড়ে উঠেছিল তা আমার আধ্যাত্মিক জীবন রক্ষার চাবিকাঠি ছিল।
১৯৪৫ সালের ৯ই মে আড়াই বছর কারাগারে থাকার পর আমরা সুসংবাদ পেয়েছিলাম—যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে! সেই দিন আমি মুক্তি পেয়েছিলাম। ১১০ কিলোমিটার হেঁটে আসার পর আমি অত্যন্ত ক্লান্তি ও অনাহারের কারণে প্রকৃতই অসুস্থ অবস্থায় ঘরে ফিরে এসেছিলাম। আমার স্বাস্থ্য ফিরে পেতে বেশ কিছু মাস সময় লেগেছিল।
আমি পৌঁছানোর সাথে সাথেই অনেকগুলি নিদারুণ দুঃসংবাদ আমাকে আঘাত করেছিল। প্রথমটি আমার মায়ের বিষয়ে ছিল। দেড় বছর কারাগারে থাকার পর নাৎসীরা তাকে যিহোবার উপর তার বিশ্বাসকে অস্বীকার করে একটি প্রমাণপত্রে সাক্ষর করতে বলে। তিনি সেটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাই নাৎসী জার্মানির গোয়েন্দারা তাকে রেভেন্সব্রুকের একটি মহিলাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তিনি যুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক আগেই এক সংক্রামক জ্বরে মারা যান। তিনি একজন অত্যন্ত সাহসী খ্রীষ্টান ছিলেন—একজন কঠোর যোদ্ধা যিনি কখনও হাল ছেড়ে দেননি। যিহোবা দয়াপূর্বক তাকে স্মরণে রাখুন।
আমার বড় ভাই ওয়ারনার সম্বন্ধেও সংবাদ ছিল যে কখনও যিহোবার কাছে নিজেকে উৎসর্গ করেনি। সে জার্মান সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল এবং রাশিয়ায় তাকে হত্যা করা হয়েছিল। আমার বাবা? তিনি ঘরে ফিরে এসেছিলেন কিন্তু দুঃখের বিষয় হল যে তিনি সেই স্বল্প সংখ্যক সাক্ষীদের মধ্যে ছিলেন যারা তাদের বিশ্বাস অস্বীকারকারী কুখ্যাত প্রমাণপত্রটিতে সাক্ষর করেছিল। যখন আমি তাকে দেখতে পেয়েছিলাম তিনি খুব বিমর্ষ ও মানসিকভাবে বিক্ষুব্ধ ছিলেন।—২ পিতর ২:২০.
উদ্যমী আধ্যাত্মিক কার্যকলাপের এক সংক্ষিপ্ত সময়কাল
১৯৪৬ সালের ১০ই মার্চ, আমি লিপজিগে যুদ্ধের পর প্রথম সম্মেলনে যোগদান করি। এটি কতই না রোমাঞ্চকর ছিল যখন ঘোষণা করা হয়েছিল যে সেই দিনেই বাপ্তিস্ম গ্রহণ অনুষ্ঠানটি হবে! যদিও আমি অনেক বছর আগেই যিহোবার কাছে আমার জীবন উৎসর্গ করেছিলাম কিন্তু বাপ্তিস্মিত হওয়ার জন্য এটিই ছিল আমার প্রথম সুযোগ। আমি কখনও সেই দিনটি ভুলব না।
১৯৪৭ সালের ১লা মার্চ, এক মাস অগ্রগামীর কাজ করার পর আমি ম্যাগবার্গের বেথেলে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। বোমা বিস্ফোরণের ফলে সমিতির দপ্তরগুলি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেই মেরামতের কাজে সাহায্য করা কত বড়ই না সুযোগ ছিল! সেই গ্রীষ্মের পর আমি উইটেনবার্গ শহরে একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসাবে কার্যভার লাভ করি। কিছু মাস আমি ২০০ ঘন্টারও বেশি সময় ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার অন্যদের জানানোর কাজে ব্যয় করেছিলাম। আবার স্বাধীন হয়ে আমি কতই না খুশি ছিলাম—আর কোন যুদ্ধ নয়, তাড়না নয়, কারাগার নয়!
