জীবন কাহিনী
আমরা আমাদের পরিবর্তিত পরিস্থিতিগুলোকে দূরদূরান্তে সাক্ষ্য দিতে ব্যবহার করি
বলেছেন রিকার্ডো মালিক্সি
খ্রিস্টীয় নিরপেক্ষতার জন্য আমি যখন আমার চাকরি হারাই, তখন আমি এবং আমার পরিবার আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা স্থির করতে যিহোবার কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। আমাদের প্রার্থনায় আমরা আমাদের পরিচর্যাকে বাড়ানোর আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলাম। শীঘ্রই, আমরা যাযাবরের এক যাত্রা শুরু করেছিলাম, যা আমাদের দুটো মহাদেশের আটটি দেশে নিয়ে গিয়েছিল। এর ফলে, আমরা দূরদূরান্তে আমাদের পরিচর্যা চালিয়ে যেতে পেরেছিলাম।
উনিশশো তেত্রিশ সালে ফিলিপনসে আমি এমন এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করি, যে-পরিবার ফিলিপিনস ইনডিপেনডেন্ট চার্চ এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমাদের পরিবারের ১৪ জন সদস্যের মধ্যে সবাই সেই গির্জার সদস্য ছিল। আমার বয়স যখন প্রায় ১২ বছর, তখন আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম যেন তিনি আমাকে প্রকৃত বিশ্বাসের দিকে পরিচালিত করেন। আমার শিক্ষকদের মধ্যে একজন আমাকে একটা ধর্ম ক্লাসে ভর্তি করেন আর আমি একজন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক হয়ে উঠি। আমি কখনও শনিবারের পাপস্বীকার এবং রবিবারের মিশা বাদ দিতাম না। কিন্তু, আমার মনে সংশয় এবং অসন্তোষ দেখা দিতে শুরু করে। লোকেরা মারা গেলে পর তাদের কী হয় এবং নরকাগ্নি ও ত্রিত্ব সম্বন্ধে বিভিন্ন প্রশ্ন আমার মনে ঘুরপাক খেত। ধর্মীয় নেতাদের দেওয়া উত্তরগুলো অর্থহীন এবং অসন্তোষজনক ছিল।
সন্তোষজনক উত্তরগুলো পাওয়া
কলেজে পড়ার সময় আমি ছাত্রসমিতিতে যোগ দিই, যার ফলে আমি মারামারি, জুয়াখেলা, ধূমপান এবং অন্যান্য অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ি। একদিন বিকেলে আমার এক সহপাঠীর মার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি যিহোবার সাক্ষিদের একজন ছিলেন। আমার ধর্ম গুরুদের আমি যে-প্রশ্নগুলো করেছিলাম সেই একই প্রশ্ন আমি তাকে জিজ্ঞেস করি। তিনি বাইবেল থেকে আমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেন আর আমি দৃঢ়প্রত্যয়ী হই যে, তিনি যা বলেছেন সেটা সত্য।
আমি একটি বাইবেল কিনি এবং সাক্ষিদের সঙ্গে সেটি অধ্যয়ন করতে শুরু করি। শীঘ্রই আমি যিহোবার সাক্ষিদের সমস্ত সভাতে যোগ দিতে শুরু করি। “কুসংসর্গ শিষ্টাচার নষ্ট করে,” বাইবেলের এই বিজ্ঞ পরামর্শ মেনে আমি আমার দুশ্চরিত্র বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করা বন্ধ করে দিই। (১ করিন্থীয় ১৫:৩৩) এটা আমাকে বাইবেল অধ্যয়নে উন্নতি করতে এবং অবশেষে যিহোবার কাছে নিজেকে উৎসর্গ করতে সাহায্য করে। ১৯৫১ সালে আমার বাপ্তিস্মের পরে, আমি কিছু সময়ের জন্য পূর্ণসময়ের একজন পরিচারক (অগ্রগামী) হিসেবে সেবা করি। এরপর ১৯৫৩ সালে, আমি অরে ম্যানডোজা ক্রুসকে বিয়ে করি, যে আমার জীবনসঙ্গী এবং পরিচর্যায় বিশ্বস্ত সহকর্মী হয়ে ওঠে।
আমাদের প্রার্থনার উত্তর
