শূনেম—প্রেম ও হিংসা দ্বারা চিহ্নিত
দক্ষিণ গালীলে যিষ্রিয়েল তলভূমির একেবারে পূর্ব প্রান্তে শূনেম শহরটি অবস্থিত। এই ছোট শহরটি বাইবেল ইতিহাসের দুটি সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ যুদ্ধের সাক্ষী কিন্তু এটি সেই দুইজন নারীর জন্মস্থান হিসাবেও প্রসিদ্ধ হয়েছিল যারা নিষ্ঠাপূর্ণ প্রেমের জন্য উদাহরণযোগ্য ছিলেন।
শূনেমের পিছন দিকে একটি পাহাড় ছিল যেটি হয়ত মোরি পাহাড় হয়ে থাকবে আর সেই সমভূমি অতিক্রম করে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে গিল্বোয় পাহাড় অবস্থিত ছিল। এই দুটি পাহাড়ের মাঝখানে একটি জলসিক্ত, ফলপ্রদ ভূমি ছিল—সমস্ত ইস্রায়েলের একটি অন্যতম প্রধান উৎপাদক অঞ্চল।
শূনেমের চতুর্দিকে এই সজীব গ্রামাঞ্চল একটি অন্যতম মনোমুগ্ধকর প্রেম কাহিনীর পটভূমি প্রদান করে যা কখনও বলা হয়েছে—পরমগীত। এই গানটি একটি সুন্দরী গ্রাম্য বালিকা সম্বন্ধে বলে যে রাজা শলোমনের পত্নীদের একজন হওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করার পরিবর্তে বরঞ্চ তার মেষপালক সঙ্গীকে বিবাহ করাকেই পছন্দ করেছিল। তার হৃদয় জয় করার জন্য শলোমন তার সমস্ত প্রজ্ঞা ও সম্পদ নিয়োজিত করেছিলেন। বারবার তিনি তার প্রশংসা করেছিলেন: “উনি কে, যিনি অরুণের ন্যায় উদীয়মানা, চন্দ্রের ন্যায় সুন্দরী, সূর্য্যের ন্যায় তেজস্বিনী?” আর সে যা কল্পনা করতে পারত না এমন স্বর্ণাভরণ দ্বারা তাকে সজ্জিত করে দেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।—পরমগীত ১:১১; ৬:১০.
রাজকীয় জীবনের স্বাদ দেওয়ার জন্য শলোমন তাকে তার সাথে তার অনুচরবৃন্দের অংশ হিসাবে যিরূশালেমে নিয়ে যান যার সাথে তার ৬০ জন সর্বোত্তম সৈন্যও সঙ্গী হয়েছিল। (পরমগীত ৩:৬-১১) তিনি তার রাজকীয় দরবারে তাকে থাকতে দেন যে দরবার এতই প্রভাব বিস্তারকারী ছিল যে যখন শিবার রাণী এটি দেখেছিলেন তিনি “এই সকল দেখিয়া হতজ্ঞান হইলেন।”—১ রাজাবলি ১০:৪, ৫.
কিন্তু শূনেমের বালিকা তার মেষপালক বালকের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিল। সে বলেছিল, “যেমন বনতরুগণের মধ্যে নাগরঙ্গবৃক্ষ, তেমনি . . . আমার প্রিয়।” (পরমগীত ২:৩) শলোমন তার হাজার দ্রাক্ষাক্ষেত্রে আনন্দ করুন। একটি দ্রাক্ষাক্ষেত্র—তার প্রিয়তমের সাথে—তার জন্য যথেষ্ট ছিল। তার প্রেম বিচলিত হয়নি।—পরমগীত ৮:১১, ১২.
অন্য এক সুন্দরী নারীও শূনেমে বাস করতেন। আমরা তার শারীরিক রূপ সম্বন্ধে কিছু জানি না কিন্তু তিনি নিশ্চিতভাবেই সুন্দর হৃদয়ের অধিকারিণী ছিলেন। বাইবেল বলে যে তিনি “এই সকল চিন্তা করিলেন” অথবা অনেক দুর্যোগ ভোগ করেছিলেন—যাতে করে তিনি ইলীশায়কে নিয়মিত খাদ্য ও বাসগৃহ সরবরাহ করতে পারেন।—২ রাজাবলি ৪:৮-১৩.