দুঃখের বিষয় হল যে সেই স্বাধীনতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। যুদ্ধের পর জার্মানী বিভক্ত হয়েছিল আর যে অঞ্চলে আমি বাস করতাম তা সাম্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণাধীনে এসেছিল। ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্ট্যাসি নামে পরিচিত পূর্ব জার্মানীর গুপ্ত পুলিশ পর্যায়ক্রমে ভাইয়েদের গ্রেপ্তার করতে শুরু করে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগটি ছিল হাস্যকর। আমি আমেরিকা সরকারের গুপ্তচর হওয়ার অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছিলাম। তারা আমাকে ব্রানডেনবার্গে দেশের সবচেয়ে জঘন্য স্ট্যাসি কারাগারে পাঠিয়েছিল।
আমার আধ্যাত্মিক ভাইয়েদের থেকে সমর্থন
সেখানে স্ট্যাসি আমাকে দিনের বেলায় ঘুমাতে দিত না। তারপর তারা সারা রাত ধরে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করত। এই অত্যাচার কিছুদিন ধরে সহ্য করার পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছিল। একদিন সকালে আমার কক্ষে পাঠানোর পরিবর্তে আমাকে তারা তাদের কুখ্যাত ইউ-বোট সেলেন-এর একটিতে নিয়ে যায় (গভীর একটি কক্ষের মধ্যে সেগুলির অবস্থান হওয়ায় এগুলি ডুবোজাহাজ কক্ষ নামে পরিচিত)। তারা একটি পুরনো মরিচা পড়া লোহার দরজা খোলে এবং আমাকে তার ভিতরে যেতে বলে। আমাকে একটি উঁচু চৌকাঠের উপর পা রাখতে হয়। যখন আমি আমার পা নিচে রাখি আমি বুঝতে পারি যে মেঝে সম্পূর্ণভাবে জলে নিমজ্জিত। দরজাটি সজোরে, এক ভীতিপ্রদ আর্ত চিৎকারের শব্দ করে বন্ধ করা হয়েছিল। কোন আলো এবং জানালা ছিল না। এটি সম্পূর্ণভাবে অন্ধকার ছিল।
মেঝেতে বেশ কয়েক ইঞ্চি উচ্চতা পর্যন্ত জল থাকায় আমি বসতে, শুতে অথবা ঘুমাতে পারিনি। মনে হয়েছিল যেন অনন্তকাল অপেক্ষা করার পর আমাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তীব্র আলোর মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমি জানি না সবচেয়ে খারাপ কোন্টি—প্রায় সম্পূর্ণ অন্ধকারে সারা দিন জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা অথবা সারা রাত ধরে সোজা আমার দিকেই রাখা যন্ত্রণাদায়ক তীব্র ফ্লাড লাইটের আলো সহ্য করা।
অনেকবার তারা আমাকে গুলিবিদ্ধ করার হুমকি দিয়েছিল। কিছু রাত ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর রাশিয়ার এক উচ্চ সামরিক আধিকারিক আমার সাথে সাক্ষাৎ করেন। আমার তাকে এটি বলার সুযোগ হয়েছিল যে জার্মান স্ট্যাসি, নাৎসী জার্মানির গোয়েন্দাদের চেয়েও আমার সাথে এমনকি আরও খারাপ ব্যবহার করছে। আমি তাকে বলেছিলাম যে যিহোবার সাক্ষীরা নাৎসী সরকারের অধীনে যেমন নিরপেক্ষ তেমনি সাম্যবাদী সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনেও নিরপেক্ষ আর তাই জগতের কোন রাজনীতিতেই আমরা কোনভাবে হস্তক্ষেপ করি না। বিপরীতে, আমি বলেছিলাম এখন যে অনেক স্ট্যাসি আধিকারিকেরা আছে যারা হিটলার যুব সংগঠনের সদস্য ছিল যেখানে তারা শিখেছিল যে কিভাবে নিরীহ লোকেদের উপর নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচার করতে হয়। যখন আমি কথা বলছিলাম, আমার দেহ ঠাণ্ডা, ক্ষুধা এবং ক্লান্তিতে কাঁপছিল।
আশ্চর্যজনকভাবে রাশিয়ার সেই আধিকারিক আমার উপর রাগ করেননি। বিপরীতে, তিনি আমাকে একটি কম্বল দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন এবং আমার সাথে সদয় ব্যবহার করেছিলেন। তার পরিদর্শনের অল্প কিছুদিন পরেই আমাকে একটি তুলনামূলক স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ কক্ষে নিয়ে আসা হয়েছিল। কিছুদিন পরে আমাকে জার্মান আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যদিও আমার বিষয়টি বিলম্বিত হচ্ছিল, আমি আরও অন্য পাঁচজন সাক্ষীর সাথে থাকার অপূর্ব সুযোগ উপভোগ করেছিলাম। অনেক নিষ্ঠুর ব্যবহার সহ্য করার পর, আমার আধ্যাত্মিক ভাইয়েদের সাহচর্য লাভ করা আমার জন্য কতই না সতেজতামূলক ছিল!—গীতসংহিতা ১৩৩:১.