সত্যিকারভাবে আমরা অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, যিহোবাকে আরও পূর্ণরূপে সেবা করার বিষয়ে আমাদের আকাঙ্ক্ষা সঙ্গে সঙ্গেই বাস্তবায়িত হয়নি। তা সত্ত্বেও, আমরা তাঁকে সেবা করার জন্য সুযোগের দ্বার খুলে দেওয়ার বিষয়ে যিহোবার কাছে প্রার্থনা করা বন্ধ করিনি। কিন্তু, আমাদের জীবন খুব সহজ ছিল না। তা সত্ত্বেও, আমরা আমাদের আধ্যাত্মিক লক্ষ্যগুলোর কথা স্মরণে রাখি এবং ২৫ বছর বয়সে আমাকে মণ্ডলীর দাস, যিহোবার সাক্ষিদের মণ্ডলীর একজন পরিচালক অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
বাইবেলের জ্ঞানে বৃদ্ধি পাওয়ার এবং যিহোবার নীতিগুলো আরও ভালভাবে বোঝার সঙ্গে সঙ্গে আমি উপলব্ধি করি যে, আমার চাকরি একজন নিরপেক্ষ খ্রিস্টান হিসেবে আমার বিবেককে দংশন করছে। (যিশাইয় ২:২-৪) আমি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এটা আমাদের বিশ্বাসের পরীক্ষা হিসেবে প্রমাণিত হয়। কীভাবে আমি আমার পরিবারের প্রয়োজনগুলোর যত্ন নেব? আবারও আমি প্রার্থনায় যিহোবা ঈশ্বরের শরণাপন্ন হই। (গীতসংহিতা ৬৫:২) আমরা তাঁকে আমাদের উদ্বিগ্নতা এবং আশঙ্কা সম্বন্ধে জানাই কিন্তু সেইসঙ্গে আমরা সেখানেও সেবা করার বিষয়ে আমাদের আকাঙ্ক্ষার কথা তাঁর কাছে প্রকাশ করি, যেখানে রাজ্য প্রচারকদের অনেক দরকার। (ফিলিপীয় ৪:৬, ৭) আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি যে, আমাদের সামনে বিভিন্ন সুযোগের দ্বার খুলে যাবে!
আমাদের যাত্রা শুরু
১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে আমি লাওসের ভিয়েনচান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অগ্নিবিস্ফোরণ এবং উদ্ধারকাজের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে একটা চাকরি নিই এবং সেখানে চলে যাই। ভিয়েনচান শহরে ২৪ জন সাক্ষি ছিল এবং আমরা মিশনারি ও সেইসঙ্গে অল্প কয়েক জন স্থানীয় ভাইবোনের সঙ্গে প্রচার কাজ উপভোগ করি। পরে আমাকে থাইল্যান্ডের উন্ডন টানি বিমানবন্দরে বদলি করা হয়। উন্ডন টানিতে অন্য কোনো সাক্ষি ছিল না। পরিবারগতভাবে আমরা নিজেরাই সাপ্তাহিক সমস্ত সভা পরিচালনা করতাম। আমরা ঘরে ঘরে প্রচারে যাই, পুনর্সাক্ষাৎ করি এবং বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করি।
শিষ্যদের প্রতি দেওয়া যিশুর এই আদেশ আমরা মনে রেখেছিলাম যে, তাদের ‘প্রচুর ফলে ফলবান্ হওয়া’ উচিত। (যোহন ১৫:৮) তাই, আমরা তাদের উদাহরণ অনুসরণ করতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হই এবং সুসমাচার ঘোষণা করা চালিয়ে যাই। শীঘ্রই আমরা ফল লাভ করি। একজন থাই যুবতী সত্যকে নিজের করে নেয় এবং আমাদের আধ্যাত্মিক বোন হয়। উত্তর আমেরিকার দুজন ব্যক্তি সত্য গ্রহণ করে এবং পরে খ্রিস্টান প্রাচীন হয়। থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে আমরা দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সুসমাচার প্রচার চালিয়ে যাই। এটা জেনে আমরা কতই না আনন্দিত হয়েছি যে, উন্ডন টানিতে এখন একটা মণ্ডলী রয়েছে! আমাদের রোপিত সত্যের কিছু বীজ এখনও ফল উৎপন্ন করে চলছে।
