যিহোবাকে আপনার আস্থা করে তুলুন
“হে প্রভু সদাপ্রভু [“সার্বভৌম প্রভু যিহোবা,” NW], তুমি আমার আশা; তুমি বাল্যকাল হইতে আমার বিশ্বাস-ভূমি [“আস্থা,” NW]।”—গীতসংহিতা ৭১:৫.
১. মেষপালক দায়ূদ কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন?
লোকটি ছিল প্রায় ৩ মিটার লম্বা। তাই, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, ইস্রায়েলের সৈন্যশ্রেণীর সমস্ত সৈন্য তার মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছিল! পর পর কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে, পলেষ্টীয় দৈত্যাকৃতি গলিয়াৎ ইস্রায়েলের সৈন্যবাহিনীকে টিটকারি দিতে থাকে, তার সঙ্গে লড়াই করার জন্য একজন বীরকে পাঠাতে বলে তাদেরকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করে। অবশেষে, সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বানে সাড়া দেওয়া হয়, তবে কোনো সৈন্য নয় কিন্তু একেবারে অল্পবয়স্ক একজন ব্যক্তি সাড়া দেন। মেষপালক দায়ূদ তার প্রতিপক্ষের তুলনায় একজন বামনের মতো ছিলেন। আসলে তার ওজন হয়তো গলিয়াতের যুদ্ধসজ্জা এবং অস্ত্রশস্ত্রের চেয়েও কম ছিল। তা সত্ত্বেও, সেই অল্পবয়স্ক ছেলে দৈত্যাকৃতি ব্যক্তির মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং সাহসের এক সুপরিচিত আদর্শ হয়ে উঠেছিলেন।—১ শমূয়েল ১৭:১-৫১.
২, ৩. (ক) কেন দায়ূদ অত্যন্ত আস্থার সঙ্গে গলিয়াতের মুখোমুখি হতে পেরেছিলেন? (খ) আমরা কোন দুটো পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করব, যেগুলো যিহোবাকে আমাদের আস্থা করে তোলার জন্য আমরা নেব?
২ কোন বিষয়টা দায়ূদকে এইরকম সাহস জুগিয়েছিল? দায়ূদের জীবনের পরবর্তী বছরগুলোতে স্পষ্টত তারই লেখা কিছু কথা বিবেচনা করুন: “হে সার্বভৌম প্রভু যিহোবা, তুমি আমার আশা; তুমি বাল্যকাল হইতে আমার আস্থা।” (গীতসংহিতা ৭১:৫) হ্যাঁ, অল্পবয়স থেকেই দায়ূদ যিহোবার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করেছিলেন। তিনি এই বলে গলিয়াতের মুখোমুখি হয়েছিলেন: “তুমি খড়্গ, বড়শা ও শল্য লইয়া আমার কাছে আসিতেছ, কিন্তু আমি বাহিনীগণের সদাপ্রভুর [“যিহোবার,” NW], ইস্রায়েলের সৈন্যগণের ঈশ্বরের নামে, তুমি যাঁহাকে টিট্কারি দিয়াছ তাঁহারই নামে, তোমার নিকটে আসিতেছি।” (১ শমূয়েল ১৭:৪৫) যেখানে গলিয়াতের আস্থা ছিল তার নিজের প্রচুর শক্তি এবং তার অস্ত্রশস্ত্রের ওপর, সেখানে দায়ূদের আস্থা ছিল যিহোবার ওপর। নিখিলবিশ্বের সার্বভৌম প্রভু তার পক্ষে, তা হলে কেনই বা দায়ূদ সাধারণ এক মানুষকে ভয় পাবেন, তা সে যত বিরাটাকায় বা সুসজ্জিতই হোক না কেন?
৩ দায়ূদের সম্বন্ধে পড়ার সময় আপনি কি চান যে, যিহোবার ওপর আপনার নিজের আস্থা আরও শক্তিশালী হোক? সম্ভবত আমাদের মধ্যে অনেকেই তা চায়। তাই, আসুন আমরা দুটো পদক্ষেপ পরীক্ষা করে দেখি, যেগুলো যিহোবাকে আমাদের আস্থা করে তোলার জন্য আমরা নিতে পারি। প্রথমটা হল, এই ধরনের আস্থার ক্ষেত্রে এক সাধারণ বাধার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অর্জন করতে ও তা বজায় রাখতে হবে। দ্বিতীয়টা হল, আমাদের জানা দরকার যে, যিহোবার ওপর নির্ভর করার সঙ্গে কী জড়িত।
যিহোবার ওপর আস্থা রাখার ক্ষেত্রে এক সাধারণ প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে ওঠা
৪, ৫. কেন অনেক লোক ঈশ্বরের ওপর আস্থা রাখাকে কঠিন বলে মনে করে?
