জীবনকাহিনি
আমি “সময়ে অসময়ে” আশীর্বাদ পেয়েছি
আমার জন্ম ১৯৩০ সালের মার্চ মাসে। আমি যখন ছোটো, তখন থেকেই আমার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব বিশ্বস্তভাবে যিহোবার সেবা করছিল। আমার জন্ম লিলংওয়ে শহরের কাছাকাছি নামকুম্বা গ্রামে। আর এই গ্রামটা যে-দেশে অবস্থিত, সেটার বর্তমান নাম মালাউই। ১৯৪২ সালে আমি ঈশ্বরের কাছে নিজের জীবন উৎসর্গ করি এবং আমাদের এলাকার একটা মনোরম নদীতে বাপ্তাইজিত হই। এরপর, ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি সেই কাজ করে চলার প্রচেষ্টা করেছি, যে-কাজ করার বিষয়ে প্রেরিত পৌল তীমথিয়কে পরামর্শ দিয়েছিলেন আর তা হল, “বাক্য প্রচার কর, সময়ে অসময়ে কার্য্যে অনুরক্ত হও।”—২ তীম. ৪:২.
১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে ভাই নেথেন এইচ. নর এবং মিলটন জি. হেনশেল যখন মালাউইতে প্রথম বার পরিদর্শন করেন, তখন আমার মনে যিহোবাকে পূর্ণসময় সেবা করার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে অবস্থিত যিহোবার সাক্ষিদের বিশ্বপ্রধান কার্যালয়ের এই প্রতিনিধিরা যে-উৎসাহজনক বক্তৃতা তুলে ধরেছিলেন, তা মনে করলে আমার এখনও খুব ভালো লাগে। আমরা প্রায় ৬,০০০ ব্যক্তি একটা কর্দমাক্ত মাঠে দাঁড়িয়ে মনোযোগের সঙ্গে ভাই নরের উৎসাহজনক বক্তৃতা শুনেছিলাম, যেটার শিরোনাম ছিল, “সমস্ত জাতির চিরস্থায়ী শাসক।”
লিডাসি নামে একজন সুন্দরী বোন, আমার মতো যিহোবার সাক্ষি পরিবারেই বড়ো হয়েছে। তার সঙ্গে যখন আমার দেখা হয়, তখন আমি জানতে পারি, আমার মতো তারও লক্ষ্য হচ্ছে পূর্ণসময়ের পরিচর্যা করা। ১৯৫০ সালে আমরা বিয়ে করি আর ১৯৫৩ সালের মধ্যে আমাদের দুটো সন্তান হয়। সন্তান মানুষ করার বাড়তি দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও আমরা পরিবারগতভাবে সিদ্ধান্ত নিই, আমি নিয়মিত অগ্রগামী হিসেবে সেবা শুরু করব। এর দু-বছর পর আমাকে একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।
এর অল্পসময় পরেই আমাকে একজন সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে বিভিন্ন মণ্ডলীতে পরিদর্শন করার বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। লিডাসি আমাকে দারুণ সমর্থন করেছিল আর তাই আমি এই কাজ করার পাশাপাশি আমাদের পরিবারের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক যত্ন নিতে পেরেছিলাম।a তবে আমাদের আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা ছিল আমরা দু-জনেই পূর্ণসময়ের পরিচর্যা করব। তাই সতর্কভাবে পরিকল্পনা করার পর এবং আমাদের চার মেয়ে ও এক ছেলের সহযোগিতায়, লিডাসি ১৯৬০ সালে পূর্ণসময়ের সেবা শুরু করতে পেরেছিল।
আমরা বিভিন্ন মণ্ডলীতে আমাদের ভাই-বোনদের সেবা করার সেই সুসময় উপভোগ করেছি। আমাদের কার্যভারের জন্য আমরা দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অপূর্ব মুলান্ইয়ে পর্বতমালার ঢাল থেকে শুরু করে মালাউই হ্রদের নিরিবিলি সৈকতের এলাকাগুলোতে গিয়েছি, যে-হ্রদটা দেশের পশ্চিমের প্রায় পুরো এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। আমরা যে-সমস্ত সীমায় সেবা করেছি, সেখানে আমরা প্রকাশক ও মণ্ডলীর ক্রমাগত বৃদ্ধি দেখেছি।
