অলৌকিক কাজগুলো—বাস্তব নাকি কাল্পনিক?
একজন ভদ্রলোকের দৃষ্টি সরাসরি সামনে দিয়ে চলে যাওয়া একটা গাড়ির বাম্পারের মধ্যে লাগানো স্টিকারে ওপরে গিয়ে পড়ে, যেটার মধ্যে লেখা ছিল, “অলৌকিক কাজগুলো ঘটে—কেবল দূতেদের জিজ্ঞেস করুন।” একজন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও, এর অর্থ কী সেই বিষয়ে তিনি অনিশ্চিত ছিলেন। এই চিহ্নের অর্থটা কি এই বুঝিয়েছিল যে, গাড়ির চালক অলৌকিক কাজগুলোতে বিশ্বাস করেন? নাকি এটা আসলে অলৌকিক কাজ এবং দূতেদের, উভয়ের প্রতি বিশ্বাসের অভাবকে ইঙ্গিত করার জন্য শুধুমাত্র এক রসিকতা ছিল?
আপনি হয়তো জার্মান গ্রন্থকার মান্ফ্রেট বার্টেল যা বলেছেন, তাতে আগ্রহী হবেন: “অলৌকিক শব্দটি এমন একটি শব্দ, যা সঙ্গে সঙ্গে দুটো বিপরীত ধারণা সৃষ্টি করে পাঠকদের বিভক্ত করে।” যারা অলৌকিক কাজগুলোতে বিশ্বাস করে, তারা দৃঢ়প্রত্যয়ী যে সেগুলো ঘটে আর সম্ভবত প্রায়ই ঘটে।a উদাহরণস্বরূপ, রিপোর্ট অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে গ্রিসে বিশ্বাসীরা দাবি করেছে যে, অলৌকিক কাজগুলো মাসে প্রায় একবার ঘটে থাকে। এর ফলে গ্রিক অর্থোডক্স গির্জার একজন বিশপ সতর্ক করে দেন: “ঈশ্বর, মরিয়ম এবং সাধুদেরকে বিশ্বাসীরা মনুষ্যোচিত করতে চাচ্ছে। বিশ্বাসীদের সীমা অতিক্রম করা উচিত নয়।”
অলৌকিক কাজগুলোর ওপর বিশ্বাস অন্যান্য দেশে ততটা ব্যাপক নয়। ২০০২ সালে জার্মানিতে প্রকাশিত আ্যলেন্সব্যাখ সমীক্ষা অনুযায়ী, জার্মানির নাগরিকদের মধ্যে ৭১ শতাংশ লোক অলৌকিক কাজগুলোকে বাস্তব নয় কিন্তু কাল্পনিক বলে মনে করে। কিন্তু, অলৌকিক কাজগুলোতে বিশ্বাস করে এমন এক তৃতীয়াংশেরও কম লোকের মধ্যে তিন জন হল মহিলা, যারা কুমারী মরিয়মের কাছ থেকে বার্তা পেয়েছে বলে দাবি করে। তাদের দাবি অনুযায়ী, মরিয়ম তাদের সামনে—দূতগণ এবং একটা পায়রাসহ—আবির্ভূত হওয়ার কয়েক মাস পরে, জার্মান সংবাদপত্র ভেস্টফালিনপস্ট রিপোর্ট করে: “এ পর্যন্ত প্রায় ৫০,০০০ তীর্থযাত্রী, আরোগ্য সন্ধানকারী ও সেইসঙ্গে কৌতূহলী লোকেরা মহিলাদের দেখা দর্শনের প্রতি গভীর আগ্রহ দেখিয়েছে।” আরও ১০,০০০ লোক পুনরায় মরিময়ের আবির্ভাব দেখার প্রত্যাশায় গ্রামের দিকে ছুটে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। কথিত আছে যে, ১৮৫৮ সালে ফ্রান্সের লোর্ড্জে এবং ১৯১৭ সালে পোর্তুগালের ফাটিমাতে কুমারী মরিয়মের একইরকম আবির্ভাব ঘটেছিল।
ন-খ্রিস্টীয় ধর্মগুলোর বিষয়ে কী বলা যায়?