৪ কোন বিষয়টা ঈশ্বরের ওপর আস্থা রাখার ক্ষেত্রে লোকেদের বাধা দেয়? কেন খারাপ বিষয়গুলো ঘটে, সেই বিষয়ে প্রায়ই কিছু ব্যক্তি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। অনেককে শেখানো হয়েছে যে, দুঃখকষ্টের জন্য ঈশ্বর দায়ী। যখন কোনো দুঃখজনক ঘটনা ঘটে, তখন পাদরিরা হয়তো বলে থাকে যে, দুঃখজনক ঘটনার শিকার এই ব্যক্তিকে ঈশ্বর তাঁর সঙ্গে থাকার জন্য স্বর্গে “নিয়ে গেছেন।” অধিকন্তু, অনেক ধর্মীয় নেতা শিক্ষা দিয়ে থাকে যে, এই জগতে ঘটা প্রতিটা ঘটনা—সেইসঙ্গে প্রতিটা দুঃখজনক ঘটনা এবং মন্দ কাজ—ঈশ্বর অনেক আগে থেকেই স্থির করে রেখেছেন। এইরকম কঠিন হৃদয়ের এক ঈশ্বরের ওপর আস্থা রাখা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। শয়তান, যে অবিশ্বাসীদের মন অন্ধ করে রেখেছে, সে এই ধরনের ‘ভূতগণের শিক্ষামালা’ ছড়িয়ে দিতে উৎসুক।—১ তীমথিয় ৪:১; ২ করিন্থীয় ৪:৪.
৫ শয়তান চায় যেন লোকেরা যিহোবার ওপর থেকে তাদের আস্থা হারিয়ে ফেলে। ঈশ্বরের সেই শত্রু চায় না যে, মানুষের দুঃখকষ্টের প্রকৃত কারণগুলো আমরা জানি। আর আমরা যদি দুঃখকষ্টের শাস্ত্রীয় কারণগুলো সম্বন্ধে শিখেও থাকি, তবুও শয়তান চাইবে যেন আমরা সেগুলো ভুলে যাই। তাই, কেন পৃথিবীতে দুঃখকষ্ট রয়েছে, সেই বিষয়ে তিনটে মূল কারণ সম্বন্ধে সময়ে সময়ে পুনরালোচনা করা আমাদের জন্য যুক্তিযুক্ত। তা করার মাধ্যমে আমরা আমাদের হৃদয়কে আশ্বাসযুক্ত করতে পারব যে, জীবনে আমরা যে-সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হই, সেগুলোর জন্য যিহোবা দায়ী নন।—ফিলিপীয় ১:৯, ১০.
৬. কীভাবে ১ পিতর ৫:৮ পদ মানুষের দুঃখকষ্ট থাকার একটা কারণ সম্বন্ধে জানায়?
৬ মানুষের দুঃখকষ্টের একটা কারণ হল যে, যিহোবার বিশ্বস্ত লোকেদের নীতিনিষ্ঠাকে শয়তান ভেঙে ফেলতে চায়। সে ইয়োবের নীতিনিষ্ঠাকেও ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছিল। সেই সময় শয়তান ব্যর্থ হয়েছিল কিন্তু সে হাল ছেড়ে দেয়নি। এই জগতের শাসক হিসেবে সে যিহোবার বিশ্বস্ত দাসদের “গ্রাস” করার জন্য অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছে। (১ পিতর ৫:৮) আমরা প্রত্যেকেই এর সঙ্গে জড়িত! শয়তান চায় যেন আমরা যিহোবাকে সেবা করা বন্ধ করে দিই। তাই, সে প্রায়ই তাড়না নিয়ে আসে। এই ধরনের দুঃখকষ্ট যদিও বেদনাদায়ক কিন্তু আমাদের সেগুলো সহ্য করার উত্তম কারণ রয়েছে। তা করার মাধ্যমে আমরা শয়তানকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে সাহায্য করি এবং এতে যিহোবা আনন্দিত হন। (ইয়োব ২:৪; হিতোপদেশ ২৭:১১) তাড়না সহ্য করার জন্য যিহোবা আমাদের শক্তিশালী করেন বলে তাঁর ওপর আমাদের আস্থা আরও বেড়ে যায়।—গীতসংহিতা ৯:৯, ১০, NW.
৭. গালাতীয় ৬:৭ পদ আমাদের দুঃখকষ্টের কোন কারণটা বুঝতে সাহায্য করে?
৭ দুঃখকষ্ট থাকার দ্বিতীয় কারণটা এই নীতির মধ্যে পাওয়া যায়: “মনুষ্য যাহা কিছু বুনে তাহাই কাটিবে।” (গালাতীয় ৬:৭) কখনও কখনও লোকেরা ভুল বাছাইয়ের মাধ্যমে বুনে থাকে এবং এর পরিণামস্বরূপ অনেক দুঃখকষ্ট কাটে বা ভোগ করে। তারা হয়তো বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো বেছে নেয় আর এর ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। অনেকে ধূমপান করা বেছে নেয়, যা হৃদরোগ বা ফুসফুসের ক্যানসারের দিকে পরিচালিত করে। আর যারা অনৈতিক যৌন আচরণে জড়িত হওয়া বেছে নেয়, তাদের পারিবারিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার, আত্মসম্মান হারানোর, যৌনবাহিত রোগব্যাধি ভোগ করার এবং অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের ঝুঁকি থাকে। এই ধরনের দুঃখকষ্টের জন্য লোকেরা হয়তো ঈশ্বরকে দোষ দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু তারা আসলে তাদের নিজেদের ভুল সিদ্ধান্তগুলোর শিকারে পরিণত হয়।—হিতোপদেশ ১৯:৩.
৮. উপদেশক ৯:১১ পদ অনুযায়ী কেন লোকেরা দুঃখকষ্ট ভোগ করে?
৮ দুঃখকষ্টের তৃতীয় কারণটা উপদেশক ৯:১১ পদের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে: “আমি ফিরিলাম, ও সূর্য্যের নীচে দেখিলাম যে, দ্রুতগামীদের দ্রুতগমন, কি বীরদের যুদ্ধ, কি জ্ঞানবানদের অন্ন, কি বুদ্ধিমানদের ধন, কি বিজ্ঞদেরই অনুগ্রহলাভ হয়, এমন নয়, কিন্তু সকলের প্রতি কাল ও দৈব ঘটে।” মাঝে মাঝে, লোকেরা কেবল ভুল সময়ে ভুল জায়গায় উপস্থিত থাকে। আমাদের ব্যক্তিগত শক্তি বা দুর্বলতা যা-ই হোক না কেন, দুঃখকষ্ট এবং মৃত্যু অপ্রত্যাশিতভাবে যেকোনো সময়ে আমাদের যেকারও ওপর আসতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যিশুর দিনে যিরূশালেমে একটা উচ্চগৃহ ভেঙে পড়ে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। যিশু দেখিয়েছিলেন যে, অতীতের পাপের কারণে ঈশ্বর তাদের শাস্তি দেননি। (লূক ১৩:৪) না, এই ধরনের দুঃখকষ্টের জন্য যিহোবাকে দোষ দেওয়া যায় না।
৯. কেন অনেকে দুঃখকষ্ট থাকার বিষয়টা বুঝতে পারে না?
৯ দুঃখকষ্টের কয়েকটা কারণ বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই বিষয়ের মধ্যে এমন একটা দিক রয়েছে, যা বোঝা অনেকের জন্য কঠিন বলে মনে হয়। সেটা হল: কেন যিহোবা ঈশ্বর দুঃখকষ্ট থাকতে দিয়েছেন?
কেন যিহোবা দুঃখকষ্ট থাকতে দিয়েছেন?
১০, ১১. (ক) রোমীয় ৮:১৯-২২ পদ অনুসারে ‘সমস্ত সৃষ্টির’ কী হয়েছে? (খ) কে সৃষ্টিকে অসারতার বশীকৃত করেছেন, সেটা আমরা কীভাবে নির্ধারণ করতে পারি?