আমরা কল্পনা করতে পারি যে ইলীশায় এক দীর্ঘ, শ্রান্তিজনক যাত্রার পর ফিরে এসে সেই ক্ষুদ্র কুঠরীতে স্বচ্ছন্দভাবে থেকেছিলেন যেটি তিনি ও তার স্বামী তার জন্য তৈরি করেছিলেন। সম্ভবত তিনি প্রায়ই তাদের গৃহে সাক্ষাৎ করতেন যেহেতু তার পরিচর্যা ৬০ বছর পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল। কেন এই শূনেমীয়া নারী অনুরোধ করেছিলেন যে যখনই ইলীশায় প্রত্যেকবার সেই রাস্তা দিয়ে যাবেন তখন তাদের ঘরে থাকবেন? কারণ তিনি ইলীশায়ের কাজকে মূল্যবান বলে দেখেছিলেন। এই নম্র, নিঃস্বার্থ ভাববাদী রাজা, যাজক এবং সাধারণ লোকেদের যিহোবার সেবায় তাদের কর্তব্যের বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দিয়ে জাতির নৈতিক চেতনা হিসাবে কাজ করেছিলেন।
কোন সন্দেহ নেই যে এই শূনেমীয়া নারী ছিলেন একজন যিনি যীশুর মনে ছিলেন যখন তিনি বলেছিলেন: “যে ভাববাদীকে ভাববাদী বলিয়া গ্রহণ করে, সে ভাববাদীর পুরস্কার পাইবে।” (মথি ১০:৪১) যিহোবা এই ঈশ্বর-ভয়শীল নারীর জন্য বিশেষ পুরস্কার অনুমোদন করেছিলেন। যদিও তিনি অনেক বছর পর্যন্ত বন্ধ্যা ছিলেন, তিনি একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। কিছু বছর পরে তিনি ঐশিক সহায়তাও লাভ করেছিলেন যখন সাত বছরব্যাপী দুর্ভিক্ষ দেশকে বিধ্বস্ত করেছিল। এই জীবন্ত বিবরণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে ঈশ্বরের দাসেদের প্রতি আমরা যে দয়া দেখিয়ে থাকি তা কখনও আমাদের স্বর্গীয় পিতার অলক্ষিত থাকে না।—২ রাজাবলি ৪:১৩-৩৭; ৮:১-৬; ইব্রীয় ৬:১০.
দুটি নিষ্পত্তিমূলক যুদ্ধ
যদিও শূনেম এই দুই নিষ্ঠাবান নারীর গৃহ হিসাবে স্মরণীয় হয়ে আছে, এটি দুটি যুদ্ধেরও সাক্ষী হয়েছে যা ইস্রায়েলীয়দের ইতিহাসের ধারা পরিবর্তিত করেছিল। মোরি ও গিল্বোয় পাহাড়ের মধ্যবর্তী সমভূমির—নিকটে এক আদর্শ যুদ্ধক্ষেত্র ছিল। বাইবেলের সময়ের সামরিক সেনাপতিরা সর্বদা এমন এক জায়গায় শিবির স্থাপন করত যেখানে জলের প্রচুর সরবরাহ থাকত, সুরক্ষার জন্য উচ্চ তলদেশ থাকত এবং যদি সম্ভব হত তাহলে এমন একটি সুবিধাজনক স্থান যেখান থেকে সেনাদল, ঘোড়া ও রথ থাকার জন্য যথেষ্ট পরিসরসহ শুষ্ক উপত্যকা ভূমি দেখা যেতে পারে। শূনেম আর গিল্বোয় এই সুবিধাগুলি প্রদান করেছিল।
বিচারকর্তৃগণের সময়ে মিদিয়নীয়, অমালেকীয় ও অন্যান্য ১,৩৫,০০০ জনের এক সৈন্যবাহিনী মোরির সামনের সমভূমিতে শিবির স্থাপন করেছিল। তাদের উট “বাহুল্য প্রযুক্ত সমুদ্রতীরস্থ বালুকার ন্যায় অসংখ্য ছিল।” (বিচারকর্ত্তৃগণ ৭:১২) সমভূমির অপর পারে তাদের সম্মুখে গিল্বোয় পাহাড়ের পাদদেশে হেরোদের কূপের কাছে বিচারক গিদিয়োনের অধীনে ইস্রায়েলীয়রা ছিল যাদের সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৩২,০০০ জন।
যুদ্ধের আগের দিন প্রত্যেক পক্ষ অপর পক্ষের মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। বিদ্রূপ করার দল, যুদ্ধের উট, রথ এবং অশ্ববাহিনী পদাতিক সৈন্যদের ভয় উৎপন্ন করতে পারত। নিঃসন্দেহে মিদিয়নীয়রা—যারা ইতিমধ্যেই তাদের স্থানে অবস্থিতি করছিল যখন ইস্রায়েলীয়রা জমায়েত হচ্ছিল তাদের জন্য—এক আতঙ্কজনক দৃশ্য হিসাবে প্রমাণিত হয়েছিল। যখন গিদিয়োন জিজ্ঞাসা করেছিলেন: ‘কে ভীত ও ত্রাসযুক্ত?’ তার সৈন্যের দুই তৃতীয়াংশ যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল।—বিচারকর্ত্তৃগণ ৭:১-৩.
