অধ্যায় ২২
“যে প্রজ্ঞা উপর হইতে আইসে,” তা কি আপনার জীবনে সক্রিয়?
১-৩. (ক) মাতৃত্বের দাবি সংক্রান্ত বিবাদ নিষ্পত্তি করতে গিয়ে কীভাবে শলোমন অসাধারণ প্রজ্ঞা দেখিয়েছিলেন? (খ) যিহোবা আমাদের কী দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন আর এতে কোন প্রশ্নগুলো ওঠে?
এটা ছিল এক অত্যন্ত কঠিন মামলা—দুজন মহিলা একটা বাচ্চাকে নিয়ে তর্ক করছে। দুই মহিলা একই ঘরে থাকত ও মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে দুজনেই একটি করে পুত্র সন্তান জন্ম দেয়। একটা বাচ্চা মারা গেছে আর এখন দুই মহিলাই নিজেকে জীবিত বাচ্চার মা হিসেবে দাবি করে।a এই ঘটনার আর কোনো সাক্ষি ছিল না। এই মামলাটা হয়তো নিম্ন আদালতেও জানানো হয়েছিল কিন্তু মীমাংসা হয়নি। শেষ পর্যন্ত এই বিবাদ ইস্রায়েলের রাজা শলোমনের কাছে নিয়ে আসা হয়। তিনি কি প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করতে পারবেন?
২ মহিলাদের ঝগড়া কিছু সময় শোনার পর শলোমন একটা খড়্গ আনতে বলেন। এরপর, অত্যন্ত দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে তিনি আদেশ দেন যে, বাচ্চাটাকে দুটুকরো করে দুজনকে যেন অর্ধেক অর্ধেক দিয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে আসল মা রাজাকে অনুরোধ করেন বাচ্চাটাকে—তার অমূল্য শিশুকে—যেন অন্য মহিলাকে দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু অন্য মহিলা বলেই চলে যে, বাচ্চাটাকে যেন দুটুকরো করে ফেলা হয়। এখন শলোমন আসল সত্যটা বুঝতে পারেন। নিজের গর্ভজাত বাচ্চার প্রতি মায়ের কোমল সমবেদনা সম্বন্ধে তার জ্ঞান ছিল আর এই ঝগড়ার মীমাংসা করতে তিনি সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়েছিলেন। শলোমন যখন আসল মাকে বাচ্চাটা দিয়ে পুরস্কৃত করেন এবং বলেন যে, “ঐ উহার মাতা,” তখন মায়ের স্বস্তির কথা একটু কল্পনা করে দেখুন।—১ রাজাবলি ৩:১৬-২৭
৩ অসাধারণ প্রজ্ঞা, তাই নয় কি? লোকেরা যখন শোনে যে শলোমন মামলাটা কীভাবে নিষ্পত্তি করেছেন, তখন তাদের মধ্যে বিস্ময়াভিভূত ভয় জেগে উঠেছিল, “কেননা তাহারা দেখিতে পাইল, বিচার করণার্থে তাঁহার অন্তরে ঈশ্বরদত্ত জ্ঞান [“প্রজ্ঞা,” NW] আছে।” হ্যাঁ, শলোমনের প্রজ্ঞা ছিল ঈশ্বরের দেওয়া এক উপহার। যিহোবা তাকে “জ্ঞানশালী [“বিজ্ঞ,” NW] ও বুঝিবার চিত্ত” দিয়েছিলেন। (১ রাজাবলি ৩:১২, ২৮) কিন্তু আমাদের সম্বন্ধে কী বলা যায়? আমরাও কি ঈশ্বরীয় প্রজ্ঞা লাভ করতে পারি? পারি, কারণ অনুপ্রাণিত হয়ে শলোমন লিখেছিলেন: “সদাপ্রভুই প্রজ্ঞা দান করেন।” (হিতোপদেশ ২:৬) যারা আন্তরিকভাবে অন্বেষণ করে, তাদের যিহোবা প্রজ্ঞা দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন, যা হল জ্ঞান, বোধগম্যতা ও বিচক্ষণতাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করার ক্ষমতা। কীভাবে আমরা ওপর থেকে আসা প্রজ্ঞা উপার্জন করতে পারি? আর কীভাবে আমরা এটাকে আমাদের জীবনে সক্রিয় করতে পারি?
“প্রজ্ঞা উপার্জ্জন কর”—কীভাবে?
৪-৭. প্রজ্ঞা উপার্জন করার জন্য চারটে প্রয়োজনীয় বিষয় কী?
৪ ঈশ্বরীয় প্রজ্ঞা লাভ করার জন্য আমাদের কি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী বা উচ্চশিক্ষিত হতে হবে? না। আমাদের পটভূমি বা শিক্ষা যাই হোক না কেন, যিহোবা তাঁর প্রজ্ঞা আমাদের সঙ্গে বন্টন করতে ইচ্ছুক। (১ করিন্থীয় ১:২৬-২৯) কিন্তু, আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে কারণ বাইবেল আমাদের পরামর্শ দেয় “প্রজ্ঞা উপার্জ্জন কর।” (হিতোপদেশ ৪:৭) কীভাবে আমরা তা করতে পারি?
৫ প্রথমত, আমাদের ঈশ্বরকে ভয় করা দরকার। “সদাপ্রভুকে ভয় করাই প্রজ্ঞার আরম্ভ [“প্রজ্ঞার প্রথম ধাপ,” দ্যা নিউ ইংলিশ বাইবেল],” হিতোপদেশ ৯:১০ পদ বলে। ঈশ্বরের প্রতি ভয় হল প্রকৃত প্রজ্ঞার ভিত্তি। কেন? মনে করে দেখুন যে, প্রজ্ঞার সঙ্গে জ্ঞানকে সফলভাবে কাজে লাগানোর ক্ষমতা জড়িত। ঈশ্বরকে ভয় করা মানে তাঁর সামনে আতঙ্কিত হয়ে জড়সড় হয়ে পড়া নয় কিন্তু তাঁর সামনে সশ্রদ্ধ ভয়, সম্মান ও নির্ভরতা সহকারে নত হওয়া। এইরকম ভয় গঠনমূলক এবং অত্যন্ত প্রেরণাদায়ক। এটা আমাদের জীবনকে ঈশ্বরের ইচ্ছা ও তিনি যেভাবে কাজ করেন সেই সম্বন্ধীয় জ্ঞানের সঙ্গে মিল রেখে চলার জন্য প্রেরণা দেয়। গ্রহণ করার মতো এর চেয়ে বিজ্ঞ আর কোনো পথ নেই কারণ যিহোবার মানগুলো সবসময়ই সেই সমস্ত ব্যক্তিকে সর্বোত্তম উপকার করে, যারা সেগুলো মেনে চলে।
৬ দ্বিতীয়ত, আমাদের অবশ্যই নম্র এবং বিনয়ী হতে হবে। নম্রতা ও বিনয় ছাড়া ঈশ্বরীয় প্রজ্ঞার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। (হিতোপদেশ ১১:২) কেন? যদি আমরা নম্র ও বিনয়ী হই, তা হলে আমরা স্বেচ্ছায় স্বীকার করব যে, আমাদের কাছে সবকিছুর উত্তর নেই, আমাদের মতামত সবসময় সঠিক নয় এবং বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের যিহোবার মন জানা দরকার। যিহোবা “অহঙ্কারীদের প্রতিরোধ করেন” কিন্তু যারা হৃদয়ে নম্রমনা, তাদের তিনি প্রজ্ঞা দান করতে পেরে খুশি হন।—যাকোব ৪:৬.
প্রজ্ঞা উপার্জন করতে আমাদের অবশ্যই তা অন্বেষণ করার জন্য প্রচেষ্টা করতে হবে
৭ তৃতীয় অপরিহার্য বিষয়টা হল, ঈশ্বরের লিখিত বাক্য অধ্যয়ন করা। যিহোবার বাক্যে তাঁর প্রজ্ঞা প্রকাশ পায়। সেই প্রজ্ঞা উপার্জন করতে আমাদের অবশ্যই তা অন্বেষণ করার জন্য প্রচেষ্টা করতে হবে। (হিতোপদেশ ২:১-৫) চতুর্থ প্রয়োজনীয় বিষয়টা হল, প্রার্থনা। আমরা যদি আন্তরিকভাবে ঈশ্বরের কাছে প্রজ্ঞা চাই, তা হলে তিনি তা দেওয়ার ক্ষেত্রে উদার হবেন। (যাকোব ১:৫) তাঁর আত্মার সাহায্য চেয়ে আমাদের প্রার্থনা কখনও উত্তরহীন থাকবে না। আর তাঁর আত্মা আমাদের তাঁর বাক্যে ধন খুঁজে পেতে সক্ষম করবে, যা আমাদের সমস্যার সমাধান করতে, বিপদ প্রতিহত করতে এবং বিজ্ঞ সিদ্ধান্তগুলো নিতে সাহায্য করবে।—লূক ১১:১৩.