১০ রোমীয়দের কাছে প্রেরিত পৌলের লেখা চিঠির একটা অংশ এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে। পৌল লিখেছিলেন, “সৃষ্টির ঐকান্তিকী প্রতীক্ষা ঈশ্বরের পুত্ত্রগণের প্রকাশপ্রাপ্তির অপেক্ষা করিতেছে। কারণ সৃষ্টি অসারতার বশীকৃত হইল, স্ব-ইচ্ছায় যে হইল, তাহা নয়, কিন্তু বশীকর্ত্তার নিমিত্ত; এই প্রত্যাশায় [“প্রত্যাশার ভিত্তিতেই,” NW] হইল যে, সৃষ্টি নিজেও ক্ষয়ের দাসত্ব হইতে মুক্ত হইয়া ঈশ্বরের সন্তানগণের প্রতাপের স্বাধীনতা পাইবে। কারণ আমরা জানি, সমস্ত সৃষ্টি এখন পর্য্যন্ত একসঙ্গে আর্ত্তস্বর করিতেছে, ও একসঙ্গে ব্যথা খাইতেছে।”—রোমীয় ৮:১৯-২২.
১১ এই পদগুলোর বিষয়বস্তু বুঝতে হলে, প্রথমে আমাদের কয়েকটা মূল প্রশ্নের সমাধান করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, কে সৃষ্টিকে অসারতার বশীকৃত করেছে? কেউ কেউ শয়তানকে নির্দেশ করে; আবার অন্যেরা আদমকে নির্দেশ করে। কিন্তু, তারা কেউই বশীকৃত করেনি। কেন নয়? কারণ যিনি সৃষ্টিকে অসারতার বশীকৃত করেছেন, তিনি তা “প্রত্যাশার ভিত্তিতেই” করেছেন। হ্যাঁ, তিনি এই প্রত্যাশা দেন যে, বিশ্বস্ত ব্যক্তিরা অবশেষে “ক্ষয়ের দাসত্ব থেকে মুক্ত” হবে। আদম বা শয়তান কেউই এই ধরনের প্রত্যাশা দিতে পারে না। কেবলমাত্র যিহোবা পারেন। তাই, স্পষ্টত তিনিই সৃষ্টিকে অসারতার বশীকৃত করেছেন।
১২. ‘সমস্ত সৃষ্টির’ শনাক্তিকরণ নিয়ে কোন বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে এবং কীভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যেতে পারে?
১২ কিন্তু, এই অংশে উল্লেখিত “সমস্ত সৃষ্টি” কী? কেউ কেউ বলে যে, “সমস্ত সৃষ্টি” বলতে পশুপাখি ও গাছপালা সহ সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক জগৎকে বোঝায়। কিন্তু, পশুপাখি এবং গাছপালা কি “ঈশ্বরের সন্তানগণের প্রতাপের স্বাধীনতা” পাওয়ার প্রত্যাশা করে? না। (২ পিতর ২:১২) তাই, “সমস্ত সৃষ্টি” কেবলমাত্র মানবজাতিকে বোঝাতে পারে। এই সৃষ্টিই এদনে বিদ্রোহের কারণে পাপ এবং মৃত্যুর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে আর এর ফলে তাদের একান্তভাবে প্রত্যাশার প্রয়োজন রয়েছে।—রোমীয় ৫:১২.
১৩. এদনের বিদ্রোহ মানবজাতির প্রতি কী করেছে?
১৩ সেই বিদ্রোহ আসলে মানবজাতির প্রতি কী করেছে? পৌল একটা শব্দে এর ফলাফল সম্বন্ধে বর্ণনা করেন: অসারতা।a একটা তথ্যগ্রন্থ অনুসারে এই শব্দটা বর্ণনা করে যে, “কোনো বস্তুর অসারতা, যা এটাকে যেভাবে কাজ করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল, সেভাবে কাজ করে না।” মানুষকে চিরকাল বেঁচে থাকার এবং পরমদেশ পৃথিবীর যত্ন নিতে এক সিদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ পরিবার হিসেবে মিলেমিশে কাজ করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এর পরিবর্তে, তারা এক সংক্ষিপ্ত, বেদনাদায়ক এবং প্রায়ই হতাশাজনক অবস্থার দিকে পরিচালিত হয়। ইয়োব যেমন বলেছেন, “মনুষ্য, অবলাজাত সকলে, অল্পায়ু ও উদ্বেগে পরিপূর্ণ।” (ইয়োব ১৪:১) সত্যিই অসারতা!
