তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন
তিনি “সদাপ্রভুর সাক্ষাতে বাড়িয়া উঠিতে লাগিলেন”
শমূয়েল তার লোকেদের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। সেই জাতি গিল্গল নগরে সমবেত হয়েছিল, যাদেরকে এই বিশ্বস্ত ব্যক্তি আহ্বান করেছিলেন, যিনি দশকের পর দশক ধরে ভাববাদী ও বিচারকর্তা হিসেবে সেবা করেছেন। সময়টা ছিল আমাদের আধুনিক ক্যালেন্ডারের মে অথবা জুন মাস; ইতিমধ্যেই শুষ্ক মরসুম শুরু হয়ে গিয়েছিল। ক্ষেত্রের গোম ইতিমধ্যেই পেকে গিয়েছিল। জনতা নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কীভাবে শমূয়েল তাদের হৃদয়ে পৌঁছাতে পারেন?
লোকেরা বুঝতে পারেনি যে, তাদের পরিস্থিতি কতটা গুরুতর ছিল। তাদের ওপর শাসন করার জন্য একজন মানব রাজা থাকার বিষয়ে তারা জোরাজুরি করেছিল। তারা উপলব্ধি করতে পারেনি যে, তারা তাদের ঈশ্বর যিহোবা ও তাঁর ভাববাদীর প্রতি চরম অসম্মান দেখিয়েছে। বস্তুত, তারা তাদের রাজা হিসেবে যিহোবাকে প্রত্যাখ্যান করছিল! অনুতপ্ত হওয়ার জন্য শমূয়েল কীভাবে তাদেরকে অনুপ্রাণিত করতে পারেন?
শমূয়েল কথা বলেছিলেন। “আমি বৃদ্ধ ও পক্বকেশ হইয়াছি,” তিনি সেই জনতাকে বলেছিলেন। তার পক্বকেশ এই কথাগুলোকে আরও বেশি মূল্যবান করে তুলেছিল। এরপর তিনি বলেছিলেন: “আমি বাল্যকাল অবধি অদ্য পর্য্যন্ত তোমাদের সম্মুখে গমনাগমন করিয়া আসিতেছি।” (১ শমূয়েল ১১:১৪, ১৫; ১২:২) যদিও শমূয়েল বৃদ্ধ ছিলেন কিন্তু তিনি তার বাল্যকালকে ভুলে যাননি। তার সেই ছোটোবেলার স্মৃতিগুলো তখনও স্পষ্ট ছিল। বড়ো হয়ে উঠতে থাকা একটা বালক হিসেবে, সেই সময়ে তিনি যে-সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিলেন, সেগুলো তাকে তার ঈশ্বর যিহোবার প্রতি বিশ্বাস ও ভক্তির এক জীবনের দিকে পরিচালিত করেছিল।
বার বার, শমূয়েলকে বিশ্বাস গড়ে তুলতে ও বজায় রাখতে হয়েছিল, যদিও তিনি অবিশ্বস্ত ও আনুগত্যহীন লোকেদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন। আজকেও, বিশ্বাস গড়ে তোলা ততখানি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক যেহেতু আমরা অবিশ্বস্ত ও কলুষিত এক জগতে বাস করছি। তাই আসুন আমরা বিবেচনা করি যে, একেবারে তার ছেলেবেলা থেকে শুরু করে, শমূয়েলের উদাহরণ থেকে আমরা কী শিখতে পারি।
‘বালক শমূয়েল সদাপ্রভুর সম্মুখে
পরিচর্য্যা করিতেন’
শমূয়েলের ছেলেবেলাটা ছিল অস্বাভাবিক। স্তন্যপান ত্যাগ করার অল্পদিন পরেই, সম্ভবত চার বছরের কাছাকাছি বয়সে, তিনি রামাতে তার বাড়ি থেকে ৩০ কিলোমিটারের বেশি দূরে শীলোতে যিহোবার পবিত্র আবাসে সেবা করার এক জীবন শুরু করেছিলেন। তার বাবা-মা, ইল্কানা ও হান্না তাদের ছেলেকে সারাজীবনের জন্য একজন নাসরীয় হিসেবে যিহোবার কাছে এক বিশেষ ধরনের সেবার উদ্দেশে উৎসর্গ করেছিলেন।a এর মানে কি এই যে, শমূয়েলকে পরিত্যক্ত করা হয়েছিল ও তার বাবা-মা তাকে ভালোবাসত না?
