টাওয়ার ব্রিজ লন্ডনের প্রবেশপথ
ব্রিটেনের সচেতন থাক! লেখক কর্তৃক
যারা কখনো ইংল্যান্ড যায়নি, সেই বিদেশিরাও এটার সঙ্গে পরিচিত। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এটা পরিদর্শন করতে আসে। প্রতিদিন লন্ডনের অধিবাসীরা এর ওপর দিয়ে পার হয় কিন্তু সম্ভবত এক ঝলকও এটার দিকে তাকায় না বা এর উৎপত্তি কীভাবে হল সেই সম্বন্ধে চিন্তাও করে না। টাওয়ার ব্রিজ হচ্ছে লন্ডনের সবচেয়ে পরিচিত নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটা।
টাওয়ার ব্রিজকে এর পার্শ্ববর্তী লন্ডন ব্রিজের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না যেন, টাওয়ার ব্রিজ টাওয়ার অভ্ লন্ডন এর পাশাপাশি অবস্থিত। ১৮৭২ সালের দিকে, ইংল্যান্ডের আইনসভা টেমস নদীর ওপর একটা সেতু নির্মাণের জন্য বিল পাশ করানোর বিষয়টা বিবেচনা করেছিল। টাওয়ারের গভর্নরের আপত্তি সত্ত্বেও, আইনসভা আরেকটা সেতু নির্মাণের এই ধারণাটা বাস্তবায়িত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তবে এই শর্তে যে, এটার নকশা টাওয়ার অভ্ লন্ডন এর নকশার মতোই হতে হবে। বর্তমান সময়ের টাওয়ার ব্রিজ এই সরকারি প্রস্তাব অনুযায়ীই নির্মাণ করা হয়েছে।
অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতাব্দীতে, অনেককটা সেতু টেমস নদীর দুই তীরে সংযোগ স্থাপন করেছিল, যেগুলোর মধ্যে ওল্ড লন্ডন ব্রিজ ছিল সবচেয়ে বিখ্যাত। ১৭৫০ সালের মধ্যে সেই সেতুটাকে নদীর নড়বড়ে ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো হয়েছিল এবং এটা যানবাহন পারাপারের জন্য যথেষ্ট চওড়া ছিল না। এই সেতুর নীচে ঘিজঘিজে বন্দরে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা জাহাজগুলো জায়গা পাওয়ার জন্য ধাক্কাধাক্কি করত। সেই সময়ে বন্দরে এত বেশি জাহাজ নঙ্গর বাঁধা থাকত যে, এইরকম কথিত ছিল, একজন ব্যক্তি একটার পর একটা নঙ্গর বাঁধা জাহাজের পাটাতনের ওপর দিয়ে কয়েক কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে পারতেন।
কর্পোরেশন অভ্ লন্ডন এর অনুরোধে, শহরের স্থপতি হরেস জোনস্ লন্ডন ব্রিজ থেকে নদীর অভিমুখে গথিক ধাঁচে একটা টানা সেতু নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই সেতুটা পশ্চিম দিকে টেমস থেকে বন্দরের দিকে জাহাজগুলোকে সহজে আসা-যাওয়া করার সুযোগ করে দেয়। এই অন্তর্ভুক্ত নকশাটাকে অনেকেই একটা অভিনব বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করেছিল।
বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নকশা
জোনস্ দূর-দূরান্তে ভ্রমণ করেছিলেন এবং নেদারল্যান্ডসের খালগুলোর ওপর দিয়ে বিস্তৃত ছোট ছোট টানা সেতুগুলো তাকে এমন একটা সেতু বানানোর ধারণা দিয়েছিল, যেটা ফাঁক হয়ে দুধারে খাড়া হয়ে যেতে পারে। বর্তমানে বিখ্যাত টাওয়ার ব্রিজ এর আকার তখনকার আধুনিক পদ্ধতি অনুযায়ী সুরকি ও পাথর দিয়ে বাঁধানো স্টিলের কাঠামো ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছিল, যেটা সেতু নির্মাণ দলের প্রকৌশলী ও স্থপতিরা নকশা করেছিল।