১৪, ১৫. (ক) মানবজাতিকে দেওয়া যিহোবার শাস্তির মধ্যে আমরা ন্যায়বিচারের কোন প্রমাণ খুঁজে পাই? (খ) কেন পৌল বলেছিলেন যে, সৃষ্টি “স্ব-ইচ্ছায়” অসারতার বশীকৃত হয়নি?
১৪ এখন আমরা মূল প্রশ্নে চলে আসি: কেন “সমস্ত পৃথিবীর বিচারকর্ত্তা” মানবজাতিকে এই বেদনাদায়ক ও হতাশাজনক অবস্থার বশীভূত করেছিলেন? (আদিপুস্তক ১৮:২৫) তা করার ক্ষেত্রে তিনি কি ন্যায়পরায়ণ ছিলেন? আমাদের প্রথম পিতামাতা কী করেছিল, তা স্মরণ করে দেখুন। ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তারা শয়তানের পক্ষ নিয়েছিল, যে কিনা যিহোবার সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধে এক বিরাট আপত্তি তুলেছিল। তাদের কাজের মাধ্যমে তারা এই দাবিকে সমর্থন করেছিল যে, মানুষ যিহোবাকে ছাড়াই ভালভাবে থাকতে পারবে, এক বিদ্রোহী আত্মিক প্রাণীর পরিচালনায় নিজেদের শাসন করতে পারবে। এর ফলে, বিদ্রোহীদের শাস্তি দেওয়ার সময় যিহোবা তাদেরকে তারা যেটার প্রাপ্য ছিল, সেটাই দিয়েছিলেন। তিনি মানুষকে শয়তানের প্রভাবের অধীনে নিজেদেরকে শাসন করতে দিয়েছিলেন। এইরকম পরিস্থিতিতে মানুষকে প্রত্যাশার ভিত্তিতে অসারতার বশীকৃত করার চেয়ে আর কোন সিদ্ধান্তই বা সম্পূর্ণরূপে ন্যায্য হতো?
১৫ অবশ্য, সেটা সৃষ্টির “স্ব-ইচ্ছায়” হয়নি। এই বিষয়ে বাছাই করার কোনো সুযোগ ছাড়াই আমরা পাপ ও ক্ষয়ের দাসত্বে জন্মগ্রহণ করি। কিন্তু, যিহোবা করুণা দেখিয়ে আদম ও হবাকে তাদের জীবনের বাকি বছরগুলো বেঁচে থাকতে ও সন্তান জন্ম দিতে দিয়েছিলেন। তাদের বংশধর হিসেবে যদিও আমরা পাপ ও মৃত্যুর অসারতার বশীকৃত কিন্তু আমাদের সেই কাজ করার সুযোগ রয়েছে, যা আদম ও হবা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। আমরা যিহোবার কথা শুনতে এবং এটা শিখতে পারি যে, তাঁর সার্বভৌমত্ব হল ধার্মিক এবং নিখুঁত, যেখানে যিহোবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন মনুষ্য শাসন কেবল বেদনা, হতাশা এবং অসারতাই নিয়ে এসেছে। (যিরমিয় ১০:২৩; প্রকাশিত বাক্য ৪:১১) আর শয়তানের প্রভাব বিষয়গুলোকে শুধু খারাপের দিকেই নিয়ে গেছে। মানব ইতিহাস এই সত্যগুলোর বিষয়ে প্রমাণ দেয়।—উপদেশক ৮:৯.
১৬. (ক) কেন আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি যে, আজকে পৃথিবীতে আমরা যে-দুঃখকষ্ট দেখছি, সেটার জন্য যিহোবা দায়ী নন? (খ) বিশ্বস্ত লোকেদের জন্য যিহোবা প্রেমের সঙ্গে কোন প্রত্যাশা জুগিয়েছেন?