৮. আমরা যদি সত্যিই ঈশ্বরীয় প্রজ্ঞা উপার্জন করে থাকি, তা হলে কীভাবে তা স্পষ্ট হবে?
৮ সতেরো অধ্যায়ে আমরা যেমন লক্ষ করেছি যে, যিহোবার প্রজ্ঞা হল ব্যবহারিক। তাই, যদি আমরা সত্যিই ঈশ্বরীয় প্রজ্ঞা উপার্জন করে থাকি, তা হলে তা আমরা যেভাবে আচরণ করি তাতে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। শিষ্য যাকোব ঐশিক প্রজ্ঞার ফলগুলো সম্বন্ধে বর্ণনা করেছিলেন, যখন তিনি লিখেছিলেন: “যে জ্ঞান [“প্রজ্ঞা,” NW] উপর হইতে আইসে, তাহা প্রথমে শুচি, পরে শান্তিপ্রিয়, ক্ষান্ত [“যুক্তিযুক্ত,” NW], সহজে অনুনীত, দয়া [“করুণা,” NW] ও উত্তম উত্তম ফলে পরিপূর্ণ, ভেদাভেদবিহীন ও নিষ্কপট।” (যাকোব ৩:১৭) ঐশিক প্রজ্ঞার প্রত্যেকটা দিক নিয়ে আলোচনা করার সময় আমরা হয়তো নিজেদের জিজ্ঞেস করতে পারি, ‘ওপর থেকে আসা প্রজ্ঞা কি আমাদের জীবনে সক্রিয়?’
“শুচি, পরে শান্তিপ্রিয়”
৯. শুচি হওয়ার অর্থ কী এবং কেন এটা উপযুক্ত যে, প্রজ্ঞার তালিকায় শুচিতা সবচেয়ে প্রথমে রয়েছে?
৯ “প্রথমে শুচি।” শুচি হওয়ার অর্থ শুধুমাত্র বাহ্যিকভাবেই নয় কিন্তু ভিতরেও বিশুদ্ধ ও নিষ্কলঙ্ক থাকা। বাইবেল প্রজ্ঞাকে হৃদয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করে কিন্তু স্বর্গীয় প্রজ্ঞা একজনের হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারে না যদি তা মন্দ চিন্তা, আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দেশ্যগুলোর দ্বারা কলুষিত হয়। (হিতোপদেশ ২:১০; মথি ১৫:১৯, ২০) কিন্তু, আমাদের হৃদয় যদি শুচি হয়—অর্থাৎ অসিদ্ধ মানুষদের পক্ষে যতটা সম্ভব—তা হলে আমরা ‘মন্দ হইতে দূরে যাইব, সদাচরণ করিব।’ (গীতসংহিতা ৩৭:২৭; হিতোপদেশ ৩:৭) এটা কি উপযুক্ত নয় যে, শুচিতা হল প্রজ্ঞার গুণগুলোর তালিকায় সবচেয়ে প্রথম গুণ? সর্বোপরি, যদি আমরা নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে শুচি না হই, তা হলে কীভাবে আমরা ওপর থেকে আসা প্রজ্ঞার অন্যান্য গুণ প্রকৃতই প্রতিফলিত করতে পারব?
১০, ১১. (ক) কেন আমাদের শান্তিপ্রিয় হওয়া গুরুত্বপূর্ণ? (খ) যদি আপনি বুঝতে পারেন যে, কোনো সহউপাসককে আপনি দুঃখ দিয়েছেন, তা হলে কীভাবে আপনি নিজেকে শান্তিস্থাপনকারী হিসেবে প্রমাণ করতে পারেন?