কিন্তু, দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, আমাদের আবারও স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছিল আর আমরা প্রার্থনা করেছিলাম যেন ‘শস্যক্ষেত্রের স্বামী’ ক্রমাগত প্রচার কাজে অংশগ্রহণ করতে আমাদের সাহায্য করেন। (মথি ৯:৩৮) আমাদের ইরানের রাজধানী তেহরানে বদলি করা হয়। তখন ছিল শাহদের শাসন আমল।
প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এলাকাগুলোতে প্রচার করা
তেহরানে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদের আধ্যাত্মিক ভাইবোনদের খুঁজে পাই। আমরা সাক্ষিদের একটা ছোট্ট দলের সঙ্গে মেলামেশা করতাম, যেখানে ১৩টা জাতির লোক ছিল। ইরানে সুসমাচার প্রচার করার জন্য আমাদের কিছু রদবদল করতে হয়েছিল। যদিও আমরা সরাসরি কোনো বিরোধিতার মুখোমুখি হইনি কিন্তু আমাদের সতর্ক থাকতে হতো।
আগ্রহী ব্যক্তিদের কাজের তালিকার কারণে আমাদের মাঝেমধ্যে মধ্যরাতে অথবা এর পরে—ভোর পর্যন্ত—বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করতে হতো। কিন্তু, সেই কঠোর পরিশ্রমের ফল দেখে আমরা কতই না আনন্দিত হয়েছিলাম! বেশ কয়েকটা ফিলিপিনো এবং কোরিয়ান পরিবার খ্রিস্টীয় সত্যকে নিজের করে নিয়েছিল এবং যিহোবার কাছে নিজেদের উৎসর্গ করেছিল।
আমার পরবর্তী কার্যভার ছিল বাংলাদেশের ঢাকায়। ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসে আমরা সেখানে গিয়ে পৌঁছাই। এই দেশেও আমাদের প্রচার কাজ সম্পাদন করা সহজ ছিল না। কিন্তু, আমরা সবসময় মনে রেখেছিলাম যে আমাদের অবশ্যই সক্রিয় থাকতে হবে। যিহোবার আত্মার পরিচালনায় আমরা এমন অনেক পরিবার খুঁজে পাই, যারা নিজেদের খ্রিস্টান বলে দাবি করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পবিত্র শাস্ত্রে পাওয়া সত্যের সতেজ জলের জন্য তৃষ্ণার্ত ছিল। (যিশাইয় ৫৫:১) এর ফলে আমরা অনেক বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করতে পারি।
আমরা সবসময় মনে রাখতাম যে, ঈশ্বরের ইচ্ছা হল যেন “সমুদয় মনুষ্য পরিত্রাণ পায়।” (১ তীমথিয় ২:৪) আনন্দের বিষয় যে, কেউই কোনো ঝামেলা বাধানোর চেষ্টা করেনি। যেকোনো প্রতিকূল ধারণার সঙ্গে মোকাবিলা করতে আমরা অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ এক উপায়ে তাদের সঙ্গে কথা বলার বিষয়ে সচেতন থাকতাম। প্রেরিত পৌলের মতো আমরা ‘সর্ব্বজনের কাছে সর্ব্ববিধ হইবার’ চেষ্টা করেছিলাম। (১ করিন্থীয় ৯:২২) আমাদেরকে যখন আমাদের সাক্ষাতের কারণ জিজ্ঞেস করা হতো, তখন আমরা সদয়ভাবে তা ব্যাখ্যা করতাম আর দেখা যায় যে, তারা অনেকে বন্ধুত্বপরায়ণ ছিল।
ঢাকায় আমরা একজন স্থানীয় সাক্ষিকে খুঁজে পাই এবং তাকে আমাদের সঙ্গে খ্রিস্টীয় সভাগুলোতে এবং পরে প্রচার কাজে যোগ দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করি। এরপর আমার স্ত্রী একটা পরিবারের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করে এবং তাদেরকে আমাদের সভাগুলোতে আমন্ত্রণ জানায়। যিহোবার প্রেমপূর্ণ-দয়ায় পুরো পরিবার সত্যে আসে। পরবর্তী সময়ে, তাদের দুজন মেয়ে বাংলায় বাইবেল সাহিত্যাদি অনুবাদ করায় সাহায্য করে ও সেইসঙ্গে তাদের অনেক আত্মীয়স্বজনও যিহোবাকে জানতে পারে। আরও অনেক বাইবেল ছাত্র সত্যকে নিজের করে নেয়। তাদের মধ্যে অধিকাংশই এখন প্রাচীন অথবা অগ্রগামী হিসেবে সেবা করছে।