১৯৬২ সালে আমরা “সাহসী পরিচারক” জেলা সম্মেলন উপভোগ করেছিলাম। অতীতের ঘটনা বিবেচনা করলে এখন আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, আমাদের সামনে যে-অসময় বা কঠিন সময় আসতে যাচ্ছিল, সেটার সঙ্গে মোকাবিলা করতে আমাদের প্রস্তুত করার জন্য এসব আধ্যাত্মিক উপলক্ষ্য প্রয়োজন ছিল। এর পরের বছর, ভাই হেনশেল আবারও মালাউই পরিদর্শন করেন আর ব্লানটায়ার শহরের বাইরে একটা বিশেষ সম্মেলন হয়, যেখানে উপস্থিতি ছিল প্রায় ১০,০০০ জন। সেই উৎসাহজনক সম্মেলন আমাদের জন্য এক শক্তিশালী সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে, যাতে আমরা আসন্ন পরীক্ষাগুলোর মুখোমুখি হতে পারি।
কঠিন সময় শুরু হয়
১৯৬৪ সালে, সাক্ষিরা রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশ নিতে প্রত্যাখ্যান করার কারণে চরম পরীক্ষা ভোগ করেছিল। ১০০টারও বেশি কিংডম হল এবং সাক্ষিদের এক হাজারেরও বেশি ঘরবাড়ি, তাড়নার এক ঢেউয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও, ১৯৬৭ সালে মালাউই সরকার সাক্ষিদের কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার আগে পর্যন্ত, আমরা ভ্রমণ কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছিলাম। ব্লানটায়ারে শাখা অফিসের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, মিশনারিদের সেই দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং স্থানীয় অনেক সাক্ষিকে কারাগারে আটক করা হয়েছিল, যাদের মধ্যে লিডাসি আর আমিও ছিলাম। কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর, আমরা বিচক্ষণতার সঙ্গে ভ্রমণ কাজ চালিয়ে গিয়েছিলাম।
১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসের একদিন, মালাউই ইয়ুথ লিগ বলে পরিচিত একটা আগ্রাসী রাজনৈতিক দলের প্রায় এক-শো জন সদস্য আমাদের বাড়ির দিকে আসতে থাকে। কিন্তু, সেই দলেরই একজন সদস্য আগে আগে দৌড়ে আমাদের কাছে এসে আমাকে পালিয়ে যেতে বলে কারণ তারা আমাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছিল। আমি তখন আমার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের কাছাকাছি কলা বাগানে লুকিয়ে থাকতে বলি। এরপর, আমি দৌড়ে একটা বড়ো আম গাছে উঠে যাই। গাছের উপর থেকে আমি দেখতে পাই, তারা আমাদের বাড়ি আর ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নষ্ট করে ফেলছে।
মালাউইতে তাড়না বৃদ্ধি পেতে থাকে আর তাই আমাদের মধ্যে হাজার হাজার সাক্ষি সেই দেশ থেকে পালিয়ে যায়। আমাদের পরিবার ১৯৭৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত পশ্চিম মোজাম্বিকের শরণার্থী শিবিরে থাকে। সেই সময়, লিডাসি ও আমাকে মালাউই সীমান্তের কাছাকাছি মোজাম্বিকের ডোমওয়া নামের ছোট্ট একটা শহরে বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে বলা হয়। আমরা ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সেখানে সেবা করি। সেই সময়ে মোজাম্বিক পোর্তুগালের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর, অন্যান্য সাক্ষির সঙ্গে আমাদেরও মালাউইতে অর্থাৎ আমরা যে-তাড়নাকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম, তাদের কাছে ফিরে আসতে বাধ্য করা হয়।
