‘খ্রীষ্টেই চল’
“অতএব খ্রীষ্ট যীশুকে, প্রভুকে, যেমন গ্রহণ করিয়াছ, তেমনি তাঁহাতেই চল।”—কলসীয় ২:৬.
১, ২. (ক) যিহোবার প্রতি হনোকের বিশ্বস্ত পরিচর্যায় অতিবাহিত জীবন সম্বন্ধে বাইবেল কিভাবে বর্ণনা করে? (খ) কলসীয় ২:৬, ৭ পদ যেমন ইঙ্গিত করে, যিহোবা কিভাবে তাঁর সঙ্গে চলতে আমাদের সাহায্য করেছেন?
আপনি কি কখনও একটি ছোট ছেলেকে তার বাবার সঙ্গে হাঁটতে দেখেছেন? ছোট ছেলেটি তার বাবার প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করে, তার মুখমণ্ডল শ্রদ্ধায় প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে; বাবা যখন তাকে সাহায্য করেন, তার নিজের মুখও ভালবাসা ও স্বীকৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। উপযুক্তরূপে, যিহোবা তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত সেবায় অতিবাহিত এক জীবন সম্বন্ধে বর্ণনা করতে গিয়ে ঠিক এইধরনের একটি চিত্র ব্যবহার করেন। উদাহরণস্বরূপ, ঈশ্বরের বাক্য বলে যে বিশ্বস্ত পুরুষ হনোক “ঈশ্বরের সহিত গমনাগমন করিতেন।”—আদিপুস্তক ৫:২৪; ৬:৯.
২ একজন বিবেচনাপূর্ণ পিতা যেমন তার ছোট ছেলেকে তার সঙ্গে হাঁটতে সাহায্য করেন, যিহোবাও আমাদের যথাসম্ভব সর্বোত্তম সাহায্য প্রদান করেছেন। তিনি তাঁর একজাত পুত্রকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। পৃথিবীতে তাঁর জীবনব্যাপী চলার প্রতিটি পদক্ষেপে যীশু খ্রীষ্ট নিখুঁতভাবে তাঁর স্বর্গীয় পিতাকে প্রতিফলিত করেছিলেন। (যোহন ১৪:৯, ১০; ইব্রীয় ১:৩) তাই ঈশ্বরের সঙ্গে চলতে চাইলে আমাদের যীশুর সঙ্গে চলা প্রয়োজন। প্রেরিত পৌল লিখেছিলেন: “অতএব খ্রীষ্ট যীশুকে, প্রভুকে, যেমন গ্রহণ করিয়াছ, তেমনি তাঁহাতেই চল; তাঁহাতেই বদ্ধমূল ও সংগ্রথিত হইয়া প্রাপ্ত শিক্ষানুসারে বিশ্বাসে দৃঢ়ীভূত হও, এবং ধন্যবাদ সহকারে উপচিয়া পড়।”—কলসীয় ২:৬, ৭.
৩. কলসীয় ২:৬, ৭ পদ অনুসারে, কেন আমরা বলতে পারি যে খ্রীষ্টেই চলার জন্য কেবল বাপ্তিস্ম নেওয়াই যথেষ্ট নয় কিন্তু আরও বেশি কিছু রয়েছে?
৩ তারা যেহেতু খ্রীষ্টেই চলতে চান, তার সিদ্ধ পদক্ষেপগুলি অনুসরণ করার প্রচেষ্টা করেন, তাই সৎহৃদয়বান বাইবেল ছাত্রেরা বাপ্তিস্মিত হন। (লূক ৩:২১; ইব্রীয় ১০:৭-৯) কেবল ১৯৯৭ সালেই, পৃথিবীব্যাপী ৩,৭৫,০০০ জনের বেশি লোক এই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি গ্রহণ করেছিলেন—প্রতিদিন গড়ে ১,০০০ জনেরও বেশি। এই বৃদ্ধি রোমাঞ্চকর! কিন্তু কলসীয় ২:৬, ৭ পদে লিপিবদ্ধ পৌলের বাক্যগুলি দেখায় যে খ্রীষ্টেই চলার জন্য কেবল বাপ্তিস্ম নেওয়াই যথেষ্ট নয়, আরও বেশি কিছু জড়িত। গ্রীক ক্রিয়াপদ “চল” এমন এক কাজকে বর্ণনা করে যা অবশ্যই ক্রমাগত, চলমান। এরপর, পৌল আরও বলেন যে খ্রীষ্টের সঙ্গে চলা চারটি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে: খ্রীষ্টে বদ্ধমূল হওয়া, তাঁতেই সংগ্রথিত হওয়া, বিশ্বাসে দৃঢ়ীভূত হওয়া এবং ধন্যবাদ সহকারে উপচিয়া পড়া। আসুন আমরা প্রত্যেকটি বাক্যাংশ বিবেচনা করি এবং দেখি যে কিভাবে এগুলি আমাদের ক্রমাগত খ্রীষ্টেই চলতে সাহায্য করে।
আপনি কি ‘খ্রীষ্টে বদ্ধমূল’?