যেহেতু ঢাকা অত্যন্ত জনবহুল একটা শহর, তাই প্রচার কাজে সাহায্য করার জন্য আমরা আমাদের পরিবারের কয়েক জন সদস্যকে আমন্ত্রণ জানাই। বেশ কয়েক জন তাতে সাড়া দেয় এবং বাংলাদেশে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। সেই দেশে সুসমাচার প্রচারে অংশ নেওয়ার যে-সুযোগ আমাদের হয়েছিল, সেটার জন্য আমরা কতই না আনন্দিত এবং যিহোবার কাছে কৃতজ্ঞ! মাত্র একজন ব্যক্তি দিয়ে শুরু হয়ে এখন বাংলাদেশে দুটো মণ্ডলী রয়েছে।
১৯৮২ সালের জুলাই মাসে আমাদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে হয়েছিল। আমরা চোখের জল ফেলে ভাইদের বিদায় জানাই। এর কিছু পরেই আমি উগান্ডার এন্টেবি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চাকরি পাই, যেখানে আমাদের চার বছর সাত মাস থাকতে হয়েছিল। এই দেশে যিহোবার মহান নামকে সম্মানিত করার জন্য আমরা কী করতে সমর্থ হব?
পূর্ব আফ্রিকায় যিহোবার সেবা করা
এন্টেবি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর একজন গাড়িচালক আমার স্ত্রী ও আমাকে গাড়িতে করে আমাদের আবাসস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসে। বিমানবন্দর ত্যাগ করার সময় আমি চালকের কাছে ঈশ্বরের রাজ্য সম্বন্ধে প্রচার করতে শুরু করি। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন: “আপনি কি যিহোবার সাক্ষিদের একজন?” উত্তরে যখন আমি হ্যাঁ বলি, তখন চালক জিজ্ঞেস করেন: “আপনাদের একজন ভাই কন্ট্রোল টাওয়ারে কাজ করেন।” সঙ্গে সঙ্গে আমি তাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলি। ভাইয়ের সঙ্গে আমরা সাক্ষাৎ করি, যিনি আমাদের দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং সভা ও ক্ষেত্রের পরিচর্যার জন্য ব্যবস্থা করা হয়।
সেই সময় উগান্ডাতে মাত্র ২২৮ জন রাজ্য প্রকাশক ছিল। এন্টেবিতে দুজন ভাইয়ের সঙ্গে আমরা আমাদের প্রথম বছরটা সত্যের বীজ বপন করায় ব্যয় করি। যেহেতু সেখানকার লোকেরা পড়তে ভালবাসে, তাই আমরা অনেক সাহিত্য ও সেইসঙ্গে শত শত পত্রপত্রিকা বিতরণ করতে পেরেছিলাম। আমরা উগান্ডার রাজধানী কাম্পালার ভাইদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, যাতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে তারা আমাদের এন্টেবির এলাকায় প্রচারে সাহায্য করে। আমার প্রথম জনসাধারণের বক্তৃতায়—আমিসহ—উপস্থিতি ছিল পাঁচ জন।
পরবর্তী তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে, আমরা আমাদের জীবনের কিছু আনন্দপূর্ণ মুহূর্ত উপভোগ করি, যখন সেই সমস্ত ব্যক্তিকে সাড়া দিতে এবং দ্রুত উন্নতি করতে দেখি, যাদের আমরা শিক্ষা দিয়েছিলাম। (৩ যোহন ৪) একটা সীমা সম্মেলনে আমাদের ছয় জন বাইবেল ছাত্র বাপ্তাইজিত হয়েছিল। তাদের অনেকে বলেছিল যে, পূর্ণসময়ের চাকরি করা সত্ত্বেও আমাদের অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে দেখে তারা পূর্ণসময়ের সেবা করার জন্য উৎসাহিত হয়েছে।
আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমাদের কাজের জায়গাও ফলবান এলাকা হতে পারে। একবার, আমি বিমানবন্দরের একজন অগ্নি কর্মকর্তার কাছে যাই এবং তাকে পরমদেশ পৃথিবীতে জীবনের বিষয়ে বাইবেলভিত্তিক আশা সম্বন্ধে জানাই। তার নিজের বাইবেল থেকে আমি তাকে দেখিয়েছিলাম যে, বাধ্য মানবজাতি শান্তিতে এবং ঐক্যে বাস করবে, কোনো দারিদ্র ভোগ করবে না, গৃহহীনতা, যুদ্ধ, অসুস্থতা অথবা মৃত্যু থাকবে না। (গীতসংহিতা ৪৬:৯; যিশাইয় ৩৩:২৪; ৬৫:২১, ২২; প্রকাশিত বাক্য ২১:৩, ৪) এগুলো সম্বন্ধে তার নিজের বাইবেল থেকে পড়া, তার উৎসাহকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই মুহূর্তেই বাইবেল অধ্যয়ন শুরু হয়েছিল। তিনি সমস্ত সভায় যোগ দেন। শীঘ্রই তিনি নিজেকে যিহোবার কাছে উৎসর্গ করেন এবং বাপ্তিস্ম নেন। পরবর্তী সময়ে, তিনি আমাদের সঙ্গে পূর্ণসময়ের পরিচর্যায় যোগ দেন।
আমরা উগান্ডায় থাকাকালীন দুবার আভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ দেখা দেয় কিন্তু এটা আমাদের আধ্যাত্মিক কার্যকলাপকে দমিয়ে রাখেনি। আন্তর্জাতিক এজেন্সিগুলোতে কার্যরত ব্যক্তিদের পরিবারকে ছয় মাসের জন্য কেনিয়ার নাইরোবিতে পাঠানো হয়েছিল। আমরা যারা উগান্ডাতে থেকে গিয়েছিলাম, আমরা আমাদের খ্রিস্টীয় সভাগুলো এবং প্রচার কাজ চালিয়ে যাই, যদিও আমাদের বিচক্ষণ এবং সাবধান থাকতে হয়েছিল।
১৯৮৮ সালের এপ্রিল মাসে আমার কার্যভার সম্পন্ন হয় এবং আমরা আবারও জায়গা পরিবর্তন করি। এন্টেবিতে আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য গভীর পরিতৃপ্তি সহকারে আমরা সেই মণ্ডলী ছেড়ে যাই। ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে আমাদের আবারও এন্টেবিতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেই সময় অবধি, আমাদের কিছু প্রাক্তন বাইবেল ছাত্র প্রাচীন হয়ে গিয়েছিল। জনসাধারণের বক্তৃতায় ১০৬ জনের উপস্থিতি দেখে আমরা কতই না রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম!
প্রচার করা হয়নি এমন এলাকায় যাওয়া
আমাদের জন্য কি সুযোগের নতুন দ্বার খোলা হবে? হ্যাঁ, আমার পরবর্তী কার্যভার ছিল সোমালিয়ার মোগাডিশু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। প্রচার করা হয়নি এমন এলাকায় সেবা করার এই নতুন সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য আমরা দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলাম।
আমাদের প্রচার কাজ মূলত দূতাবাসের কর্মচারী, ফিলিপিনো কর্মী এবং অন্যান্য বিদেশিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। প্রায়ই কেনাকাটার স্থানে তাদের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হতো। এ ছাড়া, বন্ধুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎ করতে তাদের বাড়িতেও যেতাম। উদ্ভাবনকুশলতা, দক্ষতা, বিচক্ষণতা এবং যিহোবার ওপর পূর্ণ নির্ভরতা সহকারে আমরা অন্যদের কাছে বাইবেলের সত্য জানাতে পেরেছিলাম আর এটা বিভিন্ন জাতির লোকের মধ্যে ফল উৎপন্ন করেছিল। দুই বছর পরে আমরা মোগাডিশু ছেড়ে যাই—সেখানে যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে।
আন্তর্জাতিক অসামরিক বিমানচালনা সংগঠন এরপর আমাকে মায়ানমারের ইয়ানগনে পাঠায়। আবারও, সৎহৃদয়ের ব্যক্তিদের ঈশ্বরের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে শিক্ষা দিতে সাহায্য করার উত্তম সুযোগের দ্বার আমাদের জন্য খুলে যায়। মায়ানমারের পর আমাদের তানজানিয়ার দার-এস-সালামে পাঠানো হয়। দার-এস-সালামে ঘরে ঘরে প্রচার করা খুব সহজ ছিল কারণ সেখানে ইংরেজিভাষী এক এলাকা ছিল।