১০ “পরে শান্তিপ্রিয়।” স্বর্গীয় প্রজ্ঞা আমাদের শান্তি অনুধাবন করতে প্রেরণা দেয়, যা ঈশ্বরের আত্মার একটা ফল। (গালাতীয় ৫:২২) ‘শান্তির যোগবন্ধন,’ যা যিহোবার লোকেদের একতাবদ্ধ করে, সেটা ছিন্ন করা এড়িয়ে চলার জন্য আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করি। (ইফিষীয় ৪:৩) যখন শান্তি নষ্ট হয়ে যায়, তখন তা পুনর্স্থাপন করার জন্য আমরাও সর্বাত্মক চেষ্টা করি। এটা কেন গুরুত্বপূর্ণ? বাইবেল বলে: “শান্তিতে থাক; তাহাতে প্রেমের ও শান্তির ঈশ্বর তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকিবেন।” (২ করিন্থীয় ১৩:১১) তাই, যতদিন পর্যন্ত আমরা শান্তিতে বাস করে চলব, ততদিন পর্যন্ত শান্তির ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে থাকবেন। সহউপাসকদের সঙ্গে আমরা যেরকম আচরণ করি, যিহোবার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ওপর সেটার এক সরাসরি প্রভাব রয়েছে। কীভাবে আমরা নিজেদের শান্তি স্থাপনকারী প্রমাণ করতে পারি? একটা উদাহরণ বিবেচনা করুন।
১১ আপনি যদি বুঝতে পারেন যে, কোনো সহউপাসককে আপনি দুঃখ দিয়েছেন, তা হলে আপনার কী করা উচিত? যিশু বলেছিলেন: “অতএব তুমি যখন যজ্ঞবেদির নিকটে আপন নৈবেদ্য উৎসর্গ করিতেছ, তখন সেই স্থানে যদি মনে পড়ে যে, তোমার বিরুদ্ধে তোমার ভ্রাতার কোন কথা আছে, তবে সেই স্থানে বেদির সম্মুখে তোমার নৈবেদ্য রাখ, আর চলিয়া যাও, প্রথমে তোমার ভ্রাতার সহিত সম্মিলিত হও, পরে আসিয়া তোমার নৈবেদ্য উৎসর্গ করিও।” (মথি ৫:২৩, ২৪) আপনার ভাইয়ের কাছে প্রথমে এগিয়ে গিয়ে আপনি এই পরামর্শটি প্রয়োগ করতে পারেন। কোন উদ্দেশ্য নিয়ে? তার সঙ্গে ‘সম্মিলিত হইবার’ জন্য। সেইজন্য আপনার হয়তো তার অনুভূতিকে অবজ্ঞা নয় কিন্তু মেনে নিতে হতে পারে। যদি আপনি শান্তি পুনর্স্থাপনের উদ্দেশ্য নিয়ে তার কাছে যান ও সেই মনোভাব বজায় রাখেন, তা হলে খুব সম্ভবত ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়ে যেতে পারে, সঠিকভাবে অপরাধ স্বীকার এবং ক্ষমা করা হতে পারে। যখন শান্তি স্থাপন করার জন্য আপনি প্রথমে এগিয়ে যান, তখন আপনি দেখান যে আপনি ঈশ্বরীয় প্রজ্ঞার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছেন।
“যুক্তিযুক্ত, সহজে অনুনীত”
১২, ১৩. (ক) যাকোব ৩:১৭ পদে যে-শব্দটাকে “যুক্তিযুক্ত” বলে অনুবাদ করা হয়েছে সেটার অর্থ কী? (খ) কীভাবে আমরা দেখাতে পারি যে, আমরা যুক্তিবাদী?
