ভাস্কো দা গামার নামে সেতু
পোর্তুগালের সচেতন থাক! সংবাদদাতা কর্তৃক
পোর্তুগিজ সংবাদপত্রগুলোতে এই খবরটা খুব ঘটা করে ছাপানো হয়েছিল। চারিদিকে এই বিষয়টাই লোকেদের মুখে মুখে ফিরছিল—আতশবাজি পুড়িয়ে ইউরোপের এক দীর্ঘতম সেতুর শুভ উদ্বোধন হয়। ১৯৯৮ সালের ২৯শে মার্চ ১৭.২ কিলোমিটার দীর্ঘ, ভাস্কো দা গামা সেতুর উদ্বোধন হয়েছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে যে নাবিক পশ্চিম ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষে আসার সমুদ্রপথ আবিষ্কার করেছিলেন, তার নামেই এই সেতুর নাম রাখা হয়। এই নতুন সেতু পোর্তুগালের শিল্পসমৃদ্ধ উত্তরাঞ্চলে যাওয়ার ও দক্ষিণে অ্যালগার্ভের শুভ্র সৈকত এবং স্পেনে যাওয়ার নতুন পথ খুলে দেয়।
বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম এই সেতু পোর্তুগালের রাজধানী লিসবনের টেগাস নদীর মোহনা থেকে দক্ষিণ তীরবর্তী মন্টিজো শহর পর্যন্ত বিস্তৃত। দুটো স্তম্ভের মাঝখানে এর ঝুলন্ত অংশ ৮২৬ মিটার লম্বা আর এটা নদী থেকে ৪৫ মিটার উঁচু আর তার ফলে এর নিচ দিয়ে বড় বড় জাহাজ চলাচলে কোন অসুবিধা হয় না।
খুব ধুমধাম করে শুরু হয়
সরকারিভাবে উদ্বোধনের এক সপ্তা আগেই এক জাঁকজমকপূর্ণ পার্টি দিয়ে এর শুরু হয়েছিল। আর এই উত্তেজনার চরম মুহূর্তটা ছিল ২২শে মার্চ রবিবার, যখন ১৫,০০০ লোককে ঐতিহ্যবাহী পোর্তুগিজ খাবার ফেইজোয়াদা অর্থাৎ ব্ল্যাক বিন স্টু খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এত লোককে কোথায় খেতে দেওয়া হবে? এই নতুন সেতুর উপরে ছাড়া আর কোথায়! সেতুর উপর ৫ কিলোমিটার জুড়ে খাবার টেবিল পাতা, সত্যিই একটা দেখার মতো দৃশ্য ছিল! লোকেরা সবাই তৃপ্তি করে খেয়েছিলেন আর তারা খুবই খুশি হয়েছিলেন।
চাহিদা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে
এই সেতু বানানোর কী দরকার ছিল? ১৯৬৬ সালের ২৫শে এপ্রিল থেকে লিসবন শহরের লোকেরা ১০১৩ মিটার দীর্ঘ ঝুলন্ত সেতুই ব্যবহার করতো। রোজ সেখান দিয়ে গড়ে ১,৩০,০০০ যানবাহন চলাচল করতো। আপনি কি আন্দাজ করতে পারেন যে দিনের বেলা কাজে যাওয়া-আসার সময় ও শনিবার-রবিবার রাস্তায় কী ভীষণ ভিড় উপচে পড়তো? লিসবন শহর থেকে পোর্তুগালের দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়ার জন্য সেতু পার হতে লোকেদের প্রায়ই এক কিংবা দুই ঘন্টা সময় লাগাটা এমন কিছু বড় বিষয় ছিল না। এই কারণেই আরেকটা সেতুর প্রয়োজন দেখা দেয়। নদীর ১৩ কিলোমিটার উজানে নতুন সেতুর ছটা সরু পথ আছে আর এতে অনেক সুবিধা হয়েছে। এগুলোকে এমনভাবে বানানো হয়েছে যে যদি এর ওপর দিয়ে যাওয়া গাড়ির সংখ্যা দিনে ৫২,০০০রের বেশি হয়ে যায়, তাহলে দুদিক দিয়েই একটা একটা করে সরু পথ যুক্ত করা যাবে। তাই আশা করা হচ্ছে যে এখন যানবাহনগুলো ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলে তাড়াতাড়িই সেতু পার হতে পারবে।
সেতু পার হওয়া