টাওয়ার ব্রিজ এর দুটো প্রধান টাওয়ার রয়েছে, যেগুলো প্রধান রাস্তা থেকে ৩৪ মিটার এবং জোয়ারের সময় যতদূর পর্যন্ত নদীর জল ওঠে সেই চিহ্ন থেকে প্রায় ৪২ মিটার উঁচুতে দুটো হাঁটার পথ দ্বারা সংযুক্ত। নদীর দুই তীর থেকে বের হওয়া রাস্তা সেতুর এমন একটা অংশে এসে পৌঁছায়, যেটা ফাঁক হয়ে দুধারে খাড়া হয়ে যেতে পারে। সেতুর এই বিশালাকৃতি পাতগুলোর একেকটার ওজন প্রায় ১,২০০ টন এবং সেগুলো খুলে ৮৬ ডিগ্রি কোণে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। প্রায় ১০,০০০ টন ওজনের জাহাজগুলো নিরাপদে সেতুর নীচ দিয়ে পার হতে পারে।
টানাসেতুর পাতগুলোকে তোলার শক্তি
জলশক্তির সাহায্যে সেতুর পাতগুলোকে খাড়া করা হতো আর এর ফলে যাত্রীবাহী এলিভেটরগুলো রাস্তা থেকে হাঁটার পথের সমতলে চলে আসত আর এমনকি এটার সাহায্যে ট্র্যাফিক সিগনালও নিয়ন্ত্রণ করা হতো। হ্যাঁ, এই সেতুকে চালানোর জন্য জল ব্যবহৃত হতো! আর এটা প্রচুর পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করত—প্রয়োজনের চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণে।
কয়লাচালিত চারটে বয়লার সেতুর দক্ষিণ প্রান্তের নীচে স্থাপিত ছিল, যেগুলো প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে পাঁচ থেকে ছয় কিলোগ্রাম চাপে বাষ্প উৎপন্ন করত আর এই বাষ্পে দুটো বিশাল পাম্প কাজ করত। এই পাম্পগুলো এবার প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে ৬০ কিলোগ্রাম চাপে জল সরবরাহ করত। পাতগুলোকে খাড়া করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি জোগাতে ছয়টা বড় ট্যাঙ্কে, শক্তিকে চাপের মধ্যে জলের আকারে সঞ্চিত রাখা হতো। এই ট্যাঙ্কগুলো মোট আটটা ইঞ্জিনের জন্য শক্তি সরবরাহ করত, যা পাতগুলোকে চালাত। সুইচ অন করা হলে এই পাতগুলোকে ৫০ সেন্টিমিটার ব্যাসবিশিষ্ট লম্বা দণ্ডগুলোর সাহায্যে খাড়া করা হতো। এই পাতগুলোকে পুরোপুরি খাড়া করতে মাত্র এক মিনিট লাগত।
আধুনিক টাওয়ার ব্রিজ পরিদর্শন
বর্তমানে বাষ্পীয় শক্তির পরিবর্তে বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু, পূর্বের বছরগুলোর মতো আজও টাওয়ার ব্রিজ চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় যানবাহনের চলাচল থেমে যায়। পথিক, পর্যটক এবং অন্যান্য পরিদর্শকরা সেতুর কার্যকলাপ দেখে বিস্মিত হয়ে যায়।
