বাইবেলের দৃষ্টিভঙ্গি
বন্ধুদের মধ্যে ধার দেওয়া-নেওয়া
“দুষ্ট ঋণ করিয়া পরিশোধ করে না, কিন্তু ধার্ম্মিক দয়াবান ও দানশীল।”—গীতসংহিতা ৩৭:২১.
“কাউকে ধার দেবেন না বা কারও কাছ থেকে ধার নেবেনও না; কারণ ধার দেওয়া-নেওয়া, টাকা ও বন্ধুত্ব দুটোই নষ্ট করে।” বিখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার উইলিয়াম শেকসপিয়ার যুগ যুগ পুরনো এই জ্ঞানের কথা আবারও বলেছিলেন। এটা ঠিক যে টাকা ধার দেওয়া বা নেওয়া খুবই হালকা ব্যাপার কিন্তু এতে সম্পর্কে ফাঁটল ধরতে পারে। যত ভাল পরিকল্পনাই করা হোক না কেন আর যত সৎ উদ্দেশ্যই থাকুক না কেন, পরিস্থিতি কখন বদলে যাবে আমরা কেউই তা জানি না।—উপদেশক ৯:১১, ১২.
কী বলা যায়, হয়ত এমন পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে যে যিনি টাকা ধার নিয়েছেন তার জন্য দেনা শোধ করা খুবই কঠিন বা একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাছাড়া, এমনও হতে পারে যে যিনি ধার দিয়েছেন তার হয়ত হঠাৎ করে টাকার দরকার হয়ে পড়ল। এইরকম অবস্থা যদি আসে, তাহলে শেকসপিয়ারের কথার মতো বন্ধুত্ব ও সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।
হতে পারে যে একজন ব্যক্তি সংগত কারণেই টাকা ধার নিয়েছেন। কোন বড় দুর্ঘটনা কিংবা চাকরি চলে যাওয়ায় তার হয়ত টাকার দরকার আর তখন ধার করা ছাড়া তার আর কোন পথ থাকে না। সামর্থ্য থাকলে বাইবেল অভাবী লোকদেরকে সাহায্য করার জন্য উৎসাহ দেয়। (হিতোপদেশ ৩:২৭) তা হয়ত টাকা ধার দিয়েও করা যেতে পারে। কিন্তু, খ্রীষ্টানেরা যদি এইরকম লেনদেন করেন তখন তাদের কোন্ বিষয়টা মনে রাখা উচিত?
যে নীতিগুলো বিবেচনা করা দরকার
বাইবেল টাকাপয়সা সংক্রান্ত নিয়মের কোন বই নয়। টাকা ধার দেওয়া-নেওয়ার সঙ্গে জড়িত বিষয়গুলো নিয়ে বিশদ বর্ণনা এখানে নেই। সুদ নেওয়া হবে কি না কিংবা নিলেও কত টাকা সুদ নেওয়া হবে এসব ব্যাপারগুলো যারা ধার দেন বা নেন তাদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।a কিন্তু, বাইবেলে এমন কিছু স্পষ্ট ও প্রেমপূর্ণ নীতি পাওয়া যায় যা, দেনাদার অথবা পাওনাদারদের মাথায় রাখা দরকার ও তারপর সেই মতো কাজ করা দরকার।
কিছু নীতি দেখুন যেগুলো এমন ব্যক্তির বেলায় খাটে যিনি টাকা ধার নেন। প্রেরিত পৌল খ্রীষ্টানদের পরামর্শ দিয়েছিলেন “তোমরা কাহারও কিছুই ধারিও না, কেবল পরস্পর প্রেম ধারিও।” (রোমীয় ১৩:৮) পৌল যদিও এখানে সবার জন্য কাজে লাগে এমন এক নীতির কথা বলেছিলেন, তবুও তার পরামর্শ এক সাবধানবাণী হিসেবে নেওয়া যেতে পারে যেন আমরা ধার করার ফাঁদে না পড়ে যাই। মাঝে মাঝে কারও কাছ থেকে ধার না করেই যদি চলে যায় তাহলে সেটা করাই ভাল। কেন? হিতোপদেশ ২২:৭ পদ বলে যে “ঋণী মহাজনের দাস হয়।” টাকা ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত ঋণীকে মনে রাখতে হয় যে তিনি এখনও কারও কাছে দায়বদ্ধ। আসলে বলা যায় যে তার সম্পত্তি পুরোপুরি তার নয়। চুক্তি মতো ধার শোধ করার জন্য তার সবরকম চেষ্টা করা উচিত তা না হলে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কেউ যদি সময় মতো টাকা শোধ না করেন তবে পাওনাদার রেগে যেতে পারেন। যিনি টাকা ধার নিয়েছেন তিনি যদি কাপড় কেনেন, রেঁস্তরায় খাবার খান কিংবা ছুটি কাটাতে যান, তাহলে ঋণদাতা তার ব্যাপারে কিছুটা সন্দেহ করতে পারেন। তার রাগ বেড়ে যেতে পারে। তাদের দুজনের ও এমনকি তাদের পরিবারের লোকেদের মধ্যেও সম্পর্ক খারাপ হয়ে যেতে পারে কিংবা তা নষ্টও হয়ে যেতে পারে। যিনি টাকা ধার নিয়েছেন তিনি যদি তার কথা না রাখেন, তবে এইরকম দুঃখজনক পরিণতি আসতে পারে।—মথি ৫:৩৭.
কিন্তু যদি হঠাৎ করে এমন কিছু ঘটে যাতে যিনি ধার নিয়েছেন তার কোন হাত ছিল না আর তাই তিনি তার চুক্তি মতো টাকা শোধ করতে পারছেন না, তাহলে কী বলা যায়? এর মানে কি তাকে আর ধার শোধ করতে হবে না? না। গীতরচক বলেন যে ধার্মিক ব্যক্তি “দিব্য করিলে ক্ষতি হইলেও অন্যথা করে না।” (গীতসংহিতা ১৫:৪) এমন অবস্থায়, যিনি টাকা ধার নিয়েছেন তার জন্য সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে তখনই তার পরিস্থিতি খোলাখুলিভাবে পাওনাদারকে বুঝিয়ে বলা। আর তা করলে প্রেম দেখানোও হবে। তারপর তারা দুপক্ষ মিলে কোন বিকল্প পথ বের করতে পারেন। এতে শান্তিও বজায় থাকবে আর যিহোবা ঈশ্বরও খুশি হবেন।—গীতসংহিতা ১৩৩:১; ২ করিন্থীয় ১৩:১১.
সত্যি বলতে কী, একজন ধারকে যেভাবে দেখেন তার থেকে সেই ব্যক্তির সম্বন্ধে অনেক অনেক কিছু জানা যায়। ধার শোধের ব্যাপারে গা-ছাড়া ভাব বোঝায় যে তিনি অন্যদের কথা ভাবেন না। আসলে, এরকম মনোভাব দেখিয়ে ব্যক্তি দেখান যে তিনি স্বার্থপর—তার আকাঙ্ক্ষা ও ইচ্ছাগুলোই তার কাছে আগে। (ফিলিপীয় ২:৪) কোন খ্রীষ্টান যদি ইচ্ছা করে ও জেনেশুনে ধার শোধ না করেন তবে তিনি ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ক্ষতি করেন আর তার কাজই বলে দেয় যে সে লোভী ও খারাপ লোক।—গীতসংহিতা ৩৭:২১.
যিনি ধার দেন
বেশিরভাগ দায়িত্বটা যদিও যিনি ধার করেন তার ওপর আসে, তবুও যিনি ধার দিচ্ছেন তার জন্যও কিছু নীতি রয়েছে। বাইবেল দেখায় যে অভাবী ব্যক্তিদের সাহায্য করার ক্ষমতা থাকলে আমাদের তা করা উচিত। (যাকোব ২:১৪-১৬) কিন্তু তার মানে এই নয় যে কেউ ধার চাইলেই, আমাদের তা দিতে হবে এমনকি যদি তিনি আমাদের কোন খ্রীষ্টান ভাইও হন। বাইবেল বলে, “সতর্ক লোক বিপদ দেখিয়া আপনাকে লুকায়।”—হিতোপদেশ ২২:৩.
টাকা লেনদেনের মধ্যে যে ফাঁদগুলো রয়েছে তা জেনে ও বুঝে একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি অনেক ভেবেচিন্তেই ধার দেবেন। তার ধার চাওয়ার কারণ কি সংগত? তিনি যে ধার নিচ্ছেন সে বিষয়ে কি তিনি মন দিয়ে ভেবে দেখেছেন? যিনি ধার নিচ্ছেন তিনি কি কথা দিয়ে কথা রাখেন এবং তার কি সুনাম আছে? তিনি কি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে রাজি আছেন? (যিরমিয় ৩২:৮-১৪ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।) তিনি কি সত্যিই ধার শোধ করতে পারবেন?
কিন্তু তার মানে এই নয় যে একজন খ্রীষ্টান কোন অভাবী ব্যক্তিকে ধার দেবেন না যাকে দেখে হয়ত বোঝা যায় যে তিনি টাকা শোধ করতে পারবেন না। অন্যদের জন্য একজন খ্রীষ্টানের যে ব্যক্তিগত দায়িত্ব তা টাকাপয়সা লেনদেনের চেয়েও আরও বেশি। প্রেরিত যোহন জিজ্ঞাসা করেন, “যাহার সাংসারিক জীবনোপায় আছে, সে আপন ভ্রাতাকে দীনহীন দেখিলে যদি তাহার প্রতি আপন করুণা রোধ করে, তবে ঈশ্বরের প্রেম কেমন করিয়া তাহার অন্তরে থাকে?” হ্যাঁ, খ্রীষ্টানদের অবশ্যই “বাক্যে কিম্বা জিহ্বাতে নয়, কিন্তু কার্য্যে ও সত্যে প্রেম” দেখাতে হবে।—১ যোহন ৩:১৭, ১৮.
কখনও কখনও একজন হয়ত কোন অভাবী ভাইকে টাকা ধার দেবেন না বলে ঠিক করতে পারেন। তিনি হয়ত তাকে টাকাটা উপহার হিসেবে দিয়ে বা অন্য কোনভাবে সাহায্য করতে চাইতে পারেন। এইরকমই যখন টাকা শোধ করায় সমস্যা দেখা দেয় তখন ঋণদাতা দয়া দেখাতে পারেন। তিনি হয়ত তার বদলে যাওয়া পরিস্থিতি দেখে তাকে ধার শোধ করার সময় কিছুটা বাড়িয়ে দিতে পারেন, ধারের পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে দিতে পারেন কিংবা পুরোপুরিভাবেই তাকে মুক্ত করে দিতে পারেন। এগুলো পুরোপুরিভাবে ব্যক্তির নিজের সিদ্ধান্ত যা শুধু সেই ব্যক্তিকেই নিতে হবে।
খ্রীষ্টানদের মনে রাখা উচিত যে ঈশ্বর সবকিছু দেখছেন আর আমরা কেমন আচরণ করি আর আমাদের সম্পত্তিকে কীভাবে কাজে লাগাই তার জন্য আমাদেরকে তাঁর কাছে নিকাশ দিতে হবে। (ইব্রীয় ৪:১৩) বাইবেল আমাদের উপদেশ দেয় আমাদের সব “কার্য্য প্রেমে হউক।” আর বাইবেলের এই উপদেশ বন্ধুদের মাঝে ধার দেওয়া-নেওয়ার বেলায়ও খাটে।—১ করিন্থীয় ১৬:১৪.
[পাদটীকাগুলো]
a সুদ নেওয়ার বিষয়ে আরও জানার জন্য ১৯৯১ সালের ১৫ই অক্টোবর সংখ্যার প্রহরীদুর্গ (ইংরেজি) এর ২৫-৮ পৃষ্ঠা দেখুন।
[১৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
“পোদ্দার ও তার স্ত্রী” (১৫১৪), কুনেটিন ম্যাসিস
[সজন্যে]
Scala/Art Resource, NY