না, তা নয়! তারা জানত যে, শীলোতে তাদের ছেলের যত্ন নেওয়া হবে। নিঃসন্দেহে, মহাযাজক এলি বিষয়গুলোকে তত্ত্বাবধান করেছিলেন, কারণ শমূয়েল তার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন। এ ছাড়া, বেশ কিছু স্ত্রীলোক ছিল, যারা স্পষ্টতই সংগঠিতভাবে আবাসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কিছু বিষয়ে কাজ করত।—১ শমূয়েল ২:২২.
অধিকন্তু, হান্না ও ইল্কানা কখনোই তাদের প্রিয় প্রথমজাতকে ভুলে যায়নি, যার জন্মই ছিল একটা প্রার্থনার উত্তর। হান্না ঈশ্বরের কাছে একটা ছেলের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন ও প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি সেই ছেলেকে পবিত্র সেবার এক জীবনের জন্য ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করবেন। প্রত্যেক বছর পরিদর্শন করার সময়, হান্না শমূয়েলের জন্য একটা নতুন হাতকাটা জামা নিয়ে আসতেন, যেটা তিনি আবাসে সেবা করার জন্য তার জন্য বানাতেন। নিশ্চিতভাবেই এই ছোট্ট ছেলেটি সেই পরিদর্শনগুলোকে মূল্যবান বলে মনে করত। সেই অদ্বিতীয় স্থানে যিহোবাকে সেবা করা যে কী এক বিশেষ সুযোগ, এই বিষয়ে তাকে তার বাবা-মা শিক্ষা দেওয়ার সময়, নিঃসন্দেহে তাদের সেই প্রেমময় উৎসাহ ও নির্দেশনায় তিনি উন্নতি লাভ করেছিলেন।
হান্না ও ইল্কানার কাছ থেকে বাবা-মারা আজকে অনেক কিছু শিখতে পারে। সন্তান প্রতিপালন করার ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক প্রয়োজনগুলোকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র বস্তুগত বিষয়গুলোর ওপর তাদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে কেন্দ্রীভূত করা বাবা-মাদের জন্য সাধারণ বিষয়। কিন্তু শমূয়েলের বাবা-মা আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোকে প্রথম স্থান দিয়েছিল আর তা তাদের ছেলে যে-ধরনের ব্যক্তি হিসেবে বড়ো হয়ে উঠেছিল, সেটার ওপর বিরাট প্রভাব ফেলেছিল।—হিতোপদেশ ২২:৬.
আমরা কল্পনা করতে পারি যে, ছেলেটি আরও বড়ো হয়ে উঠছেন আর শীলোর চারদিকে অবস্থিত পাহাড়-পর্বতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নীচে নগর এবং এর একদিকে বিস্তৃত উপত্যকার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার সময়, যিহোবার আবাস দেখে খুব সম্ভবত তার হৃদয় আনন্দ ও গর্বে ভরে উঠেছে। সেই আবাস বাস্তবিকই এক পবিত্র স্থান ছিল।b প্রায় ৪০০ বছর আগে স্বয়ং মোশির নির্দেশনায় নির্মিত এই আবাস, সমস্ত পৃথিবীতে যিহোবার বিশুদ্ধ উপাসনার জন্য একমাত্র কেন্দ্রস্থল ছিল।
ছোট্ট শমূয়েলের আবাসের প্রতি ভালোবাসা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরে তিনি যে-বিবরণ লিখেছিলেন, সেখানে আমরা পড়ি: “বালক শমূয়েল মসীনা-সূত্রের এফোদ পরিহিত হইয়া সদাপ্রভুর সম্মুখে পরিচর্য্যা করিতেন।” (১ শমূয়েল ২:১৮) সেই সাধারণ হাতকাটা জামা স্পষ্টতই শমূয়েল যে আবাসে যাজকদেরকে সাহায্য করতেন সেটার একটা চিহ্ন ছিল। যদিও যাজক শ্রেণীর নন, তবুও শমূয়েল সেই কাজগুলো করতেন যেগুলোর মধ্যে সকালে আবাস প্রাঙ্গণের দরজাগুলো খোলা ও বয়স্ক এলির পরিচর্যা করা অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু, যত বেশি করে তিনি বিশেষ সুযোগগুলো উপভোগ করতে থাকেন, পরবর্তী সময়ে তার সহজ-সরল হৃদয় ততই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল। যিহোবার গৃহে ভয়ানক কিছু ঘটছিল।