সতর্কতামূলক সংকেত বেজে ওঠে, রাস্তাগুলোকে বন্ধ করার জন্য বেড়াগুলো নামানো হয় এবং রাস্তার ওপর দিয়ে শেষ গাড়িটা পার হয়ে যাওয়ার পর সেতু নিয়ন্ত্রণকারীরা সংকেত দেয় যে, এখন রাস্তা পরিষ্কার। দুটো পাতকে জুড়ে রাখা চার ধারের খিলগুলো নিঃশব্দে খুলে যায় এবং পাতগুলো খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এরপর নদীর দিকে চোখ যায়। জাহাজকে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য এক ছোট শক্তিশালী নৌকা, প্রমোদভ্রমণের জন্য ব্যবহৃত এক মোটরচালিত নৌকা বা পাল তোলা নৌকা যা-ই হোক না কেন, এগুলোর দিকে লোকেদের নজর থাকে যে, কীভাবে এগুলো পার হচ্ছে। কয়েক মিনিট বাদেই সিগনাল পরিবর্তিত হয়। পাতগুলো নেমে আসে আর রাস্তার ওপরে দেওয়া বেড়াগুলোকে সরিয়ে ফেলা হয়। সাইকেল আরোহীরা অপেক্ষমাণ যানবাহনের আগে গিয়ে প্রথমে পার হওয়ার চেষ্টা করে। মুহূর্তের মধ্যেই টাওয়ার ব্রিজ আগের অবস্থায় ফিরে আসে এবং সেটাকে আবারও তোলার সেই প্রয়োজনীয় ক্ষণের অপেক্ষায় থাকে।
একজন আগ্রহী পর্যটক পর পর ঘটে চলা এই ঘটনাগুলো দেখেই শুধু থেমে থাকেন না। অন্যদের সঙ্গে এলিভেটরে চড়ে তিনি সেতুর ইতিহাস সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা জানার আকাঙ্ক্ষায় উত্তর টাওয়ারে ওঠেন, যেখানে “টাওয়ার ব্রিজ অভিজ্ঞতা” প্রদর্শনীতে এক যান্ত্রিক পুতুলের দ্বারা তা বর্ণনা করা হয়। পূর্তবিদ্যা সংক্রান্ত সম্পাদনগুলো এবং জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পটে এঁকে, বাদামি রঙের বুটিদার ছবিগুলোতে বর্ণনা করা হয়েছে এবং দেওয়ালে বসানো বোর্ডগুলোতে প্রদর্শিত নানা ছবি টাওয়ার ব্রিজ এর চমৎকারিত্বকে ফুটিয়ে তোলে।
উঁচুতে অবস্থিত হাঁটার পথগুলো একজন পর্যটককে লন্ডনের দিক-দিগন্তের অপূর্ব দৃশ্যগুলো উপভোগ করার সুযোগ করে দেয়। এখানে চড়ে একজন পশ্চিম দিকে সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল এবং লন্ডনের ব্যাঙ্ক ভবনগুলোকে দেখতে পান আর দূরে পোস্ট অফিস টাওয়ার দেখতে পান। পূর্ব দিকে একজন ব্যক্তি বন্দরগুলো দেখার আশা করতে পারেন কিন্তু এগুলোকে এখন আধুনিক শহর থেকে নদীর অভিমূখে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। সেই জায়গায়, ডকল্যান্ডস্ অর্থাৎ নগরায়ন প্রকল্পের এলাকা, যেখানে চোখ জুড়ানোর মতো নতুন নতুন নকশায় তৈরি ভবনগুলো দেখা যায়। অপূর্ব, মনোমুগ্ধকর, আগ্রহজনক—হ্যাঁ, এই সমস্ত শব্দ সুস্পষ্টভাবে লন্ডনের এই বিখ্যাত নিদর্শন থেকে দেখা দৃশ্যের বর্ণনা করে।
আপনি যখন লন্ডনে ঘুরতে যান, তখন এই ঐতিহাসিক নির্মাণ প্রকল্পটাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখে আসুন না কেন? আপনার এই পরিদর্শন উল্লেখযোগ্য প্রকৌশলবিদ্যা সম্বন্ধে এক চিরস্থায়ী ছাপ ফেলবে। (g ১০/০৬)
[১৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
দুটো বাষ্পচালিত পাম্পের মধ্যে একটা, যা একসময় ইঞ্জিনগুলোকে চালাত
[সৌজন্যে]
Copyright Tower Bridge Exhibition
[১৬, ১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
সেতুর দুটো পাত, যেগুলো মাত্র এক মিনিটের মধ্যে পুরোপুরি খাড়া হয়ে গিয়েছে
[সৌজন্যে]
©Alan Copson/Agency Jon Arnold Images/age fotostock
[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]
© Brian Lawrence/SuperStock