৪. ‘খ্রীষ্টে বদ্ধমূল’ হওয়ার অর্থ কী?
৪ প্রথমে পৌল লেখেন যে আমাদের ‘খ্রীষ্টে বদ্ধমূল’ হওয়া প্রয়োজন। (মথি ১৩:২০, ২১ পদের সাথে তুলনা করুন।) একজন ব্যক্তি খ্রীষ্টে বদ্ধমূল হওয়ার জন্য কিভাবে কাজ করতে পারেন? উদ্ভিদের মূলগুলি চোখের আড়ালে থাকে কিন্তু সেগুলি উদ্ভিদের এক অত্যাবশ্যকীয় অংশ—সেগুলি এটিকে দৃঢ়তা প্রদান ও পুষ্টি সরবরাহ করে। অনুরূপভাবে খ্রীষ্টের উদাহরণ ও শিক্ষা প্রথমে আমাদের অদৃশ্যভাবে প্রভাবিত করে, আমাদের মন ও হৃদয়ে দৃঢ়ভাবে স্থাপিত হয়। সেখান থেকে সেগুলি আমাদের পুষ্টিসাধন ও শক্তিশালী করে। আমরা যখন সেগুলিকে আমাদের চিন্তাধারা, কাজ ও সিদ্ধান্তকে নিয়ন্ত্রণ করতে দিই, আমরা আমাদের জীবন যিহোবার কাছে উৎসর্গ করার জন্য প্রণোদিত হই।—১ পিতর ২:২১.
৫. আধ্যাত্মিক খাদ্যের জন্য আমরা কিভাবে “লালসা” করতে পারি?
৫ যীশু ঈশ্বরের জ্ঞানকে ভালবেসেছিলেন। এমনকি তিনি এটিকে খাদ্যের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। (মথি ৪:৪) তাঁর পর্বতে দত্ত উপদেশে তিনি ইব্রীয় শাস্ত্রের আটটি বিভিন্ন বই থেকে ২১টি উদ্ধৃতি করেছিলেন। তাঁর উদাহরণ অনুকরণ করার জন্য আমাদের অবশ্যই প্রেরিত পিতর যেমন উপদেশ দিয়েছেন তেমন করতে হবে—“নবজাত শিশুদের ন্যায়” আধ্যাত্মিক খাদ্যের জন্য “লালসা কর।” (১ পিতর ২:২) একটি নবজাত শিশু যখন পুষ্টির লালসা করে, সে তার তীব্র লালসা সম্বন্ধে সন্দেহের কোন অবকাশই রাখে না। এই মুহূর্তে আধ্যাত্মিক খাদ্যের জন্য আমরা যদি তেমন বোধ না করি, তবে পিতরের বাক্য আমাদের সেই লালসা ‘করার’ জন্য উৎসাহিত করে। কিভাবে? গীতসংহিতা ৩৪:৮ পদে প্রাপ্ত নীতিটি সাহায্য করতে পারে: “আস্বাদন করিয়া দেখ, সদাপ্রভু মঙ্গলময়।” আমরা যদি নিয়মিত যিহোবার বাক্য, বাইবেল “আস্বাদন” করি, প্রতিদিন হয়ত কিছু অংশ পড়ি, আমরা দেখব যে এটি আধ্যাত্মিকভাবে পুষ্টিকর ও মঙ্গলময়। কালক্রমে এটির প্রতি আমাদের লালসা বৃদ্ধি পাবে।
৬. আমরা যা পড়ি তার উপর ধ্যান করা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
৬ কিন্তু একবার খাদ্য গ্রহণের পর তা ভালভাবে হজম করা গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা যা পড়ি তা আমাদের ধ্যান করা প্রয়োজন। (গীতসংহিতা ৭৭:১১, ১২) উদাহরণস্বরূপ, আমরা যখন সর্বমহান পুরুষ যিনি কখনও জীবিত ছিলেন বইটি পড়ি, প্রতিটি অধ্যায়ই অনেক মূল্যবান প্রমাণিত হবে, যদি আমরা কিছু সময় চিন্তা করি ও নিজেদের জিজ্ঞাসা করি: ‘এই বিবরণে খ্রীষ্টের ব্যক্তিত্বের কোন্ দিকটি আমি দেখতে পাই আর কিভাবে আমার নিজের জীবনে আমি এটি অনুকরণ করতে পারি?’ এভাবে ধ্যান করা, আমরা যা শিখেছি তা প্রয়োগ করতে আমাদের সমর্থ করবে। তারপর, সিদ্ধান্ত গ্রহণের মুখোমুখি হলে, আমরা হয়ত নিজেদের জিজ্ঞাসা করতে পারি এই ক্ষেত্রে যীশু কী করতেন। আমরা যদি তদনুসারে আমাদের সিদ্ধান্ত নিই, তাহলে আমরা প্রকৃতই খ্রীষ্টে বদ্ধমূল হওয়ার সাক্ষ্য দিই।
৭. কঠিন আধ্যাত্মিক পুষ্টির প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত?
৭ এছাড়াও পৌল আমাদের “কঠিন খাদ্য” অর্থাৎ, ঈশ্বরের বাক্যের গভীর সত্যগুলি গ্রহণ করতে পরামর্শ দেন। (ইব্রীয় ৫:১৪) এই ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বাইবেল পড়া আমাদের প্রথম লক্ষ্য হতে পারে। তারপর, অধ্যয়নের জন্য আরও নির্দিষ্ট বিষয়গুলি আছে যেমন, খ্রীষ্টের মুক্তির মূল্যরূপ বলিদান, তাঁর লোকেদের সঙ্গে যিহোবা যে বিভিন্ন চুক্তিগুলি করেছিলেন সেগুলি অথবা বাইবেলের কিছু ভবিষ্যদ্বাণীমূলক বার্তা। প্রচুর পরিমাণে বিষয়বস্তু রয়েছে যা আমাদের এইধরনের কঠিন আধ্যাত্মিক খাদ্য আত্মভূত ও হজম করতে সাহায্য করবে। এইধরনের জ্ঞান নেওয়ার লক্ষ্য কী? আমাদের গর্ব করার কারণ যোগানো নয়, বরং যিহোবার প্রতি আমাদের প্রেম গড়ে তোলা ও তাঁর নিকটবর্তী করা। (১ করিন্থীয় ৮:১; যাকোব ৪:৮) আমরা যদি আকুল আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে এই জ্ঞান গ্রহণ করি, নিজেদের প্রতি প্রয়োগ করি এবং অন্যদের সাহায্য করার জন্য সেগুলি ব্যবহার করি, তাহলে আমরা সত্যই খ্রীষ্টকে অনুকরণ করব। এটি আমাদের তাঁর সঙ্গে যথার্থভাবে বদ্ধমূল হতে সাহায্য করবে।
আপনি কি ‘খ্রীষ্টে সংগ্রথিত হচ্ছেন’?
৮. ‘খ্রীষ্টে সংগ্রথিত’ হয়ে ওঠার অর্থ কী?
৮ খ্রীষ্টেই চলার পরবর্তী দিকটি বোঝানোর জন্য পৌল শীঘ্রই একটি প্রাণবন্ত উপমা থেকে আরেকটিতে পরিবর্তিত হন—একটি উদ্ভিদ থেকে এক অট্টালিকায়। আমরা যখন নির্মাণাধীনে রয়েছে এমন একটি অট্টালিকার কথা চিন্তা করি, তখন আমরা কেবল এর ভিত্তিমূল সম্বন্ধেই চিন্তা করি না কিন্তু প্রচুর শ্রমসাধ্য কাজের মধ্য দিয়ে যে অট্টালিকাটি স্পষ্টভাবে উপরের দিকে ওঠে সেটির বিষয়েও ভাবি। অনুরূপভাবে, খ্রীষ্টতুল্য গুণাবলি ও অভ্যাস গড়ে তুলতে আমাদের প্রচুর কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। এইধরনের কঠোর পরিশ্রম অলক্ষিত থাকে না যেমন পৌল তীমথিয়কে লিখেছিলেন: ‘তোমার উন্নতি যেন সকলের প্রত্যক্ষ হয়।’ (১ তীমথিয় ৪:১৫; মথি ৫:১৬) কিছু খ্রীষ্টীয় কাজ কী যা আমাদের সংগ্রথিত করে?