১৬ স্পষ্টতই, মানুষকে অসারতার বশীকৃত করার বৈধ কারণ যিহোবার ছিল। কিন্তু এর অর্থ কি এই যে, যিহোবা হলেন সেই অসারতা এবং দুঃখকষ্টের কারণ, যা আজকে আমাদের প্রত্যেককে যন্ত্রণা দিচ্ছে? একজন বিচারকের কথা চিন্তা করুন, যিনি কোনো অপরাধীকে এক ন্যায্য শাস্তির রায় দেন। দণ্ডিত অপরাধী হয়তো তার শাস্তির সময়কালে অনেক কষ্ট ভোগ করতে পারে কিন্তু সে কি তার কষ্টের কারণ হিসেবে উপযুক্তভাবে সেই বিচারককে দোষ দিতে পারে? কখনোই নয়! এ ছাড়া, যিহোবা কখনোই দুষ্টতার উৎস নন। যাকোব ১:১৩ পদ বলে: “মন্দ বিষয়ের দ্বারা ঈশ্বরের পরীক্ষা করা যাইতে পারে না, আর তিনি কাহারও পরীক্ষা করেন না।” আসুন আমরা এও মনে রাখি যে, যিহোবা এই শাস্তি “প্রত্যাশার ভিত্তিতেই” দিয়েছেন। আদম ও হবার বিশ্বস্ত বংশধরের জন্য তিনি প্রেমের সঙ্গে অসারতার শেষ দেখার এবং ‘ঈশ্বরের সন্তানগণের প্রতাপের স্বাধীনতায়’ আনন্দ করার জন্য ব্যবস্থা করেছেন। চিরকাল ধরে বিশ্বস্ত মানবজাতিকে আর কখনোই এই বিষয়ে উদ্বিগ্ন হতে হবে না যে, সমস্ত সৃষ্টি হয়তো আবারও অসারতার বেদনাদায়ক অবস্থার মধ্যে পড়ে যেতে পারে। যিহোবা বিষয়গুলোকে ন্যায্যভাবে মোকাবিলা করায় তা চিরকালের জন্য তাঁর সার্বভৌমত্বের সত্যতাকে প্রতিষ্ঠা করবে।—যিশাইয় ২৫:৮.
১৭. আজকে জগতে দুঃখকষ্টের কারণ সম্বন্ধে পুনরালোচনা করার মাধ্যমে কীভাবে আমাদের প্রভাবিত হওয়া উচিত?
১৭ মানুষের দুঃখকষ্টের এই কারণগুলো বিবেচনা করার সময় আমরা কি দুষ্টতার জন্য যিহোবাকে দোষ দেওয়ার বা তাঁর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলার কোনো কারণ খুঁজে পাই? এর বিপরীতে, এইরকম অধ্যয়ন আমাদেরকে মোশির এই কথাগুলোর সঙ্গে সুর মেলানোর কারণ জোগায়: “তিনি শৈল, তাঁহার কর্ম্ম সিদ্ধ, কেননা তাঁহার সমস্ত পথ ন্যায্য; তিনি বিশ্বাস্য ঈশ্বর, তাঁহাতে অন্যায় নাই; তিনিই ধর্ম্মময় ও সরল।” (দ্বিতীয় বিবরণ ৩২:৪) এই বিষয়গুলো নিয়ে ধ্যান করে আসুন আমরা সেগুলোর ওপর আমাদের বোধগম্যতাকে সময়ে সময়ে সতেজ করি। এভাবে, আমরা যখন পরীক্ষার মুখোমুখি হই, তখন শয়তান আমাদের মনের মধ্যে সন্দেহের যে-বীজ বপন করার প্রচেষ্টা করে, সেটার প্রতিরোধ করতে পারব। কিন্তু, শুরুতে উল্লেখিত দ্বিতীয় পদক্ষেপ সম্বন্ধে কী বলা যায়? যিহোবার ওপর নির্ভর করার সঙ্গে কী জড়িত?
যিহোবার ওপর নির্ভর করা বলতে যা বোঝায়
১৮, ১৯. কোন কথাগুলোর মাধ্যমে বাইবেল আমাদের যিহোবার ওপর নির্ভর করতে উৎসাহ দেয় কিন্তু এই বিষয়ে কারও কারও মধ্যে কোন ভুল ধারণাগুলো রয়েছে?