১২ “যুক্তিযুক্ত।” যুক্তিযুক্ত হওয়ার অর্থ কী? পণ্ডিত ব্যক্তিদের মতানুসারে, মূল যে-গ্রিক শব্দটাকে যাকোব ৩:১৭ পদে “যুক্তিযুক্ত” বলে অনুবাদ করা হয়েছে, তা অনুবাদ করা বেশ কঠিন। অনুবাদকরা এই ধরনের শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন, যেমন “শান্ত,” “সহিষ্ণু” এবং “বিবেচক।” গ্রিক শব্দটার আক্ষরিক অর্থ হল, “মেনে নেওয়া।” কীভাবে আমরা দেখাতে পারি যে, ওপর থেকে আসা প্রজ্ঞার এই দিকটা আমাদের মধ্যে সক্রিয়?
১৩ “তোমাদের শান্ত ভাব [“যুক্তিবাদিতা,” NW] মনুষ্যমাত্রের বিদিত হউক,” ফিলিপীয় ৪:৫ পদ বলে। আরেকটা অনুবাদ এভাবে বলে: “যুক্তিবাদী হওয়ার সুখ্যাতি লাভ কর।” (জে. বি. ফিলিপস কর্তৃক দ্যা নিউ টেস্টামেন্ট ইন মর্ডান ইংলিশ) লক্ষ করুন যে, আমরা নিজেদের কীভাবে দেখি, সেটা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়; কিন্তু অন্যেরা আমাদের কীভাবে দেখে, আমরা কীসের জন্য সুপরিচিত তা গুরুত্বপূর্ণ। একজন যুক্তিবাদী ব্যক্তি সবসময় অক্ষরে অক্ষরে আইন পালনে বা নিজের ইচ্ছামতো কাজ করায় নাছোড়বান্দা থাকেন না। এর পরিবর্তে, তিনি অন্যদের কথা শুনতে ইচ্ছুক এবং যখন উপযুক্ত, তখন তাদের ইচ্ছাকে মেনে নেন। এ ছাড়া, তিনি শান্ত থাকেন, অন্যদের সঙ্গে আচরণে কখনও কর্কশ বা রূঢ় হন না। যদিও এটা সমস্ত খ্রিস্টানের জন্য অপরিহার্য কিন্তু যারা প্রাচীন হিসেবে সেবা করছে, তাদের ক্ষেত্রে এটা বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ। শান্তভাব আকৃষ্ট করে, প্রাচীনদের আরও সহজগম্য করে তোলে। (১ থিষলনীকীয় ২:৭, ৮) আমাদের নিজেদের জিজ্ঞেস করা উচিত, ‘আমার কি বিবেচক, মেনে নেওয়ার এবং শান্ত হিসেবে সুখ্যাতি রয়েছে?’
১৪. কীভাবে আমরা দেখাতে পারি যে, আমরা “সহজে অনুনীত”?
১৪ “সহজে অনুনীত।” যে-গ্রিক শব্দকে “সহজে অনুনীত” বলে অনুবাদ করা হয়েছে, তা খ্রিস্টীয় গ্রিক শাস্ত্রে আর কোথাও পাওয়া যায় না। একজন পণ্ডিত ব্যক্তির মতানুসারে, এই শব্দটি “প্রায়ই সামরিক শৃঙ্খলার জন্য ব্যবহৃত হয়।” এটা “সহজেই কিছু করতে রাজি হওয়া” এবং “বশীভূত” হওয়ার ধারণা প্রকাশ করে। যে-ব্যক্তি ওপর থেকে আসা প্রজ্ঞার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন, তিনি শাস্ত্র যা বলে সঙ্গে সঙ্গে সেটার বশীভূত হন। তিনি এমন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত নন, যিনি একবার সিদ্ধান্ত নিলে আর কোনো কিছুই তাকে তার মত পালটাতে প্রভাবিত করতে পারে না। এর পরিবর্তে, তাকে যখন স্পষ্ট শাস্ত্রীয় প্রমাণ দেখানো হয় যে তিনি কোনো ভুল পদক্ষেপ বা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন তিনি খুব তাড়াতাড়ি পরিবর্তিত হওয়ার চেষ্টা করেন। অন্যদের কাছে কি আপনি এভাবে পরিচিত?
“করুণা ও উত্তম উত্তম ফলে পরিপূর্ণ”
১৫. করুণা কী এবং কেন এটা উপযুক্ত যে, “করুণা” এবং ‘উত্তম উত্তম ফলের’ বিষয়ে যাকোব ৩:১৭ পদে একসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে?