মালাউইতে ফিরে আসার পর, আমাকে রাজধানী লিলংওয়ের বিভিন্ন মণ্ডলীতে পরিদর্শন করার কার্যভার দেওয়া হয়। তাড়না ও কঠিন পরিস্থিতি সত্ত্বেও, যে-সমস্ত সীমাতে আমাদের সেবা করার বিশেষ সুযোগ হয়েছিল, সেখানকার মণ্ডলীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
যিহোবার সমর্থন লাভ করা
একবার, আমরা একটা গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে রাজনৈতিক সভা হচ্ছিল। সেই রাজনৈতিক দলের কয়েক জন সমর্থক জানতে পারে, আমরা যিহোবার সাক্ষি আর তারা আমাদের নিয়ে গিয়ে মালাউই ইয়াং পাইনিয়ার্স নামে একটা রাজনৈতিক যুব দলের সদস্যদের মাঝে বসিয়ে রাখে। আমরা সেই অস্থির পরিস্থিতিতে সাহায্য ও নির্দেশনার জন্য যিহোবার কাছে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করতে থাকি। সেই সভা শেষ হওয়ার পর তারা আমাদের মারধর করতে শুরু করে। তখন একজন বয়স্ক মহিলা দৌড়ে এসে চিৎকার করে বলেন: “দয়া করে ওদের ছেড়ে দাও! ও আমার ভাইপো। ওকে যেতে দাও!” সেই সভার তত্ত্বাবধায়ক তখন বলেন: “এদের যেতে দাও!” সেই মহিলার মনে কী ছিল আমরা জানি না কারণ তিনি আমাদের আত্মীয় নন। আমরা মনে করি, যিহোবা নিশ্চয়ই আমাদের প্রার্থনা শুনেছিলেন।
১৯৮১ সালে মালাউই ইয়াং পাইনিয়ার্স দলের কয়েক জন সদস্যের সঙ্গে আমাদের আবার দেখা হয়েছিল। তারা আমাদের সাইকেল, লাগেজ, বইয়ের কার্টন এবং সীমার ফাইলপত্র নিয়ে নেয়। আমরা দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে একজন প্রাচীনের বাড়িতে উঠি। আবার আমরা সেই পরিস্থিতির বিষয়ে প্রার্থনা করতে থাকি। আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া ফাইলপত্রের মধ্যে যে-তথ্য ছিল, আমরা সেই ব্যাপারে অনেক চিন্তিত ছিলাম। ইয়াং পাইনিয়ার্স দলের সদস্যরা যখন ফাইলপত্র ঘাটায়, তখন তারা দেখতে পায়, মালাউইর সমস্ত জায়গা থেকে আমার কাছে চিঠি এসেছে। তারা তখন ভয় পেয়ে যায় কারণ তারা মনে করে, আমি হয়তো কোনো সরকারি কর্মকর্তা। তাই, তারা সঙ্গেসঙ্গে স্থানীয় প্রাচীনদের কাছে সব কিছু ঠিকঠাক ফিরিয়ে দেয়।
আরেক বার, আমরা একটা নৌকায় করে নদী পার হচ্ছিলাম। সেই নৌকার মালিক ছিলেন এলাকার রাজনৈতিক নেতা আর তাই তিনি সকল যাত্রীর কাছে রাজনৈতিক দলের কার্ড আছে কি না, তা যাচাই করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি যখন আমাদের কাছে আসতে থাকেন, তখন তিনি এক চোরকে দেখতে পান, যাকে কর্তৃপক্ষ খুঁজছিল। তখন বেশ হইচই শুরু হয় আর এর ফলে দলের কার্ড দেখা বন্ধ হয়ে যায়। আবারও আমরা যিহোবার প্রেমময় সমর্থন অনুভব করি।
গ্রেপ্তার ও কারাবাস