৯. (ক) আমাদের পরিচর্যায় খ্রীষ্টকে অনুকরণ করার জন্য কিছু ব্যবহারিক লক্ষ্য কী যা আমরা স্থাপন করতে পারি? (খ) আমরা কিভাবে জানি যে যিহোবা চান আমরা যেন আমাদের পরিচর্যা উপভোগ করি?
৯ যীশু আমাদের সুসমাচার প্রচার ও শিক্ষা দেওয়ার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন। (মথি ২৪:১৪; ২৮:১৯, ২০) সাহসী ও কার্যকারীভাবে সাক্ষ্য দিয়ে তিনি নিখুঁত উদাহরণ স্থাপন করেছেন। অবশ্যই আমরা কখনও তিনি যেমন করেছিলেন তেমন করতে পারব না। কিন্তু, প্রেরিত পিতর আমাদের জন্য এই লক্ষ্য স্থাপন করেন: “যে কেহ তোমাদের অন্তরস্থ প্রত্যাশার হেতু জিজ্ঞাসা করে, তাহাকে উত্তর দিতে সর্ব্বদা প্রস্তুত থাক। কিন্তু মৃদুতা ও ভয় সহকারে উত্তর দিও।” (১ পিতর ৩:১৫) আপনি যদি মনে করেন যে আপনি “উত্তর দিতে সর্ব্বদা প্রস্তুত” নন, হতাশ হবেন না। যুক্তিসংগত লক্ষ্যগুলি স্থাপন করুন যেগুলি আপনাকে ক্রমান্বয়ে সেই মানের নিকটবর্তী হতে সাহায্য করবে। পূর্ব প্রস্তুতি আপনাকে হয়ত আপনার উপস্থাপনায় বৈচিত্র্য আনতে অথবা একটি বা দুটি শাস্ত্রপদ অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম করবে। আপনি হয়ত আরও অধিক বাইবেল সাহিত্য অর্পণ করার, আরও অধিক পুনর্সাক্ষাৎ করার অথবা একটি বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করার লক্ষ্য স্থাপন করতে পারেন। পরিমাণের উপর দৃঢ়ভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়—যেমন কত ঘন্টা, কতগুলি অর্পণ অথবা অধ্যয়ন—কিন্তু গুণগত মানের উপর। যুক্তিসংগত লক্ষ্য স্থাপন করা ও তাতে সফল হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা পরিচর্যায় নিজেদের প্রদান করাকে উপভোগ করতে সাহায্য করবে। যিহোবা তাই চান—তাকে আমরা যেন “সানন্দে” সেবা করি।—গীতসংহিতা ১০০:২. ২ করিন্থীয় ৯:৭ পদের সাথে তুলনা করুন।
১০. অন্যান্য কিছু খ্রীষ্টীয় কাজ কী যা আমাদের সম্পাদন করা প্রয়োজন আর এগুলি কিভাবে আমাদের সাহায্য করে?
১০ মণ্ডলীতে আমরা যে কাজগুলি সম্পাদন করি সেগুলিও আমাদের খ্রীষ্টে সংগ্রথিত করে। একে অপরের প্রতি প্রেম প্রদর্শন করা হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ এটিই সত্য খ্রীষ্টানদের শনাক্তিকরণ চিহ্ন। (যোহন ১৩:৩৪, ৩৫) আমরা যখন অধ্যয়ন করি আমাদের অনেকেরই শিক্ষকদের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু, আমরা কি মণ্ডলীর অন্যান্যদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার মাধ্যমে ‘প্রশস্ত হওয়া’ সম্বন্ধে পৌলের পরামর্শ অনুসরণ করতে পারি? (২ করিন্থীয় ৬:১৩) প্রাচীনদের প্রতিও আমাদের প্রেম ও উপলব্ধি দেখানো প্রয়োজন। তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করার মাধ্যমে, তাদের শাস্ত্রীয় পরামর্শগুলি জানতে চাওয়া ও গ্রহণ করার মাধ্যমে আমরা তাদের কঠোর পরিশ্রমকে অনেক সহজ করে দেব। (ইব্রীয় ১৩:১৭) একই সময়ে এটি আমাদের খ্রীষ্টে সংগ্রথিত হওয়ার ক্ষেত্রে অবদান রাখবে।
১১. বাপ্তিস্ম সম্বন্ধে কোন্ বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের গ্রহণ করা উচিত?