১৫ “করুণা ও উত্তম উত্তম ফলে পরিপূর্ণ।”b করুণা হল ওপর থেকে আসা প্রজ্ঞার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কারণ এই ধরনের প্রজ্ঞার বিষয় বলা হয় যে, ‘করুণায় পরিপূর্ণ।’ লক্ষ করুন যে, “করুণা” এবং ‘উত্তম উত্তম ফলের’ বিষয় একসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা উপযুক্ত কারণ বাইবেলে করুণা প্রায়ই অন্যদের জন্য এক সক্রিয় চিন্তাকে ইঙ্গিত করে, এমন সমবেদনা যা দয়াপূর্ণ কাজের প্রচুর ফল উৎপন্ন করে। একটা তথ্যগ্রন্থ করুণাকে “কারও প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য দুঃখ অনুভব করা এবং এই বিষয়ে কিছু করতে চাওয়া” বলে সংজ্ঞায়িত করে। তাই, ঈশ্বরীয় প্রজ্ঞা নীরস, নিরাবেগ বা নিছক পুঁথিগত কোনো বিষয় নয়। এর পরিবর্তে, এটা উষ্ণ, আন্তরিক এবং অনুভূতিশীল। কীভাবে আমরা দেখাতে পারি যে আমরা করুণায় পরিপূর্ণ?
১৬, ১৭. (ক) ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসা ছাড়াও কী আমাদের প্রচার কাজে অংশ নিতে চালিত করে এবং কেন? (খ) কোন কোন উপায়ে আমরা দেখাতে পারি যে, আমরা করুণায় পরিপূর্ণ?
১৬ নিশ্চিতরূপে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপায় হল ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার অন্যদের কাছে বন্টন করা। কী আমাদের এই কাজ করতে প্রেরণা দেয়? এটা মূলত ঈশ্বরের প্রতি প্রেম। কিন্তু আমরা অন্যদের প্রতি করুণা বা সমবেদনার দ্বারাও চালিত হই। (মথি ২২:৩৭-৩৯) আজকে অনেকে “ব্যাকুল ও ছিন্নভিন্ন . . . যেন পালকবিহীন মেষপাল।” (মথি ৯:৩৬) মিথ্যা ধর্মীয় পালকদের দ্বারা তারা উপেক্ষিত ও আধ্যাত্মিকভাবে অন্ধ হয়ে রয়েছে। ফলে, তারা ঈশ্বরের বাক্যে থাকা বিজ্ঞ নির্দেশনা অথবা রাজ্য যে শীঘ্রই এই পৃথিবীতে আশীর্বাদ নিয়ে আসবে, তা জানে না। যখন আমরা আমাদের চারপাশের লোকেদের আধ্যাত্মিক চাহিদা নিয়ে ধ্যান করি, তখন আন্তরিক সমবেদনা যিহোবার প্রেমময় উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আমরা যা কিছু বলতে পারি, তা তাদের বলার জন্য আমাদের প্রেরণা দেয়।
১৭ অন্য আর কোন কোন দিক দিয়ে আমরা দেখাতে পারি যে, আমরা করুণায় পরিপূর্ণ? শমরীয় ব্যক্তির সম্বন্ধে যিশুর দৃষ্টান্তটার কথা মনে করে দেখুন, যিনি পথের পাশে একজন পথিককে পড়ে থাকা অবস্থায় পেয়েছিলেন, যাকে দস্যুরা আক্রমণ করেছিল ও মেরেছিল। সমবেদনার দ্বারা চালিত হয়ে সেই শমরীয় ‘দয়া [“করুণা,” NW] করিয়াছিল,’ আহত ব্যক্তির ক্ষত বেঁধে দিয়েছিল এবং তার যত্ন নিয়েছিল। (লূক ১০:২৯-৩৭) এটা কি দেখায় না যে, করুণার অন্তর্ভুক্ত যাদের প্রয়োজন তাদের ব্যবহারিক সাহায্য করা? বাইবেল ‘সকলের প্রতি, বিশেষতঃ যাহারা বিশ্বাস-বাটীর পরিজন, তাহাদের প্রতি সৎকর্ম্ম করিতে’ বলে। (গালাতীয় ৬:১০) কয়েকটা সম্ভাবনা বিবেচনা করুন। একজন বয়স্ক সহবিশ্বাসীর হয়তো খ্রিস্টীয় সভায় আসতে ও সভা থেকে যেতে পরিবহনের দরকার হতে পারে। মণ্ডলীর একজন বিধবার হয়তো তার ঘর মেরামত করার জন্য সাহায্যের দরকার হতে পারে। (যাকোব ১:২৭) একজন নিরুৎসাহিত ব্যক্তির উৎসাহিত হওয়ার জন্য হয়তো ‘উত্তম বাক্যের’ দরকার হতে পারে। (হিতোপদেশ ১২:২৫) যখন আমরা এই ক্ষেত্রগুলোতে করুণা দেখাই, তখন আমরা প্রমাণ দিই যে, ওপর থেকে আসা প্রজ্ঞা আমাদের মধ্যে সক্রিয়।
“ভেদাভেদবিহীন ও নিষ্কপট”
১৮. যদি আমরা ওপর থেকে আসা প্রজ্ঞার দ্বারা চালিত হই, তা হলে আমাদের হৃদয় থেকে কোন বিষয়টা উপড়ে ফেলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে এবং কেন?