১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, আমি জাম্বিয়ার শাখা অফিসে রিপোর্ট পাঠানোর জন্য লিলংওয়ে যাচ্ছিলাম। সেই সময়ে একজন পুলিশ আমাকে থামান এবং আমার ব্যাগ তল্লাশি করেন। তিনি কিছু বাইবেল সাহিত্যাদি খুঁজে পান আর তাই আমাকে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে গিয়ে মারধর করতে শুরু করেন। তারপর, তিনি আমাকে দড়ি দিয়ে বাঁধেন এবং এমন কারাবন্দিদের সঙ্গে একই কক্ষে রাখেন, যারা চোরাই মাল-সহ হাতেনাতে ধরা পড়েছিল।
পরের দিন, পুলিশের প্রধান কর্মকর্তা আমাকে আরেকটা কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে তিনি একটা বিবৃতি লেখেন, যেটাতে বলা ছিল: “আমি ট্রফিম আর. এনসম্বা, কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করতে চাই আর তাই আমি এখন থেকে আর যিহোবার সাক্ষি নই।” আমি উত্তর দিয়েছিলাম: “আমি শুধু বন্দি থাকতেই নয় কিন্তু সেইসঙ্গে মরতেও রাজি আছি। আমি এখনও একজন যিহোবার সাক্ষি।” আমি সেই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করিনি। তাই, সেই কর্মকর্তা রেগে গিয়েছিলেন এবং তার ডেস্কে এত জোরে ঘুসি মেরেছিলেন যে, পাশের কক্ষের একজন পুলিশ কী হচ্ছে তা দেখার জন্য দৌড়ে এসেছিলেন। পুলিশের প্রধান কর্মকর্তা তাকে বলেন: “এই লোকটা, প্রচার বন্ধ করেছি এমন বিবরণে স্বাক্ষর করতে চাচ্ছে না। তাই, ও যে একজন যিহোবার সাক্ষি, সেটা লিখে ওকে স্বাক্ষর করতে দিন। তাহলে আমরা ওকে বন্দি রাখার জন্য লিলংওয়ে পাঠাতে পারব।” এই সময়ে, আমার প্রতি কী ঘটছে, সেই বিষয়ে আমার প্রিয় স্ত্রী কিছুই জানত না। চার দিন পর কয়েক জন ভাই তাকে জানাতে পেরেছিল, আমি কোথায় আছি।
লিলংওয়ে পুলিশ স্টেশনে আমার সঙ্গে সদয় আচরণ দেখানো হয়েছিল। সেখানকার প্রধান কর্মকর্তা বলেছিলেন: “আপনাকে এক প্লেট ভাত দেওয়া হল কারণ আপনি ঈশ্বরের বাক্যের জন্য বন্দি আছেন। এখানে অন্যেরা সবাই চোর।” এরপর, আমাকে কাচেরে কারাগারে পাঠানো হয় আর সেখানে পাঁচ মাস আটকে রাখা হয়।
আমাকে সেখানে আনা হয়েছে বলে সেখানকার কারারক্ষক খুব খুশি হয়েছিলেন; তিনি আমাকে কারাগারের “পাস্টর” বানাতে চেয়েছিলেন। তিনি এই বলে আগের পাস্টরকে অপসারণ করেছিলেন: “তুমি আর কখনো এখানে ঈশ্বরের বাক্য থেকে শিক্ষা দেবে না কারণ তোমাদের গির্জা থেকে চুরি করার দায়ে তোমাকে কারাগারে রাখা হয়েছে!” তাই, আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, যেন আমি প্রতি সপ্তাহে বন্দিদের জন্য আয়োজিত সভায় বাইবেল থেকে শিক্ষা দিই।
পরে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কারাগারের কর্মকর্তারা মালাউইতে কত জন সাক্ষি রয়েছে, তা খুঁজে বের করার জন্য আমাকে জেরা করেছিলেন। আমি যখন তাদের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিইনি, তখন তারা আমাকে মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলেন। আরেক বার, তারা জানতে চেয়েছিলেন, আমাদের প্রধান কার্যালয় কোথায়। আমি বলেছিলাম, “আপনারা খুব সহজ একটা প্রশ্ন করেছেন আর আমি এর উত্তর দেব।” তখন পুলিশরা খুশি হয়ে তাদের টেপ রেকর্ডার চালু করেন। আমি ব্যাখ্যা করি, যিহোবার সাক্ষিদের প্রধান কার্যালয় সম্বন্ধে বাইবেলে বলা আছে। তারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “বাইবেলের কোথায় বলা আছে?”