আদালতে আমাকে গোয়েন্দার কাজ করার অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছিল এবং চরিত্র সংশোধনের জন্য চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এটি একটি হাল্কা দণ্ড হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। কিছু ভাইয়েদের দশ বছরেরও বেশি সময়ের জন্য দণ্ড দেওয়া হয়েছিল। আমাকে একটি সর্বাধিক নিরাপত্তাসহ চরিত্র সংশোধনমূলক কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। আমার মনে হয় যে এমনকি একটা ইঁদুরও সেই কারাগারে ঢুকতে বা বের হতে পারবে না—নিরাপত্তা এতই কড়া ছিল। তবুও, যিহোবার সাহায্যে কিছু সাহসী ভাইয়েরা একটি সম্পূর্ণ বাইবেল ভিতরে পাচার করতে সক্ষম হয়েছিল। এটিকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল এবং পৃথক পৃথক বইগুলিতে বিভক্ত করা হয়েছিল এবং যে ভাইয়েরা কারাগারে ছিল তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল।
কিভাবে আমরা এটি করেছিলাম? এটি খুব কঠিন ছিল। একমাত্র সেই সময়েই আমরা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করতে পারতাম যখন প্রত্যেক দুই সপ্তাহ অন্তর আমাদের স্নান করার জন্য নিয়ে যাওয়া হত। একদিন আমি যখন স্নান করছিলাম, এক ভাই আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলে যে সে তার তোয়ালের মধ্য বাইবেলের কিছু পৃষ্ঠা লুকিয়ে রেখেছে। স্নান হয়ে যাওয়ার পর আমার, নিজেরটির পরিবর্তে তার তোয়ালেটি নেওয়ার কথা ছিল।
একজন রক্ষী সেই ভাইকে আমার সাথে ফিসফিস করে কথা বলতে দেখেছিল আর তাকে কাঠের লাঠি দিয়ে ভীষণ খারাপভাবে মেরেছিল। তোয়ালেটা তাড়াতাড়ি নিয়ে অন্যান্য বন্দীদের সাথে আমাকে মিশে যেতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে বাইবেলের পৃষ্ঠাগুলি সমেত আমি ধরা পড়িনি। অন্যথায় আমাদের আধ্যাত্মিক খাদ্যগ্রহণের কার্যক্রম বিপন্ন হত। আমরা এইরকম অনেক সমরূপ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম। আমাদের বাইবেল পাঠ সর্বদা লুকিয়ে এবং বিরাট ঝুঁকির মধ্যে সম্পাদিত হত। “তোমরা প্রবুদ্ধ হও, জাগিয়া থাক,” প্রেরিত পিতরের এই বাক্যগুলি বস্তুতপক্ষে খুবই যথার্থ ছিল।—১ পিতর ৫:৮.
কিছু কারণে কর্তৃপক্ষেরা আমাদের বারংবার এক চরিত্র সংশোধনমূলক কারাগার থেকে আরেকটিতে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। চার বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে আমি প্রায় দশটি ভিন্ন চরিত্র সংশোধনমূলক কারাগারে স্থানান্তরিত হয়েছিলাম। তবুও, আমি সর্বদা ভাইয়েদের দেখতে সমর্থ হয়েছিলাম। এই সমস্ত ভাইয়েদের প্রতি আমার প্রেম গভীর হত আর প্রত্যেক বার সেই সময়ই ভীষণ দুঃখের সাথে আমাকে তাদের ছেড়ে স্থানান্তরিত হতে হত।
পরিশেষে আমাকে লিপজিগে পাঠানো হয়েছিল আর সেখানে আমাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কারাগারের যে রক্ষী আমাকে মুক্ত করেছিল সে আমাকে বিদায় সম্ভাষণ জানায়নি বরং বলেছিল “আমরা তোমাকে শীঘ্রই আবার দেখব।” সেই দুষ্ট ব্যক্তিটি আমাকে আবার বন্দী অবস্থায় দেখতে চেয়েছিল। আমি প্রায়ই গীতসংহিতা ১২৪:২, ৩ পদের কথা ভাবতাম যেখানে এটি বলে: “যদি সদাপ্রভু আমাদের সপক্ষ না হইতেন, যখন লোকেরা আমাদের বিরুদ্ধে উঠিয়াছিল, তখন তাহারা আমাদিগকে জীবদ্দশায় গ্রাস করিত, যখন আমাদের প্রতি তাহাদের ক্রোধ প্রজ্বলিত হইত।”