কলুষতার মুখোমুখি হওয়ার সময় শুদ্ধ থাকা
অল্প বয়সেই, শমূয়েল প্রকৃত দুষ্টতা ও কলুষতা দেখেছিলেন। হফ্নি ও পীনহস নামে এলির দুই ছেলে ছিল। শমূয়েলের বিবরণ জানায়: “এলির দুই পুত্ত্র পাষণ্ড ছিল, তাহারা সদাপ্রভুকে জানিত না।” (১ শমূয়েল ২:১২) এই পদে চিন্তাধারা দুটো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মূল ইব্রীয় ভাষায় এই পদে “পাষণ্ড” বলে অনুবাদিত শব্দটিকে আক্ষরিকভাবে “অপদার্থ সন্তান” হিসেবেও অনুবাদ করা যেতে পারে। আর এটা হফ্নি ও পীনহস সম্বন্ধে এক উপযুক্ত বর্ণনা কারণ যিহোবার প্রতি তাদের কোনো সম্মানই ছিল না। তারা তাঁর ধার্মিক মান এবং চাহিদাগুলো সম্বন্ধে কোনোরকম চিন্তাই করত না। সেটাই ছিল তাদের অন্য সমস্ত পাপের কারণ।
যাজকদের কাজকর্ম এবং তাঁর আবাসে তাদেরকে যেভাবে বলি উৎসর্গ করতে হতো, সেই বিষয়ে ঈশ্বরের ব্যবস্থা নির্দিষ্টভাবে জানিয়েছিল। তা উপযুক্ত কারণেই! সেই বলিদানগুলো পাপ সকল ক্ষমা করার জন্য ঈশ্বরের আয়োজনগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করত, যাতে লোকেরা তাঁর দৃষ্টিতে শুদ্ধ থাকতে, তাঁর আশীর্বাদ ও নির্দেশনা লাভের জন্য উপযোগী হতে পারে। কিন্তু হফ্নি ও পীনহস তাদের সহযাজকদেরকে সেই উৎসর্গগুলো অত্যন্ত অসম্মানের সঙ্গে ব্যবহার করতে পরিচালিত করেছিল।c
কল্পনা করুন যে, কোনোরকম সংশোধন ছাড়াই চলতে থাকা এই ধরনের গুরুতর অন্যায় কাজগুলোকে ছোট্ট শমূয়েল বড়ো বড়ো চোখ করে দেখছেন। দরিদ্র, সাধারণ, নিপীড়িত ব্যক্তিসহ কতজনকে তিনি কেবল হতাশ হয়ে, আঘাত পেয়ে অথবা অপমানিত হয়ে ফিরে যেতে দেখেছিলেন, যারা কিছুটা আধ্যাত্মিক সান্ত্বনা ও শক্তি খুঁজে পাওয়ার আশায় পবিত্র আবাসে এসেছিল? আর যখন তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, হফ্নি ও পীনহসও আবাসে সেবারত কিছু স্ত্রীলোকের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলার দ্বারা যৌন নৈতিকতা সম্বন্ধীয় যিহোবার আইনগুলোকে অসম্মান করেছিল, তখন তিনি কেমন বোধ করেছিলেন? (১ শমূয়েল ২:২২) খুব সম্ভবত তিনি আশা করেছিলেন যে, এলি এই বিষয়ে কিছু করবেন।
বৃদ্ধিরত এই সমস্যাকে সংশোধন করার জন্য এলিই সবচেয়ে ভালো অবস্থায় ছিলেন। আবাসে যা ঘটছিল, সেটার জন্য মহাযাজক হিসেবে তিনি দায়বদ্ধ ছিলেন। একজন বাবা হিসেবে সন্তানদের সংশোধন করার বাধ্যবাধকতা তার ছিল। সর্বোপরি, তারা নিজেদের ও সেইসঙ্গে দেশের অগণিত লোকেদেরকেও দুঃখ দিয়েছিল। কিন্তু, এলি একজন বাবা ও একজন মহাযাজক হিসেবে, উভয় ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি তার ছেলেদেরকে শুধুমাত্র মৃদু ভর্ৎসনা করেছিলেন। (১ শমূয়েল ২:২৩-২৫) কিন্তু তার ছেলেদের আরও কঠোর শাসনের প্রয়োজন ছিল। তারা মৃত্যুর যোগ্য পাপ করছিল!