আসুন এখন আমরা সবাই একসঙ্গে দক্ষিণ দিকের মন্টিজো থেকে সেতু পার হই। স্থলভাগ ও বিল ছাড়িয়ে আমরা এখন ১০ কিলোমিটার চওড়া টেগাস নদীর ওপর আছি। এখন ভরা জোয়ার আর আমাদের চারদিকে শুধু জল আর জল। ফুটপাত বাঁধানো তাই পিছলে পড়ার ভয় নেই আর ১৫০০টা স্তম্ভ যার ওপর সেতু দাঁড়িয়ে আছে তা যাত্রীদের নিরাপদ বলে মনে করায়।
আমরা এতক্ষণে সেতুর ঝুলন্ত অংশে পৌঁছে গেছি। এই অংশকে ১৫০ মিটার উঁচু দুটো স্তম্ভের সঙ্গে তারের মাধ্যমে মজবুতভাবে আটকানো হয়েছে। এই তারগুলো নৌকার পালের মতো দেখতে লাগে। এই তার যে যে স্তম্ভগুলোর সঙ্গে জোড়া সেগুলোর ভীত নদীর নিচে ৫০ মিটার থেকে ৬৫ মিটার গভীরে পোঁতা রয়েছে। আরও নিরাপদ করার জন্য, এই সেতুটাকে এমনভাবে বানানো হয়েছে যাতে এটা ঘন্টায় ২২০ কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত দমকা হাওয়াকে প্রতিরোধ করতে পারে এবং ১৭৫৫ সালে যে ভূমিকম্প লিসবনের বেশিরভাগ অঞ্চলকে ধ্বংস করে দিয়েছিল তার থেকেও সাড়ে চার গুণ বেশি কম্পনেও এটা টিকে থাকতে পারে।
এখন আমরা ভাস্কো দা গামা সেতু প্রায় পার হয়ে এসেছি। লিসবন শহরের উত্তরপূর্ব প্রান্তে এসে পৌঁছানোর পর সারি সারি পামগাছ আমাদের নজর কাড়ে। ইচ্ছে করলে এখন আমরা এই বড় রাজপথের ওপর দিয়ে পোর্তুগালের উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত যেতে পারি। এই নতুন সেতু থাকায় লিসবনের বিরক্তিকর যানজট এড়িয়ে এখন সহজেই এক সুন্দর সড়কে করে দক্ষিণের অ্যালগার্ভ থেকে উত্তরের মিনহো প্রদেশে যাওয়া যায়!
নিরাপত্তা ব্যবস্থা
এই সেতু বানানোর সময় নিরাপত্তার ব্যাপারে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছিল। যদি একটা গাড়ি খারাপ হয়ে দাঁড়িয়ে যায় তাহলেও বিরাট যানজটের সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু, সেতু ও এতে ঢোকা ও বেরোনোর রাস্তায় ৮৭টা ভিডিও ক্যামেরা কুশলভাবে বসানো আছে যেগুলোর সাহায্যে চলাচলকারী যানবাহনের সমস্ত ত্রুটি, পুলিশ স্টেশন ও যানজট নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের মনিটরগুলোতে ভেসে ওঠে। কোন যানবাহন দাঁড়িয়ে গেলে, নিয়ন্ত্রণ কক্ষে সংকেত ঘন্টি বেজে ওঠে।
এছাড়াও, ১৭ কিলোমিটারের মধ্যে ৪০০ মিটার পর পর ৩৬ জোড়া টেলিফোন আছে যেগুলোর মাধ্যমে হঠাৎ দরকার পড়লে সাহায্য চাওয়া যায়। এই জরুরি অবস্থার জন্য যে ব্যবস্থা তা কিভাবে কাজ করে? সেতুতে বিশেষ কিছু গাড়ি চলতে থাকে যেগুলো হঠাৎ দরকার হলে কাজ করে আর যার মধ্যে আগুন নেভানো ও গাড়ি খারাপ হয়ে গেলে সেগুলোকে টেনে নিয়ে যাওয়াও পড়ে।
হঠাৎ আবহাওয়ার পরিবর্তন হলেই বা কী? দুটো আবহাওয়া কেন্দ্র বাতাসের গতি, তীব্রতা ও দিক মেপে আবহাওয়া ও পথের অবস্থা দেখে গাড়ির গতিকে পরিবর্তিত করতে থাকে।
১২০০টা বাতির ঝলমলে আলোয় রাতের বেলায় সেতু আরও মোহময়ী হয়ে ওঠে।
প্রকৃতির সঙ্গে জড়িত কিছু সমস্যা
এই নতুন সেতু কোথায় হবে সেই সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব সহজ হয়নি। কোন্ কোন্ বিষয়গুলো দেখতে হয়েছিল?