১১ বাপ্তিস্ম একটি রোমাঞ্চকর ঘটনা! কিন্তু আমরা আশা করব না যে তার পর থেকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই সমভাবে রোমাঞ্চকর হবে। খ্রীষ্টে সংগ্রথিত হওয়ার এক বৃহৎ অংশ ‘একই ধারায় চলাকে’ অন্তর্ভুক্ত করে। (ফিলিপীয় ৩:১৬) এর অর্থ এক নীরস, একঘেঁয়ে জীবনযাত্রা নয়। এটির সাধারণ অর্থ হল সেই একই পথে আরও সামনে এগিয়ে চলা—অন্য কথায়, উত্তম আধ্যাত্মিক অভ্যাসগুলি গড়ে তোলা ও দিনের পর দিন, বছরের পর বছর তা বজায় রাখা। মনে রাখবেন, “যে কেহ শেষ পর্য্যন্ত স্থির থাকিবে, সেই পরিত্রাণ পাইবে।”—মথি ২৪:১৩.
আপনি কি ‘বিশ্বাসে দৃঢ়ীভূত হচ্ছেন’?
১২. “বিশ্বাসে দৃঢ়ীভূত” হওয়ার অর্থ কী?
১২ খ্রীষ্টেই চলার বিষয়টি বর্ণনা করতে গিয়ে তার তৃতীয় বাক্যাংশে পৌল আমাদের পরামর্শ দেন, “বিশ্বাসে দৃঢ়ীভূত হও।” একটি সংস্করণ এভাবে পড়া হয়: “বিশ্বাস সম্বন্ধে নিশ্চিত হও,” কারণ যে গ্রীক শব্দটি পৌল ব্যবহার করেছিলেন তার অর্থ হতে পারে “নিশ্চিত করা, নিশ্চয়তা দেওয়া ও আইনত প্রত্যাহার করার অসাধ্য।” আমরা যতই জ্ঞানে বৃদ্ধি পাই, যিহোবা ঈশ্বরের উপর আমাদের বিশ্বাস যে সুপ্রতিষ্ঠিত আর বাস্তবিকপক্ষে আইনত প্রতিপাদিত তা দেখার জন্য আমাদের আরও কারণ প্রদান করা হয়। এর ফলে আমাদের দৃঢ়তা আরও বৃদ্ধি পায়। আমাদের প্রভাবিত করা শয়তানের জগতের পক্ষে ক্রমবর্ধিষ্ণুভাবে কঠিন হয়ে পড়ে। এটি আমাদের “সিদ্ধির চেষ্টায় অগ্রসর” হতে পৌলের পরামর্শকে স্মরণ করিয়ে দেয়। (ইব্রীয় ৬:১) পরিপক্বতা ও দৃঢ়তা নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত।
১৩, ১৪. (ক) কলসীতে প্রথম শতাব্দীর খ্রীষ্টানেরা তাদের দৃঢ়তার ক্ষেত্রে কোন্ হুমকির সম্মুখীন হয়েছিলেন? (খ) কোন্ বিষয়টি প্রেরিত পৌলকে উদ্বিগ্ন করেছিল?