বিষয়গুলো এতদূর পর্যন্ত গিয়েছিল যে, যিহোবা বিচারের এক কঠোর বার্তাসহ “ঈশ্বরের এক জন লোক” অর্থাৎ নাম না জানা একজন ভাববাদীকে এলির কাছে পাঠিয়েছিলেন। যিহোবা এলিকে বলেছিলেন: “তুমি . . . আমা অপেক্ষা আপন পুত্ত্রদিগকে অধিক গৌরবান্বিত করিতেছ।” তাই ঈশ্বর ভাববাণী করেছিলেন যে, এলির দুষ্ট ছেলেরা একই দিনে মারা যাবে এবং এলির কুল খুবই কষ্ট ভোগ করবে, এমনকী যাজক শ্রেণীর বিশেষ সুযোগপ্রাপ্ত পদ হারাবে। এই জোরালো সতর্কবাণী কি সেই পরিবারের জন্য কোনো পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল? হৃদয়ের এই ধরনের পরিবর্তনের বিষয়ে বিবরণ কোনো কিছু জানায় না।—১ শমূয়েল ২:২৭–৩:১.
কীভাবে এই সমস্ত কলুষতা ছোট্ট শমূয়েলকে প্রভাবিত করেছিল? মাঝে মাঝে এই দুঃখজনক বিবরণে আমরা কিছু উজ্জ্বল আলোর ছটা দেখতে পাই আর তা হল শমূয়েলের বেড়ে ওঠা ও উন্নতি করা সম্বন্ধীয় সুসংবাদ। স্মরণ করুন যে, ১ শমূয়েল ২:১৮ পদে আমরা পড়ি যে, বিশ্বস্তভাবে ‘বালক শমূয়েল সদাপ্রভুর সম্মুখে পরিচর্য্যা করিতেন।’ এমনকী সেই অল্পবয়স থেকেই, শমূয়েল ঈশ্বরের প্রতি সেবায় তার জীবনকে কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। একই অধ্যায়ের ২১ পদে আমরা এমনকী আরও হৃদয়গ্রাহী কিছু পড়ি: “বালক শমূয়েল সদাপ্রভুর সাক্ষাতে বাড়িয়া উঠিতে লাগিলেন।” তিনি যতই বড়ো হতে থাকেন, তাঁর স্বর্গীয় পিতার সঙ্গে তার বন্ধন ততই দৃঢ় হতে থাকে। যিহোবার সঙ্গে এই ধরনের এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক হল, যেকোনো ধরনের কলুষতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে নিশ্চিত সুরক্ষা।
শমূয়েলের জন্য এই বলে যুক্তি করা সহজ হতো যে, মহাযাজক ও তার ছেলেরা যদি পাপের কাছে নতিস্বীকার করতে পারে, তাহলে তিনিও হয়তো যা খুশি তা করতে পারেন। কিন্তু কর্তৃত্বের পদে থাকা ব্যক্তিরাসহ অন্যদের কলুষতা, কখনোই পাপ করার এক অজুহাত নয়। আজকে, অল্পবয়সি অনেক খ্রিস্টান শমূয়েলের উদাহরণ অনুসরণ করে এবং ‘সদাপ্রভুর সাক্ষাতে বাড়িয়া উঠে’—এমনকী যখন তাদের চারপাশে থাকা কেউ কেউ উত্তম উদাহরণ স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়।