অলৌকিক কাজগুলোর প্রতি বিশ্বাস প্রায় সব ধর্মের মধ্যেই রয়েছে। দি এনসাইক্লোপিডিয়া অফ রিলিজিয়ন ব্যাখ্যা করে যে, বৌদ্ধধর্ম, খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম ধর্মের প্রবর্তকরা অলৌকিক কাজগুলো সম্বন্ধে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করত কিন্তু এটি বলে: “এই ধর্মগুলোর পরবর্তী ইতিহাস নির্ভুলভাবে দেখায় যে, অলৌকিক কাজগুলো এবং অলৌকিক কাজের গল্পগুলো মানুষের ধর্মীয় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে এসেছে।” এই তথ্যগ্রন্থ বলে যে, “বুদ্ধ নিজে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন অলৌকিক কাজ করেছিলেন।” পরবর্তী সময়ে যখন “বৌদ্ধধর্ম চিনে প্রতিস্থাপিত হয়, তখন সেখানকার মিশনারিরা প্রায়ই তাদের অলৌকিক শক্তিগুলো প্রদর্শন করত।”
এই ধরনের কথিত বেশ কয়েকটা অলৌকিক কাজ সম্বন্ধে উল্লেখ করার পর, সেই এনসাইক্লোপিডিয়া এই বলে শেষ করে: “একজন ব্যক্তি হয়তো ধর্মপরায়ণ জীবনীকারদের দ্বারা কথিত এই সমস্ত অলৌকিক কাজের গল্পগুলো মেনে নেওয়ার জন্য তৈরি না-ও থাকতে পারেন কিন্তু নিঃসন্দেহে সেগুলো বুদ্ধকে গৌরবান্বিত করার ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছে, যিনি তার উদ্যোগী অনুসারীদের এই ধরনের অলৌকিক শক্তিগুলো প্রদান করতে সমর্থ ছিলেন।” সেই একই তথগ্রন্থ ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে বলে: “ইসলামি সমাজের বেশির ভাগ লোক সবসময় অলৌকিক কাজগুলো দেখার প্রত্যাশা রেখে এসেছে। মুহম্মদ বহুবার জনসমক্ষে অলৌকিক কাজগুলো করেছেন বলে ঐতিহ্যগত শাস্ত্রে (হাদিস) বলা হয়েছে। . . . এমনকি পিররা তাদের মৃত্যুর পরও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের জন্য তাদের নিজেদের কবরে অলৌকিক কাজগুলো সম্পাদন করেছেন বলে বিশ্বাস করা হয় আর তাদেরকে মধ্যস্থতা করার জন্য আন্তরিকভাবে অনুরোধ জানানো হয়।”
খ্রিস্টধর্মের মধ্যে অলৌকিক কাজগুলোর বিষয়ে কী বলা যায়?
খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে এমন ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকের ভিন্ন ভিন্ন ধারণা রয়েছে। কেউ কেউ যিশু খ্রিস্ট অথবা প্রাক্খ্রিস্টীয় যুগে ঈশ্বরের দাসদের দ্বারা সম্পাদিত অলৌকিক কাজগুলো সম্বন্ধে বাইবেলের বিবরণগুলোকে বাস্তব বলে স্বীকার করে। কিন্তু, অনেকে আবার প্রটেস্টান্ট ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মার্টিন লুথারের সঙ্গে একমত। দি এনসাইক্লোপিডিয়া অফ রিলিজিয়ন তার সম্বন্ধে বলে: “লুথার এবং ক্যালভিন উভয়েই লিখেছিল যে, অলৌকিক কাজগুলোর যুগ পেরিয়ে গিয়েছে আর তাই সেগুলো ঘটবে বলে আশা করা উচিত নয়।” এই তথ্যগ্রন্থ বলে, ক্যাথলিক গির্জা “সেগুলো কীভাবে ঘটেছিল, তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা না করেই” অলৌকিক কাজগুলোতে বিশ্বাস করে চলেছে। কিন্তু, “শিক্ষিত প্রটেস্টান্ট সমাজ বিশ্বাস করে যে, খ্রিস্টধর্মের রীতিনীতি হল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নৈতিকতার বিষয় আর তাই ঈশ্বর অথবা আত্মিক জগৎ কেউই ব্যাপক মাত্রায় বাস্তব মানবজীবনের সংস্পর্শে আসেনি অথবা তাদের ওপর একেবারেই কোনো প্রভাব ফেলেনি।”
খ্রিস্টান বলে দাবি করে এমন অন্যান্য ব্যক্তি ও সেইসঙ্গে কিছু পাদরি বাইবেলে উল্লেখিত অলৌকিক কাজগুলোর বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে। উদাহরণস্বরূপ জ্বলন্ত ঝোপের বিরণের কথা ধরুন, যা বাইবেলের যাত্রাপুস্তক ৩:১-৫ পদের মধ্যে বর্ণিত রয়েছে। বাইবেল আসলে যা বলে (ইংরেজি) বইটি ব্যাখ্যা করে যে, বেশ কয়েক জন জার্মান ঈশ্বরতত্ত্ববিদ এই ঘটনাকে আক্ষরিক অলৌকিক ঘটনা বলে মনে করে না। এর পরিবর্তে, তারা এটাকে “বিবেকের দংশন এবং প্রচণ্ড জ্বলন্ত বেদনার সঙ্গে মোশির অন্তরের লড়াইয়ের প্রতীক” হিসেবে ব্যাখ্যা করে। বইটি আরও বলে: “অগ্নিশিখাকে ঐশিক উপস্থিতির সূর্যোলোকে হঠাৎ করে প্রস্ফুটিত ফুল হিসেবেও দেখা যেতে [বোঝা যেতে] পারে।”
এই ধরনের ব্যাখ্যা হয়তো আপনার মনঃপূত না-ও হতে পারে। তা হলে, কোন বিষয়টা আপনার বিশ্বাস করা উচিত? অলৌকিক কাজগুলো যে কখনও সম্পাদিত হয়েছিল, তা বিশ্বাস করা কি বাস্তবসম্মত? আজকের দিনের অলৌকিক কাজগুলো সম্বন্ধে কী বলা যায়? যেহেতু আমরা দূতেদের জিজ্ঞেস করতে পারি না, তাই কাকে জিজ্ঞেস করব?
বাইবেলের দৃষ্টিভঙ্গি
কেউই অস্বীকার করতে পারে না যে বাইবেল জানায়, অতীতে ঈশ্বর কখনও কখনও মানুষের অসাধ্য এমন কাজগুলো করার জন্য তাতে হস্তক্ষেপ করতেন। তাঁর সম্বন্ধে আমরা পড়ি: “তুমি নানা চিহ্ন, অলৌকিক লক্ষণ, শক্তিশালী হাত, প্রসারিত বাহু ও ভয়ঙ্কর মহাকর্ম সাধনে তোমার আপন জনগণ ইস্রায়েলকে মিশর দেশ থেকে বের করে এনেছিলে।” (যিরমিয় ৩২:২১, বাংলা জুবিলী বাইবেল) কল্পনা করুন যে, সেই সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী জাতি ঈশ্বরের কাছ থেকে পাঠানো দশটা আঘাত, যেগুলোর অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রথমজাতের মৃত্যু, সেগুলোর কাছে নতি স্বীকার করেছিল। সত্যিই অলৌকিক কাজ!—যাত্রাপুস্তক ৭ থেকে ১৪ অধ্যায়।
কয়েক শতাব্দী পরে, চার জন সুসমাচার লেখক যিশুর দ্বারা সম্পাদিত প্রায় ৩৫টা অলৌকিক কাজের বর্ণনা দেয়। বস্তুত, তাদের কথাগুলো দেখায় যে, তারা যে-বিবরণগুলো দিয়েছে সেগুলোর চেয়েও বেশি অতিপ্রাকৃত কাজ তিনি সম্পাদন করেছেন। এই বিরণগুলো বাস্তব নাকি কাল্পনিক?b—মথি ৯:৩৫; লূক ৯:১১.