১৮ “ভেদাভেদবিহীন।” ঈশ্বরীয় প্রজ্ঞা জাতি সম্বন্ধে প্রতিকূল ধারণা ও জাতিগত গর্বকে স্থান দেয় না। যদি আমরা এই প্রজ্ঞার দ্বারা চালিত হই, তা হলে আমরা আমাদের হৃদয় থেকে যেকোনো ধরনের পক্ষানুরাগ দেখানোর প্রবণতা উপড়ে ফেলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করব। (যাকোব ২:৯, NW) আমরা অন্যদের শিক্ষাগত পটভূমি, অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি বা মণ্ডলীর দায়িত্বের ওপর ভিত্তি করে তাদেরকে অন্যদের চেয়ে একটু বেশি প্রাধান্য দেব না; অথবা আমাদের সহউপাসকদের যত নিচু বলেই মনে হোক না কেন, আমরা কখনও তাদের নিচু করে দেখব না। যিহোবা যদি এই ব্যক্তিদের তাঁর প্রেমের পাত্র করতে পারেন, তা হলে আমাদের অবশ্যই তাদেরকে আমাদের ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য বলে দেখা উচিত।
১৯, ২০. (ক) “কপট” শব্দের জন্য ব্যবহৃত গ্রিক শব্দের পটভূমি কী? (খ) কীভাবে আমরা ‘নিষ্কপট ভ্রাতৃপ্রেম’ দেখাই এবং কেন এটা গুরুত্বপূর্ণ?
১৯ “নিষ্কপট।” “কপট” শব্দের জন্য ব্যবহৃত গ্রিক শব্দটা “একজন অভিনেতা, যিনি কোনো চরিত্রে অভিনয় করেছেন,” তাকে ইঙ্গিত করতে পারে। প্রাচীনকালে গ্রিক ও রোমীয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয় করার সময় বড় মুখোশ পরত। তাই, ‘কপটের’ জন্য ব্যবহৃত গ্রিক শব্দটা একজনের ভান করা বা মিথ্যা অভিনয় করার প্রতি প্রযোজ্য হতে পারে। ঈশ্বরীয় প্রজ্ঞার এই দিকটা শুধু আমরা আমাদের সহউপাসকদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করি, সেটাতে নয় কিন্তু সেইসঙ্গে আমরা তাদের জন্য কেমন বোধ করি, তাতেও প্রভাব ফেলবে।
২০ প্রেরিত পিতর বলেছিলেন যে, “সত্যের আজ্ঞাবহতায়” আমাদের ‘অকল্পিত [“নিষ্কপট,” NW] ভ্রাতৃপ্রেম’ দেখানো উচিত। (১ পিতর ১:২২) হ্যাঁ, ভাইদের প্রতি আমাদের অনুরাগ কখনও ওপর ওপর হওয়া উচিত নয়। আমরা অন্যদের প্রতারিত করার জন্য কোনো মুখোশ পরি না বা অভিনয় করি না। আমাদের প্রেম অবশ্যই খাঁটি ও আন্তরিক হতে হবে। যদি তা-ই হয়, তা হলে আমরা আমাদের সহউপাসকদের নির্ভরতা অর্জন করব কারণ তারা জানবে যে, আমাদের যেমন দেখা যায়, আমরা ঠিক সেইরকমই। এই অকপটতা খ্রিস্টানদের মধ্যে খোলামেলা ও সৎ সম্পর্কের পথকে সুগম করে এবং মণ্ডলীতে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করতে সাহায্য করে, যেখানে একজন আরেকজনের ওপর নির্ভর করতে পারে।
‘ব্যবহারিক প্রজ্ঞা রক্ষা কর’
২১, ২২. (ক) কীভাবে শলোমন প্রজ্ঞাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন? (খ) কীভাবে আমরা প্রজ্ঞাকে রক্ষা করতে পারি এবং কীভাবে আমরা তা করা থেকে উপকার লাভ করতে পারি?