১৮ ঈশ্বরের বাক্য আমাদের পরামর্শ দেয়: “তুমি সমস্ত চিত্তে সদাপ্রভুতে বিশ্বাস কর [“যিহোবার ওপর নির্ভর কর,” NW]; তোমার নিজ বিবেচনায় নির্ভর করিও না; তোমার সমস্ত পথে তাঁহাকে স্বীকার কর; তাহাতে তিনি তোমার পথ সকল সরল করিবেন।” (হিতোপদেশ ৩:৫, ৬) এগুলো হল অপূর্ব, আশ্বাসজনক বাক্য। নিশ্চিতভাবেই, সমস্ত নিখিলবিশ্বে আমাদের প্রিয় স্বর্গীয় পিতার চেয়ে নির্ভরযোগ্য আর কেউই নেই। তা সত্ত্বেও, হিতোপদেশে লেখা কথাগুলো কাজে লাগানোর চেয়ে পড়া আরও বেশি সহজ।
১৯ যিহোবার ওপর নির্ভর করা বলতে যা বোঝায়, সেই সম্বন্ধে অনেকের মধ্যে বিভিন্ন ভুল ধারণা রয়েছে। কেউ কেউ এইরকম নির্ভরতাকে শুধুমাত্র এক অনুভূতি, এক ধরনের পরম আনন্দপূর্ণ আবেগ বলে মনে করে, যা হৃদয়ের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই জাগ্রত হয়। অন্যেরা এইরকম বিশ্বাস করে বলে মনে হয় যে, ঈশ্বরের ওপর নির্ভর করা বলতে বোঝায়, আমরা আশা করতে পারি যে তিনি আমাদের প্রতিটা অসুবিধা থেকে রক্ষা করবেন, আমাদের প্রতিটা সমস্যা সামাধান করবেন, রোজকার জীবনের প্রতিটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে আমরা যেভাবে চাই, সেভাবে সমাধান করবেন—আর তা সঙ্গে সঙ্গে! কিন্তু, এই ধরনের ধারণা ভিত্তিহীন। নির্ভর করা শুধুমাত্র অনুভূতির চেয়ে আরও বেশি কিছু এবং সেটা অবাস্তব নয়। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য, নির্ভর করার সঙ্গে সতর্কভাবে বিবেচিত, যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্তগুলো জড়িত।
২০, ২১. যিহোবার ওপর নির্ভর করার সঙ্গে কী জড়িত? উদাহরণের সাহায্যে ব্যাখ্যা করুন।
২০ হিতোপদেশ ৩:৫ পদ কী বলে, তা আবারও লক্ষ করুন। এটা যিহোবার ওপর নির্ভর করা ও আমাদের নিজ বিবেচনায় নির্ভর করার মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরে, আমাদের পরামর্শ দেয় যে আমরা দুটোই করতে পারি না। এর অর্থ কি এই যে, আমাদের নিজেদের বিবেচনা শক্তিকে কাজে লাগানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি? না, কারণ যিহোবা, যিনি আমাদের সেই শক্তি দিয়েছেন, তিনি চান যেন তাঁর সেবায় আমরা তা ব্যবহার করি। (রোমীয় ১২:১) কিন্তু, কিসের ওপর আমরা নির্ভর বা ভরসা করি? আমাদের চিন্তাভাবনা যদি যিহোবার সঙ্গে মিল রাখতে ব্যর্থ হয়, তা হলে আমরা কি তাঁর প্রজ্ঞাকে গ্রহণ করতে পারব, যা আমাদের চেয়েও অনেক অনেক শ্রেষ্ঠ? (যিশাইয় ৫৫:৮, ৯) যিহোবার ওপর নির্ভর করা বলতে বোঝায় যে, আমাদের চিন্তাভাবনাকে তাঁর চিন্তাধারার দ্বারা নির্দেশিত হতে দেওয়া।
২১ উদাহরণস্বরূপ: চিন্তা করুন যে, একটা ছোট্ট ছেলে গাড়ির পিছনের সিটে বসে রয়েছে এবং তার বাবামা সামনে রয়েছে। তার বাবা গাড়ি চালাচ্ছেন। যাত্রার সময় যখন বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়—সঠিক পথ নিয়ে সন্দেহ অথবা হতে পারে আবহাওয়া বা রাস্তার অবস্থার বিষয়ে কোনো সমস্যা—তখন এক বাধ্য ও নির্ভরযোগ্য সন্তান কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়? পিছনের সিট থেকে সে কি চিৎকার করে পরিচালনা দিয়ে তার বাবাকে বলে যে, কীভাবে গাড়ি চালাতে হয়? সে কি তার বাবামার সিন্ধান্ত নিয়ে সন্দেহ করে বা তাকে যখন সিট বেল্ট লাগিয়ে তার সিটে ভালভাবে বসার কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়, তখন বিরোধিতা করে? না, স্বাভাবিকভাবেই সে এই ধরনের বিষয়গুলো মোকাবিলা করার জন্য তার বাবামার ওপর নির্ভর করে, যদিও তারা অসিদ্ধ। যিহোবা হলেন আমাদের সিদ্ধ পিতা। আমাদের কি তাঁর ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা উচিত নয়, বিশেষ করে যখন আমরা কঠিন পরিস্থিতিগুলোর মুখোমুখি হই?—যিশাইয় ৩০:২১.