বাইবেল যদি তা-ই হয়, যা এটি দাবি করে—ঈশ্বরের সত্যের বাক্য—তা হলে এটি যে-অলৌকিক কাজগুলোর বিষয়ে বলে, সেগুলোতে আপনার বিশ্বাস করার স্পষ্ট কারণ রয়েছে। অতীতে অলৌকিক কাজগুলো যে ঘটেছে সেই বিষয়ে বাইবেল স্পষ্ট বর্ণনা দেয়—অলৌকিকভাবে আরোগ্যসাধন, পুনরুত্থান এবং এইরকম আরও কিছু—কিন্তু এটা এই বিষয়টাও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে যে, এই ধরনের অলৌকিক কাজগুলো এখন আর ঘটে না। (৪ পৃষ্ঠায় “যেকারণে অতীতের মতো অলৌকিক কাজগুলো আর ঘটে না” নামক বাক্সটা দেখুন।) তাই, এর অর্থ কি এই যে, এমনকি যারা বাইবেলকে বাস্তব বলে গ্রহণ করে, তারা আধুনিক দিনের অলৌকিক কাজগুলোতে বিশ্বাস করাকে ভিত্তিহীন বলে মনে করে? উত্তরের জন্য পরের প্রবন্ধ দেখুন।
[পাদটীকাগুলো]
a এই প্রবন্ধে “অলৌকিক” শব্দটিকে বাইবেলের একটি অভিধানে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, সেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে: “ভৌত জগতে ঘটিত ঘটনা, যেগুলো সমস্ত পরিচিত মানুষ অথবা প্রাকৃতিক শক্তিকে ছাড়িয়ে যায় আর তাই তা অতিপ্রাকৃত উৎসের ওপর আরোপ করা হয়।”
b বাইবেল যে বিশ্বাসযোগ্য সেটার প্রমাণগুলো আপনি বিবেচনা করতে পারেন। এই ধরনের প্রমাণগুলো যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত বাইবেল—ঈশ্বরের বাক্য অথবা মানুষের? (ইংরেজি) বইয়ের মধ্যে রয়েছে।
[৪ পৃষ্ঠার বাক্স]
যেকারণে অতীতের মতো অলৌকিক কাজগুলো আর ঘটে না
ইবেলে বিভিন্ন ধরনের অলৌকিক কাজের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। (যাত্রাপুস্তক ৭:১৯-২১; ১ রাজাবলি ১৭:১-৭; ১৮:২২-৩৮; ২ রাজাবলি ৫:১-১৪; মথি ৮:২৪-২৭; লূক ১৭:১১-১৯; যোহন ২:১-১১; ৯:১-৭) এইরকম অনেক অলৌকিক কাজ যিশুকে মশীহ হিসেবে শনাক্ত করেছিল আর এগুলো প্রমাণ দিয়েছিল যে, তাঁর প্রতি ঈশ্বরের সমর্থন রয়েছে। যিশুর প্রাথমিক অনুসারীরা অলৌকিক দানগুলো প্রদর্শন করেছিল যেমন বিভিন্ন ভাষায় কথা বলা এবং অনুপ্রাণিত বাণীগুলো বুঝতে পারা। (প্রেরিত ২:৫-১২; ১ করিন্থীয় ১২:২৮-৩১) এই ধরনের অলৌকিক দানগুলো খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর সূচনালগ্নে মণ্ডলীর জন্য উপকারী ছিল। কীভাবে তা বলা যায়?
একটা কারণ হল যে, শাস্ত্রের অনুলিপিগুলো খুবই অল্প ছিল। সাধারণত, কেবল ধনী ব্যক্তিদের কাছে গুটানো পুস্তক অথবা এই ধরনের কোনো বই থাকত। পরজাতীয় দেশগুলোতে বাইবেল বা এর গ্রন্থকার যিহোবা সম্বন্ধে কোনো জ্ঞানই ছিল না। খ্রিস্টীয় শিক্ষাগুলো মৌখিকভাবে জানানো হতো। অলৌকিক দানগুলো এটা দেখানোর জন্য উপকারী ছিল যে, ঈশ্বর খ্রিস্টীয় মণ্ডলীকে ব্যবহার করছিলেন।
কিন্তু পৌল ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, এই দানগুলো একসময় লোপ পাবে, যখন এগুলোর আর প্রয়োজন হবে না। “যদি ভাববাণী থাকে, তাহার লোপ হইবে; যদি বিশেষ বিশেষ ভাষা থাকে, সে সকল শেষ হইবে; যদি জ্ঞান থাকে, তাহার লোপ হইবে। কেননা আমরা কতক অংশে জানি, এবং কতক অংশে ভাববাণী বলি; কিন্তু যাহা পূর্ণ তাহা আসিলে, যাহা অংশমাত্র তাহার লোপ হইবে।”—১ করিন্থীয় ১৩:৮-১০.
আজকে, লোকেদের কাছ বাইবেল ও সেইসঙ্গে বর্ণানুক্রমিক সূচি এবং এনসাইক্লোপিডিয়াগুলো রয়েছে। ষাট লক্ষেরও বেশি প্রশিক্ষিত খ্রিস্টান বাইবেলের ওপর ভিত্তি করে ঐশিক জ্ঞান লাভ করার জন্য অন্যদের সাহায্য করছে। তাই, যিশু খ্রিস্টই যে ঈশ্বরের নিযুক্ত উদ্ধারকর্তা, সেই বিষয়টাকে সত্য বলে প্রমাণিত করার অথবা যিহোবা যে তাঁর লোকেদের সমর্থন করছেন, তা প্রমাণ করার জন্য অলৌকিক কাজগুলোর আর প্রয়োজন নেই।