কীভাবে এই ধরনের এক জীবনধারা শমূয়েলের জন্য ভালো ফল নিয়ে এসেছিল? আমরা পড়ি: “কিন্তু বালক শমূয়েল উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাইয়া সদাপ্রভুর কাছে ও মনুষ্যদের কাছে অনুগ্রহ প্রাপ্ত হইতেন।” (১ শমূয়েল ২:২৬) তাই অন্তত এমন কিছু জন শমূয়েলকে খুব পছন্দ করত, যাদের মতামত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার বিশ্বস্ত জীবনধারার জন্য স্বয়ং যিহোবা এই ছেলেটিকে মূল্যবান বলে গণ্য করেছিলেন। আর নিশ্চিতভাবে শমূয়েল জানতেন যে, তার ঈশ্বর শীলোতে চলতে থাকা সমস্ত মন্দতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবেন কিন্তু সম্ভবত তিনি ভাবছিলেন যে, কখন।
“বলুন, আপনার দাস শুনিতেছে”
একদিন রাতে, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া গিয়েছিল। সকাল হতে চলেছিল কিন্তু তখনও অন্ধকার; তাঁবুর বড়ো বাতির আলো তখনও টিমটিম করে জ্বলছিল। সেই নিস্তব্ধতায় শমূয়েল এক কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন, যেটা তার নাম ধরে ডাকছিল। তিনি মনে করেছিলেন যে, এটা ছিল এলির কণ্ঠস্বর, যিনি তখন খুবই বৃদ্ধ ছিলেন ও চোখে ভালো করে দেখতে পারতেন না। শমূয়েল উঠে সেই বৃদ্ধ ব্যক্তির কাছে ‘দৌড়িয়া গিয়াছিলেন।’ আপনি কি আপনার মনের চোখ দিয়ে কল্পনা করতে পারেন যে, ছেলেটি এলির কী প্রয়োজন তা দেখার জন্য খালি পায়ে তার কাছে দৌড়ে যাচ্ছে? এটা দেখা হৃদয়স্পর্শী যে, শমূয়েল সম্মান ও সদয়তাপূর্বক এলির সঙ্গে আচরণ করতেন। তার সমস্ত পাপ সত্ত্বেও, এলি তখনও যিহোবার মহাযাজক ছিলেন।—১ শমূয়েল ৩:২-৫.
শমূয়েল এই বলে এলিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন: “এই যে আমি; আপনি ত আমাকে ডাকিয়াছেন।” কিন্তু এলি বলেছিলেন যে, তিনি তাকে ডাকেননি আর তাই তিনি ছেলেটিকে আবার ঘুমাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। একই ঘটনা বার বার ঘটেছিল! পরিশেষে, এলি বুঝতে পেরেছিলেন যে, কী ঘটছে। যিহোবা তাঁর লোকেদের কাছে খুবই কম দর্শন দিতেন অথবা ভবিষ্যদ্বাণীমূলক বার্তা পাঠাতেন আর কেন, তা বোঝা কঠিন নয়। কিন্তু এলি বুঝতে পেরেছিলেন যে, যিহোবা আবারও কথা বলছেন—এবার এই ছেলেটির সঙ্গে! এলি শমূয়েলকে আবারও ঘুমাতে যেতে বলেছিলেন আর কীভাবে উপযুক্তরূপে উত্তর দেওয়া যায়, সেই বিষয়ে তাকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। শমূয়েল সেটার বাধ্য হয়েছিলেন। শীঘ্র তিনি সেই কণ্ঠস্বরের ডাক শুনতে পেয়েছিলেন: “শমূয়েল, শমূয়েল!” ছেলেটি উত্তর দিয়েছিল: “বলুন, আপনার দাস শুনিতেছে।”—১ শমূয়েল ৩:১, ৫-১০.