যিহোবা তাঁর নিষ্ঠাবান সেবকদের উদ্ধার করেন
এখন আমি আবার এক স্বাধীন ব্যক্তি। আমার যমজ বোন রূৎ এবং বোন হারতা সেলেনসগ দরজার কাছে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। বন্দী জীবনের এই সমস্ত বছরগুলিতে প্রত্যেক মাসে হারতা আমার জন্য খাবারের ছোট একটি মোড়ক পাঠাত। আমি সত্যই বিশ্বাস করি যে ছোট মোড়কগুলি ব্যতীত আমি জেলে মরে যেতাম। যিহোবা যেন দয়াপূর্বক তাকে স্মরণে রাখেন।
আমার কারামুক্তির পর থেকে যিহোবা আমাকে সেবার অনেক সুযোগ দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন। আমি আবার জার্মানীর গ্রোনাউয়ে এক বিশেষ অগ্রগামী এবং জার্মান আল্পসে একজন সীমা অধ্যক্ষ হিসাবে সেবা করেছিলাম। পরবর্তীকালে আমি মিশনারীদের জন্য ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়াডের ৩১তম ক্লাসে নাম নথিভুক্ত করার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। ১৯৫৮ সালে যিহোবার সাক্ষীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন চলাকালীন ইয়াংকি স্টেডিয়ামে আমাদের গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আমার সুযোগ হয়েছিল ভাই ও বোনেদের বিরাট সমাবেশকে সম্বোধন করে আমার কিছু অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার।
গ্র্যাজুয়েশনের পর আমি চিলিতে একজন মিশনারী হিসাবে সেবা করার জন্য গিয়েছিলাম। সেখানে চিলির একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে আবার আমি এক সীমা অধ্যক্ষ হিসাবে সেবা করেছিলাম—আমাকে আক্ষরিকভাবেই পৃথিবীর একেবারে শেষ প্রান্তে পাঠানো হয়েছিল। ১৯৬২ সালে আমি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের সান এন্টোনিয়োর একজন চমৎকার মিশনারী প্যাটসী বিউটনগেলকে বিবাহ করি। তার পাশে পাশে অনেক অপূর্ব বছরগুলি আমি যিহোবার সেবায় উপভোগ করেছি।
আমার ৭০ বছরেরও বেশি বয়সী জীবনে আমি অনেক সুখের মুহূর্ত ও অনেক দুর্যোগ ভোগ করেছি। গীতরচক বলেছিলেন: “ধার্ম্মিকের বিপদ অনেক, কিন্তু সেই সকল হইতে সদাপ্রভু তাহাকে উদ্ধার করেন।” (গীতসংহিতা ৩৪:১৯) ১৯৬৩ সালে চিলিতে থাকাকালীন সময়ে প্যাটসী ও আমি, আমাদের শিশু কন্যার মর্মান্তিক মৃত্যু অভিজ্ঞতা করেছিলাম। এরপর প্যাটসী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল আর আমরা টেক্সাসে চলে গিয়েছিলাম। যখন সে মাত্র ৪৩ বছর বয়সী ছিল দুঃখজনক পরিস্থিতির মধ্যে সে মারা যায়। আমি প্রায়ই প্রার্থনা করি যে যিহোবা আমার সুন্দরী স্ত্রীকে দয়াপূর্বক স্মরণ করবেন।
এখন যদিও অসুস্থ ও বৃদ্ধ, আমি একজন নিয়মিত অগ্রগামী ও ব্রেডি টেক্সাসে এক প্রাচীন হিসাবে সেবা করার সুযোগ উপভোগ করি। এটি সত্য যে জীবন সবসময়ই সহজ হয়নি আর হয়ত আরও পরীক্ষীগুলি আছে যার সম্মুখীন আমাকে এখনও হতে হবে। তবুও, গীতরচকের মত আমি বলতে পারি: “হে ঈশ্বর, তুমি বাল্যকালাবধি আমাকে শিক্ষা দিয়া আসিতেছ; আর এ পর্য্যন্ত আমি তোমার আশ্চর্য্য ক্রিয়া সকল প্রচার করিতেছি।”—গীতসংহিতা ৭১:১৭.
[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
(১) বর্তমানে একজন প্রাচীন ও অগ্রগামী হিসাবে সেবায় রত, (২) আমাদের বিবাহের ঠিক পূর্বে প্যাটসীর সাথে, (৩) মি: স্নিডারের শ্রেণীকক্ষে (৪) আমার মা টেরেসা যিনি রেভেন্সব্রুকে মারা গিয়েছিলেন