যে-দেশগুলোতে আমরা কাজ করেছি, সেখানে আমাদের পরিচর্যা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে খুব কম সমস্যাই সৃষ্টি হয়েছিল, যদিও অনেক ক্ষেত্রে যিহোবার সাক্ষিদের কাজের ওপর সীমাবদ্ধতা ছিল। আমার পদমর্যাদার জন্য, যা মূলত সরকার অথবা আন্তর্জাতিক এজেন্সিগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, লোকেরা আমাদের কার্যকলাপ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি।
আমার চাকরির জন্য আমি এবং আমার স্ত্রী ত্রিশ বছর ধরে যাযাবরের মতো জীবনযাপন করেছি। কিন্তু, আমরা আমার চাকরিকে আমাদের প্রধান লক্ষ্যকে অর্জন করার এক মাধ্যম হিসেবে দেখেছি মাত্র। সবসময়ই, আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল ঈশ্বরের রাজ্যের কাজগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমাদের পরিবর্তিত পরিস্থিতিগুলোকে উত্তমভাবে ব্যবহার করতে সাহায্য করার এবং দূরদূরান্তে সুসমাচার ছড়িয়ে দেওয়ার অপূর্ব সুযোগ উপভোগ করার জন্য আমরা যিহোবাকে ধন্যবাদ জানাই।
যেখান থেকে শুরু হয়েছিল সেখানে ফিরে যাওয়া
৫৮ বছর বয়সে আমি সময়ের আগেই অবসর নেওয়ার এবং ফিলিপিনসে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমরা যখন ফিরে যাই, তখন যিহোবার কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি আমাদের পদক্ষেপকে পরিচালিত করেন। আমরা কেভিটি প্রদেশের ট্রেসে মারটিরেস সিটির একটা মণ্ডলীতে সেবা করতে শুরু করি। আমরা যখন প্রথম সেখানে যাই, তখন মাত্র ১৯ জন ঈশ্বরের রাজ্য ঘোষণাকারী ছিল। প্রতিদিন প্রচার কাজের ব্যবস্থা করা হতো এবং অনেক বাইবেল অধ্যয়ন শুরু হয়েছিল। মণ্ডলী বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল। একবার আমার স্ত্রী ১৯টা এবং আমি ১৪টা বাইবেল অধ্যয়ন করেছিলাম।
শীঘ্রই কিংডম হলটা লোকের তুলনায় খুব ছোট হয়ে যায়। আমরা এই বিষয়ে যিহোবার কাছে প্রার্থনা করি। একজন আধ্যাত্মিক ভাই এবং তার স্ত্রী এক টুকরো জমি দান করার সিদ্ধান্ত নেন এবং শাখা অফিস একটা নতুন কিংডম হল তৈরির জন্য ঋণ দিতে রাজি হয়। নতুন কিংডম হলটা প্রচার কাজের ওপর বিরাট প্রভাব ফেলেছিল এবং প্রতি সপ্তাহে উপস্থিতি সংখ্যা বেড়ে চলেছিল। বর্তমানে ১৭ জন প্রকাশকের অন্য একটা মণ্ডলীকে সাহায্য করার জন্য সেখানে যাওয়া-আসা করতে প্রতিবার আমরা ১ ঘন্টারও বেশি পথ ভ্রমণ করি।
আমি ও আমার স্ত্রী বিভিন্ন দেশে সেবা করার যে-সুযোগ উপভোগ করেছি, সেই সুযোগকে অমূল্য বলে মনে করি। আমাদের যাযাবরের জীবনের দিকে ফিরে তাকালে আমরা এটা জেনে গভীর পরিতৃপ্তি লাভ করি যে, এটা যতদূর সম্ভব—যিহোবা সম্বন্ধে জানাতে অন্যদের সাহায্য করায়—সর্বোত্তম উপায়ে ব্যবহৃত হয়েছে।
[২৪, ২৫ পৃষ্ঠার মানচিত্র]
(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)
তানজানিয়া
উগান্ডা
সোমালিয়া
ইরান
বাংলাদেশ
মায়ানমার
লাওস
থাইল্যান্ড
ফিলিপিনস
[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
আমার স্ত্রী অরের সঙ্গে