২২, ২৩. (ক) আমরা যখন সমস্যার মুখোমুখি হই, তখন কেন আমাদের যিহোবার ওপর নির্ভর করা উচিত এবং কীভাবে আমরা তা করতে পারি? (খ) পরের প্রবন্ধে কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে?
২২ কিন্তু হিতোপদেশ ৩:৬ পদ ইঙ্গিত দেয় যে, আমাদের ‘সমস্ত পথে যিহোবাকে স্বীকার করা’ উচিত, শুধুমাত্র যখন আমরা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হই, তখন নয়। তাই রোজ আমরা যে-সিদ্ধান্তগুলো নিই, সেগুলোতে যিহোবার ওপর আমাদের নির্ভরতাকে প্রতিফলিত করা উচিত। যখন সমস্যা দেখা দেয়, তখন আমাদের হতাশ ও আতঙ্কিত হওয়া বা সবচেয়ে ভালভাবে বিষয়গুলোর মোকাবিলা করার বিষয়ে যিহোবার নির্দেশনার বিরোধিতা করা উচিত নয়। পরীক্ষাগুলোকে আমাদের যিহোবার সার্বভৌমত্বকে সমর্থন করার, শয়তানকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে সাহায্য করার এবং বাধ্যতা ও ঈশ্বরকে খুশি করে এমন অন্যান্য গুণগুলো গড়ে তোলার সুযোগ হিসেবে দেখা উচিত।—ইব্রীয় ৫:৭, ৮.
২৩ আমরা যিহোবার ওপর নির্ভরতা দেখাতে পারি, তা সে যে-বাধাই আমাদের সামনে আসুক না কেন। আমরা তা দেখাতে পারি আমাদের প্রার্থনার এবং নির্দেশনার জন্য আমরা যিহোবার বাক্য ও তাঁর সংগঠনকে যেভাবে দেখে থাকি, সেটার দ্বারা। কিন্তু, নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, কীভাবে আমরা আজকের জগতে উত্থাপিত সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হওয়ার সময় যিহোবার ওপর নির্ভরতা দেখাতে পারি? আমাদের পরের প্রবন্ধ এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে।
[পাদটীকা]
a “অসারতার” জন্য পৌল যে-গ্রিক শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, সেই একই শব্দ গ্রিক সেপ্টুয়াজিন্ট-এ সেই অভিব্যক্তিটা অনুবাদ করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, যা শলোমন উপদেশকের বইয়ে বার বার “সকলই অসার,” এই অভিব্যক্তিটার মধ্যে ব্যবহার করেছেন। (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।)—উপদেশক ১:২, ১৪; ২:১১, ১৭; ৩:১৯; ১২:৮.
আপনি কীভাবে উত্তর দেবেন?
• কীভাবে দায়ূদ দেখিয়েছিলেন যে, তিনি যিহোবাকে তার আস্থা করে তুলেছিলেন?
• আজকে মানুষের দুঃখকষ্ট ভোগের পিছনে তিনটে কারণ কী এবং কেন সেগুলো সময়ে সময়ে পুনরালোচনা করা ভাল?
• মানবজাতির ওপর যিহোবা কোন শাস্তি ঘোষণা করেছিলেন এবং কেন সেটা ন্যায্য শাস্তি ছিল?
• যিহোবার ওপর নির্ভর করার সঙ্গে কী জড়িত?
[৮ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
দায়ূদ যিহোবাকে তার আস্থা করে তুলেছিলেন
[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]
যিশু দেখিয়েছিলেন যে, যিরূশালেমের একটা উচ্চগৃহ যখন ভেঙে পড়েছিল, সেটার জন্য যিহোবা দায়ী ছিলেন না