“যিশাইয় ৪৩:১২ পদে,” আমি উত্তর দিই। তারা তখন সেই পদ খুলে দেখেন এবং মনোযোগ সহকারে পড়েন: “তোমরাই আমার সাক্ষী, ইহা সদাপ্রভু কহেন, আর আমিই ঈশ্বর।” তারা তিন বার সেই শাস্ত্রপদ পড়েন। তারপর তারা জিজ্ঞেস করেন: “যিহোবার সাক্ষিদের প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানা আমেরিকায় না হয়ে বাইবেলে কীভাবে হয়?” আমি তাদের বলি: “আমেরিকার যিহোবার সাক্ষিরাও মনে করে, এই শাস্ত্রপদ তাদের প্রধান কার্যালয় সম্বন্ধে বর্ণনা করছে।” তারা আমার কাছে যা শুনতে চেয়েছিল, সেটা যেহেতু আমি বলিনি, তাই আমাকে লিলংওয়ের ঠিক উত্তরে ডিজালেকা কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছিল।
এমনকী কঠিন সময়েও আশীর্বাদ লাভ করি
১৯৮৪ সালের জুলাই মাসে আমাকে ডিজালেকা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে ইতিমধ্যে ৮১ জন সাক্ষি বন্দি ছিলেন। সেখানে ৩০০ জন বন্দি গাদাগাদি করে থাকত এবং মেঝেতে একসঙ্গে ঘুমাত। ধীরে ধীরে, আমরা সাক্ষিরা ছোটো ছোটো দলে বিভক্ত হয়ে প্রতিদিন এমন একটা শাস্ত্রপদ বিবেচনা করতে শুরু করি, যেগুলো সম্বন্ধে বিভিন্ন সাক্ষি প্রস্তাব দিতেন। তা করার ফলে আমরা অনেক উৎসাহ পেতাম।
তারপর, কারারক্ষক আমাদেরকে অন্য বন্দিদের কাছ থেকে আলাদা করেছিলেন। একজন পাহারাদার গোপনে আমাদের কাছে বলেন: “সরকার আপনাদের ঘৃণা করে না। আমরা দুটো কারণে আপনাদের কারাগারে রেখে দিই: সরকার ভয় পায়, ইয়াং পাইনিয়ার্স দলের লোকেরা আপনাদের মেরে ফেলবে আর আপনারা যেহেতু আসন্ন একটা যুদ্ধের বিষয়ে প্রচার করেন, তাই সরকার ভয় পায়, তাদের সৈন্যরা আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে যাবে।”
১৯৮৪ সালের অক্টোবর মাসে আমাদের সবাইকে আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে আমাদের প্রত্যেককে দু-বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আমাদের আবারও আগের মতো ন-সাক্ষি ব্যক্তিদের সঙ্গে রাখা হয়। কিন্তু, কারারক্ষক সবার সামনে এই ঘোষণা করেন: “যিহোবার সাক্ষিরা ধূমপান করে না। তাই এখানে যারা পাহারা দেন, আপনারা তাদের কাছে সিগারেট চাইবেন না এবং আপনাদের সিগারেট জ্বালানোর জন্য তাদেরকে জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে আসতে বলবেন না। তারা ঈশ্বরের লোক! সকল যিহোবার সাক্ষিকে দিনে দু-বেলা খাবার দেওয়া হবে কারণ তারা এখানে কোনো অপরাধের জন্য নয় বরং বাইবেলের প্রতি তাদের বিশ্বাসের কারণে বন্দি আছে।”