কেবলমাত্র ১০,০০০ জনের ইস্রায়েলীয় সৈন্যদল এখন শত্রুপক্ষীয় ১,৩৫,০০০ জন সৈন্যের বিপক্ষে সমভূমি পার হতে থাকে আর শীঘ্রই যিহোবা ইস্রায়েলীয় সৈন্যের সংখ্যা মাত্র ৩০০ জনে কমিয়ে নিয়ে আসেন। ইস্রায়েলীয় প্রথা অনুসারে এই ছোট দলটিকে তিনটি বিভাগে ভাগ করা হয়েছিল। অন্ধকারের মধ্যে তারা ছড়িয়ে গিয়েছিল ও শত্রুপক্ষের শিবিরের তিন দিকে তাদের স্থান নিয়েছিল। তারপর গিদিয়োনের আদেশ অনুযায়ী ৩০০ জন তাদের ঘট ভেঙেছিল যা ওই মশালগুলিকে ঢেকে রেখেছিল, মশালগুলি উচ্চে তুলে ধরে তারা চিৎকার করেছিল “সদাপ্রভুর ও গিদিয়োনের খড়্গ।” তারা তাদের তূরী বাজিয়েছিল এবং তা বাজিয়েই চলেছিল। অন্ধকারে বিভ্রান্ত সৈন্যদের দলটি কল্পনা করেছিল যে ৩০০ জনের দল তাদের আক্রমণ করছে। যিহোবা তাদের একজনকে অন্যের উপর চড়াও হতে দিয়েছিলেন আর “শিবিরের সমস্ত লোক দৌড়াদৌড়ি করিয়া চীৎকার শব্দ করিতে করিতে পলায়ন করিতে লাগিল।”—বিচারকর্ত্তৃগণ ৭:১৫-২২; ৮:১০.
রাজা শৌলের সময়ে দ্বিতীয় একটি যুদ্ধ শূনেমের নিকটবর্তী অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছিল। বাইবেল বিবৃতি দেয় যে, “পলেষ্টীয়েরা একত্র হইল, এবং আসিয়া শূনেমে শিবির স্থাপন করিল, আর শৌল সমস্ত ইস্রায়েলকে একত্র করিয়া গিল্বোয়ে শিবির স্থাপন করিলেন,” ঠিক যেমন গিদিয়োনের সৈন্য কিছু বছর আগে করেছিল। কিন্তু গিদিয়োনের বিপরীতে শৌল যিহোবার উপর সামান্যই আস্থাবান ছিলেন, ফলে তিনি ঐন্দোরে এক ভূতড়িয়া স্ত্রীলোকের সাথে পরামর্শ করাকে বেছে নিয়েছিলেন। যখন তিনি পলেষ্টীয়দের শিবির দেখেছিলেন তিনি “ভীত হইলেন, তাঁহার অতিশয় হৃৎকম্প হইল।” যুদ্ধ আরম্ভ হলে ইস্রায়েলীয়রা পালিয়ে যেতে শুরু করেছিল ও শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। শৌল ও যোনাথন উভয়েই তাদের জীবন হারিয়েছিলেন।—১ শমূয়েল ২৮:৪-৭; ৩১:১-৬.
সুতরাং এটি ছিল শূনেমের সেই ইতিহাস যা প্রেম ও হিংসা, যিহোবার উপর আস্থা ও মন্দ দূতেদের উপর নির্ভরতা উভয়ের দ্বারা চিহ্নিত। এই উপত্যকা সমভূমিতে দুই নারী প্রেম ও আতিথেয়তায় দৃঢ়তা দেখিয়েছিলেন এবং দুই ইস্রায়েলীয় নেতা নিষ্পত্তিমূলক যুদ্ধ করেছিলেন। এই চারটি উদাহরণই যিহোবার উপর নির্ভরতার গুরুত্বকে চিত্রিত করে যিনি, যারা তাঁর সেবা করে তাদের পুরস্কৃত করতে কখনও ব্যর্থ হন না।
[৩১ পৃষ্ঠার চিত্র]
প্রাচীন শূনেমের স্থানে আধুনিক সুলেম গ্রাম অবস্থিত যেটির পশ্চাৎপট মোরি পাহাড়
[সজন্যে]
Pictorial Archive (Near Eastern History) Est.