অবশেষে, শীলোতে যিহোবার এমন একজন দাস রয়েছেন, যিনি তাঁর কথা শুনছিলেন। সেটাই শমূয়েলের জীবনধারা হয়ে উঠেছিল। এটা কি আপনারও জীবনধারা? রাতে আমাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য কোনো অতিপ্রাকৃতিক কণ্ঠস্বরের জন্য আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হয় না। আজকে, এক অর্থে সবসময়ই আমরা ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। তাঁর সম্পূর্ণ বাক্য বাইবেলে তা শুনতে পাওয়া যায়। আমরা যত বেশি ঈশ্বরের কথা শুনব ও সাড়া দেব, আমাদের বিশ্বাস তত বেশি বৃদ্ধি পাবে। শমূয়েলের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছিল।
শীলোতে সেই রাতটা ছিল শমূয়েলের জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ তখন থেকেই তিনি যিহোবাকে এক বিশেষ অর্থে জানতে শুরু করেছিলেন অর্থাৎ তিনি ঈশ্বরের নিজস্ব ভাববাদী এবং মুখপাত্র হয়েছিলেন। প্রথমে, ছেলেটি এলির কাছে যিহোবার বার্তা জানাতে ভয় পেয়েছিলেন, কারণ এটা ছিল শেষ ঘোষণা যে, সেই কুলের বিরুদ্ধে বলা ভবিষ্যদ্বাণীটি শীঘ্র পূর্ণ হতে যাচ্ছিল। কিন্তু শমূয়েল সাহস সঞ্চয় করেছিলেন—আর এলি নম্রভাবে ঐশিক বিচারকে মেনে নিয়েছিলেন। খুব শীঘ্র, যিহোবা যা-কিছু বলেছিলেন, সমস্তই পূর্ণ হয়েছিল। ইস্রায়েল পলেষ্টীয়দের সঙ্গে যুদ্ধে গিয়েছিল আর হফ্নি ও পীনহস একই দিনে হত হয়েছিল। যিহোবার পবিত্র সিন্দুক হস্তগত হয়েছে এই কথা শুনে এলি মারা গিয়েছিলেন।—১ শমূয়েল ৩:১০-১৮; ৪:১-১৮.
কিন্তু, একজন বিশ্বস্ত ভাববাদী হিসেবে শমূয়েলের সুনাম কেবল বৃদ্ধি পেতে থাকে। “সদাপ্রভু তাঁহার সহবর্ত্তী ছিলেন,” বিবরণ বলে আর এও বলে যে, শমূয়েলের ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর কোনোটাকেই তিনি ব্যর্থ হতে দেননি।—১ শমূয়েল ৩:১৯.
‘শমূয়েল সদাপ্রভুকে ডাকিলেন’
কিন্তু এর অর্থ কি এই ছিল যে, ইস্রায়েলীয়রা শমূয়েলের নেতৃত্বকে মেনে নিয়েছিল এবং আধ্যাত্মিক, বিশ্বস্ত লোক হয়ে উঠেছিল? না। পরে, তারা স্থির করেছিল যে, তাদের বিচার করার জন্য তারা সামান্য একজন ভাববাদীকে চায় না। তারা অন্যান্য জাতির মতো হতে চেয়েছিল আর এও চেয়েছিল যে, একজন মানব রাজা যেন তাদের ওপর শাসন করেন। যিহোবার নির্দেশনায় শমূয়েল তাদের সেই অনুরোধ মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু ইস্রায়েলীয়দেরকে তাকে দেখাতে হয়েছিল যে, তাদের পাপ কতখানি গুরুতর ছিল। তারা সামান্য একজন মানুষকে নয় কিন্তু স্বয়ং যিহোবাকেই প্রত্যাখ্যান করছিল! তাই তিনি লোকেদেরকে গিল্গলে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
আসুন আমরা গিল্গলে ইস্রায়েলের উদ্দেশে কথা বলার সেই উত্তেজনাকর মুহূর্তে তার সঙ্গে আবারও যোগ দিই। সেখানে বয়স্ক শমূয়েল নীতিনিষ্ঠা সম্বন্ধীয় তার বিশ্বস্ত নথির বিষয়ে ইস্রায়েলকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর আমরা পড়ি: ‘শমূয়েল সদাপ্রভুকে ডাকিলেন।’ তিনি যিহোবার কাছে বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেছিলেন।—১ শমূয়েল ১২:১৭, ১৮.
বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টি? এই শুষ্ক মরসুমে? এই ধরনের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি! লোকেদের মধ্যে যদি কোনো সন্দেহ বা উপহাসের কোনো লেশমাত্রও থেকে ছিল, তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। হঠাৎ-ই আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিল। ঝড় ক্ষেত্রের গোম নষ্ট করে দিয়েছিল। কানে তালা লাগার মতো শব্দে বজ্রপাত হয়েছিল। এরপর বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছিল। লোকেরা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল? ‘লোকেরা সদাপ্রভু হইতে ও শমূয়েল হইতে অতিশয় ভীত হইয়াছিল।’ পরিশেষে তারা বুঝতে পেরেছিল যে, তারা কতটা গুরুতর পাপ করেছিল।—১ শমূয়েল ১২:১৮, ১৯.
শমূয়েল নন কিন্তু তার ঈশ্বর যিহোবা তাদের বিদ্রোহী হৃদয়ে পৌঁছেছিলেন। বাল্যকাল থেকে তার বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত, শমূয়েল তার ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন। আর যিহোবা তাকে পুরস্কৃত করেছিলেন। আজও, যিহোবা পরিবর্তিত হননি। শমূয়েলের বিশ্বাসকে যারা অনুকরণ করে, তিনি এখনও তাদের সমর্থন করেন। (w১০-E ১০/০১)
[পাদটীকাগুলো]
a নাসরীয়রা এমন একটা মানতের অধীনে ছিল, যেটার মধ্যে মদ্যপান করা এবং তাদের চুল কাটা অথবা দাড়ি কামানো সম্বন্ধীয় এক নিষেধাজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত ছিল। অধিকাংশ কেবল একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই এই মানত করেছিল কিন্তু কিছু জন যেমন, শিম্শোন, শমূয়েল এবং যোহন বাপ্তাইজক সারাজীবনের জন্য নাসরীয় হয়েছিল।
b আবাসটি ছিল আয়তাকার, মূলত কাঠের কাঠামো দিয়ে তৈরি এক বিরাট তাঁবু। কিন্তু, এটা সবচেয়ে সুন্দর সুন্দর জিনিস—সীলের চামড়া, সুন্দর কারুকার্যবিশিষ্ট কাপড়, রুপো ও সোনা দিয়ে মোড়া দামি কাঠ—দিয়ে নির্মিত। আবাসটি এক আয়তাকার প্রাঙ্গণের মধ্যে অবস্থিত ছিল, যেটার মধ্যে বলি উৎসর্গ করার জন্য একটা চাকচিক্যবিশিষ্ট বেদি ছিল। সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, যাজকদের ব্যবহারের জন্য আবাস সংলগ্ন স্থানগুলোতে স্পষ্টতই অন্যান্য কুঠরি নির্মাণ করা হয়েছিল। মনে হয় যে, শমূয়েল এইরকম একটা কুঠরিতে ঘুমাতেন।
c এই বিবরণ অসম্মান সম্বন্ধে দুটো উদাহরণ জোগায়। একটা বিষয় হল যে, ব্যবস্থা নির্দিষ্টভাবে জানিয়েছিল যে, উৎসর্গীকৃত বলির কোন অংশগুলো খাওয়ার জন্য যাজকদেরকে দিতে হবে। (দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:৩) কিন্তু আবাসে সেই দুষ্ট যাজকরা একেবারে ভিন্ন এক রীতি স্থাপন করেছিল। তারা তাদের চাকরদের, যে-কড়াইতে মাংস সেদ্ধ করা হতো তাতে একটা শূল গেঁথে সেখান থেকে যেকোনো ভালো টুকরো উঠত, সেটা নিতে বলত। আরেকটা বিষয় হল যে, লোকেরা যখন বেদিতে পোড়ানোর জন্য তাদের বলিগুলো নিয়ে আসত, তখন দুষ্ট যাজকদের একজন চাকর সেই উৎসর্গকারীকে ভয় দেখাত আর এমনকী যিহোবার উদ্দেশে সেই মেদ উৎসর্গ করার আগেই সেই কাঁচা মাংস দাবি করত।—লেবীয় পুস্তক ৩:৩-৫; ১ শমূয়েল ২:১৩-১৭.
[১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
তার ভয় সত্ত্বেও, শমূয়েল বিশ্বস্তভাবে এলির কাছে যিহোবার বিচার বার্তা জানিয়েছিলেন
[১৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
শমূয়েল বিশ্বাস সহকারে প্রার্থনা করেছিলেন এবং যিহোবা বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টির দ্বারা সেটার উত্তর দিয়েছিলেন