১৩ প্রথম শতাব্দীর কলসীর খ্রীষ্টানেরা তাদের দৃঢ়তার ক্ষেত্রে হুমকির সম্মুখীন হয়েছিলেন। পৌল সতর্ক করেছিলেন: “দেখিও, দর্শনবিদ্যা ও অনর্থক প্রতারণা দ্বারা কেহ যেন তোমাদিগকে বন্দি করিয়া লইয়া না যায়; তাহা মনুষ্যদের পরম্পরাগত শিক্ষার অনুরূপ, জগতের অক্ষরমালার অনুরূপ, খ্রীষ্টের অনুরূপ নয়।” (কলসীয় ২:৮) পৌল চাননি যে কলসীয়েরা যারা “[ঈশ্বরের] প্রেমভূমি পুত্ত্রের রাজ্যে”-র প্রজা হয়েছিলেন, তারা তাদের আশীর্বাদপ্রাপ্ত আধ্যাত্মিক অবস্থা থেকে বিচ্যুত হোক অথবা দূরে সরে যাক। (কলসীয় ১:১৩) কিসের দ্বারা ভ্রান্ত? পৌল “দর্শনবিদ্যা”-র কথা উল্লেখ করেছিলেন, যে শব্দটি বাইবেলে একবারই দেখা যায়। তিনি কি প্লেটো ও সক্রেটিস এর মত গ্রীক দার্শনিকদের কথা বলছিলেন? তারা যদিও সত্য খ্রীষ্টানদের পক্ষে হুমকিস্বরূপ ছিলেন কিন্তু ওই দিনগুলিতে “দর্শনবিদ্যা” শব্দটির আরও ব্যাপক প্রচলন ছিল। এটি সাধারণত বিভিন্ন মতবাদের অনেক দল ও ব্যক্তিকে—এমনকি ধর্মীয় ব্যক্তিদের নির্দেশ করত। উদাহরণস্বরূপ, প্রথম শতাব্দীতে যোসেফাস ও ফিলিওর মত যিহূদীরা সম্ভবত এর আবেদনকে আরও প্রবল করার জন্য, তাদের নিজস্ব ধর্মকে একটি দর্শনবিদ্যা বলেছিলেন।
১৪ কিছু দর্শনবিদ্যা যেগুলি হয়ত পৌলকে উদ্বিগ্ন করেছিল, সেগুলি ধর্মসংক্রান্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে, কলসীয়দের প্রতি লেখা তার পত্রের একই অধ্যায়ে তিনি তাদের বিষয় বলেছিলেন যারা “ধরিও না, আস্বাদ লইও না, স্পর্শ করিও না” শিক্ষা দিয়েছিলেন আর এর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে মোশির ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করেছিলেন যেগুলি খ্রীষ্টের মৃত্যুর দ্বারা পরিসমাপ্ত হয়েছিল। (রোমীয় ১০:৪) পৌত্তলিক দর্শনবিদ্যা ছাড়াও অন্যান্য প্রভাবগুলি সক্রিয় ছিল যা মণ্ডলীর আধ্যাত্মিকতার পক্ষে হুমকিস্বরূপ ছিল। (কলসীয় ২:২০-২২) পৌল সেই দর্শনবিদ্যার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিলেন যা “জগতের অক্ষরমালার” অংশ ছিল। এইধরনের মিথ্যা শিক্ষার উৎস ছিল মানুষ।
১৫. কিভাবে আমরা অশাস্ত্রীয় চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হওয়া এড়াতে পারি যা প্রায়ই আমাদের সামনে আসতে পারে?
১৫ ঈশ্বরের বাক্যের উপর দৃঢ়ভাবে ভিত্তি করে নয় এমন মানব ধারণা ও চিন্তাধারা উন্নীত করা একজন খ্রীষ্টানের দৃঢ়তার পক্ষে হুমকিস্বরূপ হতে পারে। আজকে আমাদের অবশ্যই এইধরনের হুমকি সম্বন্ধে সতর্ক হতে হবে। প্রেরিত যোহন পরামর্শ দিয়েছিলেন: “প্রিয়তমেরা, তোমরা সকল আত্মাকে বিশ্বাস করিও না, বরং আত্মা সকলের পরীক্ষা করিয়া দেখ, তাহারা ঈশ্বর হইতে কি না।” (১ যোহন ৪:১) তাই একজন সহপাঠী যদি আপনাকে বিশ্বাস করাতে প্রলোভিত করে যে বাইবেলের মান অনুযায়ী চলা সেকেলে অথবা একজন প্রতিবেশী যদি আপনাকে এক বস্তুবাদী মনোভাব গ্রহণ করার জন্য প্রভাবিত করেন অথবা একজন সহকর্মী যদি সুচতুরভাবে আপনাকে আপনার বাইবেল-শিক্ষিত বিবেককে লঙ্ঘন করার জন্য চাপ দেন অথবা এমনকি একজন সহবিশ্বাসী যদি তার নিজস্ব ধারণার উপর ভিত্তি করে মণ্ডলীর অন্য কারও সম্বন্ধে সমালোচনামূলক, নেতিবাচক মন্তব্য করেন, তাহলে তারা যা বলেন তা গ্রহণ করবেন না। ঈশ্বরের বাক্যের সঙ্গে যা সামঞ্জস্য রাখে না, তা পরিহার করুন। আমরা যখন তা করি, আমরা খ্রীষ্টেই চলার ক্ষেত্রে আমাদের দৃঢ়তা বজায় রাখি।
‘ধন্যবাদ সহকারে উপচিয়া পড়া’
১৬. খ্রীষ্টেই চলার চতুর্থ দিকটি কী আর কোন্ প্রশ্ন আমরা হয়ত জিজ্ঞাসা করতে পারি?