প্রাকৃতিক দিক দিয়ে এই জায়গা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ পশ্চিম ইউরোপের এক বিখ্যাত নদীর মোহনায় পাখিদের জন্য সংরক্ষিত এলাকার ওপর দিয়ে এই সেতু চলে গিয়েছে। উদ্ভিদকূল, মাছ, পাখি ও প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিস, বিশুদ্ধ জল ও বায়ু ও শত শত একর এলাকা জুড়ে থাকা লবণ কুণ্ডকে সুরক্ষিত রাখার জন্য অনেক বিষয়ে প্রচুর গবেষণা করতে হয়েছিল। টেগাস নদীর মোহনায় কেন পশু-পাখি আসে? কারণ এটা পোর্তুগালও ইউরোপের সবচেয়ে আর্দ্র অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটা যা প্রচরণশীল পাখিদের জন্য খুবই আদর্শ জায়গা হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। এখানে ব্ল্যাক উইংড স্টিল্ট, কেন্টিশ প্লোভার এবং লিটিল টার্ন এইসব পাখিরা আসে ও তাদের বংশবৃদ্ধির জন্য এটা এক ভাল জায়গা। শরৎ ও শীতকালে অসংখ্য পাখি এই লবণাক্ত বিলে এসে আশ্রয় নেয়।
এছাড়াও দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা মাছের খামারের কথাও চিন্তা করতে হয়েছিল। এর মানে ছিল মাছদের গতিবিধিতে যাতে বাধা না হয় সেজন্য যতটা সম্ভব মনোযোগ দেওয়া। তিন হাজার মাছকে বিশেষ করে সোল ও সি বেস মাছেদের চিহ্নিত করে রাখা হয়েছিল যাতে মাছেদের বাড়া-কমাকে বুঝতে পারা যায়।
হঠাৎই, এই শান্ত প্রকৃতিকে শহরের কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু এই প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর এর কতটা প্রভাব পড়বে? আশা করা হয় যে দক্ষিণাঞ্চলের অমূল্য তীরকে রক্ষা করার জন্য যে ব্যবস্থাগুলো নেওয়া হয়েছে সেগুলো এখানকার প্রাকৃতিক উৎসগুলোকে যথাসম্ভব রক্ষা করবে।
প্রকৌশলী অগ্রগতি, স্থাপত্যবিদ্যা, সৌন্দর্য এবং সুবিন্যাসের দিক দিয়ে ভাস্কো দা গামা সেতু সত্যিই এক বিরাট প্রাপ্তি। পোর্তুগালের জন্য এই সেতু সত্যিই এক গর্বের বিষয় যার নাম ভাস্কো দা গামা সেতু!
[১৫ পৃষ্ঠার মানচিত্র/চিত্র]
(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)
পোর্তুগাল
স্পেন
[মানচিত্র]
পোর্তুগাল
লিসবন
মন্টিজো
ভাস্কো দা গামা সেতু
[সজন্যে]
Courtesy of Lusoponte/Sonomage