এ ছাড়া, আমাদের সুনামের কারণে আমরা অন্যান্য ক্ষেত্রে উপকার লাভ করেছিলাম। অন্ধকার হয়ে গেলে অথবা বৃষ্টির সময়ে, অন্যান্য বন্দিকে কোথাও যেতে দেওয়া হতো না। কিন্তু, আমরা দালানের বাইরে যেতে চাইলে আমাদের যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো। কারণ কর্তৃপক্ষ জানত, আমরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব না। আসলে, একবার আমরা মাঠে কাজ করার সময় যে-পাহারাদার আমাদের পাহারা দিচ্ছিলেন, তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তখন আমরা তার চিকিৎসার জন্য তাকে ধরে কারাগারের ভিতরে নিয়ে যাই। কারাগারের কর্মকর্তারা জানতেন, আমাদের উপর নির্ভর করা যায়। তাই, আমরা উত্তম আচরণ বজায় রাখার মাধ্যমে, আমাদের আটককারীদের মুখে যিহোবার নাম গৌরবান্বিত হতে দেখার আশীর্বাদ পেয়েছি।—১ পিতর ২:১২.b
সুসময় ফিরে আসে
১৯৮৫ সালের ১১ মে, আমি ডিজালেকা কারাগার থেকে মুক্ত হই। আমার পরিবারের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হতে পেরে আমি কতই-না আনন্দিত হয়েছিলাম! অত্যন্ত কঠিন সময়ে যিহোবা আমাদের নীতিনিষ্ঠা বজায় রাখতে সাহায্য করেছেন বলে আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। সেই সময় সম্বন্ধে আমরাও প্রেরিত পৌলের মতো অনুভব করি, যিনি লিখেছিলেন: “হে ভ্রাতৃগণ, . . . আমাদের যে ক্লেশ ঘটিয়াছিল, তোমরা যে সে বিষয় অজ্ঞাত থাক, ইহা আমাদের ইচ্ছা নয়; . . . এমন কি, জীবনের আশাও ছাড়িয়া দিয়াছিলাম; বরং আমরা আপনাদের অন্তরে এই উত্তর পাইয়াছিলাম যে, মৃত্যু আসিতেছে, যেন আপনাদের উপরে নির্ভর না দিয়া মৃতগণের উত্থাপনকারী ঈশ্বরের উপরে নির্ভর দিই। তিনিই এত বড় মৃত্যু হইতে আমাদিগকে উদ্ধার করিয়াছেন ও উদ্ধার করিবেন।”—২ করি. ১:৮-১০.
সত্যি বলতে কী, কখনো কখনো মনে হয়েছে, আমরা হয়তো রক্ষা পাব না। কিন্তু, আমরা সবসময় যিহোবার কাছে এক নম্র মনোভাব বজায় রাখার জন্য সাহস ও প্রজ্ঞা চেয়ে প্রার্থনা করেছি, যেন আমরা সবসময় তাঁর মহান নামের গৌরব নিয়ে আসতে পারি।
যিহোবা কঠিন সময়ে ও সেইসঙ্গে সুসময়ে তাঁর সেবা করে চলার ক্ষেত্রে আমাদের আশীর্বাদ করেছেন। ২০০০ সালে লিলংওয়েতে শাখা অফিসের নির্মাণকাজ শেষ হতে দেখা আর সেইসঙ্গে মালাউইজুড়ে এক হাজারেরও বেশি কিংডম হল নির্মিত হতে দেখা, আমাদের জন্য কতই-না রোমাঞ্চকর এক বিষয়! যিহোবার কাছ থেকে পাওয়া এসব আশীর্বাদ লিডাসি ও আমাকে আধ্যাত্মিকভাবে এতটাই ধনবান করেছে, যা আমাদের কাছে বলতে গেলে একটা স্বপ্নের মতো!c
a অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান রয়েছে এমন ভাইদের এখন আর সীমার কাজের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় না।
b মালাউইতে ঘটা তাড়না সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে জানার জন্য যিহোবার সাক্ষিদের বর্ষপুস্তক ১৯৯৯ (ইংরেজি) বইয়ের ১৭১-২২৩ পৃষ্ঠা দেখুন।
c এই প্রবন্ধ প্রকাশনার জন্য প্রস্তুত করার সময়, ভাই এনসম্বা ৮৩ বছর বয়সে মৃত্যুর কোলে ঘুমিয়ে পড়েন।