১৬ খ্রীষ্টেই চলার চতুর্থ দিকটি পৌল উল্লেখ করেন যে আমরা যেন “ধন্যবাদ সহকারে উপচিয়া” পড়ি। (কলসীয় ২:৭) “উপচিয়া” শব্দটি একটি নদীর কূলগুলি উপচে পড়ছে এমন কথা মনে করিয়ে দেয়। এটি ইঙ্গিত করে যে খ্রীষ্টান হিসাবে আমাদের ধন্যবাদ প্রদান ক্রমাগত অথবা এক অভ্যাসের বিষয় হওয়া উচিত। আমরা যেন প্রত্যেকে জিজ্ঞাসা করি, ‘আমি কি ধন্যবাদ দিই?’
১৭. (ক) এই কঠিন সময়েও কেন বলা যেতে পারে যে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য আমাদের সকলের প্রচুর কারণ রয়েছে? (খ) যিহোবার কাছ থেকে কিছু দান কী যার জন্য বিশেষভাবে আপনার ধন্যবাদ দেওয়া প্রয়োজন?
১৭ বাস্তবিকই, আমাদের সকলের প্রতিদিন যিহোবার প্রতি ধন্যবাদ সহকারে উপচে পড়ার প্রচুর কারণ রয়েছে। এমনকি নিদারুণ কষ্টকর সময়েও এমন কিছু সাধারণ বিষয় থাকতে পারে যা আমাদের স্বস্তির মুহূর্ত এনে দেয়। একজন বন্ধু যখন সহানুভূতি দেখান। প্রিয়জন যখন আশ্বাসজনকভাবে স্পর্শ করেন। রাতের পর্যাপ্ত বিশ্রাম পুনরুদ্ধারকর প্রমাণিত হয়। এক সুস্বাদু ভোজ ক্ষুধার তীব্র বেদনাকে দমন করে। পাখির গান, শিশুর হাসি, দ্যুতিময় নীল আকাশ, এক সতেজ বাতাস—এই সবকিছু এবং এর চেয়ে বেশি কিছু হয়ত এক দিনে আমাদের জীবনে আসে। এইধরনের দানগুলিকে হালকাভাবে নেওয়া খুবই সহজ। এই সমস্ত বিষয়গুলি কি একটি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য নয়? এইসবই “সমস্ত উত্তম দান এবং সমস্ত সিদ্ধ বর” এর উৎস যিহোবার কাছ থেকে আসে। (যাকোব ১:১৭) উদাহরণস্বরূপ, তিনি আমাদের এক মহৎ উপহার দিয়েছেন যা এগুলিকে ক্ষুদ্র বলে প্রতীয়মান করে আর তা হল জীবন। (গীতসংহিতা ৩৬:৯) এছাড়াও, তিনি আমাদের চিরকাল বেঁচে থাকার এক সুযোগ দিয়েছেন। এই উপহার প্রদান করার জন্য যিহোবা তাঁর একজাত পুত্র যিনি “বিশেষভাবে তাঁর প্রিয় পাত্র ছিলেন, (NW)” তাঁকে প্রেরণ করার দ্বারা সর্বোচ্চ ত্যাগস্বীকার করেছিলেন।—হিতোপদেশ ৮:৩০; যোহন ৩:১৬.
১৮. আমরা কিভাবে দেখাতে পারি যে আমরা যিহোবাকে ধন্যবাদ দিই?
১৮ অতএব, গীতরচকের বাক্যগুলি কতই না সত্য: “যিহোবাকে ধন্যবাদ দেওয়া উত্তম।” (গীতসংহিতা ৯২:১, NW) অনুরূপভাবে পৌল থিষলনীকীয়ের খ্রীষ্টানদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন: “সর্ব্ববিষয়ে ধন্যবাদ কর।” (১ থিষলনীকীয় ৫:১৮; ইফিষীয় ৫:২০; কলসীয় ৩:১৫) আমরা প্রত্যেকে যেন আরও বেশি করে ধন্যবাদ প্রদানের জন্য স্থিরসংকল্প হই। ঈশ্বরের কাছে আমাদের প্রার্থনা যেন কেবল আমাদের চাহিদাগুলি সম্বন্ধে আবেদন না হয়। এগুলিকে যথাস্থানে রাখা উত্তম। কিন্তু এমন একজন বন্ধুর সম্বন্ধে চিন্তা করুন, যে কেবল আপনার কাছ থেকে যখন তার কিছু প্রয়োজন তখনই আপনার সঙ্গে কথা বলে! তাই, কেবল ধন্যবাদ ও যিহোবার প্রশংসা করার জন্য তাঁর কাছে প্রার্থনা করুন না কেন? তিনি যখন এই অকৃতজ্ঞ জগতের প্রতি দৃষ্টি দেন এইধরনের প্রার্থনা তাঁকে কতই না সন্তুষ্ট করে! একটি গৌণ উপকার হল যে এইধরনের প্রার্থনা জীবনের ইতিবাচক দিকগুলির প্রতি আমাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে সাহায্য করতে পারে, যা স্মরণ করিয়ে দেয় প্রকৃতপক্ষে আমরা কতই না আশীর্বাদপ্রাপ্ত।
১৯. কলসীয় ২:৬, ৭ পদে পৌলের বাক্য কিভাবে ইঙ্গিত করে যে আমরা সকলেই খ্রীষ্টের সঙ্গে ক্রমাগত চলায় উন্নতি করতে পারি?
১৯ ঈশ্বরের বাক্যের কেবল একটি বাক্যাংশ থেকে কত বিজ্ঞ নির্দেশনা পাওয়া যেতে পারে, তা কি লক্ষণীয় নয়? ক্রমাগত খ্রীষ্টের সঙ্গে চলা সম্বন্ধে পৌলের পরামর্শ এমন কিছু যা আমরা প্রত্যেকেই হৃদয়ে গ্রহণ করতে চাই। তাই আসুন আমরা ‘খ্রীষ্টে বদ্ধমূল,’ ‘তাঁহাতে সংগ্রথিত,’ “বিশ্বাসে দৃঢ়ীভূত,” এবং “ধন্যবাদ সহকারে উপচিয়া” পড়ার জন্য স্থিরসংকল্প হই। এই পরামর্শগুলি বিশেষভাবে নতুন বাপ্তাইজিতদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা আমাদের সকলের প্রতি প্রযোজ্য হয়। একটি প্রধান মূল কিভাবে ক্রমান্বয়ে নিম্নদেশে গভীর থেকে গভীরে যায় আর নির্মাণাধীনে রয়েছে এমন একটি অট্টালিকা কিভাবে ক্রমান্বয়ে উচ্চ হয়, তা চিন্তা করুন। তেমনই খ্রীষ্টের সঙ্গে আমাদের চলাও কখনও শেষ হয় না। বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। যিহোবা আমাদের সাহায্য ও আশীর্বাদ করবেন কারণ তিনি চান আমরা যেন তাঁর সঙ্গে ও তাঁর প্রিয়তম পুত্রের সঙ্গে আজীবন চলি।
আপনি কিভাবে উত্তর দেবেন?
◻ খ্রীষ্টেই চলার সাথে কী জড়িত?
◻ ‘খ্রীষ্টে বদ্ধমূল’ হওয়ার অর্থ কী?
◻ আমরা কিভাবে ‘খ্রীষ্টে সংগ্রথিত’ হয়ে উঠতে পারি?
◻ “বিশ্বাসে দৃঢ়ীভূত” হওয়া কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
◻ ‘ধন্যবাদ সহকারে উপচিয়া পড়ার’ কোন্ কারণগুলি আমাদের রয়েছে?
[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]
একটি গাছের মূল হয়ত দেখা যায় না কিন্তু সেগুলি গাছকে খাদ্য সরবরাহ করে ও দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ রাখে