২১ ঈশ্বরীয় প্রজ্ঞা যিহোবার কাছ থেকে আসা একটা উপহার, যেটাকে আমাদের রক্ষা করা উচিত। শলোমন বলেছিলেন: “বৎস, . . . তুমি সূক্ষ্ম বুদ্ধি [“ব্যবহারিক প্রজ্ঞা,” NW] ও পরিণামদর্শিতা রক্ষা কর।” (হিতোপদেশ ৩:২১) দুঃখের বিষয় হল যে, শলোমন নিজে তা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি তার হৃদয় বাধ্য রেখেছিলেন, ততক্ষণ তিনি বিজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত তার অনেক বিদেশি স্ত্রী যিহোবার বিশুদ্ধ উপাসনা থেকে তার হৃদয় সরিয়ে নিয়েছিল। (১ রাজাবলি ১১:১-৮) শলোমনের পরিণতি দেখায় যে, যদি আমরা জ্ঞানকে সঠিকভাবে কাজে না লাগাই, তা হলে এর কোনো মূল্যই থাকবে না।
২২ কীভাবে আমরা ব্যবহারিক প্রজ্ঞাকে রক্ষা করতে পারি? আমাদের শুধু নিয়মিত বাইবেল এবং ‘বিশ্বস্ত ও বুদ্ধিমান্ দাসের’ দ্বারা জোগানো বাইবেল-ভিত্তিক প্রকাশনাগুলো পড়াই নয় কিন্তু সেইসঙ্গে আমরা যা শিখি, তা কাজে লাগানোর জন্য অবশ্যই প্রাণপণ চেষ্টা করা উচিত। (মথি ২৪:৪৫) ঐশিক প্রজ্ঞাকে কাজে লাগানোর প্রতিটা কারণ আমাদের রয়েছে। এর মানে হচ্ছে, বর্তমানে জীবনের জন্য আরও উত্তম এক পথ। এটা আমাদের “প্রকৃতরূপে জীবন . . . ধরিয়া রাখিতে” অর্থাৎ ঈশ্বরের নতুন জগতে জীবন লাভ করতে সক্ষম করে। (১ তীমথিয় ৬:১৯) আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে, ওপর থেকে আসা প্রজ্ঞা গড়ে তোলা আমাদের সমস্ত প্রজ্ঞার উৎস যিহোবা ঈশ্বরের আরও নিকটবর্তী করে।
a প্রথম রাজাবলি ৩:১৬ পদ অনুসারে, ওই দুই মহিলাই ছিল বেশ্যা। শাস্ত্রের প্রতি অন্তর্দৃষ্টি (ইংরেজি) বলে: “এই মহিলারা হয়তো বেশ্যা ছিল, তবে ব্যবসায়িক অর্থে নয় বরং তারা হয়তো ব্যভিচার করেছিল, হয় তারা যিহুদি মহিলা ছিল বা খুব সম্ভবত তারা বিদেশি বংশজাত ছিল।”—যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত।
b আরেকটা অনুবাদ এই শব্দগুলোকে “সমবেদনা এবং উত্তম উত্তম কাজে পরিপূর্ণ” বলে অনুবাদ করে।—আ ট্রান্সলেশন ইন দ্যা ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা পিপল, চার্লস বি. উইলিয়